বদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে কী হতো?

বদর বাহিনী

রাজধানীর মোহাম্মদপুর ছিল বদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টার। এ দেশের বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে সেখানে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে হত্যা করত পাকিস্তানি সেনা, তাদের সহযোগী আলবদর বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা।
আলবদর বাহিনীর ‘টর্চার সেল’ বানাতে একাত্তরের ২৬ মার্চ বিকেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা দখল করে নেয় তিনটি ভবন— প্রশাসনিক বিল্ডিং, বয়েজ হোস্টেল ও জিমন্যাসিয়াম ভবনে ভাগ করে চলত জবাই, নির্যাতন ও ধর্ষণ। মাঠের পশ্চিম ও দক্ষিণ কোণায় গণকবর ছিল। এই কেন্দ্রে বন্দিদের হত্যা করে তাদের চোখ তুলে রাখা হতো। একাত্তরের ১০ থেকে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে সিরাজুদ্দীন হোসেন, গোলাম মোস্তফা, নিজামুদ্দীন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে অপহরণ করে এই টর্চার সেলে রাখা হয়। ১৪ ডিসেম্বর শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রাশেদুল হাসান, অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ডা. মর্তুজাসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

স্বাধীনতার পর বদর বাহিনীর সেই হেডকোয়াটার পূর্বের ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার কলেজ পুনরায় চালু হয়। ঐ কলেজের তৎকালীন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী মো. রুস্তম আলীর মোল্লা জানান, পাকিস্তানিরা কলেজটি দখল করে নেওয়ার পর বদর বাহিনীর নেতারা নিয়মিত এখানে আসতেন। মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণায় তারা তাবু টানিয়ে বৈঠক করতেন। দেশের কোন এলাকায় পাকিস্তানিদের পাঠাতে হবে, কাকে কোথায় নিয়ে হত্যা করা হবে, কাকে ধরে এনে নির্যাতন করা হবে —এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো।
মুক্তিযুদ্ধের সেই সব দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ যাদের ধরে আনা হতো, তাদের জিমন্যাসিয়াম ভবনের করাতখানায় রাখা হতো। এরপড় নেতাদের নির্দেশে প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ব্যালকনিতে বাশ বেঁধে ঝুলিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও আলবদররা তাদের নির্যাতন করত। নির্যাতনের এক পর্যায়ে নির্যাতিতরা যখন পানি পানি করে চিৎকার করতেন, তখন পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদররা প্রশ্রাব করে তাই খেতে বাধ্য করত। টর্চার শেষে বয়েজ হোস্টেলের নিচতলায় খাওয়ার রুমে রাতে তাদের গলা কেটে হত্যা করা হতো। স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এই প্রত্যক্ষদর্শী।
ভয়াবহ নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী রুস্তম জানান, আত্মসমর্পণের আগের রাতেই পাকিস্তানিরা এখান থেকে পালিয়ে যায়। এরপর কাটাশুর এলাকায় রহিম ব্যাপারীর গুদারাঘাটে বস্তাভর্তি চোখ পাওয়া যায়। সেখানে অনেক কাক ওই বস্তা ফুটো করার চেষ্টা করছিল। এ দৃশ্য দেখে বাকুটিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের হাতে ওই বস্তাভর্তি চোখ তুলে দিই আমি। তিনি বলেন, প্রশাসনিক ভবনের তিন তলায় একটা রুমে নারীদের ধরে এনে রাখা হতো। পাশের দুটি রুমে পাকিস্তানি ও আলবদর সদস্যরা নিয়মিত তাদের ধর্ষণ করত। এ ছাড়া প্রিন্সিপাল কোয়ার্টারে একজন পাকিস্তানি কর্নেল ধরে আনা সুন্দরী বাঙালি নারীদের নিয়মিত ধর্ষণ করত। এ নির্যাতনের মাত্রা এমন ছিল যে, টর্চার সেলে আনা অধিকাংশ নারীই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন।


©দৈনিক ইত্তেফাক
©বাংলাদেশের যুদ্ধদলিল