‘একটা পা-ও যদি থাকত, নিজের কাজ নিজে করতে পারত। কিন্তু এখন কারও সাহায্য ছাড়া মানুষটা চলতেও পারবে না। তার উপার্জনে এতদিন পাঁচজনের সংসার চলতো। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চলত। সেই মানুষটা যদি ঘরে পড়ে থাকে, তাহলে আমাদের কী হবে? পথে বসা ছাড়াতো আমাদের কোনও উপায় নেই!’ এভাবে নিজেদের দুর্ভোগের কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের দুই পা হারানোর শাহনুর বিশ্বাসের স্ত্রী আর্জিনা খাতুন। রবিবার পঙ্গু হাসপাতালের ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন স্বামীর পাশে বসে তিনি বলেন, ‘গত ১৬ অক্টোবর সকাল ৮ টার দিকে রড দিয়ে পিটিয়ে, শাবল দিয়ে কুপিয়ে আমার স্বামীকে আহত করে আমার মেয়ের উত্ত্যক্তকারীরা। মাহবুর ও কামাল মেম্বার দাঁড়িয়ে থেকে আমার স্বামীর ডান পায়ে গুলি করে। এরপর শাবল দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালি থেকে মাংস তুলে নেয়। এ সময় মাহাবুর বলতিছিল, ‘টাকা যত লাগে আমার লাগবে। খুন করি ফেলা, মামলা মোকদ্দমা কিচ্ছু হবি না।’
প্রসঙ্গত, দুই মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার বিচার চাইতে গিয়ে নৃশংস হামলার শিকার হন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের নল ভাঙা গ্রামের শাহনুর বিশ্বাস। ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আর্জিনা বেগম বলেন, ‘মারার সময়ে মানুষটা পানি পানি করে চিৎকার করতেছিল। ওরাতো পানি দেয় নাই, অন্য কাউকেও পানি দিতে দেয় নাই। গ্রামের মহিলারা ভিড় করে ছিল কিন্তু কাউকে কাছে আসতে দেয় নাই তারা। মেরে ফেলাইয়া দিয়ে যাওয়ার পরে আমরা খবর পাই। গিয়ে দেখি, চারিদিকে কোরবানির পশুর রক্তের মতো রক্ত, তার মধ্যে মানুষটা পইড়্যা আছে। মানুষটার গায়ে কোনও রক্ত ছিল না, এ পর্যন্ত তাকে ২০ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। আমরা ১ মাস ৫ দিন ধরে এখানে আছি।’
অন্যের জমিতে কাজ করা শাহনুর বিশ্বাস পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে-শুয়ে বলেন, ‘যশোহর সরকারি মহিলা কলেজ আর স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে আমাদের দুই মেয়ে। আমাদের দুই মেয়েকে প্রায় উত্ত্যক্ত করত মাহাবুর মেম্বারের ছেলে আজম ও তার সঙ্গী বিল্লাল, দুখু, জাহিদ, মোতালেব, ওয়ার্ড মেম্বার কামাল ও জাহিদ। আমি এ ঘটনার বিচার চাইতে গেলে তারা আমাকে শাবল দিয়ে কুপিয়ে আহত করে। মেম্বার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এ ঘটনা ঘটায়। প্রথমে ডান পায়ে গুলি করে। পরে শাবল দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালি থেকে মাংস তুলে নেয়। এ সময় মাহাবুর বলতেছিল, ‘টাকা যত লাগে আমার লাগবে। তোরা খুন করি ফেলা। মামলা-মোকদ্দমা কিচ্ছু হবি না।’
দুই পা হারানোর বিচার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে শাহনুর বলেন, ‘বিচার পাব কিনা, সেটা পরের বিষয়। হামলাকারী মোতালেবের ভাই মুসা এখন মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। বলছে, মামলা তুলে না নিলে আমাদের সবাইকে জবাই করে ফেলবে। আমি গরিব মানুষ। অন্যের জমিতে কাজ করি খাই। কষ্ট কইরা দুই মেয়েকে লেখাপড়া শিখাইতিছি। এটা সহ্য হচ্ছিল না ওদের। তারা আমার মেয়েদের বাজে প্রস্তাব দিতো। তাতে রাজি না হওয়াতেই আজ দুই পা হারাইতে হইলো।’
আর্জিয়া বেগম বলেন, ‘হামলাকারীরা আমার স্বামীর ডান পা চারভাগ ও বাম পা তিনভাগ করে ফেলে। গোড়ালির রগ কেটে দেয়। তাকে যশোর সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে দুই ব্যাগ রক্ত দিয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সেদিনই রাত ১০ টার দিকে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসি। জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন হয় তার। এরপর গত ২৯ অক্টোবর বাম পায়ের অবস্থা খারাপ হওয়ায় দু’টি পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এতবড় ঘটনার পরও পুলিশ মামলা নিতে চায় নাই। পরে মিডিয়ার চাপে পড়ে তারা মামলা নিলেও আসামিদের গ্রেফতার করছে না। উল্টো আমাদের বাড়ি গিয়েই অস্ত্র খুঁজছে।’
উল্লেখ্য, এ ঘটনায় শাহনুর বিশ্বাসের ভগ্নিপতি ইয়াকুব আলী বাদী হয়ে ঝিনাইদাহ জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এছাড়া শাহনুর মিয়ার বড় ভাই সামাউল বিশ্বাস ওই ৭জনসহ ১৬ জনকে আসামি করে কালীগঞ্জ থানায় আরেকটি মামলা করেন। তবে ইয়াকুব আলী দাবি করেন, ‘পুলিশ এ বিষয়ে একেবারেই সহযোগিতা করছে না। নানারকম টালবাহান করে সময় কাটাচ্ছে। কিছু স্থানীয় পত্রিকায় এ বিষয়ে লেখালেখি হলে তারা মূল আসামিদের বাদ দিয়ে অন্যদের গ্রেফতার করেছে। তার মধ্যে একজন জামিন পেয়েছে। এখন আবার সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মূল আসামিরা গ্রামে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেম্বার কামালতো গ্রামেই আছে, কিন্তু পুলিশ তাকে ধরছে না বলেই অভিযোগ ইয়াকুব আলীর।’
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমীনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ তৎপর। আসামিদের গ্রেফতারে আমরা কয়েকবার অভিযান চালিয়েছি কিন্তু কাউকে পাওয়া যায়নি।’ পুলিশের এ বক্তব্য প্রসঙ্গে আর্জিয়া বেগম বলেন, ‘গ্রামের সবাই বলতেছে, ওরা গ্রামে আছে। তাইলে পুলিশ তাদের পায় না কেমনে? সবই ক্ষমতা আর টাকা জোর। আমাদের যদি টাকা থাকতো, তাইলে আমরাও বিচার পাইতাম।’
সংবাদ : বাংলাট্রিবিউন