নব্বইয়ের দশকের ছাত্র রাজনীতিক, প্রকাশক, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশনা ও ব্যবসায়ী সমিতির দুইবার নির্বাচিত সভাপতি (সদ্য সাবেক) আলমগীর শিকদার লোটন পুস্তক প্রকাশনা এবং ব্যবসার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন ফলোআপনিউজ.কম পত্রিকার সম্পাদক দিব্যেন্দু দ্বীপের সাথে। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হল।
ফলোআপ: একজন লাইব্রেরিয়ান বই বিক্রি করার ক্ষেত্রে স্বাধীন কিনা? ক্রেতা বা পাঠক বই ক্রয় করার ক্ষেত্রে স্বাধীন কিনা? নাকি তাদের উপর এসব বই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? পুস্তক প্রকাশক ও ব্যবসায়ী সমিতি এক্ষেত্রে কী দায়িত্ব পালন করছে?
লোটন: সমিতির এক্ষেত্রে তেমন কিছু করার নেই। তবে যদি কেউ অভিযোগ করে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। যেসকল প্রকাশক বা যারা এটি করছেন তারা অন্যায্যভাবে করছেন। এটা তো অবশ্যই একটি বড় সমস্যা। আমরা ‘বাপুস’ থেকে একটি নীতিমালা করেছি। সেখানে বইয়ের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া আছে এবং অন্যান্য বিষয়গুলোতেও নির্দেশনা আছে। যেহেতু স্কুল থেকে শিক্ষকরা বই এর নাম বলে দেয়, তাই এটা দুর্নীতির শামিল। এখানে অসুবিধা রয়েছে তাতো বোঝাই যায়, না হলে একই স্কুলের শিক্ষার্থীরা একই বই কিনবে কেন? যাচাই বাছাই করে একেক জন একেক বই কিনবে। বাজার মুক্ত থাকলে তাইই হত।
ফলোআপ: ‘বাপুস’ যে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা কি সকল প্রকাশক মেনে চলছে?
লোটন: মেনে চলছে না। সবকিছু আমরা নজরদারীতে আনতে পারিনি। আরেকটা সমস্যা ছিল, নীতিমালাটা এতদিন সময়মত দেওয়া হয়নি। সেক্ষেত্রে প্রকাশকরা অজুহাত পায় যে নীতিমালা হাতে পাওয়ার আগেই তাদের বই ছাপা হয়ে গেছে। এবার আমরা বলেছি, জুলাই মাসের আগেই নীতিমালা প্রকাশক এবং পুস্তক ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়ে প্রণয়ন করা হবে। এবারই প্রথম পুস্তক বিক্রেতাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি থাকবে। ২০১৫ সালে ‘বাপুস’ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, যেহেতু বই পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে পুস্তক বিক্রেতাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য, তাই তাদের পক্ষ থেকেও প্রতিনিধি থাকতে হবে।
ফলোআপ: কিন্তু দাম আপনি কীভাবে নির্ধারণ করবেন? কাগজের দাম তো আর বইয়ের দাম নয়। ‘কনটেন্ট ভ্যালু’ নির্ধারণ করবেন কীভাবে?
লোটন: এটা কঠিন, তবে সরকার তো করছে। সরকার তো নির্দিষ্ট দামে বই (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত বই) বিক্রী করেছে, আবার লেখককে রয়্যালিটিও দিচ্ছে। তাহলে আমরা পারব না কেন? লেখক রয়্যালিটি এবং সামগ্রিক বিষয় মূল্যায়ন করেই বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ‘জুপিটার পাবলিকেশন্স’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিনিয়র সহ সভাপতি কাওসার-ই-আলম একটি প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলেছেন, “বইয়ের দামের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা হোক, কিন্তু সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করার প্রয়োজন নেই। কেউ কম মূল্যে বাজারে বই দিতে পারলে কারো অসুবিধা থাকার কথা নয়।” অনেক প্রকাশক আছেন, যারা নিজেই সকল কাজ করে বাজারে বই ছাড়ে। তারা বাজারে কম মূল্যে বই ছাড়তে পারে।
ফলোআপ: অভিভাবকদের পক্ষ থেকে একটা বড় অভিযোগ আছে বইয়ের মান নিয়ে। তারা বলছে, বিশেষ করে প্রাইমারি স্কুলের গাইড বইগুলো খুব নিম্নমানের নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা হচ্ছে, ছাপার মান খুব খারাপ, বইগুলো বাচ্চারা পড়তে পারে না। এক্ষেত্রে সমিতির করণীয় কী?
লোটন: বড় প্রকাশনীগুলো যদ্দুর জানি ভাল কাগজেই বই ছাপে, তাদের ছাপার মানও খারাপ নয়। সাদা কাগজে বই করলে তো সবাই কিনতে পারবে না, মূল্য তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে না। সেক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষকরা যদি শিক্ষার্থীদের বই কেনার পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীরা অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে বই পাবে। অভিভাবকদেরও ভাল বই কেনার জন্য সচেতন থাকতে হবে।
ফলোআপ: অভিযোগ বড় প্রকাশনীর বই নিয়েও আছে, তাছাড়া ছোট প্রকাশনীগুলোর বইও তো অনেক স্কুলে পাঠ্য হচ্ছে…
লোটন: আছে, তারা ব্যবসার তাগিদে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু অভিভাবকরা এসব বই কিনছে কেন? যেকোনো প্রকাশনী, ছোট হোক বা বড় হোক উচিৎ মানসম্মত বই করা, কারণ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা আমাদেরকে ভাবতে হবে। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে বিনিয়োগকারী ব্যবসার চিন্তা করবেই।
ফলোআপ: কিনতে তো তারা বাধ্য হচ্ছে। বাচ্চা তো বইটি না নিয়ে স্কুলে যেতে পারছে না, কারণ বইটি শিক্ষক তাকে নিতে বলেছে। শিক্ষককে দিয়ে বলানো হয়েছে। নাকি?
লোটন: আমাদের কাছে তো কোনো অভিযোগ আসেনি। কোনো অভিভাবক যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করে আমরা দেখব। তাছাড়া ব্যবসায়ীরা তো ব্যবসা করবেই, সরকার কেন দুর্নীতি করার সুযোগ দিচ্ছে? সরকার প্রকাশকদের নিয়ে ভাবছে না, আমাদের সাথে সরকারের সম্পর্ক উন্নত করা দরকার বৃহত্তর স্বার্থে। সরকার যদি প্রকাশকদের সাথে নিয়ে কাজ করে তাহলে প্রকাশনা জগতে স্বচ্ছতা আসবে, জবাবদিহিতা থাকবে।
ফলোআপ: আপনারা বলছেন অনুশীলনমূলক বই, সরকার বলছে গাইড বই, যাইহোক, এ বইগুলো থাকবে কিনা, সে বিষয়ে কিন্তু শিক্ষার্থী অভিভাবকেরা চিন্তিত নয়। তাদের দুশ্চিন্তা- যে বইগুলো শিশুদের হাতে যাচ্ছে, সেগুলো মানসম্মত কিনা…
লোটন: এ বইগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হোক, তাহলে মান উন্নত হবে। জনগণ চাচ্ছে বলেই এ ধরনের বই প্রকাশিত হচ্ছে। যাই করা হোক না কেন, আইন তো জনগণের জন্য। সিগারেট তো সরকার বন্ধ করেনি। একইভাবে বাজারে চাহিদা আছে বলেই এ ধরনের বইয়ের যোগান সৃষ্টি হচ্ছে।
ফলোআপ: জনগণ কি আসলে চাচ্ছে নাকি তাদের চাওয়ানো হচ্ছে?
লোটন: অনেক ক্ষেত্রে সেটি আছে। শিক্ষক প্রকাশক সম্পর্ক আছে। সেগুলো বন্ধ করা দরকার। তবে চাহিদা আছে। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার জরিপে চাহিদার বিষয়টি উঠে এসেছে।
ফলোআপ: আপানার সমিতি থেকে প্রকাশক-শিক্ষক যোগশাযশ বন্ধ করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা?
লোটন: আমার দৃঢ়ভাবে এ ধরনের সম্পর্কের বিরোধিতা করে থাকি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসলে আমরা সমিতি থেকে ব্যবস্থা নিতে পারি। তাছাড়া দেশে ভোক্তা অধিকার আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কোনো কার্যের জন্য বিক্রেতার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানাতে পারে।
ফলোআপ: ‘গাইড বই’ বা ‘অনুশীলনমূলক বই’ যাই বলি না কেন -এসব বইয়ের বিষয়বস্তু তো একই। কেউ একজন একটা বিষয়বস্তু দাঁড় করাচ্ছে। ওটি সবাই ব্যবহার করছে। ভুল থাকলে ভুলটা সবাই করছে।
লোটন: অনেক প্রকাশনী ভালো বই দিচ্ছে। ভুল বই ক্রেতারা কিনবে কেন? তারা বোঝে না? শিক্ষার্থীদের এ ধরনের বই কিনতে বলার আগে শিক্ষকদের উচিৎ বইগুলো দেখে নেওয়া। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনেক দায় আছে। শিক্ষার্থীদের ভাল-মন্দ প্রথমত ভাবতে হবে শিক্ষকদের। তারা কি তা ভাবছে?
ফলোআপ: শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বক্তব্য, পুরো বই তো আর পড়ে কেনা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে বইতে এত ভুল থাকলে তার দায় কার উপর বর্তায়?
লোটন: বললামই তো, দায় প্রথমত শিক্ষকদের নিতে হবে। অনেক প্রকাশক আছে তারা কেটেছেটে বই করছে, তবে অনেকে ভালো বইও তো করছে। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিৎ মানসম্মত বই কেনা, ভালো প্রকাশনীর বই কেনা।
ফলোআপ: আপনি সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলেন, আপনি প্রকাশক এবং আপনি একজন রাজনীতিকও। আপনার কি মনে হয়, ‘গাইড বইগুলো’ থাকা উচিৎ?
লোটন: আমরা তো এগুলোকে ‘নোট গাইড’ বলছি না। যেহেতু বেশিরভাগ শিক্ষার্থী, এমনকি শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝে না, সেক্ষেত্রে এ বইগুলো দরকার রয়েছে। শিক্ষার্থীরা তো এ বইগুলোর উপর নির্ভরশীল। আমরা তো সরকারকে সহযোগিতা করছি, সরকার আমাদের উপর রাগবে কেন? সরকার সরকারের কাজ করুক। সঠিকভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ্যক্রম দিয়ে স্কুলগুলোকে ঠিকভাবে পরিচালনা করলে বরং শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। স্কুলে পড়া শেষ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের বাড়তি বই কেনা আর লাগবে না। আমাদের শিক্ষাকার্যক্রম আগে ঢেলে সাজাতে হবে, আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে হবে। উন্নত দেশে গিয়ে দেখেছি, শিশুরা স্কুল বন্ধ থাকলে অস্বস্তি বোধ করে। শিশুরা সেখানে স্কুলে খেলা-বিনোদন সবই পাচ্ছে, তারা খেলার ছলে শিখছে। আমাদের কি সেরকম ব্যবস্থা আছে? জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কি নির্ভুল বই প্রকাশ করে, খুব ভালো বই প্রকাশ করে? যাইহোক, সরকারের দেখা উচিৎ, তাগিদ দেওয়া উচিৎ ভালো বই প্রকাশ করার জন্য। সরকার যেভাবে এগোতে চাচ্ছে এটা তো ‘কম্যুনিজম রাষ্ট্র’ হয়ে যাচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি তো সেরকম নয়।
ফলোআপ: পুস্তক ব্যবসা, বিশেষ করে পাঠ্য পুস্তকের জন্য যে নীতিমালা দরকার সেটি কি সরকার করবে নাকি আপনারা করবেন?
লোটন: নীতিমালা আমরা করেছি। কিন্তু দুর্নীতিবাজদের তো আমরা ঠেকাতে পারি না। সরকার নীতিমালা করতে পারে, আমাদের সাথে নিয়ে সরকার নীতিমালা করলে আমরা সাধুবাদ জানাব।
ফলোআপ: আপনাদের নীতিমালা তো আইন না, এটা দিয়ে আপনারা কতটা বাধ্য করতে পারবেন?
লোটন: আইন না বলে আমাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সদস্য হন তাহলে এই নীতিমালা মানতে বাধ্য হবেন। বাংলাদেশের নাগরিক হলে বাংলাদেশের আইন যেমন মানতে হয়। নীতিমালা তো প্রকাশক তার স্বার্থেই মানবে। একটি নিয়মের মধ্যে না এসে কি কেউ ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে? সেটি তো করতে দেওয়া উচিৎ নয়।
ফলোআপ: আপনি বলছেন, “সদস্যা হলে নীতমালা মানতে হবে” তাহলে অনেকে আপনাদের সদস্য হবে না …
লোটন: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ম মোতাবেক সবাই সমিতির সদস্য হতে বাধ্য। কেউ সদস্য না হলে সেক্ষেত্রে আমরা তাকে সহযোগিতা করব না। ট্রেড লাইসেন্স-এর জন্য এবং ইনকাম ট্যাক্স দিতে গেলে বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসে সমিতির সদস্য হতে হয়।
ফলোআপ: যেকোনো প্রকাশক তথা পুস্তক ব্যবসায়ীকে আপনাদের সদস্য হতে হবে, আইনটি কি আসলেই আছে?
লোটন: হ্যাঁ, এটা আইন আছে। আইন ছাড়া হবে নাকি? সারা বাংলাদেশে, প্রতিটি জেলায় আমাদের নিজস্ব অফিস আছে। প্রতিটি জেলায় আমরা ট্যুর করেছি, লাইব্রেরিয়ানদের সাথে সাক্ষাত করেছি। আমাদের মূল কাজ সবার কথা শুনে নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা।
ফলোআপ: যদি এ বইগুলো, আপনারা যেটিকে অনুশীলনমূলক বই বলছেন, বন্ধ হয় তাহলে পুস্তক বিক্রেতাদের উপর একটা প্রভাব পড়বে কিনা?
লোটন: প্রভাব পড়বে, তবে সবাই বিকল্প খুঁজে নেবে। নানান বাজে বই প্রকাশিত হবে। ব্যবসা বন্ধ হবে না, তবে বিকল্প পথ খুঁজতে গিয়ে অনেকে বিপথে যেতে পারে।
ফলোআপ: এ ধরনের বই বন্ধ হলে আপনাদের সমিতির কার্যক্রম সংকুচিত হবে কিনা?
লোটন: সমিতি সমিতির গতিতেই চলবে। সমিতি সুষ্ঠুভাবে পুস্তক ব্যবসা পরিচালনা জন্য। সরকার সরকারের কাজ করবে তাতে সমিতির কার্যক্রম সংকুচিত হবে না।
ফলোআপ: আপনাদের দুটো সমিতি কেন? বলতে চাচ্ছি সৃজনশীল (বইমেলা কেন্দ্রিক) বইয়ের জন্য তো আলাদা একটি সমিতি রয়েছে …
লোটন: এটা আমাদের ব্যর্থতা। টেন্ডার দিতে গেলে সাপোর্টিং একটা পার্টি নিয়ে যেতে হয়। বিষয়টা অনেকটা এরকম। সৃজনশীল সমিতির বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিন্তু আমাদের সমিতির একজন পরিচালক। এর আগের বছর সৃজনশীল সমিতির বর্তমান সম্পাদক নির্বাচিত পরিচালক ছিলেন বাপুস’র। আমরাই মূল সমিতি। তারা সবাই আমাদের সমিতির সদস্য। তাদের সাথে বড় বড় লেখকদের সম্পর্ক ভালো, তাদের কাছ থেকে সচিব, মন্ত্রীরা বই করে, এই কারণে তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিয়েছে। আমি নিশ্চিত আমরা মামলা করলে তারা হেরে যাবে।
ফলোআপ: মামলা কি করা হয়েছে?
লোটন: আমরা মামলা করেছি, এবং তারা হেরেছে। তারা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পর একটা ‘স্টে অর্ডার’ হয়ে আছে।
ফলোআপ: সৃজনশীল বই তদারকীর ক্ষেত্রে আপনাদের কোনো করণীয় নেই, এরকম বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আপনি কী বলবেন? সৃজনশীল বই-এর ক্ষেত্রে একই বই বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বেরোচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আপনার প্রকাশনী থেকে ২০০৮ সালে বইমেলায় একটি বই বের হয়েছিল। বইটি আর একটি প্রকাশনী থেকে ২০১৫ তে বের হয়েছে। ঐ প্রকাশনীটি ঐ বছরই প্রথম বই মেলায় গিয়েছে। অভিযোগ আছে অনেকেই প্রকাশিত বই দিয়ে বাংলা একাডেমীর বেধে দেওয়া কোটা পূরণ করে থাকে। এটা তো একটা বড় সমস্যা …
লোটন: প্রথম কথা হচ্ছে, শুধু সৃজনশীল বই নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। ‘একাডেমিক বই’ লাগবে না? কলকাতা বই মেলায় গেলাম, ওখানে বাংলাদেশ থেকে কোনো ‘একাডেমিক বই’ যায় না। পৃথিবীতে নব্বই শতাংশই বই তো ‘একাডেমিক বই’। দশ পার্সেন্ট বড়জোর সাহিত্যের বই। বাংলাদেশ ‘একাডেমিক বই’ দিয়ে পরিচিত হতে পারে না? বিশ্বের দরবারে আমাদের এসব বই তো পরিচিতি পাচ্ছে না। আর যেটা বললেন, কিছুক্ষেত্রে এরকম ঘটতে পারে, তবে বিষয়টি এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ কি? প্রকাশক তো এত খোঁজ নিয়ে জানবে না, এক্ষেত্রে লেখকের দায়বদ্ধতার বিষয়টি চলে আসে। একজনের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকা অবস্থায় একই বই আরেকটি প্রকাশনীতে দেওয়া মানে এখানে একটি বিষয়ই শুধু স্পষ্ট হয় যে শুধু প্রকাশকরা দায়বদ্ধ হলে প্রকাশনা জগত উন্নত হবে না, ভালো বই বের হবে না, এক্ষেত্রে লেখকদের বিশাল দায়িত্ব রয়েছে।
ফলোআপ: ভালো মানের পাঠ্যবই করার জন্য তো ‘রিসার্স ওয়ার্ক’ দরকার। সে ধরনের কাজ কি আমাদের প্রকাশনীগুলোতে হচ্ছে?
লোটন: হচ্ছে, তবে সব প্রকাশনীতে নয়। পাশাপাশি আমাদের সামার্থের কথাও ভাবতে হবে। একজন গবেষককে যে পারিশ্রমিক দিতে হবে, সে সামার্থ আমাদের প্রকাশকদের আছে কিনা। তারপরও অনেক প্রকাশনী ভালো মানের গবেষণাধর্মী বই বের করছে।
ফলোআপ: এরকম কয়েকটি প্রকাশনীর নাম যদি আপনি বলতেন …
লোটন: পুঁথিনিয়ল, দিকদর্শন, জুপিটার, লেকচার, পাঞ্জেরি, আইডিয়াল, বিবিসি, এঁদের সেরকম ব্যবস্থা আছে।
ফলোআপ: যেসব প্রকাশনীর নাম বললেন, প্রকাশকরা প্রায় সবাই ‘বাপুস’ এর ডিরেক্টর। তাহলে মূল্যায়নটা কীভাবে হবে? কেউ কি নিজের বিরুদ্ধে কথা বলবে?
লোটন: না না, ওনারা প্রথমত প্রকাশক। বই চালানোর জন্যই ভালো বই করবেন, এটাই স্বাভাবিক। সমিতির পরিচালক হওয়ার কারণে তো তাদের দায়িত্ব আরো বেড়েছে।
ফলোআপ: বেশিরভাগ প্রকাশনীরই তো কোনো সম্পাদনা পরিষদ নেই বলে জানি …
লোটন: আছে। আছে। আমি এটা স্পষ্ট জানি। তবে বড় বড় প্রকাশনী ছাড়া বাকীদের সম্পাদনা পরিষদ নেই, তবে ছোট যারা সামার্থ হলে তাদের একদিন সম্পাদনা পরিষদ থাকবে।
ফলোআপ: অর্থনীতির একটা ভাষা আছে, টাকা যদি বাজারে থাকে, তাহলে কোনো না কোনোভাবে তা সবার কাজে লাগে। কিন্তু টাকাটা যদি বাজার থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে সমস্যা। প্রকাশনী ব্যবসায় কি টাকা বাড়ছে, নাকি এখানে থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, দেশে বা দেশের বাইরে?
লোটন: বড় প্রকাশনীগুলো তাদের উপার্জন বেশি হলে টাকা কোথায় কি করে, এটা তো আমি জানি না। বিদেশে কেউ ব্যবসা করলে তো করতে পারে। সেক্ষেত্রে অসুবিধাটা কোথায়?
ফলোআপ: একই সাথে বিদেশ থেকে তারা ব্যবসা দেশে আনছে কিনা? বিদেশে তারা আমাদের ভালো সাহিত্যগুলো অনুবাদ করে পাঠাচ্ছে কিনা?
লোটন: তারা করছে। বড় প্রকাশনীগুলোর একটি শাখা হিসেবে এখন সৃজনশীল প্রকাশনীও করছে। তারা ভালো ভালো বই করছে। আমাদের অনেক লেখকের বই ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে, হচ্ছে।
ফলোআপ: প্রকাশনা জগতে যারা আসছে তারা কি বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে আসছে, নাকি শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্যেই আসছে?
লোটন: অনেকগুলো প্রকাশনী তো বংশ পরম্পরায় আছে। অনেকে চ্যালেঞ্জ করে উঠেছে, ক্যাম্পাসে বই বিক্রী করত, এখন অনেক বড় প্রকাশক হয়েছেন। আবার শুধু ব্যবসার জন্য এসেছে, এরকমও কিছু আছে।
ফলোআপ: যাদের সামার্থ হয়েছে, তারা তাদের সামার্থ কতটা কাজে লাগাচ্ছে? পাঠকের কিন্তু অভিযোগ রয়েছে।
লোটন: তারা ভাল কাজ করছে। মসজিদ মাদ্রাসায় তারা টাকা দিচ্ছে, যারা হিন্দু তারা মন্দিরে টাকা দিচ্ছে। আসলে এখন আর ভুঁইফোড় প্রকাশক নেই, থাকলেও হাতে গোনা, সবাই একটা যোগত্যা নিয়ে ব্যবসা করছে।
ফলোআপ: পৃথিবীতে অনেক প্রকাশনী আছে, যাদের বই কয়েক কোটি কপি বিক্রী হয়। আমাদের প্রকাশনী থেকে এরকম বই কবে বেরোবে?
লোটন: আমাদের বই গুলোতো আন্তর্জাতিক মেলাতে যাচ্ছে না। আমাদের ‘একাডেমিক বইগুলো’ ঠিকমত তুলে ধরা হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের এসব বই তুলে ধরা দরকার।
ফলোআপ: সেরকম মৌলিক কোনো পাণ্ডুলিপি আমাদের তৈরি হচ্ছে কিনা?
লোটন: বই আমাদের আছে। বাজারজাতকরণে সমস্যা আছে। বই চললে, বিদেশের বাজারে বই গেলে প্রকাশক আরো ভালো বই করতে চাইবে।
ফলোআপ: ‘নন-স্কুলগোয়িং’ শিশুদের বই নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে। শিশুরা যা দেখে, যা শোনে ওরা তা ধারণ করে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাবাজার থেকে শিশুদের জন্য বর্ণশিক্ষা বা এরকম যে বইগুলো বের হচ্ছে সেখানে নন-ম্যাটেরিয়াল বা অনুধাবনমূলক, আধ্যত্মিক বিষয়গুলো রাখা হচ্ছে। একটা তিন-চার বছরের বাচ্চা এগুলো দিয়ে কী বুঝবে? এখানে একমূখীকরণের একটা চেষ্টা বা প্রবণতা রয়েছে কিনা, নাকি অসচেতনভাবেই এগুলো হচ্ছে? তারা গ্লাস চিনবে, তারা চেয়ার চিনবে, তারা তো ‘কনসেপ্ট’ চিনবে না, ‘ননস্কুল গোয়িং’ বইয়ে কেন ‘কনসেপ্ট’ ঢুকানো হবে? তাছাড়া শুধু ধর্মের বই বাদে অন্য বইগুলো তো শুধু কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের ছেলে-মেয়েদের জন্য নয়…
লোটন: এটা ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে হয়। ব্যক্তিগত দুর্বলতা থেকে হয়। অজানা থেকেও হয়। অনেক অভিভাবক আছে, তারা এগুলো তাদের বাচ্চাকে শেখাতে চায়। অর্থাৎ বাজার আছে। তবে এক্ষেত্রেও নীতিমালা থাকতে হবে। এখানে কিছু সাম্প্রদায়িকতা ঢুকেছে। ধর্মনির্বিশেষে কিছু জিনিস অনেকে ভুলবশত ঢুকাচ্ছে। ভুলভাবে ঢুকাচ্ছে। এগুলো নজরদারীর মধ্যে আনতে হবে। তাছাড়া এ বইগুলো তো কোথাও না কোথাও বিক্রী হচ্ছে, তাদেরকে ধরতে হবে। কোন স্কুলে কী বই পড়ানো হয়, তা জানতে হবে।
ফলোআপ: প্রকাশনীর সাথে লেখকদের রয়্যালিটি নিয়ে একটা সমস্যা আছে। অর্থাৎ লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক উন্নত নয় …
লোটন: প্রধান সমস্যা হচ্ছে, বই চলে না, বই কেনার মানুষ কমে যাচ্ছে। প্রকাশক যে কোনো বইতে পঞ্চাশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করবে, টাকাটা তো তার উঠে আসতে হবে। এই কারণে অনেক প্রকাশক লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই করে। অনেক প্রকাশক আছে হয়ত, যারা বই চললেও গোপন করে। দু’দিকেই সমস্যা আছে।
ফলোআপ: টাক নিয়ে বই করলে তো প্রকাশক বইটি বাজারজাতকরণে আগ্রহী হবে না। বই পড়ে থাকবে। মাত্র তিনশো বই ছাপিয়ে তাও যদি ফেলা রাখা হয়, তাহলে লেখকের প্রাপ্তি এক্ষেত্রে কী হল?
লোটন: লেখককে সতর্ক হতে হবে। প্রকৃত প্রকাশক খুঁজে বই করতে হবে। লেখকেরও বই চালানোর চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টাটা লেখক-প্রকাশক সম্মিলিতভাবে করতে হবে।
ফলোআপ: একজন প্রকাশকের সাথে আমার কথা হচ্ছিল, উনি আমাকে বললেন, “তিনি শুধু বড় লেখকদের বই করবেন।” এটা তো ভয়ঙ্কর! একজন প্রকাশকের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে, লেখক তৈরি করা। কিন্তু উনি তো সেই দায়িত্বের জায়গাতে থাকলেন না …
লোটন: ‘বড়’ লেখকদের বই করে পাঁচ-দশটা প্রকাশনী। বাকী চার-পাঁচশো প্রকাশনী তো নতুন লেখকদের বই দিয়েই টিকে আছে। তাছাড়া বড় যারা, তারা তো একদিনে বড় হয়নি। এক সময় তাদেরও নতুন হিসেবে বই করতে হয়েছে। এ দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। আমি নিজে তথাকথিত ‘অখ্যাত’ লেখকদের বই করি।
ফলোআপ: ‘প্রকাশকই লেখক তৈরি করে’ এই স্লোগান সামনে রেখে আমরা লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক উন্নত করার কথা ভাবতে পারি কিনা …
লোটন: লেখক-প্রকাশক এখন দা-কুমড়া সম্পর্ক। শাশুড়ী এবং বউ-এর মত সম্পর্ক। এগুলো আছে, লেখক বড় হয়ে গেলে প্রকাশককে আর মনে রাখতে চায় না, প্রকাশক বড় হয়ে গেলে নুতন লেখকদের কাছে আসতে দেয় না। মানুষ হিসেবে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে, তার প্রভাব প্রকাশনা জগতেও আছে। একজন প্রকাশক কিন্তু অত্যন্ত সম্মানিত একজন ব্যক্তি, দেশের বাইরে গেলে আমরা সে সম্মানটা পাই। পাঠক এবং লেখকদের কাছে প্রকাশকদের সে সম্মান থাকতে হবে। কাউকে ছোট করার সুযোগ নেই, মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
ফলোআপ: সমিতির দায়িত্বে ছিলেন, আপনি বলেছেন নিরপেক্ষ থাকার জন্য আপনার প্রকাশনী এতদিন অনেক স্থিমিত ছিল। দায়িত্ব ছেড়ে আসার পর এখন কি আপনি প্রকাশনী নিয়ে আবার ভাবতে শুরু করেছেন? নিশ্চয়ই আমরা আপনার প্রকাশনী থেকে আগামীতে আরো ভালো ভালো বই পাবো। লেখক তৈরি করার দায়িত্বটি আপনি পালন করবেন …
লোটন: আমি অনুবাদের বাইগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। বাইরের ভালো ভালো বইগুলো অনুবাদ করাচ্ছি। আরো করব। নতুন প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের বই আমরা করতে চাই। প্রতিবছর আমরা নতুন নতুন লেখক তৈরি করছি। কিন্তু লেখকেরও মানসিকতা থাকতে হবে, লেখক হয়ে ওঠা কতটা কঠিন তা বুঝতে হবে। বইমেলা তো আর দশজন লেখক নিয়ে হবে না, কয়েক হাজার লেখকের বই বাজারে থাকে, পাঠকদেরও দায়িত্ব আছে, এর মধ্য থেকে তাদের ভালো বই খুঁজে নিতে হবে।
ফলোআপ: আপনি পুস্তক প্রকাশনা এবং বিক্রেতা সমিতির দুইবার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন, আপনি রাজনীতির সাথে আছেন, আপনি একজন সচেতন প্রকাশকও। লেখক হিসেবে আমদের প্রত্যাশা ভবিষ্যতে আরো অনেক ভালো বই করার, এই জগতে আরো অবদান রাখার প্রয়াশ আপনি পাবেন। আপনার দীর্ঘজীবন প্রত্যাশা করে শেষ করছি। ধন্যবাদ আপনাকে।
লোটন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।