চক্রপাণি দে
পিতা: শহীদ ড. হরিনাথ দে
ঠিকানা: ৪৩, মালাকারটোলা লেন, সূত্রাপুর, ঢাকা-১১০০।
সাক্ষাৎকার গ্রহণরে স্থান: নিজ বাড়ি, তারিখ: ২১/০৬/২০১৭
চক্রপাণি দে ড. হরিনাথ দে ’র কনিষ্ট সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১২ বছর। পিতা ড. হরিনাথ দে এবং মালাকারটোলা গণহত্যা সম্পর্কে তিনি বলেন,
আমার বাবা মনেপ্রাণে একজন বিজ্ঞানী এবং গবেষক ছিলেন। ওনার গবেষণা কর্ম নিয়ে বই বের হয়েছিল। সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে খোঁজ করলে অনেক কিছু পাওয়া যাবে। উনি অনেক ধরণের গবেষণা করেছিলেন, যেমন, মাছের পাউডার থেকে বিস্কুট তৈরি করা, যাতে সাধারণ মানুষের প্রোটিনের চাহিদা সহজে পূরণ হয়। এটা করেছিলেন তিনি সম্ভবত ১৯৬৭-৬৮ এ। তিনি হার্বাল মশার কয়েল তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তবে সেগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি, গবেষণা পর্যায়ে ছিল। আমরা বলি মাটির অনেক নিচে কোনো প্রাণ থাকে না। যেহেতু সেখানে কোনো আলো-বাতাস নেই। সেখানে তিনি প্রাণের সন্ধান পেয়েছিলেন। তবে সকল গবেষণা তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। মাছের পাউডারের গবেষণাটা পাকিস্তান সরকার পেটেন্ট করে নিয়েছিল। মাছ বলতে, মূলত সাগরের মাছগুলো, তখন সাগরের মাছ কেউ খেত না। পাউডার করে বিস্কুট তৈরি করলে মানুষ পুষ্টিটা পায়। পাকিস্তান সরকারের অধীনেই তিনি তখন কাজ করতেন, সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। ওনার সহকারী ছিলেন ড. দেবনাথ, ওনার কলিগ ছিলেন ড. কামাল।
তিনি বিজ্ঞানী ছিলেন, তাই আর কোনো সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন না। নন-পলিটিক্যাল লোক ছিলেন। বাসায় এসে তিনি অনেকগুলো ফাইল নিয়ে বসতেন, দেখতাম উনি শুধু টাইপ করতেন, রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত টাইপ করতেন। উনি খুব ঘন ঘন চা খেতেন, সিগারেট খেতেন। এটা একটা স্পেশাল বিষয়, সবাই তখ ক্যাপস্টান সিগারেট খেত। সবাই ওনাকে কটাক্ষ করত। উনি বলতেন, আমি ঢাকার লোক, আমি তো বিড়ি খাইছি ছোটবেলায়, এটা খুব স্ট্রং সিগারেট, এটাই আমার খুব ভালো লাগে। উনি এত বেশি চা খেতেন, অনেক সময় চা খেয়েই ভুলে যেতেন যে তিনি এইমাত্র চা খেয়েছেন। সিগারেট অনেক সময় হাতেই শেষ হয়ে যেত।
গান-বাজনা খুব পছন্দ করতেন। আমার মনে হয় উনি পোষা প্রাণী খুব পছন্দ করতেন, বিড়াল পালতেন, বিড়ালটা সবসময় ওনার কাছে থাকত। একটা কুকুর ছিল, কুকুরটা ওনার সাঙ্গাতিক প্রিয় ছিল।
উনি বাইক চালাতেন। লন্ডন থেকে ’৬২ তে ফেরৎ আসার সময় একটা বাইক নিয়ে এসেছিলেন। ঐ বাইকটা চালাতেন, জীবনের শেষাব্দি ওটা চালিয়েছেন। নষ্ট হলে নিজেই ঠিক করতেন। ওনার টেকনিক্যাল জ্ঞান খুব ভালো ছিল। ওনার বাবা, মানে আমার ঠাকুরদা ছিলেন ব্যবসায়ী, ওনার একটি মেশিন ইন্ড্রাস্ট্রি ছিল, ওখানে যিনি হেড-মিস্ত্রি ছিলেন, ওনার সাথে বাবার খুব সখ্যতা ছিল, ফলে ওখান থেকেই হয়ত ওনার টেকনিক্যাল জ্ঞান বেড়েছে। বাড়ির ছোটখাটো সমস্যাগুলো উনি নিজেই সমাধান করতেন। বাই নেচার তিনি এগুলো পারতেন।
পারিবারিক জীবনে উনি খুব রুটিন মাফিক চলতেন। সকালে বেরিয়ে যেতেন, অফিশ শেষে ফিরতেন। বাবা খুব একটা আমাদের পড়াতে বসতেন না। কখনো কখনো দেখেছি বটদা, মেজদাকে একটু পড়াতেন। ’৭১ এ বটদা তখন নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে, মেজ দা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশুনা বিষয়ে গৃহ শিক্ষকের ওপরই নির্ভর করতেন।
এমনি মায়ের সাথে গল্প করতেন, সম্পর্ক খুব ভালো ছিল ওনাদের। রাতে খাবারটা আমরা সবাই একসাথে করতাম, এটা অবশ্যই। উনি সবসময় অফিশ শেষেই বাসায় ফিরতেন। এবং তারপরে রুটিন সবসময় প্রায় একই রকম থাকত। শুনেছি উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণ রসায়নে প্রথম পোস্ট ডক্টরাল। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
গণহত্যা
ঐদিনের ঘটনা বলি- আমার মনে আছে, সেদিন ২৭ মার্চ সকাল থেকে কার্ফু উঠে গেল। বিকাল চারটা থেকে আবার কার্ফু লাগল। উনি সেদিনও বিকালে বসে টাইপ করছিলেন। বিকালে বারন্দায় বসে আমরা সালাদ খেয়েছিলাম। বিকালে আমরা সালাদ খেতাম। রাতে একসাথে আমরা ডিনার করলাম। সেদিন টেলিভিশন চ্যানেল চালু ছিল। সরকার ফিরোজ ছিলেন একজন উপস্থাপক, উনি সেদিন বাংলা খবরটা পড়েছিলেন। সম্ভবত একজন ডিফেন্সের লোক ইংরেজি খবরটা পড়েছিলেন। সেই মুহূর্তে দরজায় নক করছে, বলছে, ড. দে হ্যায়। নোট করার মত বিষয় হচ্ছে, আমাদের পাড়ার সবাই বাবাকে প্রফেসর বাবু হিসেবে চিনতেন। ড. দে নামে ওনাকে ডাকার কথা না। হয়ত, নামটা সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে তারা নিয়ে এসেছিল। ২৬ মার্চ সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে হত্যাকাণ্ড হয়েছিল। কয়েকজন বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছিল।
বাবা লুঙ্গি গেঞ্জি পরা ছিলেন, ওদের সাথে ঐ অবস্থায় নেমে গেলেন। ওরা দশ বারো জন অস্ত্রধারী সেনা এসেছিল। মেঝ ভাই, বড় ভাই ছিলেন, সবাইকে দেখেছে, কিন্তু কাউকে আর ডাকেনি। পরে ইন্ডিয়ার একটি পত্রিকায় পড়েছি, সম্ভবত পাকিস্তানী কোনো মেজরের সাথে যাবার সময় বাবার কথা হয়েছিল, তারপর তিনি অন্যদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে বলেছিলেন।
উনি যখন বাড়ি থেকে নেমে যান, কারো সাথে কোনো কথা বলতে পারেননি। সবাই ওরা অস্ত্রধারী ছিল, বাবা শার্ট পড়তে চেয়েছিলেন, ওরা বলে, জরুরত নেহি। ঐদিন আমার বয়সী একটা ছেলে ওদের সাথে এসেছিল, সম্ভবত ওকে দেখিয়ে দিতে বলেছিল। ওর কাছে হয়ত শুধু বাড়িটা দেখতে চেয়েছিল।
তবে এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড কে তাকে আমরা খুঁজছি। যাকে সন্দেহ করি, এরকম একজন পাকিস্তানে বসে মারা গেছে, স্বাধীনতার পরপর অনেকে পালিয়ে গেছে।
এই হত্যাকাণ্ডটা নিয়ে ভেবেছি, শুধু হিন্দু পাড়া হলে এখানেই শুধু কেন আসবে, আরো অনেক হিন্দু পাড়া ছিল। সম্ভবত ড. দে কেই তারা খুঁজতে এসেছিল। এলাকা হিসেবে খুঁজলে তারা ‘ড. দে’ নামে খুঁজত না। কারণ, ড. দে ছিল তার অফিশিয়াল নাম। ধারণা করি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকেই তারা তথ্য নিয়ে আসে। পরে এলাকায় এসে আরো অনেককে ধরে নিয়েছে। যার সাথে যার শত্রুতা আছে সে তাকে দেখিয়ে দিয়েছে বা কিছু।
ওনাদেরকে ঐদিন রাত এগারটার দিকে হত্যা করা হয়, ফায়ারিংয়ের শব্দ আমরা শুনেছি। এরপর বটদা গিয়ে মৃতদেহ শনাক্ত করে আসে। পরে আমরা ভারত চলে যাই।
স্মৃতিসৌধ
২০১০ সালে মালাকারটোলা গণহত্যা স্মরণে স্মৃতি সৌধ সম্পর্কে তিনি বলেন, নিজস্ব উদ্যোগে এটি নির্মিত হয়েছে। তৎকালীন কমিশনার সাঈদ ভাই যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। যেখানে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছিল সেখানে সৌধ করা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভব না। এটি রক্ষা করার বিষয় আছে। ওখানে কে দেখবে? এখানে আমাদের চোখের সামনে আছে। তারপরেও ট্রাকের ধাক্কায় এটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে সরকার উদ্যোগ নিলে ময়লার ডিপো সরিয়ে লোহার পুল মোড়ে একটি সৌধ, স্মৃতি জাদুঘর ও লাইব্রেরি হতে পারে। ঐ মোড়টির নাম শহীদ চত্বর দেয়া যায়। জহির রায়হান মিলানায়তনের সাথেই এটি হতে পারত। একই খরচে হয়ে যেত। উল্লেখ্য, লোহার পুল মোড়ে জহির রায়হান স্মৃতি মিলনায়তন রয়েছে, পাশেই মালাকারটোলা গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল। চক্রপাণি দে বলেন, আমার বাবা বিজ্ঞানী ছিলেন বলে বিভিন্নভাবে তাকে স্মরণ করা হয়, কিন্তু বাকী যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের কথা কোথাও নেই। যথাযথভাবে স্মৃতি সংরক্ষণ না করলে এগুলো থাকবে না।
#সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দিব্যেন্দু দ্বীপ
ড. হরনিাথ দে
হরিনাথ দে (জন্ম : ২১ ডিসেম্বর ১৯১৪, মৃত্যু : ২৭ মার্চ ১৯৭১) ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগের শিক্ষক। তাঁর বাবা যদুনাথ দে। মা ///////। ১৯৩১ সালে ঢাকার পোগোজ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৩৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি, ১৯৩৬-৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে যথাক্রমে বিএসসি, অনার্স ও এমএসসি পাস করেন। সকল পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯৪২ সালে পুষ্টি রসায়নে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল তাদের এদেশীয় দোসদের সহযোগিতায় ঢাকার সূত্রাপুরের লোহারপুলসংলগ্ন ৪৩ মালাকারটোলার বাড়ি থেকে বিজ্ঞানী ড. হরিনাথ দেকে ডেকে নিয়ে যায়।
এরপর লোহারপুলের পাশে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাঁকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক সেনাবাহিনী। এরপর এলাকা থেকে নারী-শিশুসহ সবাই পালিয়ে যায়। হরিনাথ দেসহ অন্যদের মরদেহ সেখানে পড়ে থাকে। এ সম্পর্কে হরিনাথ দের ছেলে সঙ্কর্ষণ দে লিখেছেন, “৪৩ মালাকারটোলা লেন থেকে লোহারপুলের ঢাল, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দূরত্ব। অথচ কী আশ্চর্য, আমি ১৬ বছরের তরুণ অতিক্রম করতে পারলাম না মাত্র ওইটুকু পথ। সেখানে পরম নির্ভাবনায় শুয়ে আছেন আমার প্রাণপ্রিয় পিতা হরিনাথ দে। শুয়ে আছেন আমারই আশৈশব দেখা আরও নয়টি মুখ। কিন্তু আমি যেতে পারলাম না।”
শিক্ষানুরাগী ও বিজ্ঞানসাধক হরিনাথ দে ১৯৩৭ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ভারতের ইন্দোরে মহাত্মা গান্ধী মেমোরিয়াল ইনস্টিটিটিউটে পুষ্টি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি আবার ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে যোগ দেন। আমৃত্যু সেখানেই মূখ্য বিজ্ঞান কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। হরিনাথ দে এককভাবে এবং তাঁর সিনিয়র সহকর্মী ড. কুদরাত-এ-খুদার সঙ্গে কাজ করে প্রাণরসায়ন ও পুষ্টি সম্পর্কে বেশ কিছু মৌলিক উদ্ভাবন করেন।
নিরীহ, শান্ত ও আত্মনিমগ্ন মানুষ হরিনাথ দের সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছিল। চাকরিজীবনের শেষ দিকে এসে তিনি পারিবারিক ব্যবসার প্রতিও মনোযোগী হয়েছিলেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞানকে সমন্বয় করে কিছু তথ্যগত বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেন। ঈক্ষণ নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনা করতেন তিনি। নাট্যদল প্রতিষ্ঠা ও অভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, উইকিপিডিয়া