ক্রেতা মাত্রেই বিক্রেতাকে শয়তান এবং ঠকবাজ ভাবে

ক্রেতা মাত্রেই বিক্রেতাকে শয়তান, ঠকবাজ ভাবে! কিন্তু সবাইতো কখনো ক্রেতা কখনো বিক্রেতা। তার মানে সবাই-ই আমরা ঠগবাজ, এখন পর্যন্ত অর্জিত সভ্যতা অন্তত সেই পরিচয়ই তুলে ধরে মানুষের।

জীবনযাপনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নিজেকে দাঁড় করাতে না পারলে কখনই জীবনে পরিপূর্ণ বোধ তৈরি হয় না। সবসময় উর্ধতন হয়ে থাকলে অধঃস্তনের কষ্ট বোঝা সম্ভব নয়। খুব বোধসম্পন্ন মানুষ ছাড়া সবকিছু বুঝতে পারে না। দোকানদারি না করলে দোকানদারের কষ্ট বোঝা যায় না। নিজে মাতা-পিতা না হওয়া পর্যন্ত মাতা-পিতার কষ্ট বোঝা যাবে না।

খুব নরম হৃদয়ের মানুষে সবার আক্ষেপ কিছুটা অনুভব করতে পারলেও আসলে সবটা বোঝা সম্ভব নয় বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া।

স্কুল জীবনে সেসব কাজ এক নাগাড়ে না করলেও মাঠের কাজ করেছি। মাঠে ধান বোনা, ধান রোপণ করা, ধান কাটা, বাড়িতে আনা, ধান মলা, সেই ধান থেকে চাল বের করা -এ এক দীর্ঘ্য প্রক্রিয়া, দাদুর সাথে এসব কাজ মাঝে মাঝে করেছি বলে কষ্টটা বুঝি।

সম্ভবত তখন অষ্টম বা নবম শ্রেণিতে পড়ি। গ্রামের বাজারে বলাই মামা মুদির দোকান করল। দোকানে আমি বসতাম, খুব আগ্রহ নিয়েই বসতাম। যতক্ষণ বসতাম ততক্ষণই কিছু না কিছু খেতে থাকতাম। তারপরেও বসে থাকতে ইচ্ছে করত না।

দোকানে বসার সবচেয়ে বড় জ্বালা হচ্ছে আসে পাশে যারা থাকে তাদের সবাইকে ক্রেতা মনে হয়। দোকান অতিক্রম করে না যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকি পথিকের দিকে, এভাবে একশোজন যাওয়ার পর হয়ত একজন ক্রেতা হয়। সেই ক্রেতা শ্যোন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পাল্লার দিকে, এরপর ওজড় করে দাম নিয়ে, পণ্যের গুণগত মান নিয়ে।

মনে মনে ভাবতাম, দোকান দেওয়া চলে শুধু নিজে সারাদিন ইচ্ছেমত খাওয়ার জন্যে, আর কোনো কারণে দোকান করা চলে না।

একই অভিজ্ঞতা আমরা আবার হয় ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন, পড়াশুনার পাট চুকিয়ে বিভাষ দা ‘র সাথে খুলনায় গিয়ে দোকান করলাম। দোকান করলাম মানে, আমি পিছেল হিসেবে গিয়েছিলাম। অর্থাৎ, বিভাষ দা ছিল মালিক আর আমি সহকারি।

কিন্তু ঘটনা গিয়ে দাঁড়াল- দোকানে মালিক আছে, কর্মচারী আছে, মাঝে মাঝে গেস্টও আছে, শুধু ক্রেতা নেই।

সেই ২০০১ সালে দোকানে প্রতিদিন ৫০০ টাকা লস হতে থাকল। ফোন মোবাইল কম্পিউটারের দোকান। তখন প্রতি মিনিট মোবাইলে কথা বলতে লাগত দশ টাকা। কথা যা বলার দেখতাম মালিক নিজেই বলত। এক মার্কিন রমণী মাঝে মাঝে আসত টিউন্ডটি কল করতে। সেই ছিল যা একটু ক্রেতা।

বিভাষ দা দেখতাম তাকে সমুচা সিঙ্গাড়া খাওয়াত। কেন খাওয়াত কে জানে, তবে আমারও ঐ মার্কিন রমণীকে সমুচা সিঙ্গাড়া খাওয়াতে ইচ্ছে করত। পুরুষের এ ইচ্ছে বোধহয় শুরু হয় হঠাৎ একদিন এবং তা চলমান থাকে আমৃত্যু। অবশ্য তখন বেশি ইচ্ছে করত নিজে খেতে, আমার ভাগে একটা জুটত বটে কিন্তু ইচ্ছে করত আরো খেতে।

ঐ দোকানের সিঙ্গাড়াগুলো ছিল দুর্দান্ত, পরিবেশন করতও তারা খুব ঢক করে। ছোট ছোট বাঁশের ঝুড়িতে করে পরিবেশন করত। দেখতাম, বিভাষ দা’ ঐ মার্কিন রমণীর সাথে ইংরেজিতে কথা বলে, আমি শুনি আর ভাবি, দাঁড়াও সুযোগ একদিন না একদিন পাবই, সেদিন অামিও…

সুযোগ দ্রুতই পেয়ে গেলাম। সম্ভবত মালিক অসুস্থ হয়েছিল বা কোথাও গিয়েছিল। আমি সারাদিন দোকানে তীর্থের কাকের মত বসে আছি কখন ঐ মার্কিন রমণী ফোন করতে আসবে। আসল না। নিজেই সমুচা সিঙ্গাড়া কিনে খাইলাম একটা। বেচাকেনা নেই টাকা মারব কোত্থেকে! তাই ইচ্ছে করলেও একটার বেশি খাওয়া হত না।

পরের দিন ঠিকই মার্কিনি আসল। আমি চেষ্টা করলাম তার সাথে বিভাষ দা’র মত করে কথা বলতে। কিন্তু খুব একটা জমল না। তখন আমি মালিকের চেয়ারে, খুব ভাব নিয়ে পাশের দোকানে সামুচা সিঙ্গাড়ার অর্ডার দিলাম, কিন্তু তিনি ধন্যবাদ দিয়ে কেটে পড়লেন না খেয়ে। মেজাজ খারাপ করে নিজেই ওগুলো খেয়ে ফেললাম, এবং মনে মনে বলে রাখলাম, না খাইছো তাতে কী হইছে মালিককে ঠিকই হিসেব দিয়ে দেব।

এভাবে আর কতদিন চলে? অবশেষে বিভাষ দা দোকান ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। আমি খুলনায় থেকে গেলাম।

দিব্যেন্দু দ্বীপ


#জীবনজুয়াড়ি (আত্মজীবনী) থেকে