অনেকদিন ধরে বেশ্যা সংগমের কথা ভাবছি। শুনেছি, বিভিন্ন হোটেল নাকি মেলে। সাহস হয় না। এক বন্ধুর সাথে গিয়ে অবশ্য একদিন দেখে এসেছি।
ও বলেছিল, ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাবে। বঙ্গবাজারের বিপরীতে মাকের্টের উপরে খুপড়ি এক হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল ও। একটি রুমে নিয়ে বলল বাছাই কর। দেখি, ছোট ছোট মেয়ে বসে আছে। বয়স চৌদ্দ থেকে ষোলোর মধ্যে। কৌতুহল থাকলেও শরীরে অত বড় রাক্ষস নেই যে, পুরোপুরি বিবেকহীন হয়ে পুতুলের মতো ছোট্ট একটি মেয়ের সাথে ঘণ্টাখানেক ছাইছাতা করব, জানব না তার ভবিষ্যত, জানব না তার অতীত। চূড়ান্ত একটি সম্পর্ক করে ফেলব বিনা কৈফিয়তে! হলো না। মনে বিতৃষ্ণা জন্মাল। হোটেলে ও জিনিস আর কোনোদিন খুঁজিনি।
ভাসমান বেশ্যার কথা শুনেছি। চলাফেরার সময় বোঝার চেষ্টা করেছি । দেখেছিও। ও তো একেবারে আবর্জনা। বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে ওরা নিজের শরীরের দ্রুত ক্ষয়িঞ্চু কয়েক দলা মাংসপিণ্ড। ওদের যত দেখেছি, মায়া বেড়েছে, ক্ষুধা নিবৃত হয়েছে।
সামাজিক বেশ্যার কথা শুনেছি, দেখেছিও। মনে হয়েছে, সামাজিক বেশ্যাদের সাথেই শুধু কাজটা করা চলে। ওরা অসহায় নয়, শিকারও নয়, স্বেচ্ছায় ওরা এই জীবনে এসেছে। হলো না, ওদের যে জীবনবোধের বড় অভাব, একেবারে যাচ্ছেতাই মানসিকতার হয় ওরা। কোনো কাজ না করে ওরা ভোগ করতে চায় জীবনের সবটুকু সুখ। বাদ দিলাম আমার বেশ্যাগমনেচ্ছা।
তবে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে, পথেঘাটে ও জিনিস দেখলে বুঝতে পারি। ফার্মগেটে বোরকা পরে লক্ষ্মীরা খদ্দের ধরে। এ তো সবার জানা। এর বাইরেও আছে। একেবারে গৃহিণী টাইপের কিছু মহিলারাও খদ্দের ধরে। কীভাবে জানলাম?
একদিন ওখান থেকে হেঁটে আসছিলাম। ওসব কিছু মনে ছিল না। হাত বিশেক দূর থেকে মধ্যবয়সী একজন মহিলাকে দেখলাম, ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে। হাতে ছোট্ট একটি ব্যাগ। ফাইল ধরনের। মধ্যে দুএকটি খাতা থাকলে যেমন দেখায়, ঐরকম। চোখে চোখ পড়েছিল। সেকেন্ডের ব্যবধানে আমি চোখ নামিয়েছিলাম, ফের তাকিয়ে দেখি সে চোখ নামায়নি।
দৃষ্টি আরো কাছে আসতে তার দেহাগ্নি চোখে পড়ল। উনি কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। আমি রেট জানতে চাইলাম। সাতশো টাকা। বড্ড বেশি হয়ে যায়। এর নিচে সে যাবে না। অগত্য ছাড়তে হল। ছদ্মবেশী পথচারী আবার ধীর পায়ে এগোতে থাকল। আমার বেশ্যার নেশা এবারও মিটল না।
ব্যস্ততায়, ত্রস্থতায় দিন কেটে যায়। বাহ্যত অভিজাত, আর্থিকভাবে ভীষণ দরিদ্র আমি জীবনে অনেক কৌতুহল পাশ কাটিয়ে এসেছি, কিন্তু এ তো শুধু কৌতুহল নয়, পুরুষের জন্মপাপ; পাশা কাটানো যায় না। ছাইচাপা আগুনের মতো থেকে থেকে দপ দপ করে জ্বলে ওঠে।
কাকরাইলে কিছু পথঠাকুরের দেখা মেলে। আঞ্জুমান মুফিদুলের ঠিক নিচে দাঁড়ায় ওরা। ও পথ দিয়ে গিয়ে একটা টিউশনি করতাম। মাঝে মাঝে হেঁটে যেতাম। সেদিন টিউশনির বেতন পেয়েছিলাম। ভাবলাম, আজকে ঠাকুরের কাপড় খুলতেই হবে।
আট/দশটা দেখলাম, কিন্তু পছন্দ হল না। অবশেষে লম্বা চওড়া ফর্সা একটা দেখে পছন্দ করলাম। একটু পুরুষালী চেহারা তবে সেক্সি। দরদাম করলাম না। সেও কিছু জিজ্ঞস করল না। বলল, তার বাসা আছে সেখানে যাওয়া যাবে। রিক্সায় উঠলাম। মহিলার নিতম্বদেশ এতটাই প্রশস্ত যে তারপাশে বড়জোর একটা পোশা বিড়াল বসতে পারে। আমিও বসতে পেরেছি!
প্রসাধনীর উৎকট গন্ধে বমি ঠেলে আসছে। জায়গায় হাত দিতে গেলে বাধা দেয়। বুঝলাম না— এ কেমন বেশ্যা! হাত বরফের মতো ঠাণ্ডা। অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা এবং শক্ত। নারীর হাত এমন শক্ত হয় নাকি! মোটা মোটা আঙ্গুল, চওড়া নখ! বুকে হাত দিতে গেলে হাত সরিয়ে দেয়। শক্ত যুক্তিও দিল— বলে, আমি পথেঘাটে এসব করি না। কেন জানি ভয় পেয়ে গেলাম, রিক্সা থামিয়ে পালাতে চাইলাম। শক্ত করে ধরে রাখল। এমনভাবে ধরেছে আমার নড়ার শক্তি নেই। অগত্য চুপ করে বসে রইলাম।
শাহাজানপুরের দিকে রিক্সা ঢুঁকে নির্জন একটি জায়গায় দাঁড়াল। মহিলা আমাকে জোর পায়ে তাকে অনুসরণ করতে বলল। একটি সরকারি কোয়ার্টারের দুই তলায় উঠলাম। ধাক্কা না দিলেও দরজা খুলে গেল। সম্ভবত উপর থেকে কেউ চোখ রেখেছে। সর্দারনি টিকিট কাটবার তাগিদ দিল।
বলে, আমার জ্বর, বেশি বাহানা করবা না, পাঁচশো টাকা ফেলো, কাম সেরে ভাগো। দুইরুমে একগাদা মানুষ, মাছ কাটার উৎকট গন্ধ। খোলা বাথরুম। একপাশে টিভি চলছে। নিচে লুঙ্গি, উপরে ব্লাউজ পরা একজন এসে বলে, মাসিরে পাঁচশো দিয়েছিস বোনগো কত দিবিরে লো?
আমার তো আত্মাখাঁচাছাড়া। পকেটে আরো তিনহাজার টাকা আছে। সবটাকা রেখে দেবে নিশ্চিত। পরানডা নিয়ে পালাতে পারলে হয়। বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম। খুচরো তিনশো টাকা মানিব্যাগে রেখে বাকি টাকা জাঙ্গের রবারে ঢুকিয়ে রাখলাম। একটু চিন্তামুক্ত হতে চেষ্টা করলাম। ওদের জীবনধারা বোঝার চেষ্টা করছি।
একটা রুমে আমাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বলল, সবই তো বুঝতে পারছিস— এবার শো, কাম করে দিচ্ছি। হাতজোড় করে বললাম, লাগবে না কিছু, বিদায় করো।
দরজা ঠেলে আরেকজন ঢুকেই মানিব্যাগ হাতাতে শুরু করল। স্মাগলার বলে পুলিশের কাছে দিতে চাইল। ও ঠেকাল। ও মানে … বুঝতেই পারছেন পাঠক সকল, নাকি? দুএকটা ভালোবাসার কথা বলেছিলাম কিনা রিক্সায় বসে! মানিব্যাগের টাকাটা নিতে দিল না। আমাকে বিদায় করল। করুণ কণ্ঠে বলে দিল, “এই তো আমাদের জীবন।”
শেকস্ রাসেল
লন্ডন, যুক্তরাজ্য