যাব কি যাব না ভেবে ভেবে আমি দাঁড়িয়েই থাকি
কার কাছে যেতে চান কবি? নির্দিষ্ট কারো কাছে, নাকি প্রেমের যে আদিম প্রতিরূপ, সেই সত্তার কাছে? কোথায় দাঁড়িয়ে তিনি দোদুল্যমান— অধরা প্রেমিক এবং প্রকৃতির মাঝে, নাকি শ্বাশ্বত এক ‘তুমি’ এবং সামাজিক সে প্রাপ্তির মাঝে? কবির হাহাকার আছে, তাই বলে তিনি বঞ্চিত নন। পৃথিবীর পথে পথে তার অছে অন্য এক জীবন। তাই বলে তিনি নিষ্ক্রান্তও নন, কোলাহলহীন সমুদ্র তটে একলা বসে তিনি করে চলেছেন আধ্যাত্মিক অন্বেষণ।
“এ শহরের চেনা এভিনিউ ধরে হেঁটে গেলে
একদিন মিলতো সুগন্ধি আতরের হাট
বসরায়ী গোলাপের বাহারি বাজার-
পার হয়ে গেছে কি বহুকাল?”
চেনা এবং সে শহরের গন্ধমাখা শরীর নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন কবি? কেনই বা ফিরে এসে এখন হাহাকার করছেন? কীসের টানে আবার ফিরে এসেছেন? নাকি কবি আসলে ফিরতে পারেননি। ফিরবেন বলে শুধু ভাবছেন—
” সময় পেরিয়ে গেলে কেউ আর
ফেরে কি কোনোদিন
ছেড়ে যাওয়া পুরনো শহরো!”
দ্বিধাগ্রস্ত কবি মৃদুমন্দ গতিতে নির্ঝরিণীর মতো চলতে চলতে কখনো থেমেছেন ছাতিম গাছের ছায়ায় কখনো বা কাঁঠালচাপার মায়ায়, কিন্ত নেশা তার কোনো দূরবর্তী গায়। তীব্র এবং সুচতুর ভালোবাসায় বেধে রাখেনি কেউ তাকে। কবি তার জন্য দুঃখ করতে চাচ্ছেন না, কিন্তু তাই বলে বেদনার চাপা সুর অনুল্লিখিত থাকেনি—
“কোনোদিনও বলোনি ভালোবাসো,
তোমাদের সত্য কথনে তাই বড় স্বস্তিতে থাকি
ভারহীন হয়ে—
ভালোবাসা পিছুটান আনে-
যে-কোনো নক্ষত্রের রাতেই
তাই চলে যেতে পারি
অন্ধকারের ওপারে
একলা পারানি বেয়ে
পিছুটানহীন—”
কিন্তু কই? কবি তো স্থবির, যেন ত্রস্থ প্রেমিক শিলাবৃষ্টির মতো বেদনা ছড়িয়ে এইমাত্র প্রস্থান করেছেন। কবি পারছেন না প্রেমের বলিরেখা মাড়িয়ে প্রেমের পথটুকু লুপ্ত করে পিছুটানহীন পেরিয়ে যেতে চেনা সীমানা। কবি যেন স্মৃতির প্রাচীরে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন বিরামহীন—
” আমার তাড়াহীন সময় কেবলই ছুঁয়ে যায়
দেয়ালের ওয়েল পেইন্টিং
শেষ বিকেলের সোনালি ধানের ক্ষেত,
আলের শুকনো ডালে
ডানায় ভর দিয়ে এখনো বসে আছে এক একলা শালিক।”
২
নাহ, কবি কবিতায় তার আত্মজীবনী লিখেছেন না। কবি তুলে এনেছেন অচেনা কোনো পাঠকের আঁকুতি। এখানে পাঠক সম্মোহিত, প্রেমিক বা প্রেমিকার জন্য তার অপেক্ষা, অবধারিত বিচ্ছেদ জেনেও অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা—
“জানি আমি,
তোমার দেয়ালে নেই
আমাদের পুরনো যুগল কোনো ছবি।
তবু তুমি বাড়ি পাল্টাবে বললেই
আচকমা ধাক্কায় দোয়াত উপচিয়ে
অমোচনীয় কালি গড়িয়ে যায়
সাদা প্রিয় রেশমি কার্পটে!!”
মাঝে মাঝে অনুভূতির দায়ভার পাঠকের ওপর চাপালেও কবির হাহাকার চাপা থাকেনি। কিন্তু কার জন্য তার হাহাকার? কোনো নির্দিষ্ট মানুষের জন্য, নাকি আমাদের ফেলে আসা দিনগুলির জন্য।
“শবরমতি নদী পেরোলেই
পিছনে পড়ে থাকে
আরেক বিদগ্ধ নগরী
যত নষ্টালজিক সময়ের মতো—
চায়ের টেবিল ছেড়ে উঠে গেছে বনলতা সেন
সন্ধ্যা নামার অজুহাতে।
টেবিলে পড়ে আছে
ভুল করে ফেলে যাওয়া চশমা
পরিত্যক্ত চায়ের কাপের পাশে।”
কবি চেয়েছেন ভুলে যেতে। লাল বাতি নীল বাতির হাতছানিতে আবার জীবন রাঙ্গাতে। পেরেছেন কি? মনে হচ্ছে তিনি সওয়ার হয়েছেন নতুন কোনো জাহাজে, কিন্তু এখনো বিষন্ন হয়ে তাকিয়ে আছেন পিছনে—
“এক জাহাজের ছবি
দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই
ব্যস্ত জেটিতে ছায়া ফেলে
নতুন মাস্তুল!”
এখানেও তিনি নিজেকে আড়াল করে মানবকূলের একটি সাধারণ ভাবানুভূতির ছবি এঁকেছেন, তাই বলে নিজের হাহাকারটুকু তিনি লুকোতে পেরেছেন কি? পরের কবিতাতেই তিনি লিখেছেন—
“আমি প্রাণপনে আলো জ্বেলে রাখি
পিলসুজে তেল, মোমের সলতে ফুরিয়ে গেলে
আমি মেলে দিই করতল
নিজেই জ্বলবে বলে।”
৩
কবি কি তাহলে জীবনের বহুমাত্রিকতায় এবং বাহুল্যতায় বিভ্রান্ত হয়েছেন। নাকি মানুষের মনোজগতে আশা, নিরাশা এবং প্রত্যাশার যে দোলাচল চলে, তারই ব্যবচ্ছেদ করেছেন। কবি হাঁটতে চাচ্ছেন পৃথিবীর পথে পথে, কিন্তু তিনি নষ্টালজিক। বিনিময় মূল্য দিয়েই তাকে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে।
“কতটা পথ একসাথে হেঁটে এলে
দু’জনার রাস্তা আলাদা হয়ে যায়?
ঠিক কতটা সময় পেরোলে আবার
মৃত্যু উপত্যকার দু’ধারে
গড়ে ওঠে প্রাণের আভাস?”
কবি কি দুঃখভারাক্রান্ত তাহলে? খুঁজে ফিরছেন হারানো কোনো সুর। কবি কি মিলনাকাঙ্ক্ষায় উন্মুক? সেকি তার ফেলে আসা কেউ, নাকি তিনি কোনো আগন্তুকের জন্য অপেক্ষারত। তিনি কি লুকাতে চাচ্ছেন তার প্রেমাতুর হৃদয় স্মৃতিকাতরতার ভণিতায়, নাকি সত্যিই তিনি স্মৃতিকাতর?
“একা একা পালিয়েছি বহুবার
ঘর থেকে, বাড়ি থেকে,
মন থেকে, প্রাসাদের কোণ থেকে
কত কতবার!
এইবার চলো একসাথে পালাই দু’জনে
পরিত্যক্ত ট্রেঙ্চে বাসা বেঁধে
সারারাত আকাশের তারাদের গল্প শুনে শুনে
পৃথিবীর কোলাহল থেকে দূরে সরে
চলো বিলীন হই কোনো এক ঘন নক্ষত্রের রাতে।”
যতই তিনি চেষ্টা করুন না কেন পাঠকের এটা মনে হতে বাধ্য যে, কবি আটকে আছেন একান্ত কোনো প্রেমে বা শ্বাসত কোনো সত্যে। কে হারিয়েছে তার বা আপনার?
“সে ছিল, এখন নেই—
রেস্তোরাঁর কাচঘেরা ঘরে কাচ পাত্রে
ফালুদার বর্ণিল কারুকাজের মতো
সেও মিলিয়ে গেছে সময়ের আবর্তে,
তাকে আর যায়নি পাওয়া কোনোদিন,
সমুদ্রের নোনা হাওয়ার অন্ধকারে
অথবা কোনো চাঁদের রাতে,
মোহনীয় টিউলিপ বনে।”
নাহ! পুরনো ছবি মনের কোণে লুকিয়ে রেখে কবি বের হয়েছেন বটে, তবে সন্যাস ব্রত তার নেই।
“এভাবেই থাকবো দাঁড়িয়ে
আরো কিছুকাল
তারপর নিশ্চিত একদিন
ডাক দেবে কেউ
নিয়ে যাবে সাথে করে
অচেনা সাগর কিনারা ধরে”
কবি কি ভুলের সাথে আবার ঘর বেঁধেছেন, নাকি সংসারে বিভ্রান্ত পাঠকের ওপর কবি চাপিয়ে দিয়েছেন এমনই এক রুপকল্প যে জীবন উচ্চতর মানুষের, আবার নিম্নতর উপায়ে বেঁচে থাকা মানুষের ক্লান্ত জীবনের কোন এক পর্যায়ের অবশম্ভাবী বিচ্যুতির? যদিও কবিতায় ভেসে উঠছে শুধু একটি চিত্র, যেহেতু কবি শাহিদা সুলতানা চিত্রকল্প দিয়ে রূপকল্প সাজাতে পছন্দ করেন।
“নিজ ঘরে পরবাসী হয়ে দেখি
নানা রঙা পরিযায়ী পাখি
এসে বসে খোলা জানালায়-
উঠোনের গোলার ধান খুঁটে খুঁটে খায়,
শুষ্কচঙ্চু ছোঁয়ায় আমারই স্ফটিক পেয়ালায়,
আমি শুধু দেখি—
দূরের ভদ্রা নদী
চুরি করে পালিয়ে গেল
আমার পারানি নৌকাখানি।”
৪
কবি আবার একা। এ ঘরও তার ভেঙ্গে গেছে। নাকি পাঠককে সে নিয়ে যেতে চায় মানুষের চিরন্তন একাকীত্বে, তবে প্রকৃতি তার একান্ত অনুষঙ্গ, যেখানে মিশে থাকে ছেঁড়া দিনের স্মৃতি।
“আমি কেবলই ভিজি, কেবলই ভিজতে থাকি
একলা দাঁড়িয়ে, ছেঁড়া পথের রেখায়।”
কবি শাহিদা সুলতানা পাঠকের ওপর একটি সার্বজনীন প্রেমসত্তা আরোপ করেছেন। এক জীবনে যত নদী সরোবর আপনি আলিঙ্গন করেছেন প্রেমাতুর স্নেহে, ভুলতে পেরেছেন কি কোনোটি তার?
“ঘরের ভেতরে ঘর, তারও ভেতরে ঘর
তার জানালায় দাঁড়িয়ে বলেছি—
বনের অন্ধকার
আমরা তো তোমার জন্যই
অপেক্ষা করেছি এতকাল।”
কবি কি তাহলে মানুষের আদীম সত্তা মেনে নিয়েছেন? না, মেনে নেননি। প্রেমের একটি মানবিক রূপ তিনি পাঠকের মধ্য থেকে তুলে আনতে চেয়েছেন বরং। প্রশ্ন হচ্ছে— সেটি কি তিনি সার্বজনীন মানেন, নাকি পাঠকের প্রতি একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে। নাহ! কবি কখনো নিজের কথা বলেন না, নিজেকে গোপন করতে চান শিশুর মতো তেলের শিশি ভেঙ্গে পায়ের ছাপটুকু রেখে।
“মাত্র কয়েক মুহূর্তেই
তোমাকে পেরিয়ে এলাম—
ট্রেনের না থামা জংশন পেরোনোর মতন!
অথচ এরই জন্য কত না দীর্ঘ আয়োজন—
কত অসংখ্য বিনিদ্র রাতের প্রস্তুতি।”
কবি শাহিদা সুলতানা তাহলে কি বোহেমিয়ান, নাকি মানুষ মাত্রেই বোহেমিয়ান? হয়ত কোনো বটগাছ জীবনের বাধ্যবাধকতায় মেনে নিয়েছে পুরাতন কোনো ভবনের শ্যাওলা পড়া দেয়ালে তার জীবন। তাই বলে কোনো স্রোতস্বীনী নদী ভালোবেসেছে কোনোদিন ছুঁয়ে গিয়েছে বলে নোঙ্গর করা জাহাজের সবটুকু শরীর?
তোমাকে ভালোবাসিনি কোনোদিন,
বস্তুত কাউকেই বাসিনি কখনো।
গভীর শূন্যতা নিয়ে সমুদ্রের বুক চিরে চিরে
আমার একলা জাহাজ যখন ভেসে যেত
ডলফিনের মতো,
তিমির গান আর
রাতের নক্ষত্রের প্রেম দেখে দেখে
মাস্তুলে ঝুলে থাকা বাতি
নিয়ে যেত এক স্মৃতিময় প্রসন্ন মন্দিরে—”
৫
কিছুতেই কবির ভালোবাসা হয় না, টেকসই হয় না। অথচ কল্পনার জগতে ঘোরতর এক প্রেমের দেবি তিনি। কবিতায়ও যেন তারই প্রতিফলন— তিনি পাঠককে প্রেমের পথ দেখাচ্ছেন, আবার প্রচ্ছন্নভাবে বলে যাচ্ছেন নিজের বঞ্চনার ইতিহাস। যদিও এ হা-হুতাশ সার্বজনীন, সবার। বইটির পাতায় পাতায় কোথাও তার সংসারী হবার আলামত নেই, তবু কোনো এক পাঠকের জীবনের ক্যানভাস তুলে ধরতে বলছেন—
“আমি ঘোর সংসারী
হিসেবের খাতা থেকে প্রতিদিন ফুরোয় সময়,
তাই তাড়াহুড়ো করি—
অত তাড়াহুড়ো হলে ভালোবাসা হয়?”
কবি সঙ্গ চান, আবার দ্রুতই হাঁপিয়ে ওঠেন। ভর করেন সহজাত বৈরাগ্য।
“বরাবরই একলা চেয়ারে বসি—
কফিশপ, সিনেমা, কবিতার আড্ডা—
মুখোমুখি অথবা পাশের চেয়ারে
মহাজাগতিক স্বপ্নেরা বসে থাকে।”
কবি শাহিদা সুলতানার জন্য প্রেমের দেবী আখ্যানটা বাহুল্যতা নয়। বইয়ের পৃষ্ঠা বাড়ছে, বাড়ছে তার বয়স, কিন্তু অগণিত ভক্তকূলের মধ্য থেকে তিনি যেন গ্রহণ করতে পারছেন না কাউকে।
“এক মেঘলা মন্দিরে আমার বসবাস
সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সমতল থেকে
উঠে আসে ভক্তের ভিড়
ধূপের গন্ধে ফুলের পাপড়িতে
ঢেকে যায় আমার পদ্ম আসন।”
কোনটা সত্য তবে? তিনি প্রেমের দেবী, নাকি নিষঙ্গ পথিক এক— পথে পথে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার কাঙ্ক্ষিত দেবতাকে। পাঠককে তিনি বিভ্রান্ত করেছেন। তাই বলে সুচতুর পাঠকের দৃষ্টিতে তার দেবীমূর্তি অধরা থাকেনি।
“দূরের দ্বীপে দাঁড়িয়ে থাকা একলা মানুষ আমি—
আমাকে কেউ খোঁজেনি কোনোদিন,
চলতি পথে কারো সাথে ক্বচিতে দেখা হলেও
ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেনি কেউ কোনোদিন!
মাটিতে পায়ের চিহ্ন দেখে দেখে
বরং আমিই গিয়েছি ছুটে, চিত্রল হরিণের খোঁজে,
যতক্ষণ নামেনি আঁধার।”
কবি শাহিদা সুলতানা পথে পথে খুঁজে ফিরছেন কাকে যেন— হয়ত আধ্যাত্মিক এক প্রেমিকের দেখা পেতে চান তিনি। কিন্তু পিছন থেকে তাকে আঁকড়ে ধরে স্মৃতি। স্বভাবজাত এক দেবীর পরিব্রাজক হবার পথরেখায় সবল স্মৃতি হঠাৎ হঠাৎ এঁকে দিয়ে যায় বিষন্নতার বলিরেখা।
“দূরে সরে যাওয়া নক্ষত্রেরা
কড়া নেড়ে নেড়ে যায়
বহুদিনের বন্ধ দরজায়।
যতবার আলো আসে,
ততবার ফিরে আসে সেই দীর্ঘ ছায়া-
আজকাল তাই নিঃশব্দ সতর্কে
মিশে থাকি ঘন অন্ধকারে,
দেয়ালের বিষন্ন গহ্বরে।”
৬
কবি শাহিদা সুলতানা সুকঠিন একটি বেশ ধরতে চান বটে, কিন্তু তিনি মায়াবী—
যে- কোনো বিদায়ে
আমি মৃত্যুর স্বাদ পাই
ছোট, বড় যে কোনো বিদায়—
স্টপেজে দাঁড়িয়ে, বাসের জানালায়,
ট্রেন স্টেশনে অথবা জাহাজের জেটিতে।”
কবি যেন একটি চক্রাকার কক্ষপথে ঘুরছেন, কিন্তু সীমানা অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেননি কোনো নতুন আলো ঝলমলে শহরে। বাস্তবে না পারলেও কল্পনায় তিনি ফিরে ফিরে এসেছেন পুরনো সেই বিষন্ন শহরে।
“যতটুকু দেবে বলে ভেবেছিল
সেই প্রসন্ন প্রহর,
ততটুকু পেয়ে গেছি।
তাই আজ আবার এসেছি ফিরে
আমার পুরনো বিষন্ন শহরে”
বিশেষ ব্যাঞ্জনায় কবি তার ধ্রুপদী প্রেমের স্মৃতির বোঝা চাপিয়েছেন পাঠকের ওপর। তার এমন কোনো প্রেম ছিলো না কোনোদিন। কবি নিষঙ্গ, পৃথিবীর পথে একাকী পথিক এক। আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়েছেন তিনি প্রতারিত হবার ভয়ে, নাকি দ্বিধাগ্রস্ত কবি চারপাশ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছেন প্রেমপ্রলাপের স্থুল সব প্রতিচ্ছবি, খুঁজে পাননি তার মনের কোণে বাসা বেঁধে স্মৃতি হয়ে থাকা দিগ্বিজয়ী কোনো মানবিক যোদ্ধার ক্লান্ত অবসর, যে তবে তাকে নিয়ে বাঁধতে পারে ঘর। অবশেষে কবি শাহিদা সুলতানা বেছে নিয়েছেন পথ।
“আমি পৃথিবীতে বাঁচি,
পৃথিবী আমার অভ্যাস—
আমার অবসরে আমি
পৃথিবীর আল ধরে হাঁটি,
আলো আর বাতাসে ভর করে
একসাথে পৃথিবীর গান গাই—”
ফেলে আসা কাউকে নয়, দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কবি যেন পাঠককেই বলছেন—
“ভালো থেকো
সারাদিন
ভালোবাসা নিয়ে
ভালোবাসা দিয়ে
পাখির কূজনে
অমৃতের গানে
নীল সরোবরে পদ্মের আসনে
সারাদিন ভালো থেকো।
এই সব নষ্ট সময়
এই সব বেসুরো বসতি
বেহাল নগরী
ছিঁড়ে যাওয়া কক্ষপথ
ধুলো পড়া সুর
কিছুই রেখো না মনে।”
সবই যেন পৃথিবীর তরে। সবশেষে শূন্যতা আসে। জীবনের যা কিছু সঞ্চয় সবই তো রয়ে যায়। কবি শাহিদা সুলতানা সচেতনে সব বিলিয়ে দিতে চান। সবকিছু ছেড়ে নিজে হয়ে উঠতে চান অপরিমেয়।
“যেখানেই থাকি সেখানেই বিলিয়ে আসি সব-
সারারাত জেগে জেগে, কবিতার খাতা,
পাণ্ডুলিপির খসড়া
রোজনামচার মেঘগুলো
টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিয়ে আসি
বন্দরে বন্দরে, অন্ধকারে
অথৈ নদীর জলে, আকাশের নীলে-
ভ্রমণের শেষে এই অবেলায় এসে
তাই মলিন সঞ্চয়ে কিছু নেই
না স্মৃতি! না স্বপ্ন!”
৭
কবি শাহিদা সুলতানা সব ছেড়ে সব ফেলে একবার চলে যেতে চান তো, আবার উঁকি দিতে ফিরে আসেন স্মৃতির জানালায়। বইয়ের পাতা যাই বলুক স্মৃতি কাতরতা তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। তিনি সত্যিই এক কাব্যিক পরিব্রাজক এখন, যার সাক্ষাৎ পেয়েছেন আরেক কবি পাঠক।
“আমি আর বেদনা নেব না কোনো
সাদা দুধের দিঘিতে নীল রং
ঢেলে দিয়ে কুড়াবো না তোমাদের
বিমর্ষ অভিশাপ।”
পরতে পরতে বিদায়, বিদায়ের সুর। শাহিদা সুলতানার এ কাব্যগ্রন্থটি পড়লে মনে হবে— জীবনভর আমরা ফেলে আসি— স্মৃতিতে জমা পড়ে, মায়া হয়ে রয় অজস্র আক্ষেপ। একটা অধরা ‘তুমি’ যেন সবারই থাকে। কবিও বারে বারে ফিরতে চেয়েছেন সেই ‘তুমি’র কাছে, কিন্তু পারেননি।
“কেবল তোমার কাছে এলেই
আমি ভিখারি হয়ে যাই
নিজের অজান্তেই রূপার রেকাবী
খুলে তুলে আনি শীর্ণ ভিক্ষাপাত্র
আতরদানীর তরল ফেলে দিয়ে
বাড়িয়ে দিই শূন্য বোতল
অসীম তৃষ্ণায়।”
ভালোবাসার দেবী ভালোবাসা নিতে পারেননি। মানুষকে তিনি দেখেছেন বাস্তবতার নিরিখে, কবি হলেও এখানেই তার কবিসত্তা ধাক্কা খেয়েছে সচেতনতার লাল পতাকায়।
“আমাকে বেসেছে ভালো
শুধু রাতের আকাশ,
ভোরের দোয়েল পাখি
কাদামাখা মাঠ, ভাটফুলে বসা ভোর,
তোমরা বাসোনি কোনোদিন!”
মাঝে মাঝে মনে হয় কবি যেন বিষন্নতার বাতাবরণে মোড়ানো কোনো কারুকার্যখচিত মন্দিরে প্রস্তরখচিত এক দেবীমূর্তি। এখানে যত কথা সব পূজারীর মন্ত্রপাঠের মতো। ভক্তকূলের আকুতির ভাষা দেবীর নিজেরই বাতলে দেওয়া। একথা তাই কবির নয়, হতে পারে আমারই মতো কোনো পাঠকের।
“নেমে এসো,
বহুতল ভবনের বারোয়ারি জীবনের
নকল নকশা ফেলে—
আলোহীন, স্বপ্নহীন ফ্লাটের দরজা গলে
সরু বারান্দা পেরিয়ে, লিফটের তলা গুণে গুণে,
কফিশপের পোশাকি কফির সুগন্ধ ছেড়ে
পাড় বাধা লেকের কৃত্রিমতা ঝেড়ে
চলে এসো এইখানে—
আকাশের সাদা মেঘ সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
পাইনের বন ঘুরে, সোনালু ফুলের দিনে
নীল সরোবর ঘেঁষা গেরুয়া মাটির পথ ধরে
ডাহুক ডাকার ক্ষণে, একদিন নিয়ে যাবো
সেই গভীর নীল পদ্মের দেশে।”
বইটি পর্যালোচনা করেছেন দিব্যেন্দু দ্বীপ।