মাওয়া ঘাট একটা অদ্ভূত জায়গা, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন যাওয়া-আসা করছে এখান দিয়ে, কিন্তু রেস্টুরেন্টগুলো ফাঁকা। খুব বেশি মানুষ খায় না এখানে, এত দাম দিয়ে খাবেই বা কেন? তাছাড়া বাঙ্গালী পথে দাঁড়ায় না, শুধু গন্তব্য খোঁজে, পথই যে মানুষের সর্বপ্রধান গন্তব্য আমরা এটি বুঝতে পারলাম না কোনোদিন। আমি এই শেষ বয়সে এসে একটু উপলব্ধি করতে শুরু করেছি।
রেস্টুরেন্ট মালিকদের ক্রেতার সংখ্যা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। জায়গার কোনো ভাড়া আছে বলে মনে হয় না, তাছাড়া বেশি ক্রেতা ডিল করে কম লাভ করার চেয়ে কম ক্রেতা ডিল করে বেশি লাভ করাই তো মালিকের জন্য ভালো। এত লোকের মধ্যে কিছু না কিছু লোক বেশি দাম দিয়ে খাবেই।
রেস্টুরেন্টগুলো এখানে প্রায় একই মানের, উপরে টিনের ছাউনি দিয়ে বাঁশের অস্থায়ী ঘর তোলা হয়েছে। মজা হচ্ছে, সামনেই ওরা ইলিশ ভেজে দেয়, এটা এখানকার বিশেষ আকর্ষণ।
মাঝারি সাইজের এক জোড়া ইলিশের ডিম ভাজার অর্ডার দিয়ে একটু কোণায় সরে বসলাম। ইলিশ মাছের ডিম, শুকনো মরিচ ভাজা, এক প্লেট ভাত, এমন বুভুক্ষুর মতো খেলাম! কে বলবে যে আমি কয়েক শো কোটি টাকার মালিক!
পরিব্রাজক হয়ে বেরিয়েছি, কিছুই ভাবতে চাই না— বাড়ি-ঘর, পরিবার, ব্যবসা, সবকিছু ভুলে থাকতে চাই। নতুন একটি মোবাইল নম্বর কিনে নিয়েছি। খুব দায় না ঠেকলে কাউকে ফোন করব না। সময়টুকু নিজের, একান্তই নিজের। এখন শুধু মনে হয়, টাকার মালিক নয়— সময়ের মালিকই আসল মালিক। আমি তো এর আগে কোনোদিন সময়ের মালিক হতে পারিনি। এ এক নতুন জীবন!
খাওয়া শেষ করে পদ্মার পাড় ঘেষে হাঁটতে থাকলাম, অসাধারণ দৃশ্য— কত কী যে ধারণ করে আছে প্রমত্ত পদ্মা! সকলে আপন বেগে আপন কাজে ধাবমান। কত লোক এ জায়গা দিয়ে গিয়েছে কতবার, কয়জন একটু আশেপাশে তাকিয়েছে? কী অদ্ভূত আমাদের জীবন, শুধু ছুটছি তো ছুটছি, তাকাচ্ছি না কোনোদিকে, অথচ জীবন তো শুধু লম্বা এক পথ, পাড়ি দেওয়া শেষ তো জীবন শেষ, জীবন শেষ তো পথ শেষ।
“পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি
সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি।”
সলিল চৌধুরীর লেখা গানের এ লাইনটি যেন আমার এখন বিশেষ পাথেয় হয়ে উঠেছে। ‘সোজা পথের ধাঁধা’ আমার চেয়ে ভালো আর কে চেনে?
অর্থ-বিত্ত হওয়ার পর থেকে জীবন নিয়ে ভাবার এতটুকু ফুসরত পাইনি কোনোদিন, অথচ গত দেড়দিনে জীবন পথের অনেকটাই আমি দেখতে পাচ্ছি।
ভ্রমণে একাকীত্ব অসাধারণ— কোনো তাগাদা নেই কারো কাছ থেকে, চারপাশের সবটুকু আপন চোখে দেখা যায়। অনেকের মাঝে থেকে যখন আমরা কিছু দেখি তখন সম্ভবত দেখাটা নিজের হয় না পুরোপুরি।
বেশ কতক্ষণ কাটালাম এখানে— ভাবছি ওপার যাব কিনা, ভাবতে ভাবতেই একটা ছোট্ট ট্রলারে উঠে বসলাম। ট্রলারটি আঘাটায় বাঁধা রয়েছে। ওরা ভাবল আমি ভ্রমে আছি— বুঝিয়ে বলল, ঘাট থেকে কীভাবে কীসে ওপার যাওয়া যায়। আমি ওদের সাথে চুক্তি করে ট্রলারেই ওপার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এক হাজার টাকা খরচ করা আমার জন্য কিছু না, তাই বলে এভাবে বেহিসেবে খরচ করিনি কোনোদিন— আজ মনে হল, আমার জন্য যেটি বেহিসেব কারো জন্য সেটি দুর্দান্ত একটা হিসেব। এই নৌকার মাঝি তো ভাবে নাই, এভাবে তার এক হাজার টাকা উপার্জন হবে! মাত্র এই একহাজার টাকা হয়ত ওর বাড়িতে বিশেষ আনন্দের উপলক্ষ্য এনে দেবে আজ।
পদ্মা বেশ শান্ত আজকে, পটপট করে ধীরে ধীরে ট্রলার এগোচ্ছে। হঠাৎ আমার কী যেনো হল! মন্দিরের সেই গুরুদেবের কথা মনে পড়ল, আচ্ছা আমার ছোট স্ত্রী আসলে কী তাই! তবে সত্য হলো সে স্ত্রী নয়, সবাইকে ‘স্ত্রী’ বলতে হয়। আবার ভাবি— স্ত্রী-ই বা কী আর না স্ত্রী-ই বা কী, প্রেমটাই আসল! প্রেমিক হতে কি পেরেছি কোনোদিন?
কোনো নিয়মেই আমরা বিয়ে করিনি, ওর দিক থেকেও কোনো তাগাদা নেই। যেহেতু আমি বিবাহিত, তাই এ নিয়ে মানুষের মাথা ব্যথাও নেই, তাছাড়া মানুষ আমার কাছে আসে টাকার জন্য, এসব জানতে আসে না। যারা টাকা না পেয়ে খেপে যায় তারা বড়জোর “শালার দুই বউ” বলে দুই লাফ মেরে চলে যায়। টাকাওয়ালা মানুষের সাথে এদেশে সহজে লাগতে আসে না কেউ।
হঠাৎ মাথায় চক্কর দিচ্ছে— পুরুষ এমনই হয় বোধহয়, মুক্তি মেলে না তার সহজে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সত্যতা উপলব্ধি করছিলাম, হঠাৎ করে যৌন ঈর্ষা সব গোলমাল করে দিচ্ছে।
একটা দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। সাত আট বছরের একটা শিশু এই বিশাল পদ্মায় ডিঙ্গি নৌকা বাইছে! মানুষের কী অসাধারণ ক্ষমতা খাপ খাওয়ানোর! কে ধনী আসলে, ঐ শিশুটি না আমি?
এই মুহূর্তে আমি যতটা না উপভোগ করছি প্রকৃতি এবং বাইরের এই প্রাণ চাঞ্চল্য, তার চেয়ে অনেক বেশি পাচ্ছি মুক্তির স্বাদ। বুঝেছি— বাঁধতে গেলে শুধু নিজেই বাঁধা পড়তে হয়। ছেড়ে দেওয়া ভালো, তাতে মুক্তি মেলে আপনারই।
অর্থ-বিত্ত, ধন-সম্পত্তি, স্ত্রী, পুত্র, পরিবার —সবই ছাড়তে হবে মন থেকে, তবেই শুধু মুক্তি মিলবে। এ যাবতে বুঝেছি— পুরুষ যদি অহংকার, আর স্বত্ত্ব ছাড়তে পারে তবেই শুধু মুক্তি। সকল মানুষের জন্যই এ বোধহয় চীর সত্য।
ট্রলার ঘাটে ভিড়েছে, ঠিক ঘাটে নয়, একটু দূরে নিজস্ব জায়গা করে ট্রলারটা কাওড়াকান্দি ঘাটে ভিড়েছে। আমার তো কোনো গন্তব্য নেই, তাই তাড়াহুড়াও নেই। ধীর পায়ে পাড়ে উঠে একটা ইটের উপর বসলাম। কিছু দূরেই অসংখ্য মানুষ, অথচ এই জায়গাটা ভীষণ একাকী! ঠিক যেন মানুষের মতো, সবার মাঝে আমরা একা থাকি সবসময়। হাহাকার পিছু ছাড়ে না মানুষের, কোনো মানুষের না।
চলবে।