বক্সা জাতীয় উদ্যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত একটি জাতীয় উদ্যান। এটি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিকে বক্সা পাহাড় এলাকায় অবস্থিত। জাতীয় উদ্যানের আয়তন প্রায় ৭৬০ বর্গ কিলোমিটার। জাতীয় উদ্যানের মধ্যে একটি বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্র বা টাইগার রিজার্ভ রয়েছে। এই জাতীয় উদ্যানে একসময় বাঘ, সিভেট ও রেড জাঙ্গল ফাউল দেখা যেত।
বক্সা জাতীয় উদ্যান পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলায় অবস্থিত। এর উত্তর সীমাটি হল ভারত-ভুটান আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও সিঞ্চুলা পর্বতমালা। তার ওপারে রয়েছে ভুটানের ফিপসু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। পূর্ব সীমায় আছে পশ্চিমবঙ্গ-আসাম রাজ্যসীমা। তার ওপারে আছে আসামের মানস জাতীয় উদ্যান। দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৩১ নং জাতীয় সড়ক। দক্ষিণ-পশ্চিমের চিলাপাতা বনাঞ্চলটি বক্সা ও জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের মধ্যে একটি এলিফ্যান্ট করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই জাতীয় উদ্যানের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫২-১৭৫৫ মিটার পর্যন্ত। অরণ্যের মধ্য দিয়ে পানা, ডিমা, রায়ডাক, বালা, গাবুর বাসরা, সঙ্কোষ নদী প্রবাহিত। বক্সা জাতীয় উদ্যান ঘুরে এসে লিখেছেন ট্রাভেলার নারায়ণ মিত্র।
পর্ব-১
গত ৫ মার্চ (২০২২) আমরা ২২ জনের দল তিস্তা তোর্ষা এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে ৬ তারিখ আলিপুরদুয়ার হয়ে গাড়িতে রাজাভাতখাওয়া হয়ে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের উত্তর পশ্চিম সিমান্তে রায়মাটাং পৌছাই। সেখান এক রাত্রি থেকে পরের দিন আবার গাড়িতে পাঁচ কিমি দূরে পোখরি গ্রামে পৌঁছে হাঁটা পথে প্রায় ৬ কি.মি. দূরে আদমা গ্রামে পৌছাই। রাস্তা খুব সহজ না হলেও খুব যে কঠিন ছিল তা নয়। প্রথমেই আধা কি.মি. যাওয়ার পর একটা ১০০ মিটার মতো দারুণ উৎরাই পথ পেরিয়ে কখনো সমতল আবার কখনো চড়াই রাস্তা পেরিয়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের এক ছড়ানো ছিটানো সুন্দর ডুকপা আদিবাসী গ্রামে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে সঙ্গে করে আনা ডিম কষা আর পরোটা সহযোগে দুপুরের আহার সমাপ্ত করে আবার দুই ঘন্টা হেঁটে পোখরি। সেখান থেকে আবার গাড়ি করে সন্ধের মধ্যে রায়মাটাং লালিগুরাস হোমস্টেতে।
পর্ব-২
আজ ৮/৩/২২ আমারা গাড়িতে চলেছি কালচিনি, রাজাভাতখাওয়া হোয়ে সান্তালা বা সান্তারা বাড়ি। পথমধ্যে দু’জায়গায় রেল লাইনের লেভেল ক্রসিং পার হয়ে রাজাভাতখাওয়া তে ক্ষণিকের বিরতি। এখান থেকে বক্সা বনাঞ্চলে ঢোকার জন্য অনুমতি নিতে হয় বন বিভাগের কাছে। জনপ্রতি ১২০ টাকা এবং গাড়িপ্রতি ৫০০ টাকা, যদিও চলার রাস্তা দেখভাল করে পিডবলিউডি। এটা বন বিভাগের খানিকটা গা জোয়ারি মনে হয়। যদি ফরেস্ট রোড দিয়ে গাড়ি যায় তাহলে ব্যাপারটা ঠিক আছে। ভ্রমণ রসিকদের অসহাতার সুযোগের সদব্যবহার। তাও আবার অনুমতি দুই দিনের জন্য। তার বেশি হলেই আরো একই পরিমাণ টাকা দিতে হবে। রাজাভাতখাওয়া থেকে ১৪ কি.মি. গেলে রায়মাটাং থেকে ৪৩ কি.মি. দূরে সান্তালাবাড়ি। এক সময় প্রচুর ভুটানের কমলা এখান থেকে ব্যাবসায়িরা ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থানে পৌছে দিতো তাই নাম হয়েছে সান্তালা বাড়ি বা সান্তারা বাড়ি। জয়ন্তী অব্দি রেগুলার বাস চললেও সান্তারাবাড়ি অব্দি কোনো বাস চলে না। এ কারণেই অটো ওয়ালাদের পোয়া বারো। মঙ্গল বারে হাট বসে, সেই দিন একটা বাস আসে। আজ মঙ্গলবার তাই পাহাড়ী গ্রাম্য হাট দেখার সৌভাগ্য হলো। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও জায়গাটা ছিলো বন বিভাগের বিট অফিস আর পিডব্লিউডি’র বাংলো, আর একটা দুইটা চায়ের দোকান সহ ছিমছাম এক জায়গা। আজ সেটা একটা মিনি শহর বলা যায়। প্রচুর গাড়ি আর মোমোর দোকানের ছড়াছড়ি। আগে ব্রিটিশদের তৈরি ৬ ফুটের সুন্দর ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে ৪ কি.মি. দূরে বক্সা দুয়ার, এখন আধুনিকতার জন্য দুয়ারে বক্সা। স্বাধিনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বা পাস দিয়ে একটা গাড়ির রাস্তা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো তা আজ ঝা চকচকে কংক্রিটের রাস্তা। প্রকৃতিপ্রেমিদের প্রচুর আন্দোলন সত্ত্বেও থামানো যায়নি রাস্তা তৈরির কাজ। এখানেও আবার গাড়িওয়ালেদের দাদাগিরি। স্থানীয় মারুতি ভ্যান মাত্র আড়াই কি.মি. পথ পার হবার জন্য ২৫০ টাকা নেয়। নিচের গাড়ি যেতে দেবে না। যদিও গাইডের কোনো জরুরি দরকার নাই, তবুও ঘণ্টা প্রতি ১৫০ টাকার বিনিময়ে গাইড নিতে হবে। আমাদের ২২ জনের দলের আয়োজক স্থানীয় বলে গাইডের থেকে মুক্তি, কিন্তু আলাদা গাড়ি নিতেই হয়েছে। মাত্র আড়াই কি.মি. পরেই জিরো পয়েন্ট। এখান থেকেই হাঁটা পথ। মাত্র ৯০০ মিটার দুরেই বক্সা সদর বাজার, আরো আধা কি.মি. দূরেই ঐতিহাসিক বক্সা দুর্গ। এখান থেকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌছানো যায় চুনাভাটি বা চুনাপাথরের জায়গা। এটাও একটি সুন্দর গ্রাম, আছে টিবিটিয়ান গুম্ফা। জঙ্গলের সুড়ি পথে লাগে সোয়া ঘণ্টা আর রাস্তা দিয়ে গেলে লাগে প্রায় পোনে দুই ঘণ্টা। আমরা বেশ কয়েকজন অবশ্য জঙ্গলের পথে চুনাভাটি ঘুরে এসেছি।
পর্ব-৩
বক্সাতে সদর বাজার ছাড়া তেমন কোনো গ্রাম নাই। কিন্তু চারপাশে প্রায় ৬৩ টা গ্রাম আছে। আসলে সদর বাজার ব্রিটিশ ভারতের বক্সার মূল ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র। জায়গাটা কেন্দ্রীভাবে অবস্থান করছে। বক্সার আসল নাম বক্সা দুয়ার। অর্থাৎ দরজা। ডুয়ার্স কথাটাও এসেছে তার থেকে। ভারত ভুটানের মধ্যে যতগুলি দরজা আছে তার মধ্যে অন্যতম। আমরা আছি আমার অনেক পূরনো এক দাদা বন্ধু হরিশংকর থাপা (বর্তমানে তিনি ইহজগতে নাই) দাদার তৈরি রোভারস্ ইন হোম স্টেতে। আমাদের পাগলদের জন্যই তিনি একটা থাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন একদম বিনা পয়সায়। হরি শংকর দার ছেলে ইন্দ্রজিৎ থাপা এখন এটাকে আরো একটু বড়ো আকারে প্রায় ৩০/৩৫ জনের থাকার ব্যবস্থা করেছে। খুবই অল্প খরচে এখানে থাকা খাওয়া দুই-ই যায়। সঙ্গে ইন্দ্রের হাসিমুখের আতিথেয়তা ও তার বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্রের সাথে গানবাজনা সহ ক্যাম্প ফায়ার এক উপরি পাওনা। একদম বিলকুল ফ্রি।
বিভিন্নরকম জীবজন্তু, ফুল, পাখি সহ গভীর এক অরণ্য। কুচবিহার রাজার অন্তর্ভুক্ত হলেও মোটামুটিভাবে ভূটান এটা দখলে রেখেছিল। গভীর অরণ্যের ও রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতার জন্য এই জায়গাটা সেভাবে দেখভাল করতে পারতো না কুচবিহারের মহারাজা। অন্যদিকে সিঞ্চুলা গিরিপথ অতিক্রম করে সহজেই চলে আসতো ভূটানের বাসিন্দারা। এখানে মূলত ডরুকপা সম্প্রদায়ের আধিপত্য ছিল। তাছাড়াও তিব্বত ভারত রেশম বাণিজ্য ভূটানের মধ্যে দিয়ে এই পথেই হতো। ভূটানের রাজা বক্সাতে বাঁশের তৈরি প্রথম সেনা ছাউনি তৈরি করে, যাতে বহিঃশত্রু সেটা দখল না করতে পারে। এই সেনা ছাউনির অবস্থান এমন একটা জায়গায় যেখানে যাবার জন্য একটাই মাত্র পথ আর চারিদিকে ২০০ ফিটের গভীর গিরিখাত। এই দূর্গের কোনো প্রাচীর নাই। ১৭৭০-৭২ সালে প্রথম ব্রিটিশ ভারত ও ভূটানের মধ্যে যুদ্ধ হয় মূলত ভূটান সৈন্যদের ঐ অঞ্চল থেকে তাড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে। এবং পরে ভূটানের সাথে ব্রিটিশ ভারতের একটা শান্তি চুক্তি হয়, যেখানে বলা হয় ব্রিটিশ কখনো ভূটানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। ব্রিটিশ ভারত মানেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুনরায় এই পথে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে। তৈরি হয় বক্সা পোস্ট অফিস, ট্যাক্স কালেকশন সেন্টার। হয়ে ওঠে বক্সা সদর। এখানে একজন এসডিও পোস্টিং ছিলেন। ট্যাক্স কালেকশন সেন্টারের নাম লালকুঠি। যার ভাঙ্গা দেয়াল এখনো দেখা যায়। গড়ে ওঠে সরকারি কর্মচারিদের আবাসস্থল। পূরনো বাঁশের দূর্গ বদলে তৈরি হয় পাথর দিয়ে তৈরি দূর্গ। ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের অধীনে থাকলেও পাকাপাকিভাবে ১৮৮৭ সালে কুচবিহারের মহারাজা এটাকে ব্রিটিশ ভারতকে হস্তান্তর করে। ১৯৫৯ সালে চিনের তিব্বত দখলের সময় প্রচুর তিব্বতি রিফিউজি ভূটান হয়ে এই অঞ্চলে চলে আসে। তাই এখানকার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই বৌদ্ধদের মোনাস্ট্রি ও চোর্তেন দেখা যায়। ইতোমধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদারের ফলে এই দূর্গকে রূপান্তরিত করা হয় ফ্রিডম ফাইটার ডিটেনশন ক্যাম্পে। তৈরি হয় সান্তারা বাড়ি থেকে ছ ফুটের এক গভীর অরণ্যবেস্টিত পায়ে ও ঘোড়া চলার এক রাস্তা। নতুন কংক্রিটের রাস্তার জন্য সে রাস্তা আজ পরিত্যক্ত এবং চলার অনুপযুক্ত। আমি অনেকবার সেই রাস্তা দিয়ে বক্সা পৌঁচেছি। আন্দামানের সেলুলার জেলের পরেই বক্সা জেলের অবস্থান। এই বক্সা দূর্গকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য প্রচুর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছেন আলিপুরদুয়ারবাসী, প্রকৃতিপ্রেমি, সাহিত্যিক ও বক্সা অঞ্চলের মানুষজন। এর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্বাস, সুব্রত গাঙ্গুলি, হরিশংকর থাপা, মাঠে ডরুকপা প্রমূখ। সুব্রত গাঙ্গুলি বাদে সবাই আজ আর আমাদের মধ্যে নাই। সে সময় সরকারি উদাসিনতার জন্য কিছুই হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে তৎকালীন ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডন শ্রী প্রনবেশ সান্ন্যালের প্রচেষ্টায় কিছুটা কাজ হয়েছিলো। প্রসঙ্গত প্রনবেশদার মামাও এই জেলে বন্দি ছিলেন। তৈরি হয়েছিলো ১২ ফিটের চওড়া রাস্তা, যেটা আজ কনক্রিটে মোড়ানো। তৈরি হয়েছিলো স্মৃতিস্তম্ভ যা আজও বিদ্যমান। দুয়ারে বক্সা হবার জন্য প্রচুর পর্যটক এখন বক্সা ফোর্ট দেখতে যায়। নতুন করে আধুনিকতায় সাজানো হচ্ছে বক্সা দূর্গ। যা হয়তো বর্তমান সুখের পর্যটকদের খুসি করবে, কিন্তু বক্সার ইতিহাস-ঐতিহ্য কি বজায় থাকবে? আমার খুব খারাপ লাগে সেই সব পূরনো মানুষদের একান্ত ইচ্ছা ও পরিশ্রমের বিনিময়ে তৈরি হয়েছিলো বক্সা মিউজিয়াম, সেটা আজ অবহেলিত। যেটা দেখলে বক্সার ইতিহাস অনেকটাই জানা যায়। নাই কোনো প্রচার, নাই কোনো রক্ষণাবেক্ষণ। এমনকি স্থানীয় গাইডরাও জানে না। মিথ্যা কথা দিয়ে সাজানো বুলি দিয়ে পর্যটকদের আকর্ষিত করে। ইউটিউব তো আছেই, গাইডরাও বলে থাকেন এখানে নাকি নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসকে আটকে রাখা হয়েছিলো। ডাঁহা মিথ্যা কথা। বক্সাতে আছে বন বিভাগের গভীর অরণ্যবেস্টিত একটা বাংলো। অধমের বেশ কয়েকবার থাকার সৌভাগ্য হয়েছে সেখানে। আজ থেকে বছর কুড়ি আগেও এখানে শিশুদের নিয়ে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প হতো। সুখের পর্যটকদের দৌরাত্মে সেসব আজ গল্পকথা। এছাড়াও আরো অনেক অনেক কথা আছে, যেটা আমার অজানা।
পর্ব-৪
আগের পর্বে বলেছিলাম বক্সা দুয়ার সম্বন্ধে। এবার বলবো. শুধু বক্সাকে কেন্দ্র করে কোথায় কোথায় ট্রেক করা যায়। প্রথমেই বলি, বক্সা ফোর্ট থেকে উত্তরমুখি পাথরের রাস্তার বা-দিকে বক্সা প্রাথমিক স্বাস্থ কেন্দ্র, ডানদিকে বক্সা পোস্ট অফিস, আর সামান্য উপরে ডানদিকের সরু পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে একটা ছোট্ট শুকনো নালার উপর সাঁকো অতিক্রম করেই ডান দিকে বন বিভাগের ডর্মিটরি— নাম আরন্যক। অবশ্য আসল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলোটা আরও একটু উপরে ছিলো। সেটার অস্তিত্ব বোধহয় আর নেই। ডরমিটরির নিচেই আছে বক্সা মিউজিয়াম। পোস্ট অফিস এর প্রায় লাগোয়া শুল্ক আদায় কেন্দ্র লালকুঠির ভগ্নাংশ, পাথরের রাস্তা ধরে আর একটু এগিয়ে গেলেই বক্সা প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়াও আছে নেপালি জুনিয়র হাই স্কুল। আরও এক কি.মি. গেলেই প্রথম যে গ্রামটা পড়বে সেটার নাম লাল বাংলা। লাল ফৌজদের ও সরকারি বাসস্থানের জন্যই নাম লাল বাংলা। লাল বাংলা থেকে রাস্তা দু’ভাগ হয়েছে। বা দিকের রাস্তা চলে গিয়েছে চুনা পাথরের জায়গা চুনাভাটি গ্রাম। এই চুনাভাটি থেকে জঙ্গলের রাস্তায় আদমা পোখরি হয়ে সমতলে রায়মাটাং নদীর ধারে রায়মাটাং বস্তি। সেখানে বেশ কিছু হোম-স্টে ও বন বিভাগের বাংলো আছে। লাল বাংলা থেকে ডান দিকের রাস্তা এঁকেবেঁকে আরো সাতশো আটশো ফিট উপরে ও বক্সা থেকে দুই কি.মি. দূরে বেশ সাজানো গোছানো গ্রাম তাঁসি গাও। এখানে বেশিরভাগ লোকজনের উপাধি তাঁসি। এখান থেকে আরো দুই কি.মি. উপরেই রোভারস্ ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে বক্সা ফোর্ট চত্ত্বর খুব সুন্দর দেখায়। ফোর্ট সংলগ্ন বক্সা ফোর্টের বন্দিদের খেলার ফুটবল মাঠটাও খুব সুন্দর দেখায়। পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পূরনো প্রকৃতি ও পাহাড়প্রেমি সংগঠন ‘রোভারস্ অ্যান্ড মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব’— ছোট করে আর.এম.সি অনুকরণে নাম রোভারস্ ভিউ পয়েন্ট। রোভারস্ পয়েন্টের পাশের পাহাড়ের মাথায় ছিল বক্সা ফোর্ট ওয়াচ টাওয়ার। আবার আরো প্রায় পাঁচ কি.মি. চড়াইয়ের রাস্তা পেরিয়ে সিঞ্চুলা গিরিরত্ন অতিক্রম করে পৌঁছে যাওয়া যায় ভুটানের রুপাং ভ্যালি। এটা অনেক পূরনো ভুটানের মধ্যে দিয়ে ভারত তিব্বত রেশম বাণিজ্য পথ। অনেক চারণিক এই পথে রুপাং ভ্যালি দেখে আবার বক্সা ফিরে আসেন। শুনেছি আজকাল তাঁসিগাওতেও হোম-স্টে হয়েছে। আবার তাঁসিগাও থেকে ওসলাম গ্রাম হয়ে কমলা বাগানের মধ্যে দিয়ে কাতলুং ও সাঁচিপু নদীর সংযোগস্থল হয়ে জয়ন্তী নদীর ধার ধরে নদী এপার ওপার করতে করতে মহাকাল গুহার পদদেশ দিয়ে ছোট মহাকাল হয়ে জয়ন্তী আসা যায়। একসময় এটা একটা মনোমুগ্ধকর ট্রেক রুট ছিল। ১৯৯৩ অথবা ১৯৯৪ সালের ভয়ঙ্কর বন্যার ফলে এই রাস্তার অস্তিত্ব নাই বললেই চলে। আমি ২০০০ সালে সস্ত্রীক এই রাস্তায় প্রায় নাকানিচুবানি খেয়ে অর্ধ মৃত অবস্থায় জয়ন্তি পৌছেছিলাম প্রায় ১৩ ঘন্টা হাঁটার পর। সেটা আর এক কাহিনি। আবার বক্সা ফোর্ট থেকে আড়াই কি.মি. দূরেই লেপচাখাঁ হয়ে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে পোখরি হয়ে বনবিভাগের ১২ ফিটের রাস্তা হয়ে জয়ন্তি আসা যায়। ব্যাঘ্রবিহীন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ধাক্কায় সেটাও বন্ধ। আরো একটা রাস্তা ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একদম নেমে আসা যেত জয়ন্তী নদীর ধারে হাওদা নামক স্থানে। সেখান থেকে নদীর ডান পারের রাস্তা দিয়ে জয়ন্তী। বন্যার জন্য সেটার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। লেপচাখাঁ থেকে সরাসরি আধা ঘন্টা নেমে কাতলুং-এর ধার ধরেও জয়ন্তী আসা যায়। এটাই এখন প্রচলিত রাস্তা। সেটার কথা পরে আসছি।
আজকে ৯ মার্চ (২০২২) আমাদের গন্তব্য লেপচাখাঁ। সদরবাজার থেকে মিনিট ১৫ চলার পর সামান্য উপরে বক্সা ফোর্ট। এখানে চা, ম্যাগি, মোমো ইত্যাদির বেশ কিছু দোকান আছে। সুখি পর্যটকদের জন্য বিক্রি বাট্টা মন্দ হয় না। তবে করোনার করুণায় ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠেছিল। এখন আবার জমে উঠেছে। এখান থেকেই খেলার মাঠের পাশ দিয়ে প্রায় ৮ ফিটের হাঁটা রাস্তায় আড়াই কি.মি. দূরেই লেপচাখাঁ। আবার লালবাংলা গ্রামের শুরুতেই ডান দিকে একটা সরু গলিপথ দিয়েই একটা ছোট্ট শুকনো নালা অতিক্রম করে ঘন জঙ্গলের শুড়িপথ ধরে ঠিক লেপচাখাঁ থেকে ছয়শো সাতশো মিটার আগে মূল রাস্তায় পড়া যায়। একটু বেশি সময় লাগলেও রাস্তাটা এক কথায় অসাধারণ। আমি আগে কখনো এই রাস্তায় যাইনি। তাই এবার দলের কয়েকজনকে নিয়ে খানিকটা এক্সপ্লোরেশনের উদ্দেশ্যে এই রাস্তায় লেপচাখাঁ পৌছেছি। ইচ্ছা ছিল যারা যারা আবার বক্সা, সদর বাজার, সান্তরা বাড়ি যাবে তাদের নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে যাব। কিন্তু সেটা আর হয়নি। কারণ, আমি আমার দলের কাউকে কাউকে কিছুতেই আমার পিছনে হাঁটাতে পারিনি। তারা কোনো না কোনোভাবেই আগে পৌঁছাতে চায়, যদিও কোনো প্রাইজ ছিলো না। যাকগে সে কথা। সকাল সাড়ে নটার মধ্যে সদর বাজার থেকে রওনা হয়ে একদম গদাই লস্করি চালে কম বেশি সবাই পৌঁছে গেলাম দেড় ঘণ্টার মধ্যেই বক্সা পাহাড়ের মাথায় বিশাল সমতল যায়গা লেপচাখাঁ গ্রামে। এখানে আছে এক সুন্দর মোনাস্ট্রি, মাঠের উপর বেশ কিছু চা জলখাবারের দোকান ও বেশ কয়েকটা হোম-স্টে। আমরা ছিলাম দিদির হোম-স্টেতে, একদম মাঠের শেষ প্রান্তে সেখান থেকে নিচে জয়ন্তী গ্রাম দেখা যায়। তাছাড়া জয়ন্তী নদী, ডিমা, বালা, কালজানি নদীর দৃশ্য এককথায় অনবদ্য। অপূর্ব এক ভিউ পয়েন্ট। দিদির হোম-স্টেতে অ্যাডজাস্ট করে থাকতে পারলে অনায়াসেই পঁচিশ ছাব্বিশ জন থাকা যায়। দিদি পেট ভর্তি খাবার দিলেও রান্নায় অত পটু না। ভালো নাই হতে পারে, তবে কিছুতেই খারাপ বলা যাবে না। এখানকার সন্ধেটা অসাধারণ। সূর্যাস্ত এক আলাদা অনুভূতি এনে দেয়। লেপচাখাঁর ডানদিকের পাহাড়ের মাথায় ছিলো বক্সা ফোর্টের দ্বিতীয় ওয়াচ টাওয়ার। আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম যারা শারীরিকভাবে ফিট ও ইচ্ছা প্রকাশ করবে তারা কাতলুং নদীর বালি পাথরের বিছানো রাস্তা হয়ে বড় মহাকালের পাদদেশ হয়ে ছোট মহাকাল পৌছাবে, আর বাকিরা বক্সা, সদরবাজার, জিরো পয়েন্ট অব্দি ট্রেক করে গাড়িতে বা আবার গাড়ির রাস্তা দিয়ে উৎরাইয়ের পথে সান্তরা বাড়ি থেকে গাড়িতে জয়ন্তি হয়ে ছোট মহাকালে একত্রিত হয়ে দুপুরের আহারের পর আবার জয়ন্তী হয়ে রাজাভাতখাওয়াতে চলে আসব।
প্ল্যান অনুযায়ী সবই ঠিকঠাক চলছিল। ঠিক হোলো গাইড নিয়ে দশ জনের দল সকালের প্যাক ব্রেকফাস্ট নিয়ে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়বে, আর বাকিরা সকাল সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্ট করে নয়টার মধ্যে সান্তারা বাড়ির দিকে রওনা হবে। আমাদের দলে দুই একজনকে বাদ দিলে প্রায় সবাই ট্রেক করে বড় মহাকাল হয়ে ছোট মহাকাল পৌঁছাতে পারত, কিন্তু দলের সকলের স্বার্থে এবং সুস্থভাবে পৌছানোর জন্য এই ভাগটা করতে হয়েছিল। আমি যেহেতু মহাকাল হয়ে জয়ন্তি ট্রেকটা বন্যার পর করেছিলাম তাই জানতাম এই হাঁটাটা মোটেই আনন্দদায়ক হবে না। আর একবার যদি একেবারে প্রোগ্রামের শেষ লগ্নে হাঁটাটা বেদনাদায়ক হয়, তাহলে গোটা ব্যাপারটা কেঁচেগন্ডুস হয়ে যাবে। তাই কারো কারোর প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও কাতলুং মহাকাল ট্রেক করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছি। তাছাড়াও ইন্দ্রর কাছে বাইশ জনের অনেক লেফট্ লাগেজ রাখা ছিলো, সেগুলো নিয়ে যাওয়ারও একটা ব্যাপার ছিলো।
সকালে প্ল্যান অনুযায়ী কাতলুং ছোট মহাকাল ট্রেক দল সাড়ে সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট ও পথমধ্যে টুকটাক খাবার, ফ্রুটজুস নিয়ে চলে গেল। সকালের জলখাবার নির্ধারিত সময়ে হাজির। কিন্তু গোল বাধলো যখন দেখা গেল দলের একজন অনুপস্থিত। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুরু হলো মানসিক অস্থিরতার পালা। জানা গেল তিনি ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু কোনদিকে গিয়েছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে না। লিডার সাথে নিজে আরো দুই তিনজনকে নিয়ে অপেক্ষায় থেকে বাকিদের রওনা করিয়ে দিলো। স্থানীয় দু’জনকে দুই দিকে পাঠানো হলো খোঁজার জন্য। আমাদেরও বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়েছে। আসলে আমরা যারা জঙ্গলে হাঁটি তারা জানি সামান্য ভুলের পরিণতি কী হতে পারে। বেশ খানিকটা নিচে আসার পর রিলে মাধ্যমে খবর পেলাম নিখোঁজ ব্যক্তিকে সুস্থ শরীরে পাওয়া গিয়েছে এবং অস্থিরতার অবসান হয়েছে। আমরা দ্বিতীয় দল আবার বক্সা, সদরবাজার, জিরো পয়েন্ট হয়ে কেউ কেউ গাড়িতে কেউ কেউ পুরোপুরি হেঁটে সান্তারা বাড়ি পৌছালাম। এখানেই দ্বিতীয় দলের হাঁটা শেষ। সান্তারা বাড়ি থেকে আবার গাড়িতে করে জয়ন্তী। সেখান থেকে দুপুরের খাবার লোড করে শুখনো নদীর বালি পাথরের বিছানার রাস্তার উপর দিয়ে বা দিক ডান দিক টাল খেতে খেতে প্রায় সাড়ে চার কি.মি. দূরে পৌছালাম ছোট মহাকাল, তখন প্রায় দুপুর দুটো। বেশ কিছু ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া চা জলখাবারে দোকান আছে। এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো প্রায় সব দোকানেই বাবা মহাদেবের দেশি বিদেশি প্রসাদ পাওয়া যায় বেশি পয়সার বিনিময়ে একদম প্রশাসনের চোখের সামনে। অবশ্য বক্সা, লেপচাখাঁতেও পাওয়া যায়। আমাদের প্রথম দল তখনও এসে পৌছায়নি। একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম প্রথম দল আসছে। এতক্ষণ নদীতে সেই রকম জল দেখিনি, এখানে কিন্তু বেশ সচ্ছ জলের ধারা। আমরা অনেকেই লোভ সামলাতে না পেরে গামছা, হাফ প্যান্ট পরেই জলকেলিতে মেতে উঠলাম। প্রায় তিনটা নাগাদ খোলা আকাশের নিচে বসে ভাত, আলুভাজা, ডাল, সবজি, ডিম, ও শেষ পাতে দুই/তিন টুকরো চিকেন। এক অনবদ্য বনভোজন।
এবার আসি প্রথম দলের অভিজ্ঞতায়। প্রথম আধা ঘণ্টা উতরাইয়ের পথ ও ছায়াবেস্টিত রাস্তা। কাতলুং রিভার বেডে নেমে ব্রেকফাস্ট। এই অব্দি বেশ আনন্দদায়ক। এরপর থেকেই বোল্ডারের পথ এবং ১২ থেকে ১৪ বার জুতো খুলে নদীর এপার ওপার হয়ে হাঁটা, সঙ্গে মাথার উপর প্রখর সূর্যের বিকিরণ একদম ফ্রি, পাঁচ মিনিটের পথ ২০ মিনিট লেগে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার অল্প বিস্তর শৈলারোহণ। এভাবেই তারা বড়ো মহাকালের পাদদেশে পৌঁছালো। এরপর তেমন নদী পারাপার ছিলো না। কিছু কিছু জায়গায় আবার গাছের গুড়ির মই বেয়ে ওঠা নামা। আগে এই পথে মাঝে মাঝেই হরিণ, বনশুয়োর দেখা মিলত। আর পাওয়া যেত বিভিন্ন বন্য জন্তুর বিস্টা ও হাড়গোড়। এখন সেই সব আর পাওয়া যায় না বটে, তবে আরো অন্যকিছু পাওয়া যায়। বন্য জন্তুর বদলে মহাকাল দর্শনে আসা পূর্নার্থীদের বিস্টা এবং রংবেরঙের বিলাতি মদের কাঁচের বোতল ও তার ভাঙ্গা অংশ পাওয়া যায়। একটু এদিক ওদিক হলেই জলে নামা অথবা পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে চলা ছাড়া কোনো গত্যান্তর থাকবে না। এভাবেই আমাদের প্রথম দল প্রায় সোয়া দুটো নাগাদ ছোট মহাকাল পৌঁছালো।
দুপুরের বনভোজনের ভুঁরি ভোজের পরে আবার সেই টালমাটাল নদীর বুক চিরে রাস্তা। আসার সময়তো আমাদের একটা গাড়ির বাম্পার ভেঙ্গে গেল। রাস্তা থেকে কাপড়ের দড়ি দিয়ে কোনরকমভাবে বাঁধাছাদা করে যাওয়া হয়েছিল। যা রাস্তা তাতে ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার যায় কিনা সন্দেহ। এভাবে ত্রিশ চল্লিশ মিনিট চলার পর জয়ন্তীর অনেক কিছুর সাক্ষী পূরনো বটগাছের তলায়। এটাকে ঘিরেই জয়ন্তীর দোকান পাট, বাস স্ট্যান্ড। আজ থেকে সাড়ে চার দশক আগেও ব্রিটিশদের তৈরি আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়া হোয়ে ন্যারো গেজের রেলগাড়ীও চলত। অধমের চড়ার অভিজ্ঞতা না হলেও রেল লাইন, জয়ন্তি রেল স্টেশন, কয়লার ডিপো দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বিদেশ হলে এটাকে হেরিটেজ হিসাবে রক্ষণাবেক্ষণ করত এবং দার্জিলিং-এর মতো জয় রাইড করতো। ধন্য আমাদের রেল বিভাগ। রেল লাইনটা উঠিয়েই দিলো!
পর্ব-৫ (শেষ পর্ব)
জয়ন্তী সম্বন্ধে আর দুচার কথা না বললেই নয়। জয়ন্তীর আসল নাম জৈন্তি, মুখে মুখে ওটা জয়ন্তী হয়ে গিয়েছে। জৈন্তি নদীর আসল নাম গদাধরি নদী। জৈন্তির পাশ দিয়ে বয়েছে বলে জৈন্তি বা জয়ন্তী নদী বলে। যে সকল প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ১৯৯৩-এর উত্তরবঙ্গ বন্যার আগে এসেছেন তাদের মধ্যে এখনো যারা বেঁচে আছেন তারা আর এ চত্ত্বরে পা মাড়ায়না। ১৯৮৩ সালে বক্সা টাইগার রিসার্ভ এস্টাব্লিসড্ হলেও সেভাবে এত বিধিনিষেধ ছিলো না। সেখানে ছিলো না কোনো হোমস্টে বা রিসোর্ট। ছিলো একটা সুন্দর পি ডব্লিউ ডি বাংলো, একদম নদীর ধারে, আর ছিলো একটা ফরেস্ট বাংলো, প্রাইমারি স্কুল ও বেঙ্গল লাইমের ডলমাইট ফ্যাক্টরি ও তাদের একটা গেস্ট হাউস। কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের বেশ কিছু প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণ রসিক ব্যক্তি যাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় কোলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই ক্রেডিট কো অপারেটিভ-এর পরিচালনায় একটা হলিডে হোম— এটার নাম অবকাশ, এখনো বিদ্যমান। নামের মতোই এখানে বুকিং-এর নিয়ম। হয় আপনাকে তিন দিনের স্লট নিতে হবে, নতুবা চার দিনের স্লট নিতে হবে। ’৯৩-এর বন্যায় পি ডব্লিউ ডি বাংলো খড় কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিলো। মাওবাদি আন্দোলনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো ফরেস্টের কাঠের বাংলোটি। বনবিভাগের সাথে মামলায় হেরে গিয়ে গুটিয়ে নিতে হয়েছে ডলমাইটের ব্যাবসা। যার ফলে হঠাৎ করেই এক বিশাল শ্রমিক শ্রেণি কর্মহীন হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছায় যে দিনে দুপুরে চুরি ছিনতাই যেন এই অঞ্চলের রুজিরোজগার হয়ে উঠেছিলো। দিনের সরকারি বাস অব্দি পুলিশ পাহারায় জৈন্তি যাতায়াত করত। আগে সন্ধ্যের পরেই জায়গাটা অন্ধকার এক শুনসান আর বন্য প্রাণীদের জায়গা হয়ে উঠতো। আর এখন ইকো ট্যুরিজমের নামে বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট, পিকনিক পার্টির দৌরাত্ব আর উজ্জ্বল আলোর ঠেলায় ইকোলজির সাড়ে বারোটা অবস্থা। বাঘ তো দূরের কথা, একটা হরিণ পর্যন্ত এখানে দেখা যায় কিনা সন্দেহ। বনবিভাগ জঙ্গলে প্রবেশের জন্য প্রবেশ শুল্ক নিতে পারে, কিন্ত জঙ্গল রক্ষণা বেক্ষণ করতে পারে না। আর হাতি? তাদের খাদ্যের এমন অভাব হয়েছে যে, তাদেরও গ্রামে এসে ডাকাতি করতে হচ্ছে। বন্যার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, তাকে ফিরিয়ে আনার বিন্দুমাত্র চেষ্টা নাই বন বিভাগের।
আমার বদ্ধমূল ধারণা— জৈন্তি নদীর পাথর বালির বিশাল নদীগর্ভ আবার সবুজ করা যায়, যে নদীতে আগের মতোই সবসময় জলের ধারা বজায় থাকবে। শুধু চাই বন বিভাগের সদিচ্ছা। এ ব্যাপারে আলিপুরদুয়ার, শিলিগুড়িতে অনেক প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠন আছে— তাদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। আমার বিশ্বাস এসব সংগঠনের সদস্যরাও এগিয়ে আসবে এই মহৎ কাজে। কারণ, জৈন্তি নদীগর্ভে এখনো ঘুমিয়ে আছে শাল গাছের জীবন্ত শেকড়। নদীর অপর পাড় দিয়ে গাড়ির পথে ভুটিয়া বস্তি, হাতিপোঁতা, ময়নাবাড়ি হয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ভারত ভুটান এর মধ্যবর্তী রায়ডাক নদীর ধারে ভুটানঘাট। অল্প সময় জৈন্তি কাটিয়ে আবার সুন্দর পিচ ঢালা রাস্তার উপর দিয়ে আমাদের চার চাকা পৌছে দিলো রাজাভাতখাওয়াতে পরিমল ঘোষের লজ কাম হোমস্টে ‘মামন লজে’। তবুও আমার কেমন জানি মনে হয় রাজাভাতখাওয়া এখনো আগের মতো আছে। চেকপোস্টের কাছে কিছু দোকানপাট হয়েছে বটে, তবে অন্যান্য জায়গা এখনো সুন্দর আছে। কথিত আছে ভুটান যুদ্ধের সময় কুচবিহারের মহারাজাকে বন্দি করে রেখেছিলো, পরে ব্রিটিশ ভুটানের যুদ্ধের পর তৎকালীন মহারাজাকে মুক্ত করে ফেরার সময় এইস্থানে প্রথম অন্ন গ্রহণ করেছিলেন, তাই নাম রাজাভাতখাওয়া। এ রকম আরো একটা জায়গা আছে যেখানে মহারাজার একটা হাতি মারা গেলে তাকে সেখানে কবর দেওয়া হয়েছিলো বলে হাতিপোঁতা নাম হয়ে গিয়েছে। সত্যি মিথ্যা জানি না।
সুন্দর এক রেল স্টেশন আছে— শিলিগুড়ি আলিপুরদুয়ার জংশন রেলের শেষ স্টেশনের আগের স্টেশন। আছে বন বিভাগের সুন্দর কাঠের তৈরি বিশ্রাম গৃহ ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে। অনলাইন বুকিং করা যায়, তবে একটু খরচ বেশি। তাছাড়াও ব্যক্তি মালিকানায় আছে ফরেস্ট জঙ্গল ক্যাম্প। এছাড়াও আরো দুই তিনটা হোমস্টে আছে। তবে সার্বিক বিচারে পরিমলের মামন লজই সবচেয়ে ভালো, যাকে বলে কম খরচে পুষ্টিকর খাদ্য। পরিমলের আন্তরিকতার তো তুলনাই হয় না। আছে একটা বন্য প্রাণীর সুন্দর মিউজিয়াম। এটা দেখতে কোনো মুল্য লাগে না।
এবার আসি রাজাভাতখাওয়াকে কেন্দ্র করে যেসব জায়গায় যাওয়া যায়— খুব ভোরে গাড়ি বুক করে চলে যেতে পারেন পরিযায়ী পাখিদের অস্থায়ী আস্থানা রসিক বিল, দুরত্ব কম বেশি ৬০ কি.মি.। সুযোগ বুঝে ভাড়া। মোটামুটি ২৫০০/৩০০০ টাকা ভাড়া। ২৫/৩০ কি.মি. দূরে চিলাপাতা জঙ্গল, জলদাপাড়া ও বক্সা জঙ্গলের মধ্যবর্তী অঞ্চল। এখানে হাতির পিঠে জঙ্গল সাফারি করা যায়, যাওয়া যায় বন বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে জৈন্তি, ভুটিয়া বস্তি, হাতিপোঁতা হয়ে রায়ডাক নদীর ধারে ভুটানঘাট। দূরত্ব আনুমানিক ৫০ কি.মি., গাড়ির রাস্তা। তাছাড়া বক্সা দূর্গতো আছেই। আবার অটোতে মাত্র আধাঘন্টা দূরত্বে শিকিয়া ঝোরা, সেখানে পয়সার বিনিময়ে নৌকা বিহার করতে পারেন। বলা হয় ডুয়ার্সের অ্যামাজন। পয়সা বেশি নেবার অনেক ফন্দি ফিকির জানে মাঝিরা। এছাড়াও আছে জীপে জঙ্গল সাফারি, কতটা কি দেখতে পাওয়া যায় সে ব্যাপারে বেশ সন্দেহ আছে, তবে খারাপ লাগবে না। আবার ফেরার দিন কুচবিহার রাজবাড়ী, বিখ্যাত মদনমোহন মন্দির ও বানেশ্বর শিব মন্দির দেখে নিউ কুচবিহার বা নিউ আলিপুরদুয়ার থেকে ট্রেনে কোলকাতা ফেরা যায়। আমাদের দলে অনেকেই শিকিয়া ঝোরা, জঙ্গল সাফারি, কুচবিহার ভ্রমণ করেছেন।
১১/৩/২২, আজ আমাদের ভ্রমণের শেষ সন্ধ্যা। পরিমলের মামন লজের সুন্দর ঘাসের উপর মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে ক্যাম্প ফায়ার এক আলাদা অনুভুতি এনে দেয়। দলের সবার গান, নাচ, আবৃত্তি, গল্প ইত্যাদির অংশগ্রহণে সমাপ্ত হয় আমাদের ভ্রমণ। কত যে সুপ্ত প্রতিভা আছে সেটা বোঝা যায় ক্যাম্পফায়ারে। স্নেহময়ের কবিতা পাঠ, অমরনাথদার কবিতা পাঠ, সমবেত কণ্ঠে গান— সর্বোপরি শিপ্রার নাচ। ভাই তাপসের কাছে শুনেছিলাম, খুব ভালো নাচাতে পারে, কিন্তু নিজে যে এত সুন্দর নাচতে জানে সেটা জানা ছিলো না। রাত্রের ভালো মন্দ খাওয়া তো আছেই। যদিও পরের দিন বিকাল ৪টা অব্দি অনেকেই ওখানে ছিলাম। ফিরে আসি পদাতিক এক্সপ্রেসে শিয়ালদহ।
পুনশ্চঃ আমি এই পাঁচ পর্বের লেখার মাধ্যমে কাউকেই বক্সা জৈন্তি অঞ্চলে ভ্রমণ করতে নিরুৎসাহিত করতে চাইনি, বরং বেশি বেশি করে যেতে বলব। তবে একটা কথা বলতে চাই, অতীতকে জানুন এবং সাধ্যমতো বন জঙ্গল পরিস্কার রাখুন, অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না, জায়গা নোংড়া করে কলুষিত করবেন না, জঙ্গলের বাসিন্দাদের ভালো থাকতে দিন। এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কোনো এক ক্যাম্পে শুনেছিলাম “গাছপালা, নদীনালা, পশুপাখি আর জঙ্গল, সকলেই করে এরা মানুষের মঙ্গল”।