‘ভারত-বিরোধিতা’ ও ‘ভারত-বিদ্বেষ’ ভিন্ন বিষয়; ঠিক তেমনি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘বাঙালির মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ ভিন্ন বিষয়; ‘বাঙালির মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ হলো সাম্প্রদায়িকতা। বেশ কয়েক বছর আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়া বাংলাদেশিদের বিএসএফের হাতে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদ করেছিলাম। সেই প্রতিবাদের ভাষাও মাঝে মাঝে কড়া ছিল। সচলায়তন ব্লগ হতে ভারতীয় পণ্য বয়কটের আহবানেও অংশগ্রহণ করেছিলাম। এসবই ছিল নির্দিষ্ট ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে ‘ভারত-বিরোধিতা’; আমাদের প্রতিবাদের ভাষা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কড়া ছিল কিন্তু কোন অবস্থাতেই তাতে ‘ভারত-বিদ্বেষ’ ছিল না। সীমান্তে হত্যার প্রতিবাদে আমাদের মনোবল যুগিয়েছিল ‘মানবিকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’।
‘বাঙালির মুসলিম জাতীয়তাবাদের’ উন্মেষের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে ১৯৪৭-এ পূর্ব-বঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হয়।
পরবর্তীতে ধর্মীয় এই জাতীয়তাবাদ অসাড়, ব্যর্থ ও ভুল বলে প্রমাণিত হয়। ফলাফল হিসেবে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ উত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বন্ধুত্বের প্রমাণ রেখেছে, সত্যি বলতে- ভারতের সহায়তা না পেলে আমাদের স্বাধীনতার জন্য আরো বেশি মূল্য দিতে হতো এবং মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতো।
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশগুলোর মাঝে সাধারণত: যে ধরণের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকতে দেখা যায়, যাকে স্বাভাবিক সম্পর্ক বলে, ভারতের সাথে সে ধরণের রাজনৈতিক সম্পর্ক স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের সব সময়ই ছিল। সীমান্ত ও বাঁধজনিত সমস্যাগুলো প্রতিবেশী অনেক দেশেই দেখা যায় কিন্তু তারপরও বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি বাণিজ্যের অংশীদার হলো ভারত। বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ১৫% ভারতের সাথে। এই চিত্রটি বাংলাদেশের সাড়ে চার দশকের ইতিহাসে প্রায় সব সময়ই ছিল।
বিষয়ভিত্তিক ইস্যুতে (যেমন, সীমান্তে হত্যা ও বাঁধ ইস্যু) ‘ভারত-বিরোধিতা’ রাজনৈতিক দিক হতে স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু ‘ভারত-বিদ্বেষীতা’ স্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিদ্বেষ বা ঘৃণা কখনই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। সত্যি বলতে ভারত রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের এমন কোন ঘটনা নেই যে ভারতের প্রতি এমন ঘৃণার জন্ম হতে পারে।
তাহলে, এই ভারত-বিদ্বেষের কারণ কি? এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়- ‘বাঙালির মুসলিম জাতীয়তাবাদ’। ‘বাঙালির মুসলিম জাতীয়তাবাদের’ কারণে মুসলমান ধর্মে বিশ্বাসী বাঙালিরা ভারতকে হিন্দুর রাষ্ট্র ভাবতে পছন্দ করে। যদিও ভারত সাংবিধানিকভাবে সেক্যুলার ও বহু ধর্মের মানুষের রাষ্ট্র এবং হিন্দুত্ববাদীদের একক প্রাধান্য নেই; তারপরও মুসলমান ধর্মে বিশ্বাসী বাঙালিরা ভারতকে হিন্দুর দেশ ভাবে। ‘বাঙালির মুসলিম জাতীয়তাবাদের’ শিক্ষা এতটাই বোধশূণ্য যে, মুসলমান ধর্মে বিশ্বাসী বাঙালিদের একটি বড় অংশ একাত্তরে বর্বরতার চূড়ান্ত নজির রেখে যাবার পরও নিপীড়ক পাকিস্তানকে আপন ভাবতে পারে। মূলত: ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ তথা সাম্প্রদায়িকতার মূল দৈন্যতা এখানেই। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কখনোই মনুষ্যত্বের নীতি মেনে চলতে পারে না; এই এধরণের জাতীয়তাবাদ একটি নৃতাত্ত্বিক জাতির মধ্যেই শ্রেণিবিভেদ সৃষ্টি করে। উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দুটোই বিষবৃক্ষের বিষফল। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কখনোই কোন সুফল বয়ে আনতে পারে না। বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অসাড় বিষয়। একত্রিত পাকিস্তানের অযোগ্যতা ও অবসান এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
সাধারণত: নিপীড়ন, বঞ্চনা হতে মুক্তি ও অন্যায়ের প্রতিবাদ হতে সুস্থ জাতীয়তাবাদের ধারা সৃষ্টি হয়। কিন্তু একটি সম্প্রদায় বা জাতি যখন অন্যদের উপর নিজেদের সুপিরিয়রটি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তা কোনভাবেই জাতীয়তাবাদের সুস্থধারা নয়; এগুলো হলো সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও উগ্রজাতীয়তাবাদ। এই সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদে আক্রান্ত বাংলাদেশের জনগণ; স্রেফ ধর্মীয় কারণে ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং প্রাত্যহিক জীবনাচরণ ও খেলাধুলোর মধ্য দিয়ে এর নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভারতের প্রতি চরম-দ্বেষ ও পাকিস্তানের প্রতি চরম-প্রীতি আমাদের এই জনপদের ধর্মভিত্তিক তথা সাম্প্রদায়িকতা আক্রান্ত রুগ্ন চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ।
পাকিস্তান বাংলাদেশকে নিজেদের করায়ত্তে রাখার জন্য ধর্মীয় কারণে ও জাতিগত ঘৃণা হতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের কম পক্ষে ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিল, পাঁচ লক্ষ নারীকে নির্যাতন করেছিল, উদ্বাস্তু হয়েছিল এক কোটি মানুষ, ধ্বংস করেছিল পুরো জনপদ। স্বাভাবিক কারণে পাকিস্তানীদের প্রতি দূরত্ব অনুভব করার কথা বাঙালিদের কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটি হয়ে গেলো উল্টো; শুধুমাত্র ধর্মে মিল থাকার কারণে বাংলাদেশের মানুষরা পাকিস্তানের প্রতি আন্তরিকতা অনুভব করে, নিপীড়কের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে। অন্যদিকে ভারতের সাথে আজ পর্যন্ত আমাদের ধর্তব্যে আনার মত বা শত্রুতা সৃষ্টির মত সংঘাত বা এই ধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি বরং মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান অপরিসীম ও স্বাধীন বাংলাদেশে তারা আমাদের বাণিজ্য অংশীদার। তারপরও শুধুমাত্র বাঙালি সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের একটি বড় অংশের মানুষ ঘৃণা পোষণ করে। এগুলো হলো সাম্প্রদায়িকতা তথা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রত্যক্ষ কুফল ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
সাম্প্রদায়িকতার তথা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বীজ এই জনপদে বিদ্যমান ছিল; ভারত-বিদ্বেষ পুরনো ও চর্চিত বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের পথ চলা শুরু হয়। কিন্তু জাতি ও রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক এই চর্চা বেশিদিন টিকে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত পক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেদের পুনঃ প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ফলে নিভু নিভু সাম্প্রদায়িকতার আগুনকে উসকে দেয়। হিন্দু-মুসলিমের পুরনো শত্রুতাকে পুঁজি করে ভারতকে হিন্দু ও শত্রু রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে সফলভাবে সাম্প্রদায়িকতার বীজ পুনরায় বপন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে দেয়া হয় ‘ভারতের দালাল’ তকমা। এভাবে করে ধর্মীয় আবহে ভারত-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে ও বাংলাদেশে ইসলামের ধারক-বাহকরূপে আবির্ভূত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত পক্ষ তথা মুসলিম জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এবং পরিণতিতে বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়।
আর এই কাজে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে ‘৭৫ পরবর্তী প্রো-পাকিস্তানি ও ধান্ধাবাজ সরকারগুলো; এছাড়া বামাতি (জামাতপন্থী বাম) প্রগতিশীল ও অর্থ-ক্ষমতালোভী ধান্ধাবাজদের বড় ভূমিকা আছে; এরা নিজেদের ক্ষমতা ও আর্থিক লাভের জন্য ভারতকে বাংলাদেশের শত্রু হিসেবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত-বিদ্বেষের চর্চা শুরু করে।
ভারত-বিদ্বেষের সাথে সাথে এই জনপদের মানুষরা বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে নিজ দেশের হিন্দুদের প্রতিও তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করে। পরবর্তীতে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিও এই বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। তাই, ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণের সাম্প্রদায়িক তথা বাঙালির মুসলিম জাতীয়তাবাদী মানসিকতা ফলে সৃষ্ট সহিংসতার বলি হয়েছে বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-পাহাড়ি-উপজাতি-আদিবাসী-নাস্তিক সহ সকল ভিন্ন মত ও ধর্মের অনুসারীরা, এমনকি মুসলমান সংখ্যালঘু শিয়া, আহমাদি, লাহোরি আহমাদি’র মত সম্প্রদায়গুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক আক্রোশের শিকার হয়েছে। সাম্প্রদায়িক হামলা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষজনিত ঘটনাগুলো বাংলাদেশে নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তবে এথেকে উদ্ধার পাবার উপায় কি? বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই সমস্যার সমাধান হিসেবে নিম্নোক্ত কাজগুলো করা যেতে পারে:
১. রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধ্যতামূলকভাবে সর্বস্তরে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবর্তন ও চর্চা করা।
২. ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
৩. রাজনীতির ধর্মনিরপেক্ষকরণ।
৪. বিজ্ঞান ও মানবিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ।
৫. জঙ্গিগোষ্টীগুলোর প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহণ ও দমনে অভিযান পরিচালনা করা।
৬. একাত্তরের পরাজিত পক্ষ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বয়কট করা এবং তাদের প্রচার ও প্রসারমূলক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা।
বাঙালিয়ানা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্পদের সুষম বণ্টন ও গণতান্ত্রিক চর্চার প্রত্যয় নিয়ে সাড়ে চার দশক আগে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। সাম্প্রদায়িক পক্ষের আগ্রাসন ও ধান্ধাবাজদের নোংরামির কারণে সেই প্রত্যয়গুলো আজ ছিন্নভিন্ন, লণ্ডভণ্ড; ফলশ্রুতিতে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে বাংলাদেশ। তারপরও আমরা আশাহত নয়; সমস্যা হলে, সমাধানও থাকে; তাই, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার এই সমস্যার সমাধান আছে, সেই লক্ষ্যে কাজও চলছে। বর্তমানে চলমান একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা ও রায় বাস্তবায়ন অসাম্প্রদায়িক ও একাত্তরের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার পথে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। এবং এর সাথে সাথে উপরে উল্লেখিত ছয় ধারার কর্মপন্থাটিরও বাস্তবায়ন করা জরুরি।
সারকথা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ বিনির্মাণ করা না গেলে একাত্তরে লাখো ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশের মৃত্যু আসন্ন। আর বাংলাদেশের মৃত্যু মানে আমাদের অস্তিত্ব ও স্বাভাবিকত্বের অবসান। তাই, নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বাভাবিকত্ব টিকিয়ে রাখতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে, রুখে দিতে হবে সাম্প্রদায়িকতা।
সাব্বির হোসাইন
পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট