বাংলাদেশের জনগণ যে দেশটি সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত বেশি ধারণা রাখে তা হলো প্রতিবেশি ভারত। নানা প্রয়োজনে এদেশের মানুষ ভারত যায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণ, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি। দুদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষার মিল এই মেলবন্ধনের অন্যতম নিয়ামক। ভারতীয় বই, পত্র–পত্রিকা, গান, চলচ্চিত্র, খাবার আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়। গুলশান, বারিধারায় অবস্থিত সব কটি বিদেশি মিশন যত ভিসা প্রদান করে এককভাবে ভারতীয় মিশন বহুগুণ বেশি ভিসা প্রদান করে। বছরে প্রায় ৫ লক্ষ বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রয়োজনে ভারত ভ্রমণে যায়। অনেক ভারতীয় নাগরিকও বাংলাদেশ সফরে আসে। দুটি নিকটতম প্রতিবেশি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে এমনি যাতায়াতের সম্পর্ক খুবই স্বাভাবিক। ইতিহাস–ঐতিহ্যোর বাইরে ভৌগোলিক অবস্থানও দু’দেশের সম্পর্কে প্রভাব বিস্তার করেছে। দক্ষিণ–পূর্ব কোণে মায়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ব্যতীত বাংলাদেশ সামগ্রিক অর্থে ভারত–পরিবেষ্টিত একটি রাষ্ট্র। বাংলাদেশের মোট সীমান্তের ৭৮.৮৬ শতাংশ ভারতের সঙ্গে। অন্যদিকে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় ভূ–বেষ্টিত রাজ্যসমূহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব সবসময় ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার অস্তিত্বের বিদ্যমানতার পক্ষে জোরালো সমর্থন অর্জন করে। গত ৪৯ বছরে দুদেশের সম্পর্কে নানা চড়াই–উৎরাই লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে কেবল নয় এদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ‘ইন্ডিয়া ফ্যাক্টর’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দিল্লিতে কংগ্রেস শাসনের অবসান এবং মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর আশংকা করা হয়েছিল দুদেশের সম্পর্ক হয়তো উন্নতির পথে এগুবে না। বিজেপি সরকার বাংলাদেশে সেকুলার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি অনুকূল মনোভাব দেখাবে না এবং সহযোগিতার হাত বাড়াতে চাইবে না। আশঙ্কাটি সঠিক প্রমাণিত হয়নি। নরেন্দ্র মোদি দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, তিনি গুজরাটের সাবেক মূখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর নন। তিনি দেশ পরিচালনায় ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুসরণ করছেন এবং প্রতিবেশি দেশগুলোর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে তিনি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন এবং ইতোমধ্যেই স্থলসীমান্ত চুক্তিসহ একাধিক সমস্যার সমাধান ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশে তাই ভারত–বিরোধিতার জোয়ার আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে এবং ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির প্রথম বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের মানুষ তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী দুদেশের সম্পর্কের যে ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি তাকে আরও শক্তপোক্ত করার ব্যাপারে এগুতে সক্ষম হয়েছেন। এই ব্যাপারে তার সদিচ্ছা রয়েছে এবং এই সদিচ্ছা পূরণের ব্যাপারে পার্লামেন্টেও তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এ জন্যই বলা চলে, ইন্দিরা গান্ধী দুদেশের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে যে শুভ উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদির হাতেই হয়তো তার নবরূপায়ণ ঘটবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতেও এতকাল কোনো ভারসাম্য ছিল না। ভারত–চীন বিরোধে একটি ক্ষুদ্র প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশের যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা উচিৎ ছিল তা সামরিক সরকার ও বিএনপি সরকারের আমলেও করা হয়নি। কখনও মার্কিন ধমকের কাছে নতজানু হওয়া এবং কখনও অতিরিক্ত চীন প্রীতি দেখিয়ে ভারতকে বিরূপ করে তোলা ঢাকার সামরিক সরকার ও বিএনপি আমলের বিদেশনীতির বিশেষ প্রবণতা ছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে এই প্রবণতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন এবং অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন। তিনি সকল ব্যাপারে আমেরিকা এমনকি বিশ্ব ব্যাংকের ধমকের কাছেও নতজানু হননি এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় একটা ইতিবাচক ভারসাম্য রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্যদানে চীন যেমন এগিয়ে এসেছে, তেমনি ভারতও এগিয়ে আসতে দ্বিধা করছে না।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কিত যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে তারমধ্যে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, ভারতের নাগরিকত্ব আইন এবং অতিসম্প্রতি দিল্লীতে ঘটে যাওয়া মসজিদে হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সীমান্তরক্ষীদের অতিউৎসাহী মনোভাবের কারণে প্রায়শই অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হয়। এই বিষয়টি নিয়ে দুদেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে প্রায়শই উত্তেজনা দেখা দেয়। কোনো দেশের নাগরিকেরই বিনা অনুমতিতে অন্যদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করা উচিৎ নয়। এই বিষয়ে সকলের সতর্কতা দু’দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
অন্যদিকে ভারতজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) বিরোধী আন্দোলন চলছে। আর এ দুটো আইন ভারতের সাংবিধানিক মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এর ফলে ভারতের অনেক অধিবাসীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে। জোরপূর্বক অনেকের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের আওতায় পড়ে।
বিলটির মূল উদ্দেশ্য হলো সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেয়া। এতে বলা হয়েছে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধসহ আরও কিছু অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা, যারা নিজের দেশে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে, তারা যদি ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করে থাকে, তবে তারা এই আইনের আওতায় ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযুক্ত। এসব সম্প্রদায়ের মানুষজন ভারতে ছয় বছর বসবাসের পর সেখানকার নাগরিকত্ব পাবেন যা আগে ছিল এগারো বছর। তাদের কোন কাগজপত্র না থাকলেও চলবে।
আসামে এই এনআরসির ফলস্বরূপ নাগরিকত্ব হারায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ, যা আসামের পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু জাতি ভিত্তিক সংস্থা এর বিরোধিতা করে আসছে। তারা মনে করে এসব অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দিলে সেটি স্থানীয় মানুষদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আসামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আশঙ্কা বাংলাভাষী হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিলে তারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। এই আইনের ফলে ভারত থেকে মুসলমানদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে এমন আশংকায় অনেকে ভারত বিরোধীতা শুরু করেছেন। যদিও বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নরেন্দ্র মোদি আশ্বস্ত করেছেন।
মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আগমনের প্রস্তুতি সম্পাদনের বিষয়ে আলোচনার জন্যে গত ২ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা দুই দিনের সফরে ঢাকায় এসে বলেছেন, এনআরসি এবং নাগরিকত্ব আইন ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের ওপরে কোন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে না। আমরাও তাই মনে করি যে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যাতে আমাদের দেশে কোনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়। মোদি সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে কোনো অন্যায় করলে প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যা করণীয় তা শেখ হাসিনা সরকার করবে। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে কিছু মানুষ বাংলাদেশে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছেন যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর একটি রাষ্ট্রীয় সফর যা দুদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
সম্প্রতি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মসজিদে হামলা পরবর্তী বিক্ষোভ–সহিংসতায় ৪২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরও তিন শতাধিক মানুষ। বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী (সিএএ) আইনকে কেন্দ্র করে দিল্লির উত্তর–পূর্বের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গা–সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এই হামলা নিন্দনীয় এবং কোনোভাবেই তা মেনে নেয়া যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এই হামলার বিরোধীতা করে নিজের নিজের অবস্থান থেকে এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। অনেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলে হুশিয়ারিও দিয়েছেন। মোদি সরকারের সময়ের ঘটনার দায় মোদি সরকারকেই নিতে হবে। এবং সাধারণ মানুষ যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন তাও আবেগ প্রসূত। এই বিষয়টির যৌক্তিক প্রতিবাদ হওয়া অবশ্যই উচিৎ। কিন্তু এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে তা যদি বাড়তে থাকে তবে তা দুদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা ইচ্ছে করলে নিজের ভাড়া বাসা পরিবর্তন করে নতুন বাসায় যেতে পারি। কিন্তু প্রতিবেশি রাষ্ট্র কখনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিৎ।
অনেকের ধারণা, নরেন্দ্র মোদি বিদেশনীতিতে সাফল্য অর্জন করলেও দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট কাটিয়ে উঠতে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাবের ফলে তেমন সফল হতে পারছেন না। তিনি যদি বিজেপির সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ির মতো সাহসের সঙ্গে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং প্রতিবেশি দেশগুলার সঙ্গে সমঅধিকার ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন তাহলে এশিয়ায় শান্তি ও সমৃদ্ধির এক নব যুগের হাওয়া তিনি বইয়ে দিতে পারবেন। আর এই ব্যাপারে ব্যর্থতা হবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের জন্য একটি বড় ব্যর্থতা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অস্তিত্ব যখন বিপন্ন, সেই চরম দুঃসময়ে ভারতের জনগণ, সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সম্পূর্ণ বন্ধুহীন, বৈরি পরিবেশে ভারতের সামগ্রিক অবদান কোন দিন ভুলবার নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পাকিস্তানিকরণের ধারা সূচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৪ সালে আবারও আওয়ামী লীগের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির ধারা অব্যাহর রয়েছে এবং থাকবে। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর দুদেশের মধ্যে বিবাদমান ইস্যু মিটিয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে সে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।