‍”এ যেন যাহাই চাপাতি তাহাই ধর্ম নিরপেক্ষতা”

নবম দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে “নবজীবনের সূচনা” অধ্যায়ে লেখা রয়েছে-

“ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি হয়। পৃথিবীর জলবায়ু তখন স্থির ছিল না। তারপর কয়েক কোটি বছর পরে আজ পৃথবী শান্ত, তার জলবায়ুও মোটামুটি স্থিতিশীল। পৃথিবীতে এখন বহু প্রজাতির জীবের বসবাস। অর্থাৎ এই দীর্ঘ সময়কালে প্রথম আবির্ভূত অনুন্নত জীবক্রম পরিবর্তন দ্বারা বিভিন্ন জীবপ্রজাতি সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর উৎপত্তির ঘটনাপ্রবাহকে বলে রাসায়নিক অভিব্যক্তি। আর জৈব অভিব্যক্তি বলতে বোঝায় সময়ের সঙ্গে কোনো জীবের পপুলেশনে পরিবর্তন, যা সৃষ্টি করে নতুন কোনো জীব প্রজাতি।”

দেখা যাচ্ছে- এখানে খুব কৌশলে এবং অত্যন্ত সংক্ষেপে বিবর্তনবাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর চেয়ে কৌশলী হওয়া বোধহয় যায় না। কিন্তু এরপরে বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে তারা লিখেছে-

“মানুষ স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ট জীব। মানুষের জীবন শুরু হয় মাতৃগর্ভে একটি কোষ থেকে। মানুষের জীবনকালে প্রথম সে থাকে শিশু। পরবর্তীতে শিশু থেকে ধাপে ধাপে বৃদ্ধ অবস্থায় উপনীত হয়। … ”

হাস্যকর ব্যাপার না? “মানুষ শুরুতে শিশু থাকে, এরপর বৃদ্ধ হয়” এটা নবম দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী পড়বে?

৭৭ নম্বর পৃষ্ঠায় জীবের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। এখানে জীবনের সূচনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটিই উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ অ্যামাইনো এসিড থেকে জৈব পরিবর্তনের মাধ্যমে কীভাবে বহুকোষী প্রাণী সৃষ্টি হল তার মোটামুটি একটা বর্ণনা রয়েছে।

পরের পৃষ্ঠায় “বিবর্তনের স্বপক্ষে প্রমাণ” নামে একটি উপধ্যায় রাখা হয়েছে। এরপর রয়েছে ল্যামার্কের মতবাদ এবং ডারউইনবাদ। তবে ল্যামার্কের মতবাদের মানুষের বিবর্তনের কথাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। ডারউইনবাদেও একই অবস্থা। বিষয়টা এমন যে- অন্য সব প্রাণী বিবর্তিত হয়েছে, শুধু মানুষবাদে।

ঠিক আছে, কৌশলী অবস্থান না হয় কিছুটা মেনেই নেওয়া গেল, কিন্তু ঐ যে লাইনটা (মানুষ স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ জীব) শুরুতে রাখা হয়েছে ওখানেই তো বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা আর থাকেনি। “স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ট জীব” মানে তো সকল জীবই টুপ করে পড়েছে। স্রষ্টার সৃষ্টি। নাকি? তাহলে পরে আর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কী দরকার? ব্যাখ্যা তো হাদিস উপনিশদে আছে।

নবম দশম শ্রেণির জীব বিজ্ঞান বইয়ে “জীবের বংশগতি ও বিবর্তন” নামে একটি অধ্যায় আছে। সেখানে দুই পৃষ্ঠা জুড়ে ডারউইনবাদের উপর কিছু আলোচনা রয়েছে, তবে সেখানেও মানুষ সম্পর্কে কোনো কথা নেই।

“মানব বিবর্তন বা মানুষের উৎপত্তি বলতে হোমিনিড থেকে একটি আলাদা প্রজাতি হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্স-এর উদ্ভব বোঝায়। সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষের (অভ্যন্তরীন গড়ন বিবেচনায়) উদ্ভব নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অনুকল্প হচ্ছে “আউট অফ আফ্রিকা” বা “আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়া”। অনুকল্পটির সারকথা হচ্ছে মানুষ আফ্রিকাতে উদ্ভূত হওয়ার পর আনুমানিক ৫০,০০০-১০০,০০০ বছর পূর্বে বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।”

এই কথাটুক যদি না থাকে তাহলে ‘বিবর্তন’ নামে আলাদা একটি চ্যাপ্টার করার কী মানে থাকে?

সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে যা যেটুকু কথা আছে তাও শুধু নবম দশম শ্রেণির বইয়ে। এর আগে কোনো শ্রেণির বইয়ে কোনো কিছু নেই।

পঞ্চম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে স্বাস্থ্যবিধি অধ্যায়ে জোর দেওয়া হয়েছে সংক্রামক রোগের ওপর। কিন্তু সেখানে যৌনবাহিত কোনো রোগ সম্পর্কে কোনো কথা না থাকলেও এইডস-এর কথা আছে। যেভাবে আছে-

“রোগাক্রান্ত ব্যক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শে যে সকল রোগ সংক্রমণ হয় তাই ছোঁয়াচে রোগ। যেমন- ফ্লু, ইবোলা, হাম ইত্যাদি। এইডস একটি ভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ, যা এইচআইভি ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। যদিও আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে বা তার ব্যবহৃত কোনো জিনিস ব্যবহার করলে কেউ এইচআইভি দ্বারা আক্রান্ত হবে না।”

প্রশ্ন হচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে যদি যৌনতা বিষয়ে কিছু না-ই বলা যায় তাহলে এইডস-এর কথা আনতে হবে কেন? এইডস কীভাবে ছড়ায় তা লিখতে হবে না? এইডস তো শুধু যৌনবাহিত রোগ নয়, আরো তো অনেকভাবে ছড়ায়।

মজার বিষয় হচ্ছে পঞ্চম শ্রেণির পরে আর কোনো ক্লাসের বিজ্ঞান বইয়ে স্বাস্থ্যবিধি বা রোগ নিয়ে কোনো অধ্যায় নেই। এইডস তথা অন্যান্য যৌনবাহিত রোগ নিয়ে আলোচনা থাকা দরকার ছিল সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণি থেকে, কিন্তু নবম দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়েও এ ধরনের কোনো আলোচনা নেই। মাঝখান দিয়ে শুধু পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে এইডস নিয়ে বিভ্রান্তিকর একটি লাইন রয়েছে।