জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে (১৯৬৪) চে গুয়েভারার ঐতিহাসিক ভাষণ

follow-upnews
0 0

মাত্র ৩৯ বছরের একটা জীবন (১৪ জুন ১৯২৮ – ৯ অক্টোবর ১৯৬৭), এই বয়সেই তিনি বিশ্ববাসীকে দিয়ে গিয়েছেন মানব মুক্তির সনদ, সেটি শুধু তাত্ত্বিকভাবে নয়, বাস্তবিক উপায়েও। সম্রাজ্যবাদী হানাদারেরা বুঝে গিয়েছিল যে, চে কে আর বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ নেই— চে কে বলিভিয়ায় সিআই-এর সহায়তায় বলিভিয়ান বাহিনী আটক করে ৮ অক্টোবর, এবং মাত্র এক দিনের ব্যবধানে ৯ অক্টোবর (১৯৬৭) তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

আজ থেকে ৫৬ বছর আগে, ১৯৬৪ সালের ১১ ডিসেম্বর চে গুয়েভারা নিউইয়র্কে জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেদিন তার প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল— বিভিন্ন দেশ, জনগণ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে “শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান”। এই “শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান” সম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের দ্বারা ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হয়েছিল এবং এই ইতিহাসগুলো ঔপনিবেশিক চিহ্নগুলোর সাথে অবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ, পুয়ের্তো রিকোর প্রতি মার্কিন আগ্রাসন, কঙ্গোর ঘটনাবলী, ভিয়েতনাম, সাইপ্রাস, লাওস এবং অবশ্যই লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে যে লড়াই চলছিল— চে জোর দিয়েছিলেন যে “শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান” এর পক্ষে পথ তৈরি করা এখন একটি “জ্বলন্ত সমস্যা”, যা এই অধিবেশনে অবশ্যই আলোচনা হওয়া উচিৎ।

ভাষণটির পূর্ণাঙ্গ অনুবাদঃ

জনাব প্রেসিডেন্ট;

বিশিষ্ট প্রতিনিধিবৃন্দ:

এই সমাবেশে কিউবার প্রতিনিধিদল হিসেবে, সবার আগে, যারা এখানে বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন তাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি নতুন দেশের সংযোজনকে স্বাগত জানানোর সর্বসম্মত দায়িত্ব পালন করতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট। সুতরাং আমরা তাদের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী, জাম্বিয়া, মালাউই ও মাল্টার জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, এবং এই আশা প্রকাশ করি যে, শুরু থেকেই এই দেশগুলো জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর দলে যুক্ত হবে— যারা সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং নব্যঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।

আমরা এই সমাবেশের সভাপতি [ঘানার অ্যালেক্স কোয়েসন-স্যাকি] এর কাছে আমাদের অভিনন্দন জানাতে চাই, যার উচ্চ পদটিতে আসীন হওয়া বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ, কারণ এটি আফ্রিকার জনগণের জন্য একটি নতুন এবং ঐতিহাসিক শুরুর দিক নির্দেশনা দেয়।

প্রেসিডেন্ট, আপনার ওপর সংঘের সদস্যরা দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তার সর্বাধিক সাফল্য আমরা দেখতে চাই।

কিউবা এখানে বিশ্বজুড়ে বিতর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে তার অবস্থান জানাতে এসেছে এবং এই রোস্ট্রামে দাঁড়িয়ে আমি বুঝাতে চাইছি যে, কিউবা পূর্ণ দায়বদ্ধতার সাথে তা করবে, একইসাথে পরিষ্কার এবং যথাযথভাবে কথা বলার অনিবার্য দায়িত্ব পালন করার সময় এটা।

আমরা এই সমাবেশটি সন্তুষ্টির সাথে পরিচালিত হতে এবং এগিয়ে যেতে দেখতে চাই। আমরা দেখতে চাই যে, সংস্থাগুলো তাদের কাজ শুরু করে এবং প্রথম বাঁধার সম্মুখিন হলেই তা তারা থামিয়ে দেবে না। সাম্রাজ্যবাদ এই সভাটিকে বিশ্বের গুরুতর সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে অর্থহীন বক্তৃতা প্রতিযোগিতার একটি অনুষ্ঠানে পরিণত করতে চায়। আমাদের অবশ্যই এটি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সংঘের এই অধিবেশনটিকে ভবিষ্যতে কেবল একটি সংখ্যা (১৯) দ্বারা স্মরণ করা উচিত নয়, যা এটিকে শুধু আক্ষরিক অর্থে চিহ্নিত করে। আমাদের প্রচেষ্টা যেন সুদুরপ্রসারী লক্ষ্যে পরিচালিত হয়।

আমরা অনুভব করি যে, এটি করার অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা আমাদের রয়েছে, কারণ আমাদের দেশটি দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের সংঘাতের মধ্যে রয়েছে। এটি সেই জায়গাগুলোর মধ্যে একটি যেখানে ছোট দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের অধিকারকে বহাল রাখার নীতিগুলি দিনে দিনে, মিনিটে মিনিটে পরীক্ষা করা হয়। একইসাথে আমাদের দেশ বিশ্বের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের পথে অগ্রসরমান দেশগুলোর তুলনায় এমন এক খাদে রয়েছে— মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থাবা থেকে কয়েক ধাপ মাত্র দূরে অবস্থিত। এটি (দেশটি) তার ক্রিয়াকলাপ দ্বারা দেখাচ্ছে, এটি প্রতিদিন উদাহরণ তৈরি করছে, মানবতার বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ তাদের স্বাধীন করতে পারে এবং নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে।

অবশ্যই, এখন একটি সমাজতান্ত্রিক শিবির রয়েছে যারা দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং লড়াইয়ের আরও শক্তিশালী অস্ত্র তাদের রয়েছে। তবে বেঁচে থাকার জন্য অতিরিক্ত শর্তাদি প্রয়োজনীয়: অভ্যন্তরীণ ঐক্যের রক্ষণাবেক্ষণ, নিজের ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস, এবং দেশের প্রতিরক্ষা এবং বিপ্লবের জন্য মৃত্যুর লড়াইয়ের অদম্য সিদ্ধান্ত। বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা, এই শর্তগুলি কিউবার মধ্যে বিদ্যমান।

এই সমাবেশে আলোচনার জন্য নির্ধারিত সমস্ত জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর মধ্যে, আমাদের জন্য একটি সমস্যা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এবং যার সমাধান আমরা বিশেষভাবে চাই, তা অবশ্যই শুরুতে আলোচিত হওয়া উচিৎ— যাতে কারও মনে সন্দেহ না হয়— বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়টিতে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বকে এটা ভাবতে বাধ্য করেছে যে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে পৃথিবীর মহান শক্তিধর দেশগুলোর শুধু একচ্ছত্র অধিকার। কায়রোতে আমাদের রাষ্ট্রপতি যা বলেছিলেন এবং আমরা পরে রাষ্ট্রপতি বা জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সরকারদের দ্বিতীয় সম্মেলনের ঘোষণায় যা প্রকাশ করেছি তা এখানে আমরা বলি: আমরা বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত করতে চাইলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান শুধু শক্তিশালী দেশগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সমস্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা উচিৎ— আকার নির্বিশেষে, পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক সম্পর্ক কীভাবে দেশগুলোকে সংযুক্ত করে সে হিসেব ব্যতিরেখে, এবং দেশগুলোর মধ্যে মুহূর্তের সমস্যা এবং সংঘাতের হিসেব না করে।

বর্তমানে, আমরা যে ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রত্যাশা করি তা প্রায়শই লঙ্ঘিত হয়। কেবলমাত্র কম্বোডিয়া কিংডম নিরপেক্ষ মনোভাব বজায় রেখেছিল এবং মার্কিন সম্রাজ্যবাদের কৌশলগুলোর কাছে মাথা নত করেনি বলেই এটি দক্ষিণ ভিয়েতনামের ইয়াঙ্কি ঘাঁটি (আমেরিকান সৈন্যদের ঘাঁটি) থেকে সব ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা এবং পাশবিক হামলার শিকার হয়েছে।

বিভক্ত দেশ লাওসও প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাওসের মানুষগুলোকে আকাশ থেকে বোমা ফেলে গণহত্যা করা হয়েছে। জেনেভাতে অনুষ্ঠিত সম্মেলন থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং এ অঞ্চলটির কিছু অংশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা কাপুরুষোচিত হামলার ক্রমাগত বিপদের মধ্যে রয়েছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ভিয়েতনাম পৃথিবীর কয়েকটি দেশের মতো সকল ধরনের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। দেশটি বারে বারে তার সীমান্ত লঙ্ঘিত হতে দেখেছে, তার স্থাপনাগুলোর উপর শত্রু বোমারু এবং যুদ্ধ বিমানের আক্রমণ দেখেছে  এবং মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলো আক্রমণ করেছে, জলসীমা লঙ্ঘন করছে, এর নৌ পোস্টগুলিতে আক্রমণ করেছে। এই মুহুর্তে ভিয়েতনামের ওপর হুমকিটি ঝুলছে— আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ নির্মাতারা আরও নগ্নভাবে এই যুদ্ধটি প্রসারিত করতে পারে, বহু বছর ধরে তারা যে অন্যায় যুদ্ধটি দক্ষিণ ভিয়েতনামের মানুষের বিরুদ্ধে চালিয়ে আসছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুতর সতর্কতা দিয়েছে। আমরা এমন একটি অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি যেখানে বিশ্ব শান্তি বিপদে রয়েছে, পাশাপাশি, এশিয়ার এই অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ে এবং মার্কিন আক্রমণকারীদের খামখেয়ালিপনার শিকার হয়।

তুর্কি সরকার এবং ন্যাটোর চাপের কারণে সাইপ্রাসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে নৃশংসভাবে পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, যা সাইপ্রাসের জনগণ এবং সরকারকে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বীরত্বপূর্ণ ও দৃঢ় অবস্থান নিতে বাধ্য করা।

বিশ্বের এই সমস্ত অঞ্চলে সম্রাজ্যবাদী সহাবস্থান কী হওয়া উচিৎ তার একটি পরীক্ষামূলক সংস্করণ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নিপীড়িত জনগণ তাদের অবশ্যই দেখাতে পারে যে, প্রকৃত সহাবস্থানের অর্থটা আসলে কী, এবং নিপীড়িত জনগণকে সমর্থন করা জাতিসংঘের বাধ্যবাধকতা হওয়া উচিৎ।

আমাদের এও বলতে হবে যে, এটি কেবল সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারণাটি সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করার বিষয় নয়, মার্কসবাদী হিসেবে জাতিসমূহের মধ্যে আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ধরে রেখেছি তবে তা শোষক এবং শোষিতদের মধ্যে, অত্যাচারী এবং নিপীড়িতদের মধ্যে সহাবস্থানকে সমর্থন করে না। আরও যেটা বলা প্রয়োজন, সব ধরনের ঔপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে জাতিগুলোর সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকার অধিকার এই সংস্থার একটি মৌলিক নীতি হওয়া উচিৎ। সে কারণেই আমরা তথাকথিত পর্তুগিজ গিনি, অ্যাঙ্গোলা এবং মোজাম্বিকের ঔপনিবেশিক জনগণের প্রতি আমাদের সংহতি জানাই, যারা তাদের স্বাধীনতার দাবিতে অনঢ় থাকায় তাদের ওপর গণহত্যা পরিচালিত হয়েছে। এবং আমরা কায়রো ঘোষণা অনুসারে আমাদের সক্ষমতার সবটুকু দিয়ে তাদের সহায়তা করতে প্রস্তুত।

আমরা পুয়ের্তো রিকো এবং তাদের মহান নেতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করি, পেড্রো আলবিজু ক্যাম্পোস, যিনি কপটতার এক করুণ শিকার, কারাগারে একটা জীবনকাল কাটানোর পর ৭২ বছর বয়সে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তিনি কথা বলতে অক্ষম, পক্ষঘাতগ্রস্থ হয়ে আছেন। আলবিজু ক্যাম্পোস এখনও শৃঙ্খলিত কিন্তু অদম্য লাতিন আমেরিকার প্রতীক। বছরের পর বছর কারাগার বাস, জেলে অসহনীয় চাপ, মানসিক নির্যাতন, নির্জনতা, তার নিজস্ব মানুষ এবং পরিবার পরিজন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা, তার নিজ জন্মভূমিতে দখলদার বিজয়ী এবং এর দালালদের ঔদ্ধত্য— কিছুই তার মনবল ভঙ্গ করেনি। কিউবার প্রতিনিধিদল, তার জনগণের পক্ষে, আমরা এমন একজন দেশপ্রেমিকের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি, যিনি আমাদের আমেরিকাকে (দক্ষিণ আমেরিকা) সম্মানিত করেছেন।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে পুয়ের্তো রিকোকে শংকর সংস্কৃতির একটি মডেলে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছে:  ইংরেজি ভাষা রীতিতে স্প্যানিশ ভাষা, স্পেনীয় ভাষাটির মেরুদণ্ডে কিছু কাঁটা জুড়ে দেওয়া— এর চেয়ে আক্ষরিক অর্থে আমেরিকার সৈন্যদের সামনে মাথা নত করা ভালো। সম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে পুয়ের্তোরিকান সৈন্যদের কামানের গোলার মতো ব্যবহার করা হয়েছে, কোরিয়াতে এটি করা হয়েছে এবং এমনকি তাদের নিজের ভাইদের উপর গুলি চালানো হয়েছে তাদেরকে দিয়ে, যেমন মাত্র কয়েক মাস আগে পানামার নিরস্ত্র মানুষদের উপর মার্কিন সেনা কর্তৃক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে— আমেরিকান সম্রাজ্যবাদী সৈন্যদের দ্বারা পরিচালিত সাম্প্রতিকতম সময়ে ঘটা একটি ঘৃণ্য অপরাধ এটি। এবং তবুও, তাদের ইচ্ছা এবং তাদের ঐতিহাসিক গন্তব্যের পথে এরকম আক্রমণ করা সত্ত্বেও পুয়ের্তেরিকোর জনগণ তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছে— দক্ষিণ আমেরিকান রীতিনীতি, তাদের সম্মিলিত অনুভূতি, স্বাধীনতার কতটা অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে তার প্রমাণ দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট এই দ্বীপ দেশটির জনগণ নিজেরাই দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই এই বলে সতর্ক করতে হবে যে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি জনগণের ইচ্ছাকে উপহাস করার অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করে না, যেমনটি তথাকথিত ব্রিটিশ গায়ানার ক্ষেত্রে ঘটেছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী চেদ্দি জাগানের সরকার সব ধরনের চাপ এবং রণকৌশলের শিকার হয়েছে, এবং জনগণের ইচ্ছাকে ভুলুণ্ঠিত করতে এবং একটি অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সেখানে স্বাধীনতা বিলম্বিত হয়েছে, গোপন কৌশলে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, যাতে দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশটিতে নপুংসক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়। সে যাইহোক না কেন, গায়ানা স্বাধীনতা পেতে যে কোনো পথ বেঁছে নিতে বাধ্য হতে পারে, কিউবার পক্ষ থেকে সব ধরনের নৈতিক এবং সামরিক সমর্থন এ দেশটির জন্য থাকবে।

তদুপরি, আমাদের অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, গুয়াদালৌপ এবং মার্টিনিক দ্বীপপুঞ্জটি নিজস্ব সরকারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছে, কিন্তু এখনও কিছু অর্জন করতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকাতে যা ঘটছে তার বিরুদ্ধে নজর রাখার জন্য আমরা বিশ্ববাসীকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই— পৃথিকীকরণের  বর্ণবাদী নৃশংস নীতিটি বিশ্বের জাতিগুলোর চোখের সামনে প্রয়োগ করা হয়েছে। আফ্রিকার জনগণ ঘৃণ্য এই সত্যটি এখন সহ্য করতে বাধ্য যে, আফ্রিকা মহাদেশে অন্য জাতির চেয়ে এক জাতির শ্রেষ্ঠত্ব সরকারি আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং এই বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের নামে অনেক হত্যাকাণ্ড দায়মুক্তি পেয়ে থাকে সেখানে। জাতিসংঘ কি এগুলো থামাতে কিছুই করতে পারে না?

আমি বিশেষত কঙ্গোর বেদনাদায়ক ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে যা জঘন্য, এটা দেখায় যে, কীভাবে নিখুঁত দায়মুক্তি সহকারে, কদর্য আচরণের দ্বারা মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করা যায়। এই সমস্ত কিছুর প্রধান কারণ কঙ্গোর বিপুল পরিমাণ সম্পদ, যা সম্রাজ্যবাদী দেশগুলি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। জাতিসংঘে তার প্রথম সফরকালে তিনি যে ভাষণটি দিয়েছিলেন— ফিদেল কাস্ত্রো সংক্ষেপে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, জনগণের মধ্যে সহাবস্থানের পুরো সমস্যাটি জনগণের সম্পদ অন্যায়ভাবে বরাদ্দ দেওয়ার মধ্যে নিহীত রয়েছে। তিনি বলেছিলেনঃ “লুণ্ঠনের দর্শন শেষ করুন তাহলে যুদ্ধের দর্শনও শেষ হবে।”

তবে লুণ্ঠনের দর্শন একটুও বিলিন হয়নি, বরং এটি আগের চেয়েও শক্তিশালী এখন। এবং এই কারণেই লুমুম্বা হত্যার জন্য যারা জাতিসংঘের নাম ব্যবহার করেছিল তারা আজ সাদাদের আত্মরক্ষার নামে হাজার হাজার কঙ্গোলিকে হত্যা করছে। প্যাট্রিক লুমাম্বা জাতিসংঘের সামনে যে স্বপ্ন সিঁড়ি রচনা করেছিলেন, সে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতায়, এটা আমরা কীভাবে ভুলে যেতে পারি? জনতার জাগরণের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সেনা কর্তৃক এই দেশ দখলের পরে যেভাবে অস্ত্রমোতায়েন করা হয়েছে এবং রণকৌশলগুলো নেওয়া হয়েছে, কীভাবে আমরা তা ভুলে যেতে পারি? কাদের পৃষ্ঠপোশকতায় এই মহান আফ্রিকান দেশপ্রেমিকের ঘাতকরা দায়মুক্তি নিয়ে কাজ করে যেতে পারছিল? বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা, কীভাবে আমরা ভুলে যেতে পারি, লোকটি কঙ্গোতে জাতিসংঘের কর্তৃত্বকে ঘৃণা করেছিল— এবং ঠিক দেশপ্রেমের কারণে তা নয়, এটা বরং হয়েছিল সম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে— তিনি হচ্ছেন মোইস তুষোম্বে, যিনি বেলজিয়ামের সহায়তায় কাটাঙ্গা বিচ্ছিন্নকরণের সূচনা করেছিলেন। এবং কীভাবে কেউ ন্যায়সঙ্গতভাবে এটা বিচার করতে পারে, কীভাবে কেউ এটা ব্যাখ্যা করতে পারে যে, সেখানে জাতিসংঘের সমস্ত কার্যক্রম শেষে, তুষোম্বে, কাটাঙ্গা থেকে যাকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল, তাকে বসানো হতে পারে কঙ্গোপ্রজাতন্ত্রের প্রভু বানিয়ে। সম্রাজ্যবাদীরা জাতিসংঘকে সেখানে যে দুঃখজনক ভূমিকা পালন করতে বাধ্য করেছিল কে তা অস্বীকার করতে পারে?

কাটাঙ্গার বিচ্ছিন্নকরণ ঠেকাতে প্রচুর লোক সমাগমের প্রয়োজন হয়েছিল, কিন্তু দুঃজনক হচ্ছে, আজ সে-ই তোষেম্বেই ক্ষমতায়, কঙ্গোর সম্পদ এখন সম্রাজ্যবাদীদের হাতে— একটি সম্মানিত জাতিকে এখন এসবের জন্য মূল্য দিতে হবে। যুদ্ধের ব্যবসায়ীরা অবশ্যই ভালো ব্যবসা করে! এ কারণেই কিউবা সরকার এই অপরাধের জন্য ব্যয়ভার বহন করতে অস্বীকার করা সোভিয়েত ইউনিয়নের ন্যায়সঙ্গত অবস্থানকে সমর্থন করে।

এবং যদি এমন হয় যে এটা যথেষ্ট নয়,  আমাদের মুখ থেকে এমন সব ঘৃণাবাক্য বেরিয়ে আসবে যা বিশ্বকে ক্রোধান্বিত করে তুলেতে পারে। অপরাধীরা আসলে কারা? আমেরিকার বিমানগুলি বহনকারী বেলজিয়ামের প্যারাট্রোপাররা, যারা ব্রিটিশ ঘাঁটি থেকে যাত্রা করেছিল। আমরা খুব ভালোভাবে স্মরণ করতে পারি, যেন এটা গতকালই ঘটেছে— ইউরোপের একটি ছোট্ট, সভ্য এবং পরিশ্রমী দেশকে আমরা হিটালারের সেনা দল দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখেছিলাম। আমরা এটা জেনে ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম যে, ছোট্ট এই রাষ্ট্রটিকে জার্মান সম্রাজ্যবাদীরা তছনছ করে ফেলেছিল, এবং আমরা এর জনগণের প্রতি অনুরাগ অনুভব করেছিলাম। কিন্তু এই সম্রাজ্যবাদীদের জাদু-মুদ্রার অপর পিঠে কী ছিল আমরা অনেকেই তখন তা দেখতে পারিনি। সম্ভবত সেই দেশপ্রেমিক, যিনি বেলজিয়ামের জন্য জার্মান সম্রাজ্যবাদীদের হাতে জীবন দিয়েছিলেন, তার সন্তান আজ হোয়াইট রেসের নামে হাজার হাজার কঙ্গোলিজকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করছে, যেমন বেলজিয়ানরা জার্মানদের গোড়ালীর নিচে পড়েছিল, কারণ তারা যথেষ্ট পরিমাণে আর্য রক্তের উত্তরাধিকারী ছিল না। আমাদের মুক্ত চোখ এখন নতুন দিগন্ত দেখতে পায় এবং দেখতে পায় গতকাল কী হয়েছিল, ঔপনিবেশিক দাস হিসেবে আমাদের অবস্থায় যারা ছিল— পশ্চিমা সভ্যতার সম্মুখে প্রহরী হয়ে বসে থাকা হায়েনা এবং শিয়ালের সে ছবিটি আমরা দেখতে পাই না। কঙ্গোতে যারা এই ধরনের ‘মানবিক’ কাজগুলি সম্পাদন করতে গিয়েছিল তাদের ক্ষেত্রে কেবল এমন উপমাই প্রয়োগ করা যেতে পারে— একটি মাংসাশী প্রাণী, যে নিরস্ত্র মানুষকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয়। সম্রাজ্যবাদ আমাদের সাথে এটাই করেছে। এইসব পরিচয় দ্বারাই সম্রাজ্যবাদী সাদা মানুষগুলোকে চিহ্নিত করা যায়।

বিশ্বের সকল মুক্ত মানুষকে কঙ্গোতে সংগঠিত অপরাধের প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। সম্রাজ্যবাদীদের অস্ত্রে সজ্জিত সেসব সৈন্যদের অনেককেই ঊনমানুষ পরিণত হয়েছিল, সরল বিশ্বাসে এটাই বলা যায় যে, তারা একটি উৎকৃষ্ঠ জাতির অধিকার রক্ষা করছিল। সত্যিকারার্থে এই সমাবেশেও তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ যাদের চামড়া পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের রোদে পুড়ে বাদামী রং ধারণ করেছে, অথবা যারা কালো। এবং তারা পুরোপুরি এবং স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে যে, মানুষে মানুষে পার্থক্য তাদের ত্বকের রঙের কারণে হয় না, এটা হয় উৎপাদন মাধ্যমগুলিতে মালিকানা থাকা বা না থাকাতে, পার্থক্যের এ বিষয়টি উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত। কিউবার প্রতিনিধি দল দক্ষিণ রোডেসিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার জনগণকে শুভেচ্ছা জানায়, যারা সংখ্যালঘু সাদা সম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছে; আমরা একইসাথে আমাদের শুভেচ্ছ বার্তা পৌঁছে দেব বাসুতোল্যান্ড, বেচুয়ানাল্যান্ড, সোয়াজিল্যান্ড, ফরাসী সোমালিল্যান্ড, ফিলিস্তিনের আরব, আদেন, প্রোটেকটারেটস ও ওমানের লোকদের কাছে; এবং তাদের সকলের কাছে যারা ঔপনিবেশীকতাবাদ এবং সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত আছে। আমরা তাদের প্রতি আমাদের সমর্থন পুনরায় নিশ্চিত করছি।

আমি এই আশাবাদও প্রকাশ করি যে, মালয়েশিয়ার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম প্রজাতন্ত্র ইন্দোনেশিয়ার সাথে সংঘাতের একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধান হবে। মিঃ প্রেসিডেন্ট: এই সম্মেলনের অন্যতম মূল বিষয় হল সকলের জন্য ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ। নিরস্ত্রীকরণ নীতির প্রতি আমরা আমাদের সমর্থন ব্যক্ত করতে চাই। পাশাপাশি আমরা সমস্ত থার্মোনিউক্লিয়ার ডিভাইসগুলো ধ্বংসের পক্ষে আমাদের অবস্থান ব্যক্ত করি এবং সকল মানুষের এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করতে বিশ্বের সমস্ত জাতির সমন্বয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। এই সম্মেলনের আগে এক বিবৃতিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই বলে সতর্ক করেছিল যে, অস্ত্র প্রতিযোগিতার দৌড় যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। পৃথিবীতে নতুন পারমাণবিক শক্তিধর দেশ আছে, এবং সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়ছে। আমরা বিশ্বাস করি— নিউক্লিয়ার অস্ত্র সম্পূর্ণ ধ্বংস করার জন্য এরকম একটি বহুজাতীক সম্মেলন করা জরুরী এবং প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এ ধরনের সকল পরীক্ষা নীরিক্ষা বন্ধ করতে হবে। একইসাথে আমাদের খুব সুস্পষ্টভাবে আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে যেন আমরা অন্য দেশের সীমান্তের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি এবং যেকোনও ধরনের আক্রমণাত্মক অবস্থান থেকে সরে আসতে পারি, এমনকি কোনও রকম সাধারণ অস্ত্রে সজ্জিত সংঘাতও নয়।

সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য বিশ্বের যে সকল জনগণ দাবি জানিয়েছে তাদের সাথে আমাদের কণ্ঠ যুক্ত থাকবে যাতে সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্রাগার ধ্বংস করা হয় এবং নতুন থার্মোনিউক্লিয়ার ডিভাইস এবং যেকোনও ধরনের পারমাণবিক পরীক্ষার ভবনগুলো সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি এবং এটা খুব জরুরী যে, দেশগুলোর আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করা উচিৎ এবং সম্রাজ্যবাদীদের সশস্ত্র হাত গোটায়ে নেওয়া উচিৎ, কারণ এরা যখন কেবল প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করে তাও কম বিপজ্জনক নয়। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করেই তারা কঙ্গোর হাজার হাজার নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করেছে। তারা সেখানে প্রচলিত অস্ত্রই ব্যবহার করেছিল। প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করেও সম্রাজ্যবাদীরা প্রচুর মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

এমনকি যদি এখানে পরামর্শকৃত পদক্ষেপগুলো কার্যকর হয়ে ওঠে এবং আরও কিছু উল্লেখ করা অপ্রয়োজনীয় করে তোলে, তবুও আমাদের অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, আমেরিকা যতক্ষণ আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ডে, পুয়ের্তেরিকো, পানামা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য অংশে —যেখানে তাদের সসস্ত্র ঘাঁটি গাড়ার অধিকার আছে বলে তারা মনে করে, আগ্রাসী মনোভাব বজায় রাখবে, আমরা ততক্ষণ পারমাণবিক অস্বীকৃতির জন্য কোনও আঞ্চলিক চুক্তি মেনে চলতে পারব না। আমরা মনে করি যে, কিউবার বিরুদ্ধে আমেরিকান স্টেটস অর্গানাইজেশন-এর সাম্প্রতিক রেজুলিউশনের আলোকে আমাদের অবশ্যই নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হতে হবে, কারণ রিও চুক্তিটির অজুহাতে আমাদের ওপর আক্রমণ চালানো হতে পারে। আমরা যে সম্মেলনটি কথা এইমাত্র উল্লেখ করেছি তা যদি এই সমস্ত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য করা হয়ে থাকে— তবে তা খুব সহজ হবে না— আমরা বিশ্বাস করি এটি মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে। এটা নিশ্চিত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিনিধিত্ব করার প্রয়োজন হবে, এবং সে কারণেই অবশ্যই এই ধরনের একটি সম্মেলন হওয়া উচিৎ। তবে বিশ্বের জনগণের পক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অস্তিত্বের অনস্বীকার্য সত্যকে স্বীকৃতি দেওয়া আরও সহজ হবে, যার সরকার তার জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি, এবং এই ব্যবস্থা যেটি প্রত্যাশা করে সেটি তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে— বর্তমানে বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তাইওয়ান প্রদেশ নিয়ন্ত্রণকারী একটি গ্যাং, যাদের দ্বারা প্রদেশটি  দখল করা হয়েছে।

জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধিত্বের সমস্যাটিকে কোনওভাবেই এই সংস্থায় নতুন অন্তর্ভুক্তির সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, বিষয়টিকে বরং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের বৈধ অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা অবশ্যই ‘দুই চীনা নীতির’ চক্রান্তকে শক্তিশালীভাবে প্রত্যাখান করব। তাইওয়ানের চিয়াং কাইশেক গ্যাং জাতিসংঘে থাকতে পারে না। আমরা যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি, আমরা তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই, তা হল দখলদারকে বহিষ্কার করা এবং চীনা জনগণের বৈধ প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

জাতিসংঘে চীনের বৈধ প্রতিনিধিত্ব নিয়ে মার্কিন সরকারের ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন’-এর বিরুদ্ধে আমরা আমাদের অবস্থান ব্যক্ত করে তাদেরকে সতর্ক করছি— তারা মূলত দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতি এবং তাদের ভোট দানের বিষয়টিকে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত করা প্রকৃতপক্ষে সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তবে জাতিসংঘের কাঠামোর জন্য নয়— এক্ষেত্রে প্রশ্নটা শুধু নিয়ম রক্ষার। এভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। ন্যায়বিচার অর্জনের মতোই এটা গুরুত্বপূর্ণ, এবং সর্বদা এটা প্রদর্শিত হবে যে, এই অগাস্ট অ্যাসেমব্লির দেখার মতো চোখ রয়েছে, শোনার মতো কান রয়েছে, কথা বলার মতো জিহ্বা রয়েছে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথাযথ মানদণ্ড রয়েছে। ন্যাটোর সদস্য দেশগুলির মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার এবং বিশেষত ফেডারেল রিপাবলিক জার্মানি কর্তৃক গণ বিধ্বংসী এই ডিভাইসগুলির দখল নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত একটি চুক্তির সম্ভাবনাকে আরও কঠিন করে তুলবে, এবং এই জাতীয় চুক্তির সাথে জার্মানির শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলনের সমস্যাটিও যুক্ত হয়ে গেল। যতক্ষণ পর্যন্ত না স্পষ্ট কোনো বোঝা পড়ায় পৌঁছানো যায়, ততক্ষণ দুটি জার্মানির অস্তিত্বকেই স্বীকৃতি দিতে হবে: এটি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং আরেকটি ফেডারেল প্রজাতন্ত্র। জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র অধিকারের সকল বিষয়গুলো মাথায় রেখে আলোচনায় এগিয়ে আসলেই কেবল জার্মান সমস্যার সমাধান হতে পারে। আমরা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রশ্নগুলিতেই আলোচনা করব যা বর্তমান এজেন্ডায় বিস্তৃতভাবে করা হয়। এই বছরের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত জেনেভা কনভেনশনে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে নির্ভর দেশগুলোর দুর্ভাগ্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতিনিধি দলের সতর্কতা এবং পূর্বাভাস সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়েছিল সে সভার আলোচনায়।

কিউবার উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বিষয়টি আমরা তুরে ধরতে চাই— আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সেই সম্মেলনের থেকে নেওয়া সুস্পষ্ট সুপারিশগুলি কার্যকর করেনি, এবং সম্প্রতি মার্কিন সরকার কিউবায় ওষুধ বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। এটা করে তারা বরং নিজেদেরকেই বেশি বঞ্চিত করেছে, মানবতার মুখোশ পরে এরা কিউবার জনগণের কাছে যে ছদ্মবেশটি ধারণ করার চেষ্টা করছিল সেটি খসে পড়েছে।

অধিকন্তু, আমরা আরও একবার বলেছি যে, জনগণের বিকাশের পথে বাধাগুলি এবং ঔপনিবেশিকতাবাদ দ্বারা রচিত চিহ্নগুলি কেবল রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রকাশিত হয়নি— বাণিজ্য নীতির তথাকথিত শিথিলকরণের বিষয়টি কাঁচামাল উৎপাদনকারী এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অসম বিনিময় চুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়, এই নীতি বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে এবং যা মূল্যবোধের সমান এবং সমান্তরাল চর্চার ক্ষেত্রে  ন্যায়বিচারের মায়জাল রচনা করে।

অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল জনসাধারণ যতক্ষণ না পুঁজিবাদীদের দখলকৃত বাজার থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হতে না পারবে,  শোষক ও শোষীতের মধ্যে কোনো নতুন সম্পর্ক চাপিয়ে দিলেও প্রকৃতপক্ষে কোনও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে না।

বিশিষ্ট প্রতিনিধিবৃন্দ, পরিশেষে এটি অবশ্যই স্পষ্ট করে দিতে হবে যে, ক্যারিবীয় অঞ্চলে, কিউবার বিরুদ্ধে, সর্বোপরি নিকারাগুয়ার উপকূলে, কোস্টারিকায়, পানামা খাল অঞ্চলে, পুয়ের্তো রিকোর ভাইকস দ্বীপে, ফ্লোরিডা এবং মার্কিন সীমান্তের অন্যান্য অঞ্চলে এবং সম্ভবত হন্ডুরাসও রণকৌশল এবং আগ্রাসনের প্রস্তুতি চলছে। এই জায়গাগুলিতে কিউবার দালাল সৈন্যরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, একইসাথে অন্যান্য দেশের দালাল সৈনরাও প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, এবং এটা অবশ্যই কোনো শান্তির লক্ষ্যে নয়। একটি বড় কেলেঙ্কারির পরে, এটা বলা হয় যে, কোস্টারিকা সরকার কিউবা হতে নির্বাসিত সৈনিকদের সমস্ত প্রশিক্ষণ শিবির বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছে।

কেউই এটা জানে না যে, তাদের এই অবস্থানটি আন্তরিক নাকি প্রবঞ্চনামূলক, কারণ সেখানে ভাড়াটে প্রশিক্ষণার্থীরা কিছু অপকর্ম করতে চলেছিল। আমরা আশা করি আগ্রাসনের সে ঘাঁটিগুলো সম্পর্কে আরও ভালোভাবে খোঁজখবর করা হবে। অনেক আগেই আমরা নিন্দা করেছিলাম— বিশ্ব এমন একটি দেশের সরকারের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব বিবেচনা করবে, যারা কিউবা আক্রমণ করার জন্য ভাড়াটে সৈনিকদের প্রশিক্ষণের অনুমোদন দেয় এবং সহায়তা করে।

আমাদের লক্ষ্য করা উচিত যে, ক্যারিবীয় অঞ্চলে ভাড়াটেদের প্রশিক্ষণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের এই ধরনের ক্রিয়াকলাপে অংশ নেওয়ার সংবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রগুলিতে খুব স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় একটি বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত হয়। আমরা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এমন কোনও কণ্ঠস্বরের কথা জানি না যারা আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রতিবাদ করেছে। এটি সেই ঘৃণাকেই প্রতিষ্ঠিত করে যার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার থাবা প্রদর্শন করে।

আমেরিকান রাষ্ট্রসংঘের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে কিউবার প্রতি এবং যদিও বা তিনি ভেনেজুয়েলাতে ইয়াঙ্কি সৈন্যদের অস্ত্র মহড়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন, কিন্তু আক্রমণের জন্য আড়ালে আমেরিকার যে প্রস্তুতি সেটি তারা দেখে না, যেমন তারা প্রেসিডেন্ট কেনেডির বক্তব্য শোনে না— প্লেয়া জিরনে সুস্পষ্টভাবে তিনি নিজেকে কিউবার জন্য একজন আক্রমণকারী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে ল্যাটিন আমেরিকার শাসক শ্রেণিদের দ্বারা আমাদের বিরুদ্ধে অন্ধভাবে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। অন্য ক্ষেত্রে— এবং এগুলো আরও বেশি বেদনাদায়ক— এইসব জমকালো এবং ঘৃণ্য প্রদর্শনী প্রকৃতপক্ষে দুবৃত্তের সম্পদের পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

ক্যারিবীয় অঞ্চলে তীব্র সংঘাতের সময়ে যেটি তথাকথিত ক্যারিবীয় সঙ্কট হিসেবে চিহ্নিত— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কিছু প্রতিশ্রুতি দ্বারা আবদ্ধ হয়েছিল। চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের অস্ত্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরামহীন আগ্রাসন প্রত্যাহার করার কথা ছিল, যেমন: প্লেয়া জিরনে ভাড়াটে সৈন্যদের দ্বারা আক্রমণ এবং আমাদের স্বদেশের বিরুদ্ধে আক্রমণের হুমকি অব্যহাত রাখা— বৈধ এবং অপরিহার্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে  কিউবাতে আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছিল।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে দিয়ে আমাদের অঞ্চলটি পরিদর্শন করানোরও চেষ্টা করেছিল। তবে জোরের সাথে আমরা তা প্রত্যাখান করেছিলাম, যেহেতু কিউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সে অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না, এমনকি কিউবা তার নিজ ভূখণ্ডে কতটা অস্ত্র মজুদ করেছে সেটি দেখার ক্ষেত্রে অন্য কারও অধিকারকেও স্বীকৃতি দেয় না।

এই প্রসঙ্গে আমরা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের জন্য সমান বাধ্যবাধকতার নিয়ম এবং কেবল বহুপাক্ষিক চুক্তি মেনে চলব। ফিদেল কাস্ত্রো যেমন বলেছেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত সার্বভৌমত্বের ধারণাটি কয়েকটি জাতি এবং স্বতন্ত্র কিছু লোকের অধিকার হিসেবে বিবেচিত থাকে, যতক্ষণ না তা সকল মানুষের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, আমরা আমাদের অধিকারকে সেই অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করব না। যতক্ষণ না পৃথিবী সেই সকল নিয়ম নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়, যতক্ষণ না পৃথিবী সেই সার্বজনীন তত্ত্বগুলি দ্বারা পরিচালিত হয় যেগুলোর সার্বজনীন বৈধতা রয়েছে, কারণ, এগুলো সার্বজনীনভাবে গৃহীত এবং জনগণের দ্বারা স্বীকৃত, আমার সে সকল অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করার প্রচেষ্টাকে গ্রহণ করব না, এবং আমরা এই অধিকারগুলোর কোনোটিই ত্যাগ করব না।” জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট নিশ্চয়ই আমাদের যুক্তিগুলো বুঝতে পেরেছিলেন। তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন পূর্বনির্ধারিত, স্বেচ্ছাচারী এবং অবৈধ কতৃত্ব স্থাপন করার চেষ্টা করেছিল: একটি ছোট দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল।

সুতরাং সম্পূর্ণ দায়মুক্তি সহকারে আমাদের আকাশপথ দিয়ে মার্কিন ইউ-২ বিমান এবং অন্যান্য ধরনের গুপ্তচর বিমানগুলিকে উড়ে যেতে দেখি। আমরা আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় সতর্কতা তাদেরকে দিয়েছি, পাশাপাশি গুয়ান্তানামো অঞ্চলে আমাদের সেন্ড্রি পোস্টগুলির বিরুদ্ধে মার্কিন নৌবাহিনীর উস্কানি বন্ধ করার জন্যও বলেছি, আন্তর্জাতিক জলসীমায় আমাদের জাহাজ এবং বিভিন্ন দেশের জাহাজের চলাচল নির্বিঘ্ন করা, বিভিন্ন দেশের জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমণ এবং আমাদের দ্বীপে গোয়েন্দগিরি, নাশকতা এবং অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটানো বন্ধ করার কথা বলেছি।

আমরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা ঘোষণা দিয়েছি যে, যারা শান্তির জন্য সংগ্রাম করে আমরা তাদের সমর্থক। আমরা জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সাথে নিজেদের যুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়েছি। যদিও আমরা মার্কস এবং লেনিনবাদী, কিন্তু আমরা মনে করি জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোও সম্রাজবাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের লড়াইয়ে নিয়োজিত রয়েছে। আমরা শান্তি চাই। আমরা আমাদের জনগণের জন্য একটি সুন্দর জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই। একারণেই আমরা যতটা সম্ভব ইয়াঙ্কিদের উস্কানির ফাঁদে পড়া থেকে বিরত থেকেছি। তবে তাদের পরিচালনাকারী কতৃপক্ষের মানসিকতা আমরা জানি। প্রত্যাশিত শান্তির জন্য তারা আমাদের দিয়ে খুব বেশি মূল্য দেওয়াতে চায়। আমরা এই বলে জবাব দিয়েছি যে, দরকষাকষি মর্যাদার সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে না।

এবং কিউবা আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে, নিজ ভূখণ্ডে অস্ত্র মজুদ রাখার অধিকার তার রয়েছে, এবং কিউবা এক্ষেত্রে পৃথিবীর যেকোনো শক্তিকে অস্বীকার করতে চায়— আমাদের স্থলসীমা, জলসীমা এবং আকাশসীমা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কে কতটা শক্তিশালী এখানে তা বিবেচনার বিষয় নয়।

এ ধরনের সমাবেশ থেকে কিউবা যদি সম্মিলিত প্রকৃতির কোনো দায়বদ্ধতা স্বীকার করে, এটা লিখিতভাবে সবাইকে জানানো হবে। যতক্ষণ না সেটি ঘটছে ততক্ষণ পর্যন্ত কিউবা অন্য সবার মতো তার সমস্ত অধিকার সংরক্ষণ করবে। সম্রাজ্যবাদের দাবির মুখে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ক্যারিবীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। সেগুলো হলোঃ

১. আমাদের দেশের বিরুদ্ধে এবং বিশ্বের সমস্ত অঞ্চলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ এবং সমস্ত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যচর্চা বন্ধ করে দেওয়া।

২. সমস্ত ধরনের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ, আকাশ এবং সমুদ্রপথে অস্ত্র এবং বিস্ফোরক অবতরণ বন্ধ করতে হবে।

৩. আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং পুয়ের্তো রিকোতে বিদ্যমান ঘাঁটি থেকে জলদস্যুদের আক্রমণ থামাতে হবে।

৪. আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিমান এবং যুদ্ধজাহাজ দ্বারা আমাদের আকাশসীমা এবং আমাদের আঞ্চলিক জলসীমা লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে।

৫. গুয়ান্তানামো নৌ ঘাঁটি  প্রত্যাহার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে থাকা কিউবান অঞ্চল ফিরিয়ে দিতে হবে।

এই প্রাথমিক দাবিগুলির কোনওটিই মেটেনি, এবং আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে এখনও গুয়ান্তানামোর নৌ ঘাঁটি থেকে উস্কানি দিচ্ছে। এই ঘাঁটিটি চোরদের একটি বাসা এবং তাদের জন্য আমাদের অঞ্চলটিকে একটি লঞ্চিং প্যাডে পরিণত করেছে। আমরা যদি এই সমাবেশকে বিষাদময় করে থাকি তবে আমরা বিপুল সংখ্যক উস্কানির একটি বিশদ বিবরণ দিতে চাই। এটি বলার অপেক্ষা রাখে যে ডিসেম্বরের প্রথম দিনগুলি সহ এই সংখ্যাটি কেবলমাত্র ১৯৬৪ সালেই ১৩২৩ বার।  তালিকাটিতে সীমানা রেখা লঙ্ঘনের মতো ছোটখাটো উস্কানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে কিছু নিক্ষেপ, উভয় লিঙ্গের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মীদের দ্বারা যৌন প্রদর্শনীজনিত ক্রিয়াকলাপ, এবং মৌখিক অবমাননা —এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় আরও গুরুতর যে বিষয়গুলি রয়েছে— যেমন ছোট ক্যালিবারের অস্ত্র থেকে গুলি চালানো, আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করা এবং আমাদের জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে অপরাধ। চরম মারাত্মক উস্কানির মধ্যে রয়েছে কিউবার সীমানা লাইনটি অতিক্রম করা এবং স্থাপনাগুলোতে আগুন লাগানো, সেইসাথে রাইফেল হতে ফায়ার করা। এ বছর এ পর্যন্ত ৭৮ বার রাইফেলের গুলি চালানো হয়েছে, তাতে একজন মৃত্যুবরণও করেছে: উত্তর সীমান্তে উপকূল থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে মার্কিন পোস্ট থেকে চালানো গুলিতে বিদ্ধ হয়ে রামন ল্যাপেজ পেঁয়া নামে একজন সৈনিক নিহত হয়েছেন। এই মারণিক উস্কানির ঘটনাটি ঘটেছিল সন্ধ্যা ৭:৭ টায়, ১৯ জুলাই ১৯৬৪ তারিখে, এবং আমাদের সরকারের প্রধানমন্ত্রী ২৬ জুলাই প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, এরকম কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে তিনি আমাদের সৈন্যদের আগ্রাসন ঠেকানোর নির্দেশ দেবেন। একই সময়ে সীমানা রেখা থেকে আরও দূরে অবস্থান নেওয়ার জন্য কিউবান বাহিনীকে ফরোয়ার্ড লাইন হতে প্রত্যাহারের আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং প্রয়োজনীয় দুর্গ নির্মাণ করতে বলা হয়েছিল। এক হাজার তিনশ তেইশটি উস্কানির ঘটনা ৩৪০ দিনের মধ্যে ঘটেছে— প্রতিদিন প্রায় চারটি পরিমাণ। কেবলমাত্র একটি নিখুঁত শৃঙ্খলাবদ্ধ সেনাবাহিনী তার আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারানো ছাড়াই আমাদের মতো মনোবল নিয়ে এতগুলি উস্কানি প্রতিহত করতে পারে।

জোট নিরপেক্ষ ৪৭ টি দেশ দ্বিতীয় অধিবেশন থেকে অকুণ্ঠভাবে এ বিষয়গুলিতে একমত হয়েছিলঃ

উদ্বেগের সাথে উল্লেখ করা হয় যে, বিদেশী সামরিক ঘাঁটিগুলি বাস্তবে জাতিসমূহের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে এবং তাদের মুক্তি ও সে সকল বিকাশকে প্রতিহত করার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা তাদের নিজস্ব মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, এই সম্মেলন উদারভাবে সেসব দেশের প্রতি সমর্থন জানাতে চায় যারা তাদের ভূখণ্ড থেকে বিদেশী ঘাঁটিগুলোকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছুক এবং সমস্ত এ ধরনের দেশগুলোকে আমরা অনুরোধ করব যাতে তারা অন্য দেশে সেনা ও ঘাঁটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করে। সম্মেলনে বিবেচনা করা হয়েছে যে, গুয়ান্তানামো (কিউবা) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির রক্ষণাবেক্ষণ— এটি কিউবার সরকার ও জনগণের সদিচ্ছার বিরোধিতা এবং বেলগ্রেড সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে সম্মত বিধানগুলিকে অমান্য করে, কিউবার সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘন করে।

উল্লেখ করা হয় যে, কিউবার সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গুয়ান্তানামোতে ঘাঁটি নিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে তার বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, সম্মেলনটি মার্কিন সরকারকে তাদের ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং কিউবান সরকারের সাথে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কায়রো সম্মেলনের এই অনুরোধের জবাব দেয়নি এবং আমাদের অঞ্চলটির কিছু অংশ দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে এবং জোর করে দখল বজায় রাখার চেষ্টা করছে, এখান থেকে তারা আক্রমণাত্মক কার্যকলাপগুলো পরিচালনা করে যেগুলো বিশদভাবে উল্লিখিত হয়েছে।

দ্যা অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস্— যাকে লোকেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রীদের উপনিবেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে— যদিও আমাদের তারা সরিয়ে রেখেছিল, তবুও ‘শক্তিশালীভাবে’ আমাদের নিন্দা করেছে, তার সদস্য দেশগুলোকে কিউবার সাথে সকল ধরনের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে। যে কোনও অজুহাতে এবং যে কোনও পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে ওএএস স্বীকৃত আগ্রাসনগুলো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে এবং জাতিসংঘকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা। উরুগুয়ে, বলিভিয়া, চিলি এবং মেক্সিকো তাদের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকোর ওপর যে অবরোধগুলো আরোপ করেছিল মেক্সিকো সেগুলো মানতে অস্বীকার করেছিল। সেই থেকে মেক্সিকো ছাড়া লাতিন আমেরিকার কোনও দেশের সাথে আমাদের কোনও সম্পর্ক ছিল না, এবং এটি সম্রাজ্যবাদ দ্বারা কোনো দেশে সরাসরি আগ্রাসনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলির একটি পূরণ করে।

আমরা আবারও স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, লাতিন আমেরিকা নিয়ে আমাদের উদ্বেগ সেই সম্পর্কগুলোর ভিত্তিতে যা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে: আমরা যে ভাষায় কথা বলি, যে সংস্কৃতি আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করি এবং আমাদের মধ্যে যে সাধারণ উৎকর্ষ ছিল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক জোয়াল থেকে লাতিন আমেরিকাকে মুক্ত করতে চাওয়ার আমাদের আর কোনও কারণ নেই। এক্ষেত্রে যদি লাতিন আমেরিকার কোনও দেশ কিউবার সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা সাম্যতার ভিত্তিতে এটি করতে ইচ্ছুক হব এবং কোনো ধরনের স্বীকৃতি ছাড়াই আমাদের সরকারের কাছে কিউবাকে একটি মুক্ত স্বাধীন দেশ হিসেবে উপহার দিতে সমর্থ হব। আমরা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে রক্ত ​​দিয়ে সেই স্বীকৃতিটি অর্জন করেছিলাম। আমাদের উপকূল রক্ষায় ইয়াঙ্কি (আমেরিকান) সৈন্যদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে এ স্বীকৃতি আমরা অর্জন করেছিলাম।

যদিও আমরা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নীতি প্রত্যাখান করি, তবে সেসব মানুষের প্রতি আমাদের সমর্থন আমরা অস্বাীকার করতে পারি না, যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। আমাদের অবশ্যই আমাদের সরকারের বাধ্যবাধকতা রক্ষা করতে হবে এবং আমাদের জনগণ সুস্পষ্ট এবং সুনিশ্চিতভাবে এটা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেবে যে, জাতিসংঘ সনদে ঘোষিত পূর্ণ সার্বভৌমত্বের অধিকারকে বাস্তবায়িত করার জন্য যারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় লড়াই করছে এমন জনগণের প্রতি আমাদের নৈতিক সমর্থন এবং একাত্মতা থাকবে।

এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা হস্তক্ষেপ করে। লাতিন আমেরিকায় ঐতিহাসিকভাবে তারা এটি করেছে। গত শতাব্দী শেষ হওয়ার পর থেকে কিউবা এই সত্যটি অনুভব করেছে; শুধু কিউবা নয়, এই সত্যটি অনুভব করেছে ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া, মধ্য আমেরিকার সকল দেশ, মেক্সিকো, হাইতি এবং ডোমিনিকান রিপাবলিক। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, আমাদের জনগণের কথা বাদ দিলেও পানামা প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, পানামা খালে ঘাঁটি গাড়া মেরিন সেনারা প্রতিরক্ষাহীন মানুষের ওপর ঠাণ্ডা মাথায় গুলি চালিয়েছিল; রাফায়েল ট্রুজিলোকে হত্যার ফলে ফুঁসে ওঠা জনগণকে মোকাবেলা করতে ইয়াঙ্কি সৈন্যরা বারে বারে ডোমিনিকান রিপাবলিকের জলসীমা লঙ্ঘনের অপরাধ করেছে; গাইতানকে (কলম্বিয়ার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা জর্জ এলিয়েচার গাইতান) হত্যার ফলে কলোম্বিয়ার রাজধানী ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার সম্মুখিন হয়েছিল। গোপন হস্তক্ষেপগুলি সামরিক মিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যারা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে অংশগ্রহণ করে, অনেক দেশে এই উদ্দেশ্যে এরা বিশেষ বাহিনী সংগঠিত করে, এবং সামরিক অভ্যুত্থানের সাম্প্রতিক বছরগুলিতেও লাতিন আমেরিকা মহাদেশে এর ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। স্পষ্ট করে বলতে— মার্কিন বাহিনী ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া এবং গুয়াতেমালার জনগণের ওপর দমন-পীড়নে হস্তক্ষেপ করেছিল, যারা তাদের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র নিয়ে লড়াই করছিল। ভেনিজুয়েলায় মার্কিন সেনারা কেবল সেনাবাহিনী ও পুলিশকেই পরামর্শ দিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি, তারা বিদ্রোহী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষক জনগোষ্ঠীর উপর আকাশ থেকে গণহত্যা পরিচালনারও সরাসরি নির্দেশ দেয়েছিল। এবং সেখানে পরিচালিত ইয়াঙ্কি ঘাঁটিগুলো প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ বাড়াতে সকল ধরনের চাপ প্রয়োগ করে। সম্রাজ্যবাদীরা আমেরিকার (লাতিন আমেরিকা) জনগণকে দমন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং অপরাধের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করছে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকায় হস্তক্ষেপ করে নিখরচায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিরক্ষা করার জন্য। সময় আসবে যখন এই সংস্থা অধিকতর পরিপক্কতা অর্জন করবে এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এই আহ্বান জানাবে যাতে তাদের সরকার তাদের দেশে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ এবং লাতিন আমেরিকানদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা দেয়, এরা সবাই আসলে আমেরিকারই নাগরিক সেটি আদিনিবাস হিসেবে হোক আর গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে হোক।

যারা নিজের বাচ্চাদের হত্যা করে এবং তাদের ত্বকের রঙের কারণে প্রতিদিন তাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে; যারা কৃষ্ণাঙ্গদের খুনিদের মুক্ত থাকতে দেয়, তাদের সুরক্ষা দেয়, এবং তদুপরি কৃষ্ণাঙ্গ জনগণকে শাস্তি দেওয়া হয়, কারণ তারা মুক্ত মানুষ হিসেবে তাদের বৈধ অধিকারের দাবিতে লড়াই করতে চায় —যারা এই কাজগুলো করে তারা কীভাবে স্বাধীনতার অভিভাবক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে? আমরা বুঝতে পারি যে, আজকের এই সভা এসবের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করার মতো অবস্থানে নেই। এটা অবশ্যই পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন নয়, তারা বরং বিশ্বের মানুষের বিরুদ্ধে এবং তার নিজস্ব জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশের বিরুদ্ধে শোষণ-নিপীড়নের অপরাধে অপরাধী।

অনেক প্রতিনিধি কিছু দ্ব্যার্থবোধক ভাষায় কিউবা এবং আমেরিকান রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা বর্ণনা করেছেন, আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শব্দ দিয়ে জবাব দিতে চাই এবং আমরা ঘোষণা করতে চাই যে, লাতিন আমেরিকার জনগণ তাদের পরাস্ত করবে, বিক্রীত সরকার তাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মূল্যে দিতে বাধ্য হবে।

বিশিষ্ট প্রতিনিধিবৃন্দ, কিউবা, একটি মুক্ত ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে, যার কোনো শৃঙ্খল নেই এবং এটি কারও কাছে আবদ্ধ নয়, কিউবার ভূখণ্ডে কোনো বিদেশী বিনিয়োগ নেই, কোনও বহিরাগত পরিকল্পনাবিদ কিউবার নীতি-পদ্ধতি প্রণয়ন করে না, এজন্য কিউবা এই সমাবেশে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারে এবং যে শব্দগুলো হৃদয়ে ধারণ করে কিউবা স্বাধাীন হয়েছিল:  “আমেরিকা অঞ্চলের মুক্ত স্বাধীন অঞ্চল।” আমাদের পথে মহাদেশের অন্যান্য দেশগুলোও হাঁটবে, ইতোমধ্যে গুয়েতেমালা, কলম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলা সে পথে কিছুটা হলেও হেঁটেছে।

সেখানে আর কোনও ক্ষুদ্র প্রতিপক্ষ বা তুচ্ছ শক্তি নেই, কারণ সেখানে আর কোনও বিচ্ছিন্ন লোক নেই। হাভানার দ্বিতীয় ঘোষণাপত্রে যেমন বলা হয়েছে:

লাতিন আমেরিকার কোনও জাতিই আর দুর্বল নয়— কারণ প্রত্যেকে তারা ২০০ মিলিয়ন সদস্যের একটি পরিবারের অংশ, যারা একই দুর্দশায় ভুগছেন, যারা একই অনুভূতি পোষণ করে, যাদের শত্রু একই, যারা একইভাবে আরও ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, এবং যারা বিশ্বের সকল সৎ পুরুষ এবং মহিলাদের সংহতি প্রত্যাশা করে।

আমাদের আগে এই মহাকাব্যটি ক্ষুধার্ত ভারতীয় জনসাধারণ লিখে গিয়েছেন— তারা ছিলেন জমিবিহীন কৃষক এবং শোষিত শ্রমিক। এটি প্রগতিশীল জনগণের দ্বারা লেখা হচ্ছে, সৎ ও উজ্জ্বল বুদ্ধিজীবী, যারা দক্ষিণ আমেরিকার দুঃখ দুর্দশার মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত রেখেছেন। জনগণ দ্বারা একটি আদর্শবাদী সংগ্রাম: একটি মহাকাব্য যা আমাদের লোকেরা এগিয়ে নিয়ে যাবে, সম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা দুর্ব্যবহার ও বদনামের শিকার হয়েও; আমাদের জনগণ, আজ অবদি যারা অবিচ্ছিন্ন থেকেছে, যারা এখন তাদের নিদ্রা ঝেড়ে ফেলতে শুরু করেছে। সম্রাজ্যবাদ আমাদের দুর্বল ও আজ্ঞাবহ পশুরূপে বিবেচনা করেছিল; তবে  তারা আমাদের কাফেলা দেখে আতঙ্কিত হতে শুরু করেছে; ২০০ মিলিয়ন লাতিন আমেরিকানদের একটি বিশাল কাফেলা যাদের দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া পুঁজিবাদের কবর রচনা হতে চলেছে।

এখন মহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তারা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সময়টা এসে গেছে— নজির স্থাপনের সময়। এখন এই বেনামী জনতা, বিভিন্ন বর্ণের আমেরিকা, অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং মিতভাষী আমেরিকা, সমস্ত আমেরিকা জুড়ে যারা একই দুর্দশার একই মোহমুক্তির গান গায়, এই জনগণ এখন নিশ্চিতভাবে নিজস্ব ইতিহাসে প্রবেশ করতে শুরু করেছে, এটা তারা এখন নিজেদের রক্ত ​​দিয়ে লিখতে শুরু করেছে, এর জন্য ভোগান্তি পোহাতে ও মরতে শুরু করেছে।

কারণ এখন আমেরিকার পাহাড় এবং মাঠে, সমতলভূমি এবং জঙ্গলে, প্রান্তরে বা শহরগুলির ট্র্যাফিকে, এর মহাসাগর বা নদীর তীরে, এই পৃথিবী এখন কাঁপতে শুরু করেছে। উদ্বিগ্ন হাতগুলি প্রসারিত, তারা অধিকারের জন্য মরতে প্রস্তুত, সেই অধিকারগুলি জিততে যেগুলি ৫০০ বছর ধরে শুধু উপহাসের বিষয় হয়েছে। হ্যাঁ, এই ইতিহাসে আমেরিকার দরিদ্রদের বিবেচনায় নিতে হবে, আমেরিকার শোষিত এবং অগ্রাহ্য মানুষ, যারা সর্বকালের জন্য তাদের ইতিহাস রচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে তারা রাস্তায় নেমে এসেছে, তারা পদযাত্রা করছে, অধিকার আদায়ের জন্য দিনের পর দিন শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে তারা সরকারি সে উদগমের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে।

দ্রুতই তাদের পাথর, লাঠি, চাপাতি ইত্যাদি অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত দেখা যেতে পারে, তাদের মাতৃভূমিতে নিমজ্জিত কাঁটা তুলতে এবং জীবন দিয়ে সে ভূমিকে রক্ষা করতে প্রত্যেক দিন তারা এদিক বা ওদিক থেকে একটু একটু করে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের দেখা যেতে পারে পতাকা হাতে গান গাইতে এবং স্লোগান দিতে; এ পতাকা পর্বতের চূড়ায় বা বিস্তির্ণ সমতল ভূমিতে ওড়াতে দিতে হবে। ন্যায়বিচারের দাবিতে, পদদলিত অধিকারের দাবিতে জেগে ওঠা ক্রোধের এ তরঙ্গ থামবে না যতক্ষণ না লাতিন আমেরিকা হতে সম্রাজ্যবাদীদের সাফ না করা যায়। প্রতিটি দিন শেষে ক্রোদের এ তরঙ্গ আরও স্ফিত হবে। যে তরঙ্গটি সর্বাধিক সংখ্যার সমন্বয়ে গঠিত, যেকোনো বিবেচনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ— তাদের নিয়ে যাদের শ্রমে ধন সম্পদ পুঁঞ্জিভূত হয়েছে এবং ইতিহাসের চাকা ঘুরেছে। তারা এখন তাদের দীর্ঘ পাশবিক ঘুম থেকে জেগে উঠেছে যে কারণে তারা এতদিন পদানত থেকেছে।

মানবতার এ বিশাল মিছিল বলতে শুরু করেছে, “যথেষ্ট হয়েছে!” এবং তারা পদযাত্রা শুরু করেছে। তাদের এ দৈত্যাকার ভ্রমণ শেষ হবে না যতক্ষণ না তারা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারছে— যার জন্য তারা একাধিকবার নিরর্থকভাবে মারা গেছে। তবে এ যাত্রায় যারা মারা যাবে তারা প্লেয়া জিরনে কিউবার মতো মারা যাবে। তারা তাদের সত্য এবং কখনও আত্মসমর্পণ না করা স্বাধীনতার জন্য মারা যাবে।

বিশিষ্ট প্রতিনিধিবৃন্দ, সবকিছুর শেষে— পুরো মহাদেশের এই জাগ্রত স্বপ্ন, হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র হাতকে পঙ্গু করার জন্য তাদের এ শপথ অকাট্য অভিব্যক্তি হিসেবে ঘোষিত হয় আমাদের জনগণের প্রতিদিনের ক্রুদ্ধ চিৎকারে। এটি এমন এক আত্মচিৎকার যা বিশ্বের সমস্ত মানুষের বোধগম্যতায় পৌচেছে এবং সমর্থন পেয়েছে।

আমাদের শপথঃ মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু।


ইংরেজি হতে অনুবাদ করেছেন দিব্যেন্দু দ্বীপ

Che Guavara
হত্যা করার পরদিন বলিভিয়ার ভালগ্রাডে হাসপাতালের লন্ড্রি ঘরে চে গুয়েভারার মৃতদেহ প্রদর্শন করা হয়। ছবি: ব্রাইড লেন লাইব্রেরি / পপারফোটো / গেট্টি ইমেজ
Next Post

জাতিগত নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে: হত্যা করা হয়েছে আরেক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক রেশার্ড ব্রুকসকে

জর্জ ফ্লয়েডে হত্যকাণ্ডের ঘটনা এবং বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভের রেশ কাটতে না কাটতেই ১২ জুন রেশার্ড ব্রুকস্ নামে একজন ৩৭ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে আটলান্টা পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টায় কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক রেশার্ড ব্রুকস্ হত্যার ঘটনায় গুলিবর্ষণকারী পুলিশ কর্মকর্তা গারেট রোলফের বিরুদ্ধে হত্যা ও লাঞ্ছনার অভিযোগ আনা […]
যুক্তরাষ্ট্র