কোলকাতায় তার বিভাগে বসে গবেষক ও সাংবাদিক দিব্যেন্দু দ্বীপের সাথে ঘণ্টাখানেক কথা হয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিজি হাসপাতালের একজন অধ্যাপক চিকিৎসকের সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে কেন অনেক মানুষ চিকিৎসা নিতে ভারতে যাচ্ছে —এমন প্রশ্নের সূত্র ধরে তিনি জানান যে, বিষয়টি শুধু চিকিৎসার নয়, আত্মতৃষ্টিরও। একইসাথে তিনি বাংলাদেশ এবং কোলকাতার চিকিৎসা ব্যবস্থায় সমস্যা রয়েছে বলেও জানান। চিকিৎসা দেওয়ার দীর্ঘ্য অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, রোগীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে অনেক সময় চিকিৎসককে অহেতুক সময় নষ্ট করতে হয়, এ কারণে প্রকৃতপক্ষেই যখন কোনো রোগীর প্রতি সময় দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন চিকিৎসকের হাতে আর সময় থাকে না, অথবা ধৈর্য্য থাকে না। বাংলাদেশ এবং কোলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র তুলে ধরে বলেন, এখানে যত রোগী আসে সবাই আসলে রোগ নিয়ে আসে না, আসে ছোটখাটো উপসর্গ নিয়ে, কিন্তু সবার প্রত্যাশা থাকে ডাক্তার বাবু তাদের অনেক সময় দেবেন, কিন্তু বাস্তবে কি সেটি সম্ভব? অনেক সময় রোগীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে ডাক্তার বাড়তি ওষুধ লেখেন বা পরীক্ষা-নীরীক্ষা দেন, ব্যবসা বা কমিশনের বিষয়টিও রয়েছে। অভিজ্ঞ এ চিকিৎসক বলেন, ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য একমুখীভাবে কাউকে দায়ী করার সুযোগ নেই। বিষয়টির অনেকগুলো মাত্রা রয়েছে। সাউথে, বিশেষ করে চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর এবং ভেলোরে বাংলা থেকে— কোলকাতা এবং বাংলাদেশ থেকে কেন এত রোগী যাচ্ছে —এ বিষয়ে তিনি বলেন, ভালো চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ওরা বাঙালির ‘আমিত্ব’-কে জয় করছে। ওখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে সবাই খুশি মেনে ফিরতে পারছে। পিজি হাসপাতালের একটি বিভাগের প্রধান ষাটোর্ধ এ চিকিৎসক বলেন, বাঙালি শুধু খেয়েপরে এবং প্রয়োজন মিটিয়ে সন্তুষ্ট নয়, বাঙালির মধ্যে এক ধরনের ইগো রয়েছে, ‘আমি’ রয়েছে, ওটাকেও সন্তুষ্ট করতে হয়, যেটি দুই বাংলার কোনো বাংলাই পারছে না। চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি বাংলার মানুষের এ ‘ইগো স্যাটিসফাই’ করতে পারছে না বলেই সাউথের সাথে বাংলা চিকিৎসা ব্যবসায় পেরে উঠছে না।
সবশেষে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে সমস্যা রয়েছে, একথা তিনি স্বীকার করেন। চিকিৎসা বাণিজ্যে পরিণত হওয়া, কর্পোরেট হাসপাতালের দৌরাত্ম, চিকিৎসকের স্বল্পতা, অতিরিক্ত রোগীর চাপ এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা আজকে বাঙলার চিকিৎসা ব্যবস্থা যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছে তার জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভালো ডাক্তার এবং ভালো চিকিৎসা নেই, এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। কোনো না কোনোভাবে রোগীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। রোগীদের মন জয় করার দায়িত্ব শুধু চিকিৎসকের নয়, ডাক্তারের সাথে যে আনুষঙ্গিক সেট-আপ থাকে, সেগুলো আরো ফাংসনলার হতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সেবামূলক হতে হবে, শুধু বাণিজ্যের মনোভাব নিয়ে নন-মেডিকেল পারসন যারা চিকিৎসা ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে, তারা চিকিৎসককেও পাত্তা দেয় না, রোগীকেও পাত্তা দেয় না, তাদের প্রয়োজন ব্যবসা। চিকিৎসকেরাও প্রাকটিস করার ক্ষেত্রে এদের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে কিনা তিনি প্রশ্ন তোলেন।
অবশেষে দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রাজনীতি নিয়ে কথা হয় প্রবীণ এ চিকিৎসকের সঙ্গে। তিনি দুই বাংলার ভাগ হয়ে যাওয়াটাকে দুর্ভাগ্যজনক বলেন। তিনি বলেন, বাঙালির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি বাংলাদেশ এবং কোলকাতা কোনো অংশই হয়ত আর রক্ষিত হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমরা একদিন আত্মপরিচয়হীন জাতিতে পরিণত হব বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। একইসাথে তিনি আশার কথাও বলেন— সমাজে দুবৃত্তরা যেভাবে একত্রিত হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে তাদের বদ করা সহজ হবে, ভবিষ্যতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো না কোনো একটি দল হাল ধরবে, সবকিছু সুন্দর হবে। প্রকৃতির নিয়ম চক্রাকার, কোনোকিছুই নিরবিচ্ছিন্নভাবে খারাপ বা ভালো নয়। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক এবং মানবিক ঐক্য দিনে দিনে আরো দৃঢ় হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।