“ওরা আমার বেডরুমে ক্যামেরা রেখেছিল”

বেডরুমে ক্যামেরা
আমি তিরিশের কোঠায় পা ফেলা একটা মানুষ। শিশু, বালিকা, তরুণী অথবা মহিলা— ঠিক জানি না।শারীরিক গঠন একটা মেয়ে মানুষের— আর এটা আমার এদেশে জন্ম নেবার আজন্ম পাপ। আমাকে আমার আব্বা একটুও পছন্দ করেন না, যেদিন জন্ম নিয়েছি সেদিন থেকে তিনি সবসময় আমার মৃত্যু কামনা করেন। ২০০৪ সালে একবার কীটনাশকের বোতল হাতে দিয়ে বলেছিলেন খেতে, আমি কেন জানি খাইনি। যদি সেদিন খেতাম তাহলে জীবনের তিন নম্বর পরীক্ষাটা দিতে হোতো না।
মাতাল নই, তবু মাথা থেকে হুবহু সত্য কথা বের হচ্ছে। ২০০৪ সাল আমার বয়স তখন ষোলো। ভাল করে ওড়না না পরলেও চলত। আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। তখন আমার অপেক্ষা দুটো জিনিসের জন্য— ২৬ জুন রেজাল্ট আর ৯ জুলাই আমার বিয়ে। তখন পাত্রপক্ষের দেয়া সোনার হার আমার গলায় চিকচিক করছে। ভাবা যায় কত বড়লোক বাড়ীতে আমার বিয়ে হচ্ছে!
বিয়েটাতে আমার মনের কোনো ভূমিকা ছিল না, পরিবারই সব। এমনকি সামান্য অনুভূতিও আমার কাজ করেনি। আমার বিয়ে দেয়া হয় আমাদের বাড়ীর খুব নিকটে— এ পাড়া ও পাড়া। আমাদের বাড়ীর দোতলা ঘরের উত্তরের জানালা খুললে এখনো তাদের বাড়ীর পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা যায়। কত নিকট অথচ আমি জানি না যে মানুষটার সাথে আমার বিয়ে দেয়া হচ্ছে সে কী করে সে দেখতে কেমন।
বিয়েটা কোনো একটা ঝামেলার জন্য ভেঙে যাচ্ছিল, আমার আব্বা পাত্রের হাত ধরে আমার বিয়ে দেয়। কেননা অনেক মানুষকে দাওয়াত করা হয়ে গেছে। একথাও পরিবারে আলোচনা হচ্ছিল ওখানে না হলে আরো ছেলে খোঁজা হোক। ৯ জুলাই বিয়ে দিতেই হবে। যে কোনো একটা ছেলে হলেই হবে।বিয়ে হলো শেষমেশ ওখানেই। সেদিন কিছু বুঝিনি, খুব আয়োজন আর ধুমধামের বিয়ে— বাপ মা বাঁচল। তাদের স্বপ্ন পূরণ তো করলাম।
বিয়ের আয়োজন চলা অব্দি স্বামী নামের মানুষটার দিকে তাকাইনি। স্বাভাবিকভাবে শ্বশুরবাড়ী যাওয়া হোলো, তখনও আমার কোনো পরিবর্তন নাই। কিছু সময় পর তিনি আসলেন। মানুষটাকে এক পলক দেখলাম, ভালো লাগল না, গলার স্বর ভালো লাগল না, তিনি হাসলেন— আমার তাও ভালো লাগল না। ভালো লাগল না তো লাগলোই না।

কিছুদিন অভিনয় করে চলতে লাগলাম—এমন অভিনয় যা অস্কার পাওয়ার মতো। কাউকে বোঝাতে পারলাম না সেই সময়ের কথাগুলো। আল্লাহকে ডাকলাম যত চোখের পানি আছে সব নিবেদন করে—সাড়া পেলাম। কিছুদিন পর বিচ্ছেদ। মুক্তির স্বাদ পেলাম। ভাবছেন খুব ভালো হোলো, না আমার গোটা পরিবারে যেটা নাই, সেটা কেউ মানতে পারল না।

আব্বার অসহনীয় কথা যখন তখন গায়ে হাত তোলা আমাকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিচ্ছিল। একটু মুক্তি পেলাম, আজ যে চাকরিটা করি—পড়ার সুযোগ পেলাম মায়ের চেষ্টায়, আল্লাহর ইচ্ছায়। বাড়ী থেকে অনেক দূরে হোস্টেলে থাকতাম। ভেবেছিলাম আর কোনো বন্ধনে জড়াব না। কিন্ত হলো না। ২০০৭ সালে আবারও জড়িয়ে গেলাম—যে ছেলেটা আমাকে ২০০১ সাল থেকে পছন্দ করতো  তার সাথে। আবার পারিবারিকভাবে বেশ ঝামেলার বিয়ে হলো।
যাইহোক, বিয়ে হলো বলে খুশি ছিলাম। প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসতে লাগলাম— এবং সেও। বেশিদিন থাকলো না সে ভালবাসা। তাঁর বিভিন্নরকম প্রতারণা, মিথ্যে কথা এবং আরো অনেক কারণে মন উঠে যাচ্ছিল। তাঁর বিরহ আমাকে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে লাগল। আল্লাহকে বললাম ওর ওপর থেকে ভালোবাসা মমতা আমার মন থেকে উঠিয়ে দাও। তিনি আমার কথা শুনলেন।
আমি একটা মোটামুটি ভাল চাকরি করি, চাকরিটা আমার নিজ জেলায় বদলি করি। সদর হাসপাতালে যোগদান করি। খুব ভালো কাটছিল দিনগুলো। শহরে বাসা নিলাম, ছেলেটাকে ভালো স্কুলে দিলাম, হাসপাতালেও ভালো সুনাম হলো। সবাই ম্যাডাম বলত। হঠাৎ ‘বেশ্যা’ ডাকটাও জুটে গেল। 
হুট করে খুঁজে পাওয়া আমার কলেজ বন্ধু ভালোবেসে আমাকে পাগল বানিয়ে দিল। শরীর-মন সব সঁপে দিলাম। ও আমার বাসায় হুটহাট চলে আসত। অনেক নিষেধ উপেক্ষা করেও। এটা পরকীয়া এবং অবশ্যই তা খারাপ— সমাজ এবং ধর্মমতে। অবশ্য শুধু জানাজানি হলে খারাপ। এটাও বুঝি যে মানব সমাজে এসব ছিল, আছে এবং থাকবে।
 

ভালো সাজার জন্য বলছি না, সত্য হলো— আমি অনেক চেষ্টা করেও ওই পাগল ক্ষ্যাপাটাকে আটকাতে পারলাম না। তার নাকি যেভাবেই হোক আমাকেই চাই। আমি বেশ কঠিন তবু তাকে উপেক্ষা করতে পারলাম না। আমি নিছক শারিরীক প্রয়োজনে ওর সাথে মিশিনি। কী যেন একটা ছিল। আমার স্বামীর শারীরিক অক্ষমতাই শুধু আমাকে ওর কাছে নিয়ে যায়নি— ভাগ্যও তো দায়ী ছিল।

বুক ফাটা কষ্ট এটাই— আমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও করল এবং তা আমার হসপিটাল স্টাফ থেকে শুরু করে সবাইকে দেয়া হলো। যে বাসায় থাকতাম তার সাথেই সন্মুখে একটা ডায়াগনস্টিক ল্যাব ছিল, যারা মুখে অনেক ভালো ব্যাবহার করতো— তাদেরকে আমি সর্বাত্মক সাহায্য করেছি সবসময়, কিন্ত তাঁদের কাছ থেকে এমনটা কল্পনাও করিনি। আমার বেড রুমে ওরা ভিডিও ক্যামেরা রেখেছিল। ঘটনার কিছুদিন আগে আমার বাসার চাবি হারিয়ে গেছিল, তবু সরলমনে ঐ তালাটাই ব্যবহার করতাম— জানি না ওটা ওরা ব্যবহার করেছিল কিনা।
মুখে এতো ভালো ব্যবহার করতো অথচ ওদের ভেতরটা বুঝিনি— আসলে কাউকেই বোঝা যায় না। তবে এটুকু জানতাম সত্য একদিন সামনে আসবেই, এলোও। কিন্ত এতটা নোংড়াভাবে আসবে ভাবতে পারিনি। জানতে পারলাম ওরা অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছিল, ওদের প্রচেষ্টা সার্থক হলো।
ওরা আমাদের জিম্মি করল। তিন লাখ টাকার বিনিময়ে ভিডিওটা ডিলিট করবে বলে জানাল। কাউকে আর জানাবে না বলে বলল। মাথায় কিছু কাজ করছিল না। এদিকে ভদ্র সমাজ খুব মজার একটা টপিক পেল। কতটা ভেঙে পড়লাম— বোঝানোর মত শব্দ আমার আসছে না। জানি না এটাকে কোন আঙ্গিকে কে কীভাবে বিচার করবে । আমার তখন কে স্বামী আমি বুুঝতে পারছিলাম না— একজন সমাজ স্বীকৃত অন্যজন মন স্বীকৃত। কাউকে বলার মতো অবস্থায় তখন ছিলাম না। কারো সাহায্যপ্রত্যাশাও করলাম না।
শেষ পর্যন্ত কিছুই কারো জানতে বাকি থাকলো না। হাটে হাড়ি ভাঙার মতো অবস্থা হলো। বাকি দিনগুলো চোখের উপর দিয়ে ভেসে গেলো। বাড়ী সমাজ সবার কাছ থেকে আজ অনেকটা নির্বাসিত। নিজের অস্তিত্ব সবার কাছ থেকে আড়াল করেছি। তবুও কি ভাল আছি? ‘স্বামী’ নামের জিনিসটা খুব বিভ্রান্তিকর হয়েছে আমার জন্য। শুধু নিজের সন্তানটাকে আগলে আর চাকরিটাকে সম্বল করে বেঁচে আছি।
মসুলমান মেয়ে আমরা দাসীর জাত। স্রষ্টা আমাদের প্রয়োজনে আমাদের সৃষ্টি করেননি। পুরুষের প্রয়োজনে তার বাম পাঁজড়ের হাড় থেকে অতি দূর্বল করে বানিয়েছেন। আমার ক্ষেত্রে কিন্ত বিষয়টা কনফিউজিং— আমি কীসের থেকে তৈরী? ধর্মকে দোষারোপ করে লাভ নেই জানি। কিন্তু এটাও তো সত্য— পুরুষেরা ধর্মের অজুহাতে একসাথে অনেকগুলো বিয়ে করে রাখতে পারে, তারা কারো সাথে হাজারবার শুলেও দোষ তেমন নেই। মেয়েদের বেলায় সব বেইজ্জতি। মেয়েরা বাইরে না বেরিয়ে অন্তঃপুরে থাকলেই বেশ হোতো। বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্ন।

ভৈরবী (ছদ্মনাম)

লেখক একজন চিকিৎসক