যৌনতার সম্ভাব্য সত্য, সততা এবং রহস্যময়তা

ভালোবাসা প্রেম

মানব জীবনের সর্বাধিক রহস্যময় বিষয় হচ্ছে যৌনতা। এবং এটা এমন একটা বিষয় যেক্ষেত্রে অবধারিতভাবে কোনো না কোনো প্রয়োজনে মানুষ মিথ্যে কথা বলবেই। এ এমনই এক গুপ্ত ধন, যা পেলে বোকা লুকায়, বৃদ্ধও লুকায়; যৌনতা লুকানোর বিষয় হয়ে উঠেছে মানুষের সভ্যতার অন্তর্জালে জড়িত হওয়ার পর থেকেই।

lust

লাখ টাকা দামের প্রশ্ন হচ্ছে, যৌনতায় সততা বলতে আসলে কী বোঝায়? সম্ভাব্য কয়েকটি উত্তর বাতলে দিয়ে আলোচনা এগোনো যেতে পারে–

ক. শুধু একজনের সাথে যৌনজীবন উপভোগ করা।

খ. যৌনজীবনে দায়িত্ব এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং খুব বাধ্য না হলে একজনের সাথেই যৌনতায় সীমাবদ্ধ থাকা।

গ. যৌনজীবনে দায়িত্ব এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজন এবং ইচ্ছার প্রাধান্য দিয়ে যৌনজীবনে লিপ্ত হওয়া।

ঘ. যৌনজীবনে কোনো ধরনের দায়িত্বের বিষয়টি অস্বীকার করা এবং যথেচ্ছভাবে যৌনতায় তৎপর থাকা।

ঙ. যৌনতা দোকান থেকে একটি মজাদার খাবার কিনে খাওয়ার মতো তাৎক্ষণিক বিষয়।

এর বাইরেও অনেক ধরনের রকম থাকতে পারে। যৌনতা শুধু পছন্দ করে নেওয়ার বিষয় নয়, এটা শারীরবৃত্তীয়, চর্চা, অভিজ্ঞতা এবং মূল্যবোধেরও বিষয়। বাইরে থেকে এটা ঠিক করে দেওয়া কঠিন যে কারো যৌনজীবন কতটুক এবং কেমন হবে। সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে— যৌনতা এবং ভালোবাসা অঙ্গাঅঙ্গি নয়, হওয়া ‍উচিৎও নয়, নাকি?

মানসিকভাবে অপছন্দের মানুষের সঙ্গেও যৌনজীবন সম্ভব, যদি তাকে শারীরিকভাবে ভালো লাগে বা অভ্যস্ততা তৈরি হয়। বিয়ের মাধ্যমে যে যৌনজীবন সেখানে তো তাইই হয় আসলে। ভালোবাসার একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি করে নেওয়া হয় সেক্ষেত্রে। পোষা প্রাণী যেভাবে আমরা ভালোবাসি বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িত থাকা মানুষটিও হয়ত ওভাবে ভালোবাসার মানুষ হয়ে যায় এক সময়।

যৌনতা থেকে গভীর ভালোবাসা জন্ম নিতে পারে, আবার নাও পারে। যৌনতা আসলে একটি পণ্য, ফলে এটি কেনাবেঁচাও হয়। কেনাবেঁচা সবসময় হয়ত দৃশ্যত হয় না, কিন্তু পরোক্ষাভাবে হরদম হয়। তাই এটা বলা যায়, যৌনতা অতটা নীতি-নৈতিকতা, সত্য-অসত্যের বিষয় নয়; এটা একটা চাহিদা, যেখানে অন্তরঙ্গতা এবং আকর্ষণের বিষয় রয়েছে।

অন্য সকল চাহিদার মতো নিরাপদে থেকে নিরাপদে রেখে এবং ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে বৈজ্ঞানিকভাবে এ চাহিদা মেটানো যেতে পারে। ব্যক্তিত্ব এবং সব কূল বজায় রাখাটাই সৌন্দর্য, এটা করতে গেলে আর স্বেচ্ছাচারী হওয়া যায় না।

সমস্য হয়, কারো সাথে প্রতিশ্রতিবদ্ধ থাকলে, প্রতিশ্রুতির একটা মানে মনে মনে তৈরি করে নেওয়া হয় যে, একই সাথে (সম্পর্কে জড়িত থাকাকালে) অন্য কারো সাথে যৌনজীবনে জড়ানো যাবে না। বেশিরভাগ দেশে এটি আইনত দণ্ডণীয়ও। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী বলে এক্ষেত্রে?

বিষয় হচ্ছে— যৌনতার সাথে সঙ্গীর প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করার সুযোগ রয়েছে, অন্যান্য বস্তুগত চাহিদার ক্ষেত্রে এরকম কিছু হয় না। চাহিদাটা এক্ষেত্রে বস্তুগত, একইসাথে মানবিকও। মানবিক জায়গাটা এড়িয়ে যাওয়াটাই আসলে মূল বিপর্যয়। মানুষ হলে যৌনতার মানবিক দিকটি সে এড়িয়ে যেতে পারে না, পারার কথা না। 

Marriage

ফলে এ ধরনের একটি সম্পর্ক দ্বারা যে আরেকটি সম্পর্ক কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা বলাই যায়। তাছাড়া নতুন সঙ্গীর প্রতি নতুনভাবে বেশি আকর্ষণ তৈরি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়, ফলে পরিবারের প্রতি মনোযোগ এবং দায়িত্বশীলতা কমে যেতে পারে পরকীয়ার কারণে।  

আবার বিপরীত দিক থেকে বলা যায়—পরকীয়া ক্ষয়ে যাওয়া, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া একটি মানুষকে টেনে তুলতে পারে, নতুনভাবে বাঁচতে সহযোগিতা করতে পারে। অনেক স্বামী-স্ত্রী রয়েছে যাদের একে অপরের পরকীয়ায় মৌন সমর্থন থাকে। অনেকে আবার খুবই যুদ্ধংদেহী এক্ষেত্রে।

‘কী হওয়া উচিৎ’ —এটা আপেক্ষিক, কেউ ঠিক করে দিতে পারে না। কিন্তু যাই করা হোক না কেন মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখাটা হচ্ছে আসল কথা। দিনশেষে ভালোবাসাটা যেন অটুট থাকে। যার সাথে আমি সর্বোচ্চ সম্পর্কে জড়িয়েছি তার প্রতি যেন কোনো অজুহাতে অমানবিক না হই। তার প্রতি ঘৃণা পোষণ না করি, এটাই আসল কথা। 

যৌনতার রকমফের

দেহের যেকোনো অঙ্গ ঘিরেই জটিলতা তৈরি হতে পারে। মানুষের হাত পা জন্মগতভাবে অকেজো হতে পারে, হাতে আঙ্গুল একটা বেশি হতে পারে। মানুষ জন্মান্ধ হতে পারে, বোবা বা কালা হতে পারে। তেমনি যৌনাঙ্গ এবং যৌনতায় এ ধরনের অনেক সমস্যা এবং ভিন্নতা থাকতে পারে।

বিচ্যুতি

যেহেতু যৌনতা বিষয়ে রেখেঢেকে কথা বলার একটি চর্চা, বিশেষ করে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে রয়েছে, তাই অনেক সময় আমরা অনেক ধরনের ভুল ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠি এবং সকলের যৌন জীবন একই ধরনের এবং একই প্রকার হবে বলে মধ্যযুগীয় ধারণা পোষণ করি। এখান থেকেই জন্ম নেয় বিভিন্ন সোস্যাল মিথ। যৌনতা সম্পর্কে প্রচলিত যেসব ধারণা সত্য নয়, এরকম দশটি সামাজিক গুজব এখানে দেয়া হল:

১. সমাজের অনেক মানুষের ধারণা কেউ সেমকামী হবে কিনা এটা তার পছন্দ অপছন্দের বিষয়।

সত্য: বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, সমকামী হওয়ার বিষয়টা জন্মগত ত্রুটি-বিচ্যুতি বা এটাই জন্মগত ভিন্ন এক সত্য।

২. প্রচলিত ধারণা হচ্ছে. মহিলাদের চেয়ে পুরুষের যৌন আকাঙক্ষা বেশি।

সত্য: যৌন আকাঙক্ষা নারীরও পুরুষের মতো, তবে এটি ব্যক্তিভেদে কম বা বেশি হতে পারে। তাছাড়া মাসিকের সাথে মহিলাদের যৌনাকাঙক্ষার কিছু সম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টা গর্ভধারণের সাথেও সম্পর্কিত। অথাৎ এটা বলা যায়— নারীর ক্ষেত্রে যৌনতা বিষয়টি প্রভাবিত হয় কিছু বেশি প্রভাবক দ্বারা।

জিরাফ

৩. প্রাণীদের মধ্যে সমকামিতা নেই।

সত্য: বিভিন্ন গোত্রের প্রাণীদের মধ্যে সমকামিতা রয়েছে। যেমন, জিরাফ, সিংহ, হাঁস, কুকুর এবং অনেক আরো নিম্নশ্রেণির প্রাণীর মধ্যে সমকামিতা রয়েছে। এমনকি মানুষের খুব কাছের প্রাণী বনবো এপস-এর মধ্যে সমকামিতা রয়েছে।

৪. প্রাকৃতিকভাবে মানুষ একগামী।

সত্য: প্রাকৃতিকভাবে মানুষ বহুগামী। একগামী হতে হলে মানুষকে তা সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং কঠোরতার মাধ্যমে হতে হয়। আদী মানুষেরা বহুগামী ছিল বলেই জানা যায়।

৫. পুরুষেরা সাধারণত উভকামী হয় না।

সত্য: পুরুষেরাও উভকামী হতে পারে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে অনেক পুরুষ রয়েছেন যারা উভয় ধরনের যৌনতায় সাড়া দিতে সক্ষম, এবং অনেকে তা চর্চাও করে থাকে।

৬. লিঙ্গ দুই প্রকার।

সত্য: লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় একই ধরনের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন বিবেচনায় নিয়ে। অর্থাৎ বিষয়টা করা হয় অঙ্গ সণাক্তকরণের মাধ্যমে। এটা সামাজিকভাবে প্রমাণিত যে তৃতীয় লিঙ্গ রয়েছে, এবং আরো কোনো ধরনের অন্তর্নিহীত জেন্ডার থাকাটাও অবাস্তব নয়।

৭. প্রত্যেক মানুষের যৌনাকাঙক্ষা রয়েছে।

সত্য: এটা প্রমাণিত যে জনসংখ্যার অন্তত এক শতাংশের কোনো যৌনাকাঙক্ষা নেই। এই ১ শতাংশের মধ্যে ৭০ শতাংশই আবার নারী। জন্মগত হরমোনাল ত্রুটির কারণে এটা হয়ে থাকে বলে বিজ্ঞানীরা বলেন। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে তাদেরও একটি আলাদা সমাজ গড়ে উঠেছে বর্তমানে। তবে এদের মধ্যে অনেকের অবশ্য প্রেমময় সম্পর্কের আকাঙক্ষা থাকে।

৮. যৌনতার ধরণ সুনির্দিষ্ট এবং এটা অপরিবর্তনীয়।

সত্য: এটা পরিবর্তন হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা দাবী করেছেন। অর্থাৎ কেউ সমকামী থেকে উভকামী বা এককামী হতে পারেন, কেউ আবার সমকামীও হয়ে যেতে পারেন জীবনের কোনো পর্যায়ে গিয়ে।

৯. রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষ যৌনতা বিষয়ে বিব্রত এবং বিভ্রান্ত থাকেন।

সত্য: বিষয়টা সেরকম কিছু নয়। ট্রান্সজেন্ডারদের যৌনাঙ্গ দেখতে হয়ত পুরুষ বা নারীর মতো, কিন্তু আসলে সেটির ফাংসন আসলে ঠিক উল্টো। তাই তারা প্রয়োজনে রূপান্তর করে নেয়, ফলে এটা শুধুমাত্রই একটি বাহ্যিক রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা।

১০. মানুষ শুধু নারী বা পুরুষ হিসেবে জন্ম নেয়। 

সত্য: ‘নারী এবং পুরুষ’ হিসেবেও মানুষ জন্ম নিতে পারে। এদের ইন্টারসেক্স বলা হয়। অনেকে সার্জিক্যালি যে কোনো একদিকে টার্ন করে পরবতীতে। 


লেখক: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।