জিপিএ-৫ এবং আমাদের পারা-না পারা

52

জিপিএ-৫ নিয়ে বের হচ্ছে যেসব শিক্ষার্থীরা, তাদের মান আশানুরূপ নয়, অভিযোগটি দীর্ঘদিনের। যারা স্বর্ণ জিপিএ নিয়ে বের হচ্ছে , তাদের অবস্থাও যে খুব আশানুরূপ, সেটিও কেউ বলতে পারছেন না। প্রশ্ন হলো, আমরা কি ঠিক করতে পেরেছি, কোন পর্যায়ে কী কী পারলে মনে করবো একজন শিক্ষার্থী পারে? নিশ্চয়ই। সিলেবাস আছে প্রত্যেক শ্রেণীর জন্য। সেই সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা হয়। সেখানে নম্বর দেয়া হয়। সেই অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী নম্বর পান।

আমরা ধরে নিতে পারি, সেই পরীক্ষার ভেতর থেকে গিয়েই শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পেয়েছেন। সেই সিলেবাসে যদি স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিষয়ে পড়ানো হয়, পরীক্ষায় আসে এবং তারপরও শিক্ষার্থীরা না পারেন, অথচ জিপিএ-৫ পান ওই বিষয়ে, তবে চিন্তার বিষয়। কিন্তু সেই পরীক্ষাটি নেবেন কে? শিক্ষক না কি সাংবাদিক? আর যদি এসব সিলেবাসে না থেকে থাকে, তবে সাধারণ জ্ঞান হিসেবে তাদের পারার কথা কিন্তু তারা পারেন নি বলে তাদের হতমান করা হয়, সে কাজের নিন্দা জানানোর যথেষ্ট ভাষা জানা নেই। দুই ক্ষেত্রেই প্রতিবেদনকারী সাংবাদিক অনধিকার চর্চা করেছেন। সাংবাদিক পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরবেন, এমনকি শিক্ষার্থীদের মানের অবনতি হয়েছে এই মর্মে শিক্ষাবিদকে উদ্ধৃত করবেন- এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তাঁকে পরীক্ষা নেবার অধিকার কে দিয়েছে? আর এইভাবে জাতির সামনে তাদের তুলে ধরার অধিকার তো পরের বিষয়। এই কথাটি স্পষ্ট করে বলার পরে না হয় আমাদের পারা-না পারা নিয়ে কয়েকটি কথা বলি।

শিক্ষায় জড়িত থাকার সুবাদে দীর্ঘদিন থেকে পর্যবেক্ষণ করে আসছি, শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল তাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেবার সকল বিভাগে নিজস্ব নিয়মে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলো, সেবার খাতা দেখে আমরা অসাধারণ সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। ৪২০০ শিক্ষার্থী আমাদের বিভাগে পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা ৩০ জন শিক্ষার্থী পাই নি যারা বাংলা-ইংরেজি-সাধারণ জ্ঞানে ১০+১০+১০ পেয়েছেন। এটা ১৯৯৭ সালের কথা সম্ভবত।
পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হয়েছে আঁচ পাই। তবে সেটি কেবল স্কুল-কলেজের জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীদের হয়েছে, এমন নয়।  আমরা সবাই অনেক জানি আমাদের নিজেদের বিষয়ে, বলতে পারছি না। আমরা কিন্তু শিক্ষকদের, সরকারী কর্মকর্তাদের, সাংবাদিকদের, অন্যান্য পেশার মানুষদের পরীক্ষা নিচ্ছি না তাঁরা কতোটুকু জানেন। কিংবা পরীক্ষা যদি নিতে হয়, নিচ্ছেন তাঁদের পেশার মানুষেরা। শিক্ষার্থী বলেই তাঁদের পরীক্ষা নেবার নামে অপমান করার অধিকার সবার থাকতে পারে না।

কেনো শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি? যদি একটি শুদ্ধ বাংলা বাক্য লেখাকে মান ধরি, তবে ৫০০ প্রশ্নের ‘প্রশ্নব্যাঙ্ক’ মুখস্থ করিয়ে টিক চিহ্ন দিয়ে পাশ করা প্রজন্মের কাছে শুদ্ধ একটি বাংলাবাক্য পাওয়ার আশা যাঁরা করেন, তাঁদের আমি খুব বেশি আশাবাদী বলতে চাই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথাই উঠছে। সৃজনশীল পরীক্ষার ব্যাপারে কেনো শিক্ষাবিদরা খড়গহস্ত হলেন হঠাৎ, জানি না। এই পদ্ধতি প্রবর্তনে যাঁরা অংশ নিয়ে এক সময় ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে খুব উচ্চকণ্ঠ হতে দেখে বিস্ময় মানি। একটু বিনয়ের সাথে বলি, এই পদ্ধতি কোন খারাপ পদ্ধতি না। দরকার ছিলো শিক্ষকদের যথাযথ ট্রেনিং দিয়ে নেয়া, কিংবা ভালো বেতন দিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিয়ে স্কুলে পড়ানো। যেমন করিয়েছে ফিনল্যান্ড। কিন্তু সে হবার নয় আমার দেশে। আমরা ধান গাছের কাছ থেকে কাষ্ঠ আশা করবো, না পেলে অপমান করবো।

আমার দেশে হাতে কলমে কেমন শিক্ষা হয়, তার একটা উদাহরণ দেই। গ্রামের এক স্কুল শিক্ষকের কাছে শোনা। নিজে দেখিনি। কিন্তু বিশ্বাস করেছি। কারণ আমিও একটি জেলা শহরের (এখন বিভাগীয় শহর) সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং সরকারী মহিলা কলেজে পড়ে এসেছি বিজ্ঞান বিভাগে। পদার্থ, রসায়ন আর জীববিজ্ঞানে আমরা কীভাবে ব্যবহারিক না করেই বা নামে মাত্র করেই ২৫-এর মধ্যে ২৪/২৫ করে পেয়ে এসেছি, সেটা জানি। যাঁরা আমার সমসাময়িক, তাঁরা সৎ হলে স্বীকার করবেন নিশ্চয়। না করলে নাই। আমি একাই খারাপ ছিলাম, ধরে নিতে হবে।

তো সেই শিক্ষক জানালেন, বাংলাদেশের সব স্কুলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কোন একটা ক্লাসের জন্য আবশ্যিক করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের স্কুলে রেকর্ড প্লেয়ার নেই। তাই শিক্ষক ক্লাসে ঢুকে একটা সিডি দেখিয়ে বলেন, ‘এই সিডির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আছে। তোমরা দেখলে?’ শিক্ষার্থীরা তখন তারস্বরে উত্তর করে, ‘হ্যাঁআআআআআআ’। এই হলো তাঁদের বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা শোনা বা দেখা।

সাধারণ জ্ঞানের বিচার করতে বসলে আমি উতরে যাবো, এমন গ্যারান্টি দিতে পারি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ আর আর ঘ ইউনিটের প্রশ্নপত্র দেখেছি বহুবার। আমি এখন পরীক্ষা দিতে বসলে ভর্তির সুযোগ পাবো না, এমনটা বলাই নিরাপদ। কাজেই অসাধারণ ‘সাধারণ জ্ঞান’ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। জাত গেলো জাত গেলো রব তোলারও কোন কারণ দেখি না। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন বাংলা একটি পূর্ণ বাক্য লিখতে না পারা নিয়ে, আমি উদ্বিগ্ন সাধারণ গণিতে বা বিজ্ঞানে মুখস্থ ছাড়া নিজেরা একটি সমস্যার সমাধান না করতে পারার অসহায়ত্ব নিয়ে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রত্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছি পরীক্ষার্থীরা অনেক সময় জানেন না যে নিজের নামের প্রথম অক্ষর, ইংরেজিতে লেখার সময়, বড় হাতের হয় (ক্যাপিটাল লেটার বলি যাকে)। এরাও জিপিএ ৫ পাওয়া। এই জায়গাগুলো আতঙ্কিত করে। এসব ক্ষেত্রে বরং আমার প্রশ্ন, কোন মন্ত্রবলে এরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়? আমি সেই পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করি।

কয়েকজন কিশোরকে ক্যামেরার সামনে এনে তাঁদের না পারাকে জাতির সামনে উন্মোচন করাটা আমাকে আহত করেছে। আমরা অনেকেই অনেক কিছু পারি না। তবে যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে, সাংবাদিকদের অনধিকারের জায়গাটুকু বিবেচনায় না নিলে, সেগুলো পারাটাই ছিলো কাঙ্ক্ষিত। এই না পারা মানে শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে এমন বড় ফাঁকি আছে, যা আর ঢেকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সেই ফাঁকিটাকে আসুন চিহ্নিত করি খোলা মনে। আমরা আমরাই তো!

কোন দেশে মুদ্রাস্ফীতি হলে আমরা ক্রেতাদের নিয়ে ঠাট্টা করি না যে, হুম, একশো টাকা দিয়ে পাঁচটা মরিচ কিনে এনেছে। আমরা প্রশ্ন করি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে। ঠিক তেমনি, জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের এই এতো কম পারার দায়টা বর্তায় গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। প্রশ্নটা সেদিকে হোক।

ভালো বেতনে মেধাবী শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হোক। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো হোক। শিক্ষা কোন রাজনৈতিক পণ্য নয়, ভোটের বাহন নয়। শিক্ষা হলো শিক্ষা। কোন জাতির সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ, যার উপরে সেই জাতির বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। সব কিছুতে ফাঁকি দিতে দিতে ফাঁকিগুলো আমাদের দিকে দাঁত বের করে হাসছে। আগেও বলেছি, ফের বলছি, এটা জাতীয় দুর্যোগ। মোকাবেলাটাও তাই দুর্যোগ মোকাবেলার মতো করেই করা উচিত। আর জিপিএ৫ পাওয়া ওই কিশোররা হলো এই দুর্যোগের শিকার। শিকারদের নিয়ে তামাশা করা আর যাই হোক, সুস্থ আচরণ নয়। ওদের শিক্ষা দেয়া যায়নি ঠিকমতো, অন্তত মমতাটুকু থাক। প্রতিবেদনকারী সাংবাদিক আর প্রচারকারী টিভি চ্যানেলের এইটুকুও না-পারা ঠেকাবে কে?

ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।