প্রসঙ্গ মেরাদিয়া গণহত্যা: ’৭১-এ গণহত্যা ঘটেছিলো বর্তমান ঢাকা শহরের এমন অনেক স্থান এখনও অরক্ষিত // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
1 0

একাত্তরের গণহত্যার বিস্তৃতি ছিলো সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। গণহত্যা ঘটেছিলো বর্তমান ঢাকা শহরের এমন অনেক স্থান এখনও অরক্ষিত


ঢাকা শহরের কয়েকটি বড় গণহত্যার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং বইপত্রে আসলেও বাদ পড়ে গিয়েছে আরও অনেক গণহত্যা, যা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঢাকা শহরে এবং তৎকালীন শহরতলীতে সংগঠিত হয়েছিলো।

মেরাদিয়া গ্রামটিও তখন ছিলো শহর সংলগ্ন। মেরাদিয়া গ্রাম থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে ‘পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশন’ নামে টিভি সেন্টারটি তখন কেবলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে— এটি ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ সালে ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক ভবনটি যে জায়গায় অবস্থিত) ‘পাকিস্তান টেলিভিশন’ নামে সম্প্রচার শুরু করে। ১৯৭০ সাল থেকেই রামপুরাতে একতলা ভবনে ছোট্ট একটি সম্প্রচার কেন্দ্র ছিলো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী এখানে ক্যাম্প করেছিলো।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন বর্তমান ভবনে সম্প্রচার শুরু করে। স্থানটির নাম অনেক আগে ছিলো মতিরটেক। জানা যায়— জমিদারী আমলে মতিবাবু নামে এক ভদ্রলোকের পরগণা ছিলো এটি, এজন্য নাম হয়েছিলো মতিরটেক।

অদূরে বিপরীত পাশে ছিলো উলোন হিন্দুপাড়া, যেখানে প্রধানত জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করত। উলোন, মেরাদিয়া, মেরুল, বাড্ডা, দাসেরকান্দি ইত্যাদি গ্রামগুলোতে তখন প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাই বসবাস করত। অন্যদিকে রামপুরা,ভুইঞাপাড়া, ছাইতানতলী, সিপাহীপাড়া … ইত্যাদি গ্রামগুলোতে ছিলো মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস।

’৪৭-এর দেশভাগের সময় এবং ’৪৭-এর পরে ১৯৬৪ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় প্রথম এইসব এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারত গমন শুরু করে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এবং পরে প্রায় বেশিরভাগ অধিবাসীই ভারত চলে যায়। এখন এখানকার প্রায় সব গ্রামই শহর সম্প্রসারণের ধাক্কায় বিলিন হয়ে গেছে। বনশ্রী এবং আফতাবনগর বৈধ-অবৈধভাবে বেশ কয়েকটি গ্রাম গ্রাস করে নিয়েছে।

তখন বুড়িগঙ্গা থেকে ধোলাই খাল ধরে একেবারে হাতিরঝিল হয়ে ধানমণ্ডি লেক পর্যন্ত নৌ চলাচল করতে পারত। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনী বড় বড় গানবোট নিয়ে টহল দিত। বর্তমানে শহর হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং-এর নামকরণ করা বনশ্রী এবং আফতাব নগরের মাঝে যে খালটি রয়েছে এই খালের মেরাদিয়া হাটের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের টহল বোটটি রাখত। গ্রামগুলোতে ঢুকতো তারা মুরগী, ছাগল এবং যুবতী নারীর সন্ধানে।

মেরাদিয়া গ্রামটিতেও তারা আসত মূলত খাবার দাবার সংগ্রহ করতে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা লুকিয়ে আছে কিনা এরকম সন্দেহ থেকেও তারা হিন্দু গ্রামগুলোর ওপর বিশেষভাবে চোখ রাখত। পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়েছিলো, বা তাদের বুঝানো হয়েছিলো যে, হিন্দুরাই মুক্তিবাহিনীর প্রধান সহযোগী।

মেরাদিয়া গণহত্যাটি ঘটেছিলো ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর, এবং সেদিন ছিলো ঈদের দিন, শনিবার। মেরাদিয়া গ্রাম সংলগ্ন মেরাদিয়া হাট— যেটি তখন ঢাকার পুরাতন এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি হাট। মেরাদিয়া গ্রাম থেকে ১১ জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে এই হাটে।  বর্তমানে জীবীত (আমি যখন ‘মেরাদিয়া গণহত্যা’ নিয়ে গবেষণাটি করি তখন তিনি বেঁচে ছিলেন), দরিদ্রতায় নিমজ্জিত লক্ষ্মী রাণী মিস্ত্রির স্বামী ফণীন্দ্র সরকার সহ আরো ১০জন মেরাদিয়া গণহত্যার শিকার। মেরাদিয়া গ্রামে তখন বাস করত শ্রমিক শ্রেণির মানুষ— মাছ ধরা এবং কৃষিকাজ ছিলো তাদের প্রধান পেশা, দু’একজন ব্যবসা বাণিজ্য করতেন। তাই শুধু লুটপাটের উদ্দেশ্যে গণহত্যাটি ঘটেছিলো এমন কিছু নয়। হিন্দুরা পালিয়ে গেলে তাদের জায়গা সম্পত্তি দখলে নেওয়া যাবে এরকম মনোভাব তখন এদেশীয় রাজাকারের মনে ছিলো— তারা ছিলো গণহত্যার অন্যতম ইন্ধনদাতা। সামনে আসেনি বলে তাদের সবাইকে কখনো চিহ্নিত করা যায়নি।

যদিও এটা সত্য যে, ’৭১-এ বেশিরভাগ গণহত্যাই ঘটেছিলো জাতিগত ঘৃণা এবং জিঘাংসা থেকে। ১৯৭১ সালে সংগঠিত অন্যান্য গণহত্যার মতো এটিও এটিও ছিলো মূলত জাতিগত সংখ্যালঘু নিধন। সংখ্যালঘু হিন্দুরা মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করছে এবং তারা ভারতীয় জাতিয়তাবাদের বিশ্বাসী— এরকম বিভিন্ন ইস্যুতে ’৭১ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক, মুক্তিকামী মানুষ এবং আওয়ামী লীগের লোকেদের নিধনে মেতে উঠেছিলো পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় ঘাতাক দালাল চক্র। 

মেরাদিয়া তখন ছিলো ঢাকা শহর সংলগ্ন একটি গ্রাম। ১৯৭৫ সালে যখন রামপুরা টেলিভিশন সেন্টারটিতে পূর্ণাঙ্গভাবে সম্প্রচার চালু হয় তখনও বিল পেরিয়ে মাত্র ২ কিলোমিটার পূর্বে মেরাদিয়া পুরোপুরি একটি গ্রাম। মাঝখানে বিশাল মাঠ। বর্ষাকালে সেটি বিলে পরিণত হয়। 

মেরাদিয়া গ্রাম সহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষের কৃষি জমি ছিলো এখানে, পাশাপাশি অনেক খাশ জমিও ছিলো। এই বিল এবং খোলা মাঠে ইস্টার্ন হাউজিং শহর নির্মাণ শুরু করে ১৯৮৩ সালে। পর্যায়ক্রমে বালু ফেলে জমি উঁচু করা হয়। গ্রামবাসীর জমির পাশাপাশি এখানে অনেক জমি ছিলো পতিত— খাস জমি। সেগুলো কীভাবে ইস্টার্ন হাউজিং-এর দখলভুক্ত হলো সেটি একটি বড় প্রশ্ন। 

মেরাদিয়াবাসীর জমিজমাও অধিকাংশ বেহাত হয়ে যায়। বর্তমান বনশ্রীর মাঝামাঝি ছিলো একটি বিশাল বটগাছ। বটগাছতলাতে পূজা এবং মেলা হতো। সরকারি বা দেবোত্তর এই সম্পত্তির মতো এরকম সকল সম্পত্তিই দখলে নেয় ইস্টার্ন হাউজিং কর্তৃপক্ষ। নির্মিত হয় বনশ্রী আবাসিক এলাকা, নির্মিত হচ্ছে আফতাবনগর। আড়ালে চলে যায় মেরাদিয়া গ্রাম, ওপারের ছাইতানতলী গ্রাম, বুড়াবুড়ি মন্দির, ১৯৭১-এর গণহত্যা এবং আরো অনেক ইতিহাস। 

মেরাদিয়া গণহত্যা
এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্যমতে বনশ্রী প্রজেক্টের জি এবং এফ ব্লকের মাঝামাঝি এই জায়গাটিতে ছিলো কয়েকশো বছরের সেই পুরাতন বটগাছ এবং বুড়াবুড়ি আশ্রম নামে একটি স্থাপনা। কয়েক একর জায়গা নিয়ে ধর্মীয় এই স্থাপনাটি ছিলো, যেটি বনশ্রী প্রজেক্ট করার সময় নিশ্চিহ্ন করা হয় এবং জায়গাটির দখল নেওয়া হয়। সম্পত্তি হয়ে যায় কোম্পানির এরপর প্লট বিক্রির পর তা ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়।

 

 

ভৌগলিক অবস্থান এবং স্থানটির বর্তমান অবস্থা

মেরাদিয়া হাটটি যেখানে বসত এবং যে জায়গাটিতে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিলো— জায়গাটিতে স্থাপনা নির্মাণের জন্য দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সাইনবোর্ড টানিয়েছে। হাটটি যেখানে বসত তার উত্তর পূর্ব কোণে দু’টি আম গাছ তলায় (গাছ দু’টি এখন নেই) গণহত্যাটি সংগঠিত হয়েছিলো। ‘শহীদস্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি, মেরাদিয়া’ শহীদস্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের জন্য সেখানে একটি সাইনবোর্ড বসিয়েছে।

মেরাদিয়া হাট
ঠিক এই জায়গাটি থেকে ডানে সোজা পিছনে ২০ নভেম্বর ১৯৭১ গণহত্যাটি সংগঠিত হয়।

কালের বিবর্তনে এলাকার ভূমিরূপ, বসতি, জীবীকা— সবই বদলে গিয়েছে। মেরাদিয়া গ্রামটি চাপতে চাপতে এখন ছিন্নভিন্ন। শত শত বছরের পুরাতন দুই শতাধিক পরিবারের একটি গ্রামে পুরাতন বসতি হিসেবে এখন টিকে আছে মাত্র পঁচিশটি পরিবার। জায়গা বেহাত হয়েছে, চারপাশে বড় বড় ভবন উঠেছে, কিন্তু মেরাদিয়াবাসী যে তিমিরে ছিলো তার চেয়ে গভীর তিমিরে তলিয়ে গেছে। ইস্টার্ন হাউজিং যখন চাষের জমিতে বালু ভরাট করে বনশ্রী শহর বানানো শুরু করে তখন মেরাদিয়া গ্রামবাসী জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে— এমনকি প্রতি বিঘা মাত্র এক লক্ষ থেকে দুই লক্ষ টাকায়। সে টাকাটাও তারা একসাথে পায়নি, কেউ কেউ লেগে থেকে ধাপে ধাপে পেয়েছে, কেউ কেউ আবার পায়ইনি। অনেকে ভারত চলে গিয়েছিলো, ভারত থেকে এসে আর টাকা আদায় করতে পারেনি। চারপাশে সুউচ্চ ভবনের নিচে চাপা পড়ে ধুকতে থাকা টিনের বাড়িগুলো দেখে সহজেই বোঝা যায় মেরাদিয়া গ্রামবাসীর বর্তমান অবস্থা।

গ্রামবাসীর একটি শশ্মান ছিলো, সে জায়গাটিও দখলে নিয়ে রেখেছে কতিপয় ব্যক্তি। বারবার দাবী করলেও জায়গাটি মেরাদিয়াবাসীর অনুকূলে প্রশাসন বুঝায়ে দেয়নি। এ বিষয়ে ১৮/১০/২০১৮ ইং তারিখে রাখাল চন্দ্র দাস, অনিল বরণ সরকার, সমিরণ মণ্ডল এবং গয়ানাথ দাসের ‍উদ্যোগে বর্তমান সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর নিকট দরখাস্ত দেওয়া হয়। “মেরাদিয়া গণহত্যায় স্বজন হারানো আমরা শশ্মানের জায়গাটিতে একটি ভবন করতে চাই, যেখানে ‘৬৪-এর দাঙ্গায় এবং ’৭১-এর গণহত্যায় পালিয়ে বাঁচা মানুষগুলো আশ্রয় পাবে, পাশাপাশি একটি আবাসিক এবং সকল সুযোগ-সুবিধা সহ একটি প্রতিবন্ধী স্কুল পরিচালিত হবে। মেরাদিয়া গ্রামের অনেকে এখনও আশ্রয়হীন, তারা পালিয়ে ভারত গিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভবনটি ‘শহীদস্মৃতি ভবন নামে সরকারেরই করে দেওয়া উচিৎ। এ জমিটি নিয়ে বিতর্কের কোনো জায়গা নেই, খাস খতিয়ান ঘাটলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখনও মেরাদিয়াবাসীর অনেক জায়গা দখল বেদখল হয়ে আছে। ইতিহাস তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। মেরাদিয়ার প্রায় প্রত্যেক অধিবাসীর কয়েক বিঘা করে জায়গা ছিলো, কিন্তু এখন আমরা এক/দুই শতক জায়গার মধ্যে কোনোমতে ছাপড়া তুলে বসবাস করছি! এই বাস্তবতা তো প্রাকৃতিক না, কিছু মানুষ-ই এজন্য দায়ী। কারা দায়ী? সেটি খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়।”

মেরাদিয়া
মেরাদিয়া হিন্দুপাড়ায় ঢোকার মুখে ‘বুড়াবুড়ি আশ্রম’ নামে মন্দিরটি তখন এখানে ছিলো না। আনুমানিক ১৩০০ বঙ্গাব্দে, যেখানে বর্তমানে বনশ্রীর এফ ব্লক এবং জি ব্লকের মাঝামাঝি রাস্তাটি পড়েছে (গুদারাঘাট নামে জায়গাটি পরিচিত), সেখানে একটি বিশাল বটগাছ ছিলো। বট গাছাতলাতে পূজা হতো এবং মেলা বসতো। ১৯৮৩ সালে ইস্টার্ন হাউজিং-এর আবাসিক প্রকল্প শুরু হলে কয়েকশো বছরের বটগাছটি কেটে ফেলা হয়, মন্দিরটি বিনষ্ট হয়। একইসাথে পূজার জায়গাটিও আর থাকে না। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে মেরাদিয়া গ্রামবাসী বর্তমান স্থানে মেরাদিয়া হিন্দুপাড়া ‘বুড়াবুড়ি আশ্রম ও মন্দির’ নামে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করে। মেরাদিয়াবাসীর অভিযোগ পুরাতন যে বটগাছতলায় পূজা হতো সেটি কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি ছিলো না। ফলে ইস্টার্ন হাউজিং কীভাবে জায়গাটি ভরাট করে মানুষের কাছে বিক্রি করলো সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
Next Post

নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং সুস্বাদু খাবার খেতে আসতে পারেন রামুর চা-বাগান বাজারে

নাম চা বাগান বাজার হলেও এখানে আসলে কোনো চা বাগান নেই— অদূরে আছে রাবার বাগান। তবে এখানে আট দশটি রেস্টুরেন্ট আছে, যেগুলো বিলাসবহুল না হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং খাবারের মানের দিক থেকে খুবই ভালো। দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ এখানে খেতে আসে। এখানে সব ধরনের মাংস— কবুতর, টার্কি, হাঁস, দেশী মুরগী, খাসি […]
রামু