বাবাকে কে ভোলে ।। স্বপন বসু

বাগেরহাট

মুক্তিযুদ্ধ

উনিশ’ একাত্তর সালের ১৭ মে আমার বাবা শহীদ হন। বাসাবাটির করিম মওলানার ছেলে আলী আর রাজমিস্ত্রি কুটি মোল্লা বাবাকে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫মার্চ ঢাকায় ক্রাকডাউন করলেও বাগেরহাটে প্রথম আসে ২৪ এপ্রিল। এ পর্যন্ত বাগেরহাটের জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক ছিল। সেদিন আমরা শেলের শব্দ শুনে বাড়ি চলে আসি। এর এক ঘণ্টা পরে বাজার বা নাগেরবাজার এলাকায় কালো ধোঁয়া দেখা যায়। দোতলার বাথরুমে দাঁড়িয়ে বাবা, মা, আমরা সব ভাইবোন ঐ ধোঁয়া দেখতে থাকি। বাবাকে দেখি কিছুটা উদভ্রান্তের মতো। বাবা নদী পেরিয়ে গিয়েও আমাদের কথা চিন্তা করে বাড়ি ফিরে আসেন। সে সময় নাগেরবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। বিকেলে জানা যায় যে, নাগেরবাড়ি মনে করে নাগেরবাজার এলাকাকে পাকিস্তানি বাহিনী গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানি বাহিনী আসার পর থেকেই বাংলাদেশবিরোধী শক্তি সমস্ত এলাকায় সঙ্গবদ্ধ হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা সহজ ছেড়ে চলে যাওয়ায় ঐসব অশুভ শক্তি লুটতরাজ চালাতে থাকে। আমার মনে আছে ২৫ বা ২৭ এপ্রিল বাগেরহাটে পাকিস্তানের সংহতির জন্য এক মিছিল বের হয়। যাদের কাছে লাইসেন্সওয়ালা একনলা ও দোনলা বন্দুক ছিল, সেসব মুসলমানদের মিছিলে অংশ নিতে বলা হয়। মিছিল শেষে বাসাবাটি গ্রামের কিছু লোক যখন দাঁড়িয়ে ছিল বাসাবাটি প্রাইমারি স্কুলের ধারে, তখন আমিও ওখানে দাঁড়ানো ছিলাম। দুই ব্যক্তি, সম্ভবত তখনকার মহকুমা অফিসের কর্মচারী হবে, বাসাবাটি এলাকার কয়েকজনকে আমার সামনেই বলতে থাকে—হিন্দুদের প্রশ্রয় দেবেন না। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম, পরে আস্তে আস্তে বাড়িতে চলে আসি। শহরবাসী অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে থাকে। এপ্রিল মাসের ৩০-৩১ বা মে মাসের ১-২ তারিখের দিকে বাগেরহাট রেল ক্রসিংয়ে টহলদার পুলিশের কাছ থেকে কয়েকটি ছেলে অস্ত্র ছিনতাই করে। বাগেরহাটের তখনকার আওয়ামী লীগের সম্পাদক অজিয়র রহমানকে বন্দী করে পুলিশ। রাতের দিকে বৃষ্টির মধ্যে হঠাৎ গুলির আওয়াজ। আমি আর আমার ভাই তপন নিচের ঘরে ঘুমোতাম। থেকে থেকে গুলির শব্দের মধ্যে উঠে বসি। পরে জানতে পারি অজিয়র রহমানকে মুক্ত করতে রাতে মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করে। পরদিন বাগেরহাটে পাকিস্তানি বাহিনী এসে অজিয়র রহমানকে নিয়ে যায় এবং তাঁকে নিমর্মভাবে হত্যা করে। এর পরে বাগেরহাট শহর থেকে আমাদের বাইরে যাওয়া কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। জগন্নাথ তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। ওই বাজার করে। শহরের যে কোনো কিছু শোনার মাধ্যম হচ্ছে ও। বাবা অস্থির। আমরা এগারো ভাইবোন, তাঁর মা অর্থাৎ আমাদের ঠাকুরমা, আমাদের মা, মানসিক প্রতিবন্ধী জ্যাঠা, এদের সকলকে নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া অসম্ভব। রাতে গোপনে প্রতিবেশীদের অনেকে চলে গেছেন। দেখি বিভিন্ন বাড়ি থেকে মালামাল লুট করে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কাঁসার বাসন বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। ১৪ বা ১৫ মে বাসাবাটির মওলানার অনুসারী একজন এসে বাবাকে ডেকে নিয়ে কিছু বলে। পরে শুনেছি বাবাকে ধর্মান্তরিত হতে বলে। বাবা রাজি না হওয়ায় তারা বাবার বিরুদ্ধে চরম সিদ্ধান্ত নেয়।
১৭ মের সকাল। কোনো কাজ নেই। বর্তমানে বাবার যেখাসে সমাধি তার সামনে বাঁধানো চত্বর ছিল। তার সামনে কিছুটা খালি জমি। আগাছায় ভর্তি। আমি ঐগুলো মাথা নিচু করে পরিষ্কার করছি। ঐ সময় আমি ঝিনাইদা সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। হঠাৎ একটা ডাক ‘এই শুনে যা’। তাকিয়ে দেখি কুটি। তার হাতে একটা বড় রামদা আর বাসাবাটি মওলানার ছোট ছেলে আলীর হাতে রাইফেল। সঙ্গে ঐ এলাকার কয়েকটা ছেলে। কুটিকে আমি চিনতাম আমাদের মিলের প্রতিবেশী জালাল মিনার রাজমিস্ত্রী হিসেবে। কুটি কালীমন্দিরের সামনের আমগাছে এককোপে রামদাটা আটকে আলীর হাত থেকে রাইফেল নিল। আমি পিছু পিছু ছুটছি। বাবা খোলা বারান্দার সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ভাই আমার একটা কথা।’ কুটি গুলি করলো, একের পর এক। অসহায় আমি কুটির পা জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘গুলি করবেন না।’ হঠাৎ বাবাকে দেখলাম পড়ে যেতে। দৌড়ে বারান্দায় উঠে বাবাকে ডাকলাম। বাবা ইশারা করে কথা বলতে বারণ করলেন। শুধু ইস্টনাম জপ করলেন। বাবু (আমার সেজভাই) একটা গ্লাসে জল নিয়ে এলো বাবাকে খাওয়ানোর জন্য। তখন আমাদের রান্না হতো বর্তমানে পশ্চিম দিকের টিনের ঘরে ভাড়াটিয়ারা থাকে যেখানে সেই জায়গায়। মা এসে বললেন তোশক এনে বাবাকে শোয়ানোর জন্য। মঞ্জু ও ঝর্ণা তোশক নিয়ে এলো। আশপাশের মুসলিম প্রতিবেশীরা বাড়ির উঠোনে ভিড় করতে থাকলো। ওর মধ্যে হঠাৎ একজনে চিৎকার করলো, ‘মিলিটারি আসছে, মিলিটারি আসছে।’ উঠোনের লোক ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমরা ভাইবোন চোখের জল ফেলতে থাকলাম। সেই মুহূর্তে একটি লোকের সাহায্য ভুলবো না। সে হচ্ছে ইসহাক মোল্লা। ইসহাক মোল্লা মাকে জিগ্যেস করলেন, আমরা কি করতে চাই। আমরা বাবার দেহ সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নিই। তার সহায়তায় কিছু লোক সমাধির জন্য গর্ত খুড়ল। বাবাকে তোশকের পরে শুইয়ে আমরা নিয়ে এলাম। শেষ মুহূর্তে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে বাবার মুখাগ্নি করলাম। বাবার মুখে দাঁড়ি-গোঁফ ছিল। ঐ আগুনে কিছু পুড়ে গেল। সমাধিস্থ করার পর সকলের সাথে উঠোনে এলাম। মা বারান্দার সিঁড়ির ওপরে বসা। নিশ্চুপ। আমাকে দেখে মা উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে কাছে এসে বললেন পুকুরে গিয়ে স্নান করতে। মার সাথে আমি পুকুরে গিয়ে জলে নামলাম। আমার পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি, বাবার রক্তে ভিজে গেছে। মা জলে নেমে একটা ইটের টুকরো দিয়ে দু’হাতের শাখা ভেঙে ফেললেন। লাল পলাটা খুলে জলে ফেলে দিলেন। আমার গেঞ্জিটা খুলতে গিয়ে দেখি সেখানে কিছু লাল সাদা জিনিস আটকে আছে। বাবাকে গুলি করা হয়েছিল বেশ কয়েকটি। তার মধ্যে একটা বুক ভেদ করে ফুসফুস ছিদ্র করে যায়। বাবাকে যখন জড়িয়ে ধরি তখন ছিদ্র থেকে বের হওয়া মাংস বা ফুসফুসের কিছু অংশ আমার গেঞ্জিতে লেগে যায়। আমি এগুলো তুলে ফেলার পর মা বললেন, ‘তোর বাবার দেহ পবিত্র, যেখানে সেখানে ফেলিস না।’ আমি ঘাটের পাশে একটা উঁচু জায়গায় রাখলাম। একটা কাক মুখে করে নিয়ে গেল। গেঞ্জিটা খুলে জলে ভাসিয়ে দিলাম। আমাদের জীবনের ভালোলাগা-মন্দলাগা, হাসি-আনন্দ সব থেকে সাহসী জীবনের এভাবেই শেষ হলো।
এখন মাঝে মধ্যে ভাবি নিয়তি তাঁকে এখানে টেনে এনেছিল। একমাত্র মামার পিরোজপুরের ডুবন্ত ব্যবসা বাবা দাঁড় করিয়েছিলেন, সেই ব্যবসার সফলতার সময় বাবাকে তিনি এক কাপড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন। ১৯৪৬-এর সেই দিনে দাঙ্গা-বিক্ষুদ্ধ কলকাতা শহরের একজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী তাঁর জীবন বাঁচান। তাঁর নাম হরলাল শুক্লা। বাবার মৃত্যুর পর যখন কলকাতা শহরে আসি, তখন এই হরলাল শুক্লা বাবুকে খোকন কাকা দেখা করিয়ে দেন। বাবাকে হরলাল শুক্লা বাবু বলেছিলেন, ব্যবসার স্থান ঠিক করতে যাতে তিনি ব্যবসায়ীক সাহায্য করতে পারেন। বাবা কুচবিহারে থাকার ঘর ও ব্যবসায়ীক স্থান ভাড়া করে আমাকে ও মাকে নিতে মূলঘর গ্রামে আমার মামাবাড়ি আসেন। ঐ সময় তাঁর অসুস্থতার কারণে আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। বাগেরহাটেই ব্যবসা আরম্ভ করেন। বাগেরহাট রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ স্বামী পরদেবানন্দজি মহারাজ একটা কথা বলতেন, ‘প্রারব্ধ’, বা Pre-destination  —হয়ত বাবার নিয়তি তাঁকে এভাবে মৃত্যুর মধ্যে টেনে নিয়েছিল।
বাবা মারা যাওয়ার পর আমি গৃহবন্দী। আমাদের ছোট বোন বেবি। সে ছিল বাবার সব থেকে আদরের। ঐ সময় পূরব পাকিস্তানে একটি সিনেমার জনপ্রিয় গান ছিল—‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়।’ বেবি ময়নার বদলে সবসময় ‘ফাদার’ শব্দটা বসাতো। একটা অসহায় করুণ মুখ।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। দমদমে জ্যাঠার বাড়িতে থাকি মঞ্জু, ঝর্ণা, খুখু আর আমি। পাশে থাকেন বাবার ডাক্তার মামা। তাঁর স্ত্রীকে ডাক্তার দিদো বলে ডাকি। সেদিন ডাক্তার দিদোর বাড়িতে অনেক কেঁদেছিলাম তাঁর সামনে। অনেক স্বান্তনা দিয়েছিলেন। আমার বন্ধু হান্নান আর অহিদ কাকা, জালাল মোল্লা, ইসহাক মোল্লার বড় ভাইয়ের মেয়ে আলেয়ার স্বামী, ঠাম্মার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে পৌঁছেছিল দমদমে, ঠাম্মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর। এই হান্নান, অহিদ কাকা, দাউদ এরা সাহায্য করেছিল ঝর্ণা, মঞ্জু, খুকু আর আমাকে অবরুদ্ধ বাগেরহাট শহর থেকে বের করে কলকাতায় জ্যাঠার বাড়িতে পৌঁছাতে। সবাইকে দেখার জন্য কাউকে কিছু না বলে আমি বাগেরহাটের দিকে রওনা হলাম। শুধু তপনকে বলেছিলাম, আমি বাগেরহাট যেতে পারি। তপন আর বাবু শিবপুর মামাবাড়িতে থাকে। যশোর রোডের পেট্রোপোলে কোনো সীমান্ত-রক্ষী নেই। যশোরের দিকে যাওয়ার কোনো গাড়িও তখন নেই। একটা মালবাহী ট্রেইলারে করে আমরা কয়েকজন রওনা হলাম যশোরের দিকে। বিধ্বস্ত ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদের উপরে ব্রিজ উড়ানো। নদীর উপরে বোট ব্রিজ। এই অবস্থায় ট্রেইলার বিকেলে যশোর পৌঁছলো। একটা বাসে রওনা হয়ে রাতে খুলনা পৌঁছলাম। খুলনা শহরে ফেরিঘাটের মোড়ে আসতেই বাসের হেলপার বাসের জানালা বন্ধ করতে বললো। তখনও স্থানীয় বিহারীদের সাথে থেকে থেকে গুলি হচ্ছে। রাতে বড় বাজারে একটা হোটেলে উঠলাম। সেখানে পাশের বাড়ির তরণী সেনের সাথে দেখা। কয়েকজন মিলে হোটেল ম্যানেজারকে বললাম, আমরা শরণার্থী, বেশি টাকা দিতে পারব না। ভদ্রলোক অল্প টাকায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তার বদান্যতা ভুলব না। থাকতে না দিলে ঐ শীতে যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না।
রূপসা থেকে তখন সকালে ট্রেন ছাড়ে। সেই ট্রেন ধরে সকাল দশটার দিকে বাগেরহাট। রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে দাসপাড়া মোড়ের দিকে তাকালাম। কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই। আনোয়ার কাকার দোকানের দিকে যাওয়ার সময় এক পরিচিত রিকশাওয়ালা জোর করে রিকশায় উঠিয়ে বাড়ির দিকে নিয়ে চললো। বর্তমানে যেখানে শঙ্কর পালদের বাড়ি ঐ পর্যন্ত এলে দেখি বিশু, আমার ছোট ভাই খালি গায়ে একটা কালো রঙের প্যান্ট পরে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আসছে। রিকশা থামিয়ে ওকে উঠালাম। বটতলায় চায়না দাঁড়ানো। জাকাতে পাওয়া একটা সবুজ জমিনের শাড়ি পড়ে। রিকশা ছেড়ে দিলাম। গেটে মা, আলেয়া, কাকিমা, আরতিদি, ছবি, বেবি দাঁড়ানো। বিশু, চায়নাকে নিয়ে মার দিকে এগিয়ে গেলাম। মাকে জড়িয়ে ধরলাম, মার চোখে জল, আমারও। জগন্নাথ বাজারে ছিল। সংবাদ পেয়ে ছুটতে ছুটতে এলো।
আজ দীর্ঘ সাতচল্লিশ বছর হতে চলেছে। আজও আমার মনে হয় সেদিনের কথা। আমি একজন ভীরু অপদার্থ সন্তান। আমার বাবার হত্যার বিচার চাইতে পারিনি। এই লজ্জা, এই দুঃখ আজও আমাকে কষ্ট দেয়।


স্বপন বসু

শহীদ ভোলানাথ বসুর প্রথম পুত্র