গ্রাম হতে দূর-নিকট আত্মীয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এরকম অনেকের নিকট হতে চার হাজার টাকা ধার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম এপ্রিল ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে—সবে মাত্র ক্লাস শুরু হল প্রাণিবিদ্যা বিভাগে।
গ্রাম হতে এসেছি, যাকে বলে অঁজপাড়া গাঁ। নতুন নতুন বন্ধু, সোডিয়াম আলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আর নিয়ন বাতির চোখ ধাঁধানো ঢাকা শহর। পৌরাণিক কাহিনীর মত শুরুটা, দিনগুলি সুখেই কাটছিল—গদ্যের বিষয় শুধু বন্ধুদের নিকট হতে ধার করে করে ক্ষুধা মেটাবার ব্যাপারটি।
কিন্তু সবকিছুর তো একটি সীমাবদ্ধতা থাকে। এক শিক্ষকের কাছে সরাসরি লজ্জায় না বলতে পেরে দোকান হতে ফোন করে পাঁচশত টাকা ধার চেয়েছিলাম। শিক্ষক জানতে চেয়েছিলেন আমি নেশা করি কিনা। হয়তোবা এ ধরনের ঘটনা তার জানা থাকবে। লজ্জায় পরের দু’তিন বছর তার চোখ এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম।
যা হবার হল, যতদূর মনে আছে ২০০৪ সনের আগস্টের মাঝামাঝি সব ক্লাস-ব্যবহারিক বন্ধ করে গ্রামে চলে যেতে হল। বন্ধুদের কাছ হতে ধার দেনা করে, অন্য বন্ধুর মেসে ফ্রি খেয়ে আর কত দিন চলা যায়। গ্রামের অনেকের চাহনী এ রকম যে লেখাপড়ার পাট চুকলো। আর কত? নিস্বের সন্তানের আইএ পাস যথেষ্ঠ হয়েছে।
সর্বশক্তিমানের পরিকল্পনা সর্বদা পূর্ব-নির্ধারিত। আলাওল অন্যের ফোন থেকে ফোন করে আমাকে জানালো তার কাছের কেউ আমার জন্য একটি টিউশনি ঠিক করেছে, মাসিক নয়শত টাকায় শ্যামলীতে। আমি গভীর নিশ্বাঃস নিলাম আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম মনে মনে।
কার কাছ হতে এখন মনে নেই একশত টাকা ধার করেছিলাম ঢাকা আসার জন্য। আশি টাকা দিয়ে টিকিট করে আবার পাড়ি দিলাম মসজিদের শহরের উদ্দেশ্যে। আবার ক্লাস-ব্যবহারিক শুরু। এসে দেখলাম দশ নম্বরের একটি টিউটোরিয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে, যা আমি দিতে পারিনি। ঐ জের আমাকে অনার্সের তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত টানতে হয়েছিল। তৃতীয় বর্ষে পৌছেও প্রথম শ্রেণি হতে এক নম্বর কম ছিল।
পড়াতে শুরু করলাম আর মাসিক নয়শত টাকা পেতে থাকলাম। তখন দিনে ত্রিশ টাকায় ভালভাবে আমার দিন চলে যেত। কিন্তু সমস্যা একটু রয়ে গেল। মাসিক নয়শত টাকা পেলেও বাসাভাড়া বাবদ মাসিক প্রায় দেড়শত টাকা চলে যেত। তাছাড়া আয় রোজগারহীন পরিবারে কোন সমস্যায়, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনায় অনিয়মিতভাবে কিছু টাকা পাঠাতে হত। ফলে কিছু টাকা ধার করতেই হত। এ ভাবে অনেক বন্ধুর কাছে বেশ কিছু টাকা ঋণী হয়ে গিয়েছিলাম।
বন্ধুরা আমার টিউশনিতে টাকার পরিমাণটা হয়তো জানতো না। তাই তাদের টাকা শোধ না করাতে কয়েকজন মিলে (হয়তো দৈবক্রমে) আমার কক্ষে এসে অপমানসূচক কথাবার্তা বলেছিল। সেদিন রাত্রে মুখে বালিশ চেপে অনেক কেঁদেছিলাম। রুমের বড় ভাই এসে কিছু বলেছিলেন কিনা আমার আজ তা মনে নেই। আমার বন্ধুদের কোন দোষ ছিল না কারণ টাকা ধারের বয়স দু’বছর হয়ে গেলেও আমি ঋণ পরিশোধ করিনি। তাদের সামর্থ্য ও ধৈর্যের তো সীমা ছিল।
সেদিনের ঘটনা আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। আমি দ্রুত চাকুরীর জন্য প্রস্তুতি নিতে পেরেছিলাম। প্রথম দিকে দু’এক জন যারা একটি চাকুরী পেয়েছিল আমি তাদের মধ্যে একজন ছিলাম। অপরদিকে, ভর্তির প্রথমদিকে যে মেয়েটি আমার সাথে ঘোরাফেরা করত ততদিনে তাকে অন্য ছেলের সাথে ফোনে ও রিক্সায় দেখা গিয়েছিল।
-চলবে
শান্ত, যশোর