’৭১-এর গল্প // বীর মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী এমদাদুল হক

follow-upnews
0 0
গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ
বীর মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী এমদাদুল হক। প্রশাসক, জেলা পরিষদ, গোপালগঞ্জ।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিই। প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য কোলকাতা যাই। কোলকাতায় যাওয়ার পর কোথায় ট্রেনিং নেব চিন্তাভাবনা করছিলাম।

সেখানে তৎকালীন এমপি মোল্লা জালাল উদ্দিন সাহেবের সাথে দেখা করলাম। আমার সঙ্গে তখন আরও অনেকে ছিলো। উনি আমাদেরকে বললেন, তোমাদের জন্য স্পেশাল একটা ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোল্লা জালাল উদ্দিন সাহেব বিশ্ব জনমত গঠন করার জন্য পরে লেবানন চলে যান। তারপর আমি হঠাৎ রাজ্জাক ভাইয়ের দেখা পাই। ঐ ৮ নং থিয়েটার রোডেই। আমি কোলকাতায় কোথায় উঠেছি রাজ্জাক ভাই জানতে চাইলেন। বললাম, আমি তো এখনও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। উনি শ্যামবাজারের একটা ঠিকানা দিয়ে আমাকে সেখানে যেতে বললেন। এতদিন বেনাপোল, বনগাঁ আর কোলকাতায় ঘোরাঘুরি করেছি। কোলকাতা যেতাম, ঘুরতাম, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।

শ্যামবাজার যাওয়ার পর খাওয়া দাওয়া ভালোই হলো। এভাবে কিছুটা সুস্থ হলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম, গামা (ইসমত কাদির গামা) আমার আগেই ওখানে পৌঁছে গেছে। ওখানে একটি চারতলা বাড়ী ভাড়া নেওয়া হয়েছিলো। বাড়ীটাতে বিশেষ ব্যক্তিদের রাখা হত।

মণি ভাই (শেখ ফজলুল হক মণি) আমাকে আর গামাকে বললেন, আমি তোমাদেরকে এক জায়গায় পাঠাব। আমি বললাম, আমাকে মোল্লা জালাল সাহেব এক জায়গায় যেতে বলে গিয়েছে, তবে আপনি বললে আমি জাহান্নামেও যেতে পারি।

কোথায় যাব জিজ্ঞেস করি নাই। তাছাড়া জিজ্ঞেস করলেও জানা যেত না। আমি না গেলে আমার জানার সুযোগ নেই। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি যাব। উনি আমাদের কিছু টাকা দিলেন ভাগ করে। উনি বললেন, আমরা যেন আরও কিছু লোক যোগাড় করে নিয়ে যাই। আমরা নিজেরা সহ মোট ৩১ জন লোক একসাথে জোগাড় হয়েছিলাম। এখন আর ওভাবে নাম মনে নেই। লুৎফর রহমান বাচ্চু, জয়ন্ত কুমার সরকার —এরকম অনেকে ছিলো। ৩১ জন লোকের একটা টিম পেলাম আমরা। কী ধরনের লোক নিয়ে যেতে হবে তার একটা গাইডলাইন আমাদের আগে থেকেই দেওয়া হয়েছিলো। মূলত মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং-এর জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।

মুজিব বাহিনীর ট্রেনিংটা দুই ভাগে হত। শ্রমিকদের নিয়ে একটা, আরেকটা ট্রেনিং হত আমাদের মতো শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে। স্কুলের ছাত্রদেরও আমাদের সাথে ট্রেনিং-এ নেওয়া হত। বনগাঁ এসে আমরা আরও লোক জোগাড় করলাম। বনগাঁ স্টেশন থেকে আমরা পরের দিন রওনা হয়েছিলাম। ওখানে তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, এবং আরও অনেক নেতা ছিলেন। বিভিন্ন জেলার মিলিয়ে আমরা ৭০০/৮০০ জন ছিলাম। ফারাক্কা পার হয়ে আমরা নিউ শিলুগুড়ি রেল স্টেশনে নামলাম। ফারাক্কায় তখনও বাঁধ হয়ে পারেনি। 

কয়েকটি আর্মির ট্রাকে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো পাহাড়ের পাদদেশে। মূলত ওটা ছিল নকশাল বাড়ী। ওখানে আমরা ১৫ দিন থাকলাম। এরপর আমাদের বাগডুগরা নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা শুধু কথামতো কাজ করেছি, হাইকমান্ড যা বলে তাই শুনেছি।

তোফায়েল আহমেদ, ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক —এই চারজন আমাদের লিডার ছিলেন। এদেরকে একসাথে ফোর লিডার বলা হত তখন। তাদের নির্দেশেই আমরা সবকিছু করেছি। কিছুদিন এখানে ট্রেনিং করার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো উত্তর প্রদেশের শাহরানপুর নামক একটা জায়গায়। ওটা ছিলো আর্মিদের ক্যান্টনমেন্ট এয়ারপোর্ট। ওখানে নেমে আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম। আর্মিরাই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো। ওখান থেকে আবার ট্রাকে করে চলে গেলাম দেরাদুন। দেরাদুন আর্মি ক্যান্টনমেন্ট আমাদের পৌঁছে দিলো, কিছুদূর আমাদের সুড়ঙ্গ পথেও যেতে হয়েছিলো।

পথে আমাদের একটা বিপদ হয়েছিলো। সুড়ঙ্গ পথে একটা ট্রাক আটকে ছিলো, ফলে আমরা আর এগোতে পারছিলাম না। পরে ওয়ারলেসে খবর পাঠানোর পর ওপাশ থেকে তিনটে ট্রাক এসে আমাদের নিয়ে যায়। আমরা পাঁচ ট্রাকের যাত্রী নেমে আটকে থাকা ট্রাকটা পার হয়ে আবার ট্রাকে উঠি। যাইহোক, দেরাদুনে খাওয়া দাওয়া করে রাত ১০টায় আবার রওনা হলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। ঐ জায়গার নাম ছিল সম্ভবত চাকারতা। এটা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত একটি গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্প। আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন জেনারেল ওভান। আমাদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থাটা জেনারেল ওভানের মাধ্যমে হয়েছিলো।

ওখানে পৌঁছে আমরা ট্রেনিং শুরু করলাম। আমরা আর্মস্ ট্রেনিং নিয়েছিলাম। থ্রি-নট-থ্রি চালানো, এসএলআর চালানো ট্রেনিং দিছে, গ্রেনেড কীভাবে ছুড়তে হয় ইত্যাদি ট্রেনিং। আমরা ট্রেনিং নিয়েছিলাম একটা পাহাড়ের উপরে। পাহাড়ের উপরের ঐ জায়গাটা ছিলো খুবই সুন্দর। কিন্তু ওখানে গোসলের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। একটা ট্যাংকি ছিলো যেটাতে ঝর্ণার পানি ধরা হত। এক রাত্রে দেখা গেল পানি সব বরফ হয়ে গেছে। খাওয়ার পানি নাই, হাত ধোয়ার পানি নাই, সব পানি বরফ হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে গিয়ে মাটিতে হাত পরিষ্কার করে কাগজ দিয়ে মুছে ফেলতাম। এরপর কোনোমতে এক কাপ চা খেতাম। আমাদের খাওয়া দাওয়া খুব ভালো হত। আমরা ওদের কাছে একবার মাছ খেতে চাইলাম। কোলকাতা থেকে মাছ এনে আমাদের খাওয়ানো হয়েছিলো। এমনকি আমাদের মাংসও খাওয়ানো হয়েছিলো।

৪৮দিন আমরা আর্মসের ট্রেনিং করেছিলে। এর মধ্যে ভারি আর্মসের মধ্যে মর্টারের ট্রেনিংও করেছি। এনআরগা নামে বিমানে মারার একটা অস্ত্র ছিলো— ওটার ট্রেনিংও নিয়েছিলাম। মেশিনগান চালানোর ট্রেনিং-এর ব্যবস্থাও ছিলো। হাতে কলমে ট্রেনিং করার পর ক্লাস হত। যুদ্ধে কীভাবে ডিফেন্স নিতে হয় সে বিষয়েও ট্রেনিং নিয়েছিলাম। হাতে-কলমে আমরা এটা করেছি। একদল আমাদের আক্রমণ করছে, আর আমরা তা প্রতিহত করছি। পিসি ভায়াস আমাদের এই ট্রেনিংটা দিতেন। উনি ছিলেন মেজর জেনারেল। আর্মসের সাথে তার এতটাই সম্পর্ক ছিলো যে, ভদ্রলোক রাইফেল দিয়ে গুলি করে নাম লিখতে পারতেন। উনি সিপাহী থেকে ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন। আর ছিলেন মিস্টার মালহোত্রা, উনিও খুব শার্প ছিলেন। আমি একদিন ক্লাসে ঝিমোচ্ছিলাম, উনি চক দিয়ে ব্লাকবোর্ডে লিখছিলেন— চক ছুড়ে মারলেন ঠিক আমার কপালে। মালহোত্রা আমাদের ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন।চাকারতায় আমরা মোট ৪৮ দিনের ট্রেনিং করেছি। ৪৮ দিন পর ট্রেনে করে আবার শাহরানপুর ফিরে আসলাম।

ট্রেনিং নিয়ে আমরা শাহরানপুর থেকে দমদম চলে আসি বিমানে। সেখান থেকে চলে যাই আলীপুর। আলীপুরে আর্মি ক্যাম্প ছিলো। ক্যান্টনমেন্টের একটি বাড়ীতে আমাদের রাখা হয়েছিলো কয়েকদিন। আমার সাথে চেনাজানা কয়েকজন ছিলো— মাদারিপুরের শাহজাহান খান, যশোন নওয়াপাড়ার পীর সাহেবের ছেলে শাহ হাদিউজ্জামানের কথাও মনে আছে। শাহ হাদিউজ্জামান যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, মারা গিয়েছেন। গোপালগঞ্জের মকসুদপুর থেকে মাওলানা সিরাজ, কাশিয়ানির মুজিব বাহিনীর ক্যাপ্টেন হাসান ছিলো। এরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রেনিং নিয়েছে। আলীপুরে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম।

এরপর আমরা দেশে আসলাম। দেশে আমাদের আগে আরেকটু টিম আসছিলো। ঐ টিমটা সম্ভবত শ্রমিকদের ছিলো। তাদেরকে বলা ছিলো— আমি না আসা পর্যন্ত তারা কোনো অ্যাকশনে যাবে না। তাদের থাকার কথা ছিলো সুলতান শাহীতে, কিন্তু তারা সুলতান শাহীতে ছিলো না, তারা ছিলো নিজরায়।

আমরা দেশে ঢুকেছিলাম বাগদা বর্ডার দিয়ে, বনগাঁ বর্ডারের পাশে বাগদা বর্ডার। যশোরের কালিগঞ্জ দিয়ে এসে লোহাগড়া নামলাম। বর্ষাকাল ছিল, খাল দিয়ে আসছি। ক্যাপ্টেন সাহেবের বাড়ী পর্যন্ত আসতে আসতে রাত হয়ে গেলে সেখানেই থেকে যাই।

প্রথমে আমরা কাশিয়ানীতে এসে ক্যাপ্টেন সাহেবের বাড়ীতে উঠেছিলাম। উনি আমাদের খাওয়ালেন। গামার টিম আর আমার টিম, আমরা দুই টিম তখন ক্যাপ্টেন সাহেবের বাড়ীতে, বাকীরা চলে গেছে।

ওখান থেকে জুন্নু ভাই আমাদের নিয়ে আসলেন আড়োকান্দি। আড়োকান্দি স্কুলে আমরা ছিলাম। এরপর আমরা ঐ টিমটা খুঁজতে বের হলাম। ওদের খুঁজতে জুন্নু ভাই আর আমি প্রথমে গেলাম বড়ফা, পরের দিন ভোরে সুলতান শাহীর দিকে আসলাম। তখন তো আর মোবাইলের যুগ না, তাই কোনোভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না।

ওখান থেকে পাইককান্দি গেলাম। পাইককান্দি গিয়ে খবর পেলাম— একটা টিম নিজরাতে আছে। ধরে নিলাম ওরাই ওখানে আছে। এরপর ওদেরকে এবং গামার টিম নিয়ে ক্যাম্পে উঠলাম। নিজরার নারকেলবাড়ীতে প্রথমে ক্যাম্প করেছিলাম। একজনকে টিম লিডার বানিয়ে দিয়ে ছয়জনকে কাশিয়ানী পাঠিয়ে দিলাম। ওখানে তখন পাকিস্তানিদের ক্যাম্প ছিলো। যাদের পাঠিয়েছিলাম, ওদের বাড়ীও ওখানে ছিলো।

নারকেলবাড়ী ছিলো নিচু জায়গা, তাই কয়েকদিন পরে গোপীনাথপুরে এসে আমরা ক্যাম্প করি। গোপীনাথপুর এসে একটা বড় মিটিং করলাম। সবগুলো টিম সে মিটিং-এ অংশগ্রহণ করেছিলো। আমাদের কাজ শুধু যুদ্ধ করা ছিলো না, আমরা নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম। আমরা আওয়ামীলীগের লোকজনদের সংগঠিত করতাম। খবর দিলে সবাই গোপীনাথপুর আসত, ওদেরকে মোটিভেশন দিয়ে পাঠাতাম। মুক্তিবাহিনীর সবাইকে বলে দিয়েছিলাম, তোমরা কারও কাছ থেকে চাঁদা নিতে পারবা না, তোমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা আমরা করব। 

আওয়ামী লীগের নেতারা খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করত, টাকা দিত, চাউল দিত। আমাদের এই টিম কোনোদিন কারও কাছে টাকা পয়শার জন্য যায়নি। অনেকে তো অনেকের কাছে গিয়ে টাকা চাইছে, অনেকে ভয়ে দশ হাজার বিশ হাজার দিয়েও দিছে। আমাদেরকে যারা দিয়েছে স্বেচ্ছায় দিয়েছে, তাদেরকে আমরা যুদ্ধের সাথে জড়িত করেছি। আমাদের সাথে এবাদত ছিলো, শেখ আব্দুল্লাহ ছিলো, ওরা ইন্ডিয়া যায়নি। সবাই যে ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে যুদ্ধ করেছে এমন নয়। আওয়ামীলীগের অনেক নেতাও ইন্ডিয়া যায়নি।

আমরা যুদ্ধের সাথে আরও বেশি মানুষকে যুক্ত করতে চাইলাম। বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন ইউনিয়নের সভাপতি এবং সম্পাদককে আমরা সম্পৃক্ত করেছিলাম যুদ্ধের সাথে। তারপরে আমরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মিটিং করেছি। এসময় আমরা একটা বিরাট মিটিং করেছিলাম কড়পাড়ায়। আমরা ছোটখাট কিছু যুদ্ধও করেছি— যেমন, উলপুরে যুদ্ধ করেছি, আর যুদ্ধ করেছি ফুকরাই। ফুকরাইয়ের যুদ্ধে লিডারশিপ ছিলো আমাদের ক্যাপ্টেন বাবুলের হাতে। ক্যাপ্টেন বাবুল আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ছিলেন, ওনার নেতৃত্বে ফুকরাইয়ের যুদ্ধ হলো।

ফুকরাইগামী পাকিস্তানি আর্মিদের লঞ্চে ফায়ার করা হলো। ওরা ফায়ার করতে করতে পাড়ের দিকে ভিড়ছে। পাড়ের দিকে এসে সিঁড়ি দেয় না, ফায়ার করে চলেছে। ফুকরা দিয়ে যাওয়ার সময় ওরা গণহত্যা চালায়। বহু সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। ফুকরায় অনেক বড় ম্যাসাকার ঘটিয়েছিলো পাকিস্তানি আর্মিরা সেদিন।

এরপর আমরা গোপালগঞ্জ ঢোকার সিদ্ধান্ত নিই। হেমায়েতের টিক একদিন থেকে, আমার এবং গামার টিম একদিন থেকে। আর একটা টিম আসার কথা ছিলো গোবরা দিয়ে। একটা ডেট ছিলো ডিসেম্বরের ১০ তারিখ বোধহয়। ৬ তারিখ আমরা হঠাৎ শুনলাম যে, ভারত স্বীকৃতি দিয়ে দিছে। ওই দিনই আমরা শুনলাম, গোপালগঞ্জের আর্মিরা চলে গেছে। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম। সন্ধ্যার মধ্যে গোপালগঞ্জ পৌঁছুলাম। আমরা এসে পৌঁছার আগেই ক্যাপ্টেন শিহাবের একটা টিম ঢুকেছিলো। এরপর মুক্তি বাহিনীর অন্য টিমগুলো ঢুকেছিলো। এসে দেখি ডিসি নেই, পুলিশ সুপার নেই, ওসি নেই, থানায় অস্ত্র নেই। তখন আমরা মিটিং করলাম যে, কী করা যায়। প্রথমে ঠিক করলাম— এই রাত্রে কেউ বের হতে পারবে নাম কারফিউ দিয়ে দিলাম। মাইকিং করলাম। এসব সিদ্ধান্ত আমাকে দিতে হয়েছে তখন। কেন কারফিউ দিলাম সেটি একটি প্রশ্ন— আমরা শুনতে পেলাম যে, আজকে রাতে কয়েকজন মুসলিম লিগারের বাড়ীতে আক্রমণ করা হবে, লুটপাট করা হবে। এখন এই মুক্তিযোদ্ধারা লুটপাট করবে, এটা আমরা হতে দিতে পারি না। আমরা সেটা করতে দিইনি। এরপর হাজার হাজার লোক গোপালগঞ্জ ঢুকলো, প্রথমেই ওয়াহিদুজ্জামানের বাড়ী, দুই ঘণ্টার মধ্যে এক এক খান করে ইট খুলে ফেললো।

আমার জানা ছিলো যে, মাহমুদের কালেকশনে অনেক বই আছে। আমি হুমায়ুন স্যারকে ডেকে বললাম, আপনি বইগুলো লিস্ট করে নেন। শেষে ঠ্যালা গাড়িতে করে ঐ বইগুলো দিয়ে দিছি। না হলে ওগুলোও নষ্ট হয়ে যেত। এখনও বইগুলো আমাদের নজরুল লাইব্রেরিতে আছে। তারপরে তো আমরা গোপালগঞ্জে পতাকা ওড়ালাম। ৭ তারিখে আমরা গোপালগঞ্জে ঢুকেছি, ৮ তারিখ একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে পতাকা ওড়াইছি। তারপরে এডমিনিস্ট্রেশনে হাত দিলাম— থানায় আমাদের লোক বসায়ে দিলাম। জেলখানা খালি, জেলার ছিলো না। একজন জেল ক্লার্ক ছিলো, আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলো, তাকে ঐ সময় জেলার বানায়ে দিলাম। ওখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে আরও কিছু স্টাফ বানায়ে দিলাম।

মুন্সেফ সাহেবকে এডমিনিস্ট্রেশনে বসালাম। উনি নির্দেশ দিতেন, সেই নির্দেশ অনুযায়ী আমরা লোকাল এডমিনিস্ট্রেশন সাজালাম। থানার লুটপাট করা আর্মস্ উদ্ধার করলাম। সেগুলো উদ্ধার করলাম মাঝিগাতির ওদিক থেকে। এই করতে করতে ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) বঙ্গবন্ধু আসলেন। সে যে কী ফুর্তি তোমরা তা চিন্তা করতে পারবা না। ফুর্তিতে অনেক ফায়ারিং হইছে, ওপেন ফায়ারিং, বন্দুকের গুলি আছে খরচ করলাম। দু’টি ছেলে মারা গিয়েছিলো এইসব কাণ্ড কারখানায়— ওরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলো।

দুই মাস পর্যন্ত আমাদের এডমিনিস্ট্রেশন চালাতে হয়েছে। তখন মানুষ আমাদের কাছেই আসত। আমরা চাকরি বাদ দিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, এখন মানুষ আমাদের কাছে আসতে শুরু করল, তাদের একটি সার্টিফিকেট দিতে হবে, কারণ, তারা চাকরিতে ফেরৎ যাবে। এই কাজও আমরা করেছি। আমার এবং বাচ্চুকে এই কাজটা করতে হয়েছিলো। 

আমি গোপালগঞ্চ ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। বুড়ো বয়সে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হলাম। সে আরেক ব্যক্তিগত ইতিহাস। এই সময় আমি বি.কম পড়ি— ঘটনাক্রমে জেলা ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্টে হতে হয়েছিলো। এর আগে আমি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ছিলাম। সেখান থেকে ছাত্রলীগে আসলাম। তখন ছাত্র রাজনীতি এভাবে করা যেত না, আমরা পার্টির নির্দেশ মেনে কিছু আনুষাঙ্গিক কাজ করতাম। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আসলাম, কিছু নির্দেশনা নিয়ে আসলাম। এবার আমরা দেশের কাজে লেগে গেলাম।

Next Post

অথৈ অতল // গাজী লতিফ

ব্রহ্মাণ্ডের চেয়ে বড়, ক্ষুদ্র এই মন খামোকাই হতে পারে মন উচাটন আলগোছে অকারণ সে যে মানে না বারণ!   যে পারে মানাতে বশ সে-ই মহাজন।   সাগর তো সামান্যই, কতইবা জল! দু’চোখের ঝরনাই আদি ও আসল এ চোখের গভীরতা এতোটাই অথৈ-অতল! দিনরাত টলমল অবিরল করে ছলছল   অথৈ অকূল বলে […]
গাজী লতিফ

এগুলো পড়তে পারেন