অবহেলিত দিনগুলি

পূর্ব প্রকাশের পর

একটা বয়স পর্যন্ত সন্তানের মা-বাবার প্রতি কোনো মনোযোগ থাকে না, থাকে শুধু আবদার। আবদার করার খুব সুযোগ পেতাম না, বাবা মাকে কাছে পাওয়ার সুযোগ ছিলও খুব কম। বাবা বাইরে বাইরে বেশি খাকতেন। মা চরম অগোছালো এবং চরম অভাবের সংসারে হিমসিম খেতেন। মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন থাকতেন বছরের অর্ধেক সময়, ফলে সমস্যা আরো বাড়ত।

’৯২ সালের প্রথম দিকের কথা। বাবার শরীরের বাম পাশে বুকের নিচে একটি টিউমার ওঠে। ক্রমান্বয়ে ওটি বড় হতে থাকে। টিউমারটি দুই হাতের তালু দিয়ে ধরার মত বড় হয়ে যায়। ওটা নিয়ে তিনি আগের মতই ঘোরাফেরা করতেন। কালিপূজোর সামিয়ানা টানাতে গিয়ে টিউমারটিতে বেলের কাঁটার খোঁচা লাগিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরিয়েছিলেন। টিউমারটিতে সমস্যা হতে শুরু করে।

অপারেশন করানো প্রয়োজন ছিল। চেয়ে, ধার করে টাকা যোগাড় করা প্রয়োজন ছিল, উনি তা করলেন না। অবশ্য চরম অভাবী হলেও চরম বেহিসেবি ছিলেন, জীবনের প্রতি মারাত্মকভাবে উদাসীন, কিছুটা দাম্ভিক একজন ব্যক্তির পক্ষে চেয়েচিন্তে টাকা যোগাড় করা দুঃসাধ্য।

উনি সহজ পথে হেঁটেছিলেন। জেলা শহরের একজন ডাক্তার দিয়ে অপারেশন করিয়ে নিলেন। শুনেছি ডাক্তার অপারেশন করতে রাজি ছিলেন না, উনিই রাজি করিয়েছিলেন। ডাক্তার মোজাম্মেল, যিনি পরে সংসদ সদস্য হন, বর্তমানেও তিনি সংসদ সদস্য। প্রচুর রক্ত ঝরেছিল।

অপারেশন পরবর্তী চিকিৎসা এবং শুশ্রুষা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সুযোগ ছিল না। আবার তিনি আগের জীবনধারায় ফিরে গেলেন। ঘা শুকিয়ে গেল। উনি সেরে উঠলেন। পরিবারে আপাত স্বস্তি ফিরল।

শেষ পর্যন্ত পারলেন না, শরীরের দুর্বলতার কারণেই আগের জীবনধারায় তিনি আর ফিরতে পারলেন না। খেতে পারতেন না, ক্রমান্বয়ে মোটেও আর খেতে পারেন না। সুস্থ অবস্থায় সকালে আলু ভর্তা এবং সাথে শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে নিতেন। এখন আর তা পারেন না। সকালে দুটো শুকনো রুটি চায়ে ভিজিয়ে খান, তাও শেষ করতে পারেন না।

মুখোরোচক না হলেও তরল খাবার গিলে ফেলা যায়। সে সুযোগ ছিল না। দুধ যোগাড় করার মত সামার্থ কোথায়? ঘরে ঠিকমত রান্নার চালই তো থাকত না। ওনার সুঠাম স্বাস্থ্য ভাঙতে থাকে। অপারেশনের জায়গায় গুটির মত কিছু একটা দেখা যায়। ওটি আবার বড় হতে থাকে।

বাবার শরীরের অবস্থা খেয়াল করার মত বয়সে আমরা কেউই ছিলাম না। না বুঝে যতটুক যা দেখতাম। টিউমারটা আবার আকার পায়। এখন উনি একেবারেই খেতে পারেন না। আমি পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে গেছি। বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বাগেরহাট মামার বাসায় চলে গেলাম। বাবা বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য একটি বই কিনে দিয়েছিলেন। বইটি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতাম। পড়া হত না কিছুই।

বাগেরহাট বসে একদিন শুনলাম বাবাকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে চিকিৎসার জন্য। সামান্য জায়াগা জমা রেখে কিছু টাকা ম্যানেজ করা হয়েছে। বাবার কাকাত ভাই এবং এক বোন সাথে গিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে ফিরবেন বলে নিশ্চিত হয়েছিলাম।

গ্রাম থেকে শহরে গিয়েছি। পড়ার চেয়ে শহুরে চালচলনে আগ্রহ ছিল বেশি। ক্রিম রোল জিনিসটা বেশ পছন্দ হয়েছিল। মামার টেবিল থেকে খুচরো পয়শা নিয়ে তিন টাকা দিয়ে একটা কিনে খেয়েছিলাম একবার। বাসে ওঠাও তখন অ্যাডভেঞ্চার। বাগেরহাট থেকে বাড়ি আসলে নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা মনে হত। সমবয়সীদের সাথে ইঙ্গিতে ভাব নিতাম, “তোরা কোনোদিন এতবার বাসে চড়েছিস!” দ্যাখ! আমি প্রতিমাসে বাসে উঠে বাগেরহাট যাই।

বাবার চিকিৎসার খবরাখবর জানতাম না। চিকিৎসা সম্পর্কে অনবরত কোনো ভাবনাও তখন ছিল না। এমন হয়েছিল, ইন্ডিয়ার নেওয়ার পর বাবার কথা খুব একটা আর মনে পড়েনি। মা তার অন্য সন্তানদের নিয়ে মামা বাড়িয়ে উঠেছিলেন। মামা বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত থাকায় ঐ যাওয়াটা আলাদা কিছু ছিল না।

শীতকাল শেষ। গরম পড়তে শুরু করেছে। বাগেরহাটে মামাদের বাসা ছিল তখন রাস্তা ঘেষে। রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে মোটর গাড়ি চলে যাওয়া দেখতাম। ঘন ঘন রিক্সা চলা দেখে রোমাঞ্চিত হতাম। গ্রামের রাস্তায় আধাঘণ্টা দাঁড়ালে একটা ভ্যানের দেখা মিলত। এখানে একসাথে কত রিক্সা! মাঝে মাঝে রেলগাড়ি দেখতে যেতাম। সাপের মত ঢেউখেলানো লম্বা একটি রেল গাড়ি দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা থাকত না। তখন বাগেরহাট থেকে খুলনা পর্ন্ত রেলগাড়ি চলত। ভয়ে ভয়ে থামানো রেলেগাড়িতে উঠে আবার নেমে অাসতাম। কাজটা করতাম চুরি করে। বাসায় ফিরে পড়তে বসতাম, কিন্তু পড়া হত না। ইচ্ছে করত রেলে চড়ে অনেক দূরে যেতে, ইচ্ছে করত স্প্রিং লাগানো একটি খেলনা গাড়ি কিনতে, ইচ্ছে করত ক্রিম রোল খেতে।

বড় মামা বললেন, বাড়ি যেতে হবে। বাবা নাকি ইন্ডিয়া থেকে ফিরেছেন। বইপত্র গোছানোর সময় দিলেন না। অামাকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে আমাদের বাড়ি আসলেন। – চলবে।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক