বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে সবাই যখন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে সাধারণ জ্ঞান, হাবিজাবি ইত্যাদি পড়াশুনা করছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে প্রায় সবা-ই যখন আবার মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনায় মনোযোগ দিচ্ছে, এমনকি এই বয়সে চাকরির জন্য কোচিংও করছে, শাওন তখন বিশ্বসাহিত্যে মনোযোগ স্থাপন করেছে। বিশ্বসাহিত্য, বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্য পড়ে বুঝতে চাচ্ছে কেন ওরা সাহিত্য-দর্শনে এতটা এগিয়ে।
শাওন মূলত কবিতা লেখে, তবে কবিতার পাণ্ডুলিপি পর্যন্তই, কোনো পত্রিকায় কবিতাগুলো ছাপা হচ্ছে না, কোনো প্রকাশকও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশে কবিতার কোনো বাজার নেই। যাদের কবিতা ছাপা হচ্ছে তারা বেশিরভাগই কবি নয়, তবুও তাদের কবিতা ছাপা হচ্ছে যোগাযোগ, বন্ধুত্ব, মালিকানা এবং টাকা পয়শার লেনদেন ইত্যাদি কারণে। শাওনের তাই এ বিষয়ে খুব বেশি আক্ষেপ নেই, ও ভাবনাচিন্তা ছাড়াই লিখে যেতে চায়। কিন্তু গোল বেঁধেছে পল্লবীর আচরণে। পল্লবী একজন প্রতিষ্ঠিত কবির প্রেমে পড়তে চায়। শাওনের সাথে ও প্রেম করছে, কিন্তু সচেতনভাবে প্রেমে এখনও পড়েনি বোধহয়।
সপ্তাহখানেক আগে শাওন একটা কবিতার পাণ্ডুলিপি একজন খ্যাতনামা প্রকাশককে দিয়েছিল। এবার ও বই বের হওয়ার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। প্রকাশক তাকে বসিয়ে চা-বিস্কুট খাইয়েছে, যেটি এর আগে ঘটেনি। কোনো প্রকাশক বলতে গেলে বসতেই বলেনি। “কবিতার বই চলে না” বলে বিদায় দিয়েছে। বইটা ছাপা হবে কিনা কালকে প্রকাশক ফাইনাল জানাবে। ও মনে মনে একরকম নিশ্চিত হয়ে রয়েছে যে, এবার বইটা ছাপা হবেই। খবরটা ও পল্লবীকে সাথে নিয়ে পেতে চায়। আজকেই ফোন করে একটা ডেটিং-এর পরিকল্পনা জানিয়ে রাখতে হবে।
পল্লবী অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে, কিন্তু লেখকদের প্রতি ছোটবেলা থেকেই ওর বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। শাওন বড় লেখক হয়ে উঠবে— এটাই ওর বিশ্বাস ছিল। কিন্তু গত তিন বছর অপেক্ষা করে করে ও এখন বিরক্ত। শাওনকে এখন খুব একটা পাত্তা দিতে না চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারে না। শাওনের ফোন পেয়ে উল্লসিত না হলেও দেখা করার বিষয়ে এখনও কখনো ‘না’ করে না। কালকে বিকালে টিএসসিতে দেখা হবে। শাওন বইয়ের কথা বলতে যেতেই ও থামিয়ে দিয়ে বলে— থাক, কবিত্ব আর লাগবে না, চাকরি বাকরির জন্য চেষ্টা করছো কিনা, সেইটা বলো। শাওনের চাকরির বয়স প্রায় শেষ। শেষ মুহূর্তে এসে এখন চাকরির চেষ্টা করতে ইচ্ছে না করলেও পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে চেষ্টাটা করতে হচ্ছে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে— এখনই একটা চাকরি না পেলে আর চলছে না।
শাওন সারাদিন অপেক্ষা করছে সুসংবাদটির জন্য। বেলা চারটা বেজে গেলো, কিন্তু এখনও কোনো ফোন আসলো না। শেষ পর্যন্ত প্রকাশনীর ম্যানেজারের কাছে ও নিজেই ফোন করেছে। ম্যানেজার সবই জানে, তবু বলছে, আমি বসের কাছে শুনে আপনাকে জানাব। শুধু শাওনের পাণ্ডুলিপিটি নয়, গতকালকে এরকম শ খানেক পাণ্ডুলিপি ম্যানেজার নিজেই কাগজের দরে বিক্রি করে রুম পরিষ্কার করেছে। বেশিরভাগ পাণ্ডুলিপিই কেউ পড়ে দেখেনি। বস পড়ে দেখার তো প্রশ্নই আসে না। শাওনের পাণ্ডুলিপিটিও কেউ পড়ে দেখেনি। বস শুধু শাওনের সামনে দু’একটি কবিতা পড়েছিল। ও পর্যন্তই। শাওন চলে আসলে এরপর আর কিছুই মনে রাখেনি প্রকাশক। শিক্ষিত মানুষ, নিজের সুনামের স্বার্থেই লেখক হিসেবে কেউ গেলে আপ্যায়ন করে, এতে শাওনের মতো অনেকেই বিভ্রান্ত হয়।
পল্লবী আসার সময় হয়ে গেছে, পল্লবী আসার আগেই শাওন সুখবরটা পেতে চায়। এক ঘণ্টা পরে শাওন আবার ম্যানেজারকে ফোন করেছে। এবার ম্যানেজার কোনো রাগঢাক না করেছে বলে, না বস, আপনার পাণ্ডুলিপিটি এবার মনোনিত হয়নি।
শাওনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পল্লবীকে তাহলে এবার সে কী বলবে! যেভাবে হোক পল্লবীকে ভোলাতেই হবে। ডায়েরি বের করে শাওন একটি কবিতা বাছাই করে রাখে, কবিতাটি জমা দেওয়া পাণ্ডুলিপিতেও আছে— কবিতাটি পল্লবী আসলে পড়তে হবে। নাহ! পুরনো কবিতা পড়া যাবে না। ও বসে বসে ছোট্ট একটা কবিতা লিখে ফেলে। প্রায় ছয়টা বাজে, টিএসসি’র সামনে রাস্তাঘেষা প্রাচীরের উপর বসে শাওন ডায়েরির পাতা ওল্টাচ্ছিল, হঠাৎ তাকিয়ে দেখে খয়েরি স্যালোয়ার কামিজ পরা ছিপছিপে গড়নের পল্লবী সামনে হাজির। এক সপ্তাহ পরে দেখা, শাওন লাফ দিয়ে পড়ে পল্লবীকে জড়িয়ে ধরতে চায়, কিন্তু সে সাহস ওর নেই। শুধু লাফ দিয়েই পড়ে, পল্লবী একটু পিছনে সরে গিয়ে শাওনকে জায়গা করে দেয়। পল্লবী বলে, আমি কিন্তু আজকে শুধু সুখবরটি শুনতে এসেছি, শুনেই চলে যাব। পরশুদিন একটি পরীক্ষা আছে।
দিশেহারা শাওন কোনো কথা খুঁজে পায় না। দিগ্বিদিক হারিয়ে বলে, ওরা তো এখনও কিছু জানালো না, ভুলে গিয়েছে হয়ত। “তুমি ফোন করো”— পল্লবী কয়েক পা ডান দিকে সরে গিয়ে দু’টো চায়ের অর্ডার দেয়। শাওন পিছে পিছে গিয়ে বলে, আমি ফোন করব কেন? ওরা ফোন করলে করুক, না করলে না করুক। “না করলে করুক! কী আমার বিখ্যাত কবি … এত ভাব তোমার নেওয়ার আর দরকার নেই, ভাব নেওয়ার দিন শেষ। তাড়াতাড়ি ফোন করো।” পল্লবী, তুমি কি এই পাণ্ডুলিপির কোনো কবিতা শুনেছো? জানি না, তুমি তো আমাকে বলোনি যে কোন কবিতাগুলো জমা দিয়েছো। আচ্ছা, পাণ্ডুলিপির সবচেয়ে দুর্বল কবিতাটি তোমাকে শোনাই। এখানে না, একটু অপেক্ষা করো, চা-টা শেষ করে আমরা কোথাও গিয়ে নিরিবিলিতে বসব, তখন শুনব।
টিএসসি থেকে হাঁটতে হাঁটতে ওরা মল চত্বরে এসে ঘাসের উপরে বসে। শাওন মুখ অন্ধকার করে রেখেছে, যতই হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করছে, ততই যেন ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিল— এবার বইটা ছাপা হবেই। আসলে ও জানে না যে, বর্তমান কোনো কবিতার বই-ই লেখকের টাকা ছাড়া ছাপা হয় না। পল্লবী নিরবতা ভঙ্গ করেছে। শাওন, এবার কবিতা শোনাও। একটাই, আজকে তোমার মন ভালো না। মন খারাপ কেন করো শুধু শুধু, তুমি কবি হতে পারবে না, এটা মেনে নাও। তোমার কবিতা কেউ পছন্দ করে না। এখনও সময় আছে চাকরি বাকরির চেষ্টা করো। এসব কথা শোনার পরে শাওনের আসলে কবিতা শোনানোর কোনো মুডই নেই। ডায়েরি এগিয়ে দিয়ে পল্লবীকে পড়তে বলে। পল্লবী পড়ে নেয়।
দেখতে ইচ্ছে করছে,
খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, ভীষণ!
আমার আকাশ,
আমার স্বপ্নের বাড়ী,
আমার মাঝ পথের গন্তব্য—
তুমি। তোমাকে।
শাওন মূলত পল্লবীকে ভোলাতে এই কবিতাটি পড়তে বলে। আসলে এটি পাণ্ডুলিপিতে নেই। পল্লবী আসার একটু আগে লেখা। এটা অতটা জোরালো কোনো কবিতা নয়, কিন্তু প্রেমিকাকে ভোলানোর জন্য তো বেশ। স্বাভাবিকভাবেই পল্লবী ধরে নেয়— কবিতাটি তাকে নিয়ে লেখা, তাই বাহবা না দিয়ে পারে না। আসলে পল্লবী কবিতা অতটা বোঝেও না, দেখতে চায় কোনো কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে কিনা, কোনো কবিতার বই বের হয়েছে কিনা, কবি বিখ্যাত কিনা। অন্য পাঁচ দশজনের মতো ওর-ও সরল অংক। সে হিসেবে শাওন ওর কাছে এখন পর্যন্ত কোনো কবিই নয়। তবে এরকম কোনো কবিতা যখন শাওন পল্লবীকে শোনায় তখন ওর ভালো লাগে। তবে ভালোলাগাটা কখনই গভীর আকর্ষণে পরিণত হয় না, বরং কিছুটা করুণা হয়।
নারী ব্যর্থ কারো প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে না, তবে কারও কারও জন্য বিশেষ করুণা অনুভব করে। শাওনের জন্যও পল্লবীর ঐ করুণাটুকু আছে। করুণার সাথে আছে মায়ার সম্পর্ক, আকর্ষণ যার প্রতি থাকে তার প্রতি আবার নারী বিশেষ মায়া অনুভব করে না। নারীর কাছ থেকে সবটুকু পাওয়া খুবই কঠিন। ওটা বোধহয় শুধু নারীর মাতৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
টিউশনি দুটোই শাওনের এখন একমাত্র উপার্জন। এই বয়সে টিউশনি করতে ভালো লাগে না, কিন্তু কিছু করার নেই। ইচ্ছে ছিল কোনো একটি পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক হওয়ার। কিন্তু এখানে সবকিছু সবজায়গায় সিন্ডিকেট এবং জোরাজুরির একটা বিষয়। এখন আর কিছু ভালো লাগে না, শুধু বেঁচে থাকাটাই দায়িত্ব,পাশাপাশি রয়েছে পরিবারের প্রতি দায়। তেজকুনি পাড়ায় টিউশনি। মাত্র আধাঘণ্টা হাতে আছে, পল্লীবের কাছ থেকে অনিচ্ছকৃতভাবে বিদায় নিয়ে শাওন শাহবাগের দিকে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করে। একটা কবিতা গুণ গুণ করছে বুকের ভেতর–
অস্তাচলে যাবার বেলায়,
প্রেয়শীর সুক্ষ্ম হেলায়
সন্ধ্যে নামে ছদ্মবেশে;
[তবু জীবন মহান,
লিখে রাখি সে মহা-উপাখ্যান।]
এখানে কৌতুক আছে সবকিছুতে,
তাইতো আমি বাঁচতি পারি
নীরবে অট্টহাসি হেসে।
এভাবে আর চলছে না। একটা কোনো চাকরি নেবে বলে মনস্থির করে ফেলেছে ও। খুব না হোক, কিছুটা পছন্দের কাজের ধারেকাছে চাকরি পেলেই ভালো হয়। গত কয়েকদিন ধরে শুধু চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে চলেছে। কোনো একটা প্রাইভেট চাকরিতে ঢুকতে হবে। হঠাৎ করে একটা এড ফার্মের বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছে। ওদের ওয়েব পোর্টালটা চালাতে হবে। তেমন না হলেও, কিছুটা লেখালেখির কাজ আছে বৈকি। “ভ্রমণ বিষয়ক ব্লগ লেখার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে” বলে ওরা শর্ত দিয়েছে। আগামী রবিবার জীবন-বৃত্তান্ত নিয়ে সরাসরি দেখা করতে হবে। বেতন আলোচনাসাপেক্ষ।
আসাদ সাহেবের আরও অনেক ব্যবসা আছে। অনেকটা শখের বসেই উনি ‘হলিডে’ নামে এই এডফার্ম এবং ভ্রমণবিষয় কোম্পানিটি করেছিলেন। সেটিও আজ খুব সফল। বাংলাদেশ থেকে তিনিই একমাত্র সফলভাবে এবং সুলভে মানুষকে বিদেশ সফর করান, একইভাবে বিদেশীদের বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। অনেকদিন ধরে ওয়েবসাইটটি নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছেন। এমনভাবে কিছু লেখা সেখানে দিতে চাচ্ছেন, যাতে পর্যটন বিষয়ে মানুষ অনেক কিছু জানতে পারে, শিখতে পারে এবং মানুষ ভ্রমণপিপাসু হয়ে ওঠে। যদিও ওনার কাছে ব্যবসাটাই মুখ্য, কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে নাম-যশ-খ্যাতি চান, টাকা দিয়ে যা যা করা যায় সবই তিনি করেছেন।
শাওন যথাসময়ে এক পৃষ্ঠার একটি সিভি নিয়ে আসাদ সাহেবের গুলশানের অফিশে হাজির হয়। ওয়েটিং রুমে আরও বিশ পঁচিশজন বসে আছে। শাওনের সিরিয়াল ২৭। শাওন যথেষ্ট সকাল সকাল এসেছে, তারপরও তার সিরিয়াল সাতাশ! দেশে চাকরির বাজারের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। যদিও বেশিরভাগ তরুণই চাকরির জন্য তৈরি নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনার সাথে কর্মক্ষেত্রের খুব সামান্যই মিল রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা না পারছে ভারী ভারী পড়াশুনা করে তত্ত্বজ্ঞানী হতে, না পারছে কর্মক্ষেত্রের জন্য নিজেকে তৈরি করতে।
এসব ভাবনা মনে আসলে শাওন নিজেকে ধিক্কার দেয়, কারণ, সে নিজেও চাকরির জন্য তৈরি নয়। আমাদের দেশে আবোল তাবোল পড়ে সরকারি চাকরিতে যারা ঢোকে তারাও সবাই শিক্ষানবিশ হিসেবেই ঢোকে, এবং সংশ্লিষ্ট চাকরিটির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করবার পূর্বেই অবৈধ উপার্জনের সাক্ষাৎ পেয়ে যায়। কাজটা বরং করে তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণিই। অবশ্য অন্ধকারের বিপরীতে আলোও নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু অন্ধকারের আধিক্য থাকলে সে আলো চোখে পড়বে কী করে!
এবার শাওনের ইন্টারভিউর পালা। আসাদ সাহেব নিজেই ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। যতজন এসেছে চাকরির জন্য এর মধ্যে শাওন একাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফলে আসাদ সাহেব প্রথম প্রশ্ন করেন শাওন কোনো চাকরি করে কিনা। শাওন ‘না’ সূচক জবাব দেওয়াতে আসাদ সাহেব বিস্মিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও কোনো চাকরি না পাওয়াটা বিস্ময়কর। “চাকরি পাননি, নাকি করেননি?” শাওন কিছুটা বিব্রত হয়ে জবাব দেয়— আমি আসলে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিলাম। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মও করতাম। কিন্তু এখন একটা চাকরি খুবই দরকার। ধরুণ, আপনাকে চাকরি দেওয়া হলো, ধৈর্য ধরে করতে পারবেন তো? শুধু ওয়েব সাইটটা চালাবেন, তা নয়। আমার অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবেও কাজ করতে হবে। অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। “পারতে হবে, স্যার। যেহেতু এই মুহূর্তে চাকরিটা আমার খুব দরকার।” তখনই আসাদ সাহেব শাওনের চাকরি কনফার্ম করে। শাওনের পরে যারা ছিল তাদের সাথে জাস্ট সৌজন্য হায় হ্যালো করে সবাইকে বিদায় দেয়।
শাওনের এতে আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই, জীবন বাঁচাতে কিছু একটা করতে হবে তাই। ক্লাসমেট, বন্ধুরা বড় বড় চাকরি নিয়ে, বড় বড় বিয়ে বিয়ে করে ইতোমধ্যেই সমাজের হর্তাকর্তা হয়ে গেছে, আর একজন লেখককে বাঁচার তাগিদে ছুটতে হচ্ছে এখন ঢাকা শহরের বিভিন্ন ফার্মে। যে দেশ পছন্দমতো জীবীকার সুযোগ রাখতে পারে না, তাকে সভ্য দেশ বলা যায় না। এমন না যে এদেশে লেখকের ছড়াছড়ি, এমন না যে লেখক প্রয়োজন নেই। কিন্তু এত বড় জনসংখ্যার একটি দেশে একশো জন লেখকও পাওয়া যাবে না, যারা লেখালেখি দিয়ে জীবীকা নির্বাহ করতে পারছে। গাইড বই এবং ধর্মীয় হাবিজাবি বইয়ের লেখকদের কথা ধরলে অবশ্য ভিন্ন বিষয়। প্রকৃত লেখকরা পারছে না। তাদের জন্য উন্মুক্ত কোনো মঞ্চ নেই। বাংলা একাডেমি পারত প্রতি বছর বিশজন নতুন লেখককে প্রমোট করতে, সেটি তারা করছে না। এক শ্রেণির সিন্ডিকেটের হাতে বাংলা একাডেমি বন্দী। সবখানেই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম। গোষ্ঠীতন্ত্র, পরস্পরের পিঠ চুলকানি— সাহিত্য দর্শনের ক্ষেত্রেও এসবই চলছে এদেশে।
সচেতন সত্তায় শাওন এসব আর ভাবতে চায় না, কোনো অভিযোগ আর করতে চায় না, স্রোতে গা ভাসাতে চায়, বাঁচতে চায়, কিন্তু হয় না, ফিরে ফিরে আসে ভাবনাগুলো— এত পড়াশুনা করে, সমাজ নিয়ে চিন্তা করে, দেশ নিয়ে ভেবে তাহলে লাভ কী হলো? সবার মতো একই স্রোতে যদি গা ভাসাতে হয়, তাহলে মাঝখানে পাঁচ ছয়টা বছর নষ্ট করা কেন?
১০ টা ৮টা অফিশ। খারাপ লাগছে না। আসাদ সাহেব শাওনের সাথে প্রচুর গল্প করে। গল্পের বেশিরভাগ অংশজুড়ে থাকে তার নিজের ইতিহাস এবং সফলতমার সকল সম্পাদ্য। কীভাবে কঠোর পরিশ্রম এবং বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবসা করে সফল হয়েছেন সে কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন। রাজনৈতিক কথাবার্তা যা বলেন তার বেশিরভাগই বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যায়, আবার শেষে এক লাইনে সব ঠিক করে নেন— আমি আমার জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর একজন।
যাইহোক, শাওন এসব শোনার কথা শুধু শোনে, বোঝার কিছু নেই, ভাবারও কিছু নেই। আজকে বরং সে কিছু আগে অফিশ থেকে বের হওয়া যায় কিনা সে পায়তারা করছে। অনেকদিন হলো পল্লবীর সাথে দেখা নেই, আজকে দেখা করার কথা। আজিজ সুপার মার্কেটের পিছনে জুস বারে দেখা হবে। জুস শাওনের প্রিয় খাবার, কিন্তু টাকার অভাবে খেতে পারে না। গতকাল টিউশনির টাকা হাতে পেয়েছে, তাই আজকে পল্লবীকে টিএসসিতে আসতে না বলে জুসবারে আসতে বলেছে। যেহেতু চাকরি করছে, তাই টিউশনির টাকাটা এবার বাড়ি না পাঠালেও চলবে। অবশ্য প্রথম মাসের বেতন পেয়ে টিউশনি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে, মানুষের বাসায় গিয়ে পড়াতে আর ভালো লাগে না। তাছাড়া চাকরি আর টিউশনি দুটো একসাথে চালিয়ে নেওয়াটাও খুব কঠিন হবে। বসের অনুমতি নিয়ে শাওন আজকে এক ঘণ্টা আগে বেরিয়ে পড়ে।
পল্লবী আজ খুব সাজগোজ করেছে। রুপালী পাড়ের কালো শাড়ী, জমিনে সিলভার কালারের ছোট ছোট ফুল, ইচ্ছাকৃতভাবেই কিনা— নিচের সাদা পেটিকোটটা একপাশ থেকে আবছা দেখা যাচ্ছে, তাতে ওকে একটু উগ্র সুন্দরী লাগছে আজকে। শাওন দাঁড়িয়ে আছে আজিজ সুপার মার্কেটের গেটে, পল্লবী বিপরীত দিক থেকে রাস্তা পার হয়ে আসছে। শাড়ীর কুচির ভাজ ধরে এক পাশের রাস্তা পার হয়ে যখন আইল্যান্ডের উপর উঠছে ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকে বাস গাড়ির একগাদা চোখ তখন রমণীরত্নের উপর আছড়ে পড়েছে। অভ্যস্ত বাঙালি নারী তাতে কালেভদ্রে বিরক্ত হলেও বেশিরভাগ সময়ই শ্লাঘা অনুভব করে অথবা এড়িয়ে যায়। স্বল্প পরিচিতি বা অপরিচিত কোনো যুবক সভ্যতা ভব্যতা মেনে কোনো নারীর সামনে দাঁড়িয়ে বলবে না—“আপনাকে/তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে” এটা তারা পারে না, করে না। কিন্তু সবার মধ্যে একটা ছোক ছোক ভাব কাজ করে, অনেক সময় নারীর জন্য সেটি বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নারী চায় সম্মানজনক স্তুতি, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাঙালি পুরুষ যেটা করে সেটি টিজিং-এর দিকে চলে যায়।
রাস্তার সামষ্টিক চোখ পল্লবীর জন্য পরোয়া করার বিষয় না হলেও শাওনের ঠিকই চোখে পড়ছে। পুরুষ আজীবনই এমন পাহারাদার, নারীকে সে না চিনুক পুরুষদের তো সে ঠিকই চেনে। অবচেতনেই কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পল্লবীকে হাত ধরে নিয়ে আসে। আজীজ সুপার মার্কেটের পিছনের জুসবারগুলোতে খুব বেশি ভীড় থাকে না। দুই তিনশো টাকা খরচ করতে পারলে ঘণ্টা দুই ভালোই আড্ডা দেওয়া যায়। শাওনের এ জায়গাটা খুব পছন্দ। পাথরের ছাউনি দেওয়া স্কয়ার টেবিলে দু’জনে মুখোমুখো গম্ভীর হয়ে বসে পড়ে। পাঁচ মিনিট দু’জনেই চুপচাপ। অবশেষে পল্লবীই মুখ খোলে— চাকরি পাওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে তুমি আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছো? যে চাকরি! কেন চাকরিটা করতে ভালো লাগছে না? ভালো লাগা না লাগার কোনো প্রশ্ন কি থাকার কথা? বেঁচে থাকার জন্য উপার্জন দরকার এই মুহূর্তে, তাই একটা কিছু করছি। এমন তো নয় যে, এরকম একটা চাকরি পেলে কেউ আমাকে লাফ দিয়ে পড়ে বিয়ে করার কথা ছিল! খোঁচা দিও না। চাকরি তো তুমি অগত্যা করছো। তুমি তো আসলে লেখক, কবি। না! আমি আর লেখালেখি করব না। কেন করবা না? ছাপা হচ্ছে না বলে, বই বের হচ্ছে না বলে? তুমি একটু জিদ কমাও, পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলো পড়ে বোঝার চেষ্টা করো ওরা কী ধরনের কবিতা ছাপে, তুমিও সেরকম করে লেখো, তাহলেই তো হয়ে যায়। আমি এসব কথা শোনার জন্য তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। পল্লবী শাওনের কথায় কর্ণপাত না করে দেশের শীর্ষ পত্রিকার সাহিত্য পাতা থেকে একটি কবিতা পড়ে? ঠোঁঠের কোণে মৃদু হাসি ফুঁটিয়ে বলে— তুমি চাইলেই এমন লিখতে পারো, একটু চেষ্টা করো। শাওন বিরক্তির চূড়ান্ত সীমায় গিয়ে বলে, তুমি কি এই কবিতার আগামাথা কিছু বুঝতে পেরেছো? রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়লে প্রথমবারেই তুমি একটা ভাব এবং অর্থ পেয়ে যাবে। দ্বিতীয়-তৃতীয়বারে তা ভিন্ন মাত্রা পাবে, বিস্তৃত হবে। জীবনানন্দের কবিতা তুমি হয়ত পাঁচবার পড়ে বুঝতে পারবে। কিন্তু এদের কবিতা তুমি পাঁচশো বার পড়েও বুঝতে পারবে না, কারণ, এরা বোঝার মতো কিছু লেখেনি। এখান থেকে সেখান থেকে কয়েকটা কঠিন কঠিন শব্দ এবং বাক্যের সমাহার ঘটিয়ে দাবী করেছে ‘কবিতা’। সাহিত্য পাতার নির্বোধ সম্পাদক এটা না বুঝলেও ক্ষতি নেই, বোঝাবুঝির কোনো বিষয়ই এখানে নেই। বিষয় হচ্ছে— অুমকেরটা ছাপতে হবে, তমুকেরটা ছাপা যাবে না। পাশাপাশি আছে সম্পাদকের ফরমায়েস, লেনদেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, এরকম অনেক কিছু। পল্লবী পত্রিকার পাতাটা ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, তুমি আসলে বেশি বোঝো। বেশি বুঝলে ক্ষতি কী? বেশি বোঝো বলেই তোমার কিছু হচ্ছে না। আমার না হয় হচ্ছে না, কিন্তু এই দেশের কতটা কী হচ্ছে? “এই দেশেরও কিছু হচ্ছে না।” তাহলে মেনে নাও যে, আমাদের মতো মানুষদের যদি কিছু হয় তাহলেই শুধু দেশের কিছু হবে, যাদের হচ্ছে তাদের হলে দেশের কিছু হবে না। “তোমার সাথে কথায় পারা যাবে না। জুস দিয়েছে জুস খাও।”
আসাদ সাহেবের আজকে মনটা খুব খারাপ। শাওনকে ডেকে সামনে বসিয়েছে, কিন্তু দশ মিনিট হয়ে গেল কোনো কথা বলছে না। অবশেষে শাওনই কথা বলে— স্যারের আজকে মনটা খুব খারাপ মনে হচ্ছে। ঠিকই বলেছো, মনটা খুব খারাপ। আসলে এদেশের মানুষ সব বেঈমান। গত পরশুদিন আমাদের জেলাতে একটা অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানের সব খরচ আমিই বহন করেছি। এমনকি ব্যানারে আমার কোনো কোম্পানির নামও দিইনি। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন আমাকে বলতে গেলে একরকম অপমানই করেছে। কোন জায়গার কোনো এক কবি, তাকে নিয়ে সব আদিখ্যেতা! বিষয়টা আমার মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে!
আচ্ছা শাওন, তুমি তো কবিতা লেখো, তাই না? জ্বি স্যার, আমি কবিতা লিখতাম। এখন আর লিখছি না। আমিও তোমার মতো বয়সে কবিতা লিখতাম। এখন ব্যবসা বাণিজ্যের চাপে আর হয়ে ওঠে না। তুমি কী পরিমাণ কবিতা লিখেছো? অনেক, স্যার। প্রেমের কবিতা লেখো? জ্বী স্যার, আমি প্রেমের কবিতাই বেশি লিখি। তুমি একটা কাজ করবা— তোমার লেখা তিনটা কবিতা কালকে আমাকে দেখাবা। কবিতাগুলো হতে হবে সহজ, কিন্তু মাধুর্যময়। সবাই যেন পড়ে বুঝতে পারে, অর্থ না বুঝুক ভাবটা যেন সবাই বুঝতে পারে। আমার এক সময় খুব ইচ্ছে ছিল কবি হওয়ার, কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে আর হলো না। শাওন মাথা নেড়ে বলে, সমস্যা নেই স্যার, এখনও চেষ্টা করলে আপনি কবিতা লিখতে পারবেন। সে যাইহোক, তুমি কালকে আমাকে তিনটা কবিতা দেখাও।
শাওন বাসায় এসে কবিতার ঝাপি খুলে বসেছে। সহজ এবং ভালো তিনটে কবিতা খুঁজে বের করতে হবে। বসকে খুশি করা জরুরী। চাকরিটা খারাপ লাগছে না, পাশাপাশি বেতনকড়ি যদি আরেকটু বাড়ায়ে নেওয়া যায় তাহলে দ্রুতই গ্রামে মাকে একটা বাড়ি করে দেওয়া যাবে। নানানভাবে বিচার বিশ্লেষণ চলছে কবিতা নিয়ে, কিন্তু নিজের কবিতা থেকে কয়েকটি কবিতা বাছাই করার কাজটিই বোধহয় খুব কঠিন। কয়েক ঘণ্টা চলে গেল, কিন্তু তিনটা কবিতা সিলেক্ট করতে পারছে না শাওন। অবশেষে অত ভাবনাচিন্তা ছাড়াই র্যানডমলি তিনটে প্রেমের কবিতা বেছে নিয়েছে। কালকে সকালে গিয়েই বসের সাথে বসার কথা। শাওন নিলক্ষেত গিয়ে একটু সাজিয়ে তিন পৃষ্ঠায় তিনটে কবিতা প্রিন্ট দিয়ে রাখে।
১
নারী, আমার কাছে আয়,
চল যাই
তোরে সঙ্গী করে
নতুন কোনো গায়।
আমি তোরে নিয়ে যাব অচিনপুরে,
দূর সীমানায়।
গড়ে নেব নতুন পৃথিবী,
তোর কোলে মাথা রেখে
কষ্ট লুকাব সেথায়।
২
নারী, কী এমন হয়?
কবির কাব্য কথায়
হয় কি তোমার কোনো ক্ষয়?
এত স্বর্গ তোমার
লুকিয়ে রেখেছো সযতনে,
কেউ কি নাই পৃথিবীতে
যে তোমাকে চাইতে পারে
অপার্থিব সে ঐকতানে?
তোমায় দেখে দেখে
অবিরত নেশার ঘোর আমার,
মরূভূমিতে এবার উপচে পড়ুক
বিন্দুতে প্রস্ফুটিত মহাসিন্ধু তোমার।
৩
পারবে তুমি অতটা নিষ্ঠুর হতে?
অসাধারণ হয়েছে। তবে ৩ নম্বর কবিতাটা পাল্টাতে হবে। ঠিক আছে স্যার, আমার সাথে একটি পাণ্ডুলিপি আছে, আপনি দেখতে পারেন। দেখাও। আসাদ সাহেব শাওনকে একটি কবিতা দেখিয়ে বলে, আমি ‘এটা’ বাছাই করলাম।