ছোটগল্প: প্রেম ও পরকীয়া // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0

ছেলের স্কুল থেকে পিকনিকে যাবে কক্সবাজার। মিতু সাধারণত কোথাও যেতে চায় না, তবে এবার প্রায় এক সপ্তাহ ধরে গোজগাছ করা শুরু করেছে। সজলও এই সুযোগে তিন দিনের একটা প্লান করে ফেলেছে। মিতুকে ও প্লানটা বলেছে— অফিশের এক কলিগের সাথে তার শশুর বাড়ি যাবে। সজল বাড়িতে একটু বড় গরুর খামার করতে চায়। অফিশের কলিগ শাহীনের শশুরের বড় গরুর খামার আছে। ওটা দেখে কিছু অভিজ্ঞতা নেওয়া যাবে। দু’জনের বৃহস্পতিবার রওনা হবে। দু’জনের দু’জনকেই সাগ্রহে সহযোগিতা করছে। মিতু বাচ্চা নিয়ে যাবে, এজন্য নতুন কিছু কেনাকাটার প্রয়োজন থাকলে মিতু যাতে কিনতে পারে এজন্য বাড়তি কিছু টাকা সজল মিতুকে দেয়। মিতু তারিখের দু’দিন আগে থেকে কিছু শুকনো খাবার বানানোয় মন দেয়। সজল যাতে কিছু খাবার ব্যাগে রাখতে পারে। বাইরের খাবারে সজলের সমস্যা। খুব মনোযোগ দিয়ে মিতু কিছু হালুয়া, বিস্কুট এবং লাড্ডু বানিয়ে রাখে। 

দু’জনেই ওরা কালকে রওনা হবে। রাতের অর্ধেক গল্পে গল্পেই কেটে যায়। ছাদের সাথে একটি রুম আছে। সজল ছাদে যেতে চায়। মিতু আগ্রহ পায় না। তার মনে এখন ভিন্ন গ্রহের আন্দোলন। সজলের আগ্রহ কোনো বিশেষ গ্রহে নয়, সবটুকু টান ওর ভরকেন্দ্রে গিয়ে ঠেকে। ফলে মাত্র একদিন পরেই দু’জনের গন্তব্য একই হলেও প্রস্তুতি একই নয়। সজলের চাপাচাপিতে দু’জনে ওরা ছাদে যায়।

মিতুর ভরাট শরীর চাঁদের আলোয় ঠিকরে বের হচ্ছে যেন। মিতু ভেবেছিল সজল বুঝি ছাদে যেতে চাইছে মহামিলনের জন্যে। কিন্তু সজল আনমনে শুধু পায়চারিই করছে। মিতু কিছুটা উচাটান হয়ে সাড়া না পেয়ে আবার ভিনগ্রহে মন দিয়েছে। দু’জনের মনেই এখন অন্যকিছু, কিন্তু দূর থেকে দেখে মনে হবে প্রেমাতুর দু’জন নারী-পুরুষ মধ্যরাতে পায়চারি করছে কবুতরের মতো ডানা ঝাপটিয়ে। মিতু ছাদের কোণায় গিয়ে একটি ফুলের টবের উপর পা তুলে দেয়। ফুলের টবটা একটু বেশিই উঁচু। প্রেমিকের সামনেই শুধু এভাবে পা তুলে দেওয়া চলে। সজল এবার পুরুষত্বের পরীক্ষায় জিততে চায়। আলতো করে মিতুর কাপড় কোমরঅবদি তুলে উরুতে একটি চুমু খায়। অনেকটা দায়িত্ব পালনের মতো। মিতু ছট করে পা নামিয়ে নিয়ে সরে যায়। শেষরাত অবদি দু’জনেই ওরা ভেতরে ভেতরে নিজের সাথে যুদ্ধ করেছে, স্থির হয়ে আগামীর জন্য দু’জনেই অস্থির সময় পার করেছে দু’জনেরই অজান্তে।

স্কুলের বাস রেডি। মিতু সারিনকে নিয়ে বের হয়েছে। ওর প্লান হচ্ছে ঢাকা পর্যন্ত গিয়ে একটা গুরুতরে কোনো অজুহাত দেখিয়ে পিকনিকে না যাওয়া । এরপর সৈকতের সাথে সন্ধ্যার লঞ্চে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। মিতু ফেসবুক ব্যবহার করে না, এটা একটু সুবিধা। পিকনিকের ছবি ফেসবুকে দেওয়ার বিষয় নেই, তাছাড়া সজল মিতুকে বিশেষ অবিশ্বাসও করে না। অন্তত এভাবে পিকনিকের বাস থেকে অযৌক্তিকভাবে নেমে গিয়ে অন্য কারো সাথে মিতু কুয়াকাটায় যাবে সারিনকে সঙ্গে নিয়ে— এতটা ভাবা সজলের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু মিতু গত কয়েক বছর ধরে ভেতরে ভেতরে এতটাই বদ্ধ অনুভব করছে যে, হিসেব নিকেষ করে কিছু করার ধৈর্য ওর নেই, তাছাড়া একটা শিশু সন্তান নিয়ে প্লান করে এ ধরনের ট্রিপে যাওয়ার সুযোগও নেই। সারিন অটিস্টিক, তাই সারিনের কাছ থেকে সজল কিছু জানবে এ ভয় মিতুর নেই।

বাসের সিটে বসে মিতু কিছুক্ষণ সজলের সাথে কথা বলার ভাণ করে, যাতে অন্য অভিভাবকরা বুঝতে পারে যে, মিতুর কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। সায়েদাবাদ বাস পৌঁঁছুলে মিতু নেমে যায়। সৈকতকে টেক্সট করা আছে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ৩ নম্বর গেটে সৈকত অপেক্ষা করছে। মিতু একটা রিক্সা নিয়ে সদরঘাট পৌঁছায়। সজল পারাবত-১০ লঞ্চে একটা ডাবল কেবিন নিয়ে রেখেছে। যদিও ৪টার আগে কেবিনে ওঠার নিয়ম নেই। কিন্তু সঙ্গে শিশু থাকায় সবাই-ই ধরে নেয় এরা স্বামী স্ত্রী, তাই এতটুকু ছাড় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ দেয়। ওরা রুমে গিয়ে আরাম করে। 

এর আগেও সৈকতের সাথে অনেকবার মিতুর সাক্ষাৎ হয়েছে, তবে এভাবে এক ঘরে উদ্দেশ্য নিয়ে থাকা হয়নি। রুমে ঢুকে মিতু কিছুটা নারীসুলভ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সৈকত বুঝতে পেরে সারিনকে আড়াল করে মিতুকে একটা চুমু খেয়ে পরিবেশ সহজ করে নিতে চায়। মিতু সরে গিয়ে ব্যাগ থেকে কাপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করার কাজে মন দেয়। 

এদিকে সজলও আর দেরি করতে চায় না। সজলের অবশ্য মিতুর মতো মুক্তি টুক্তির কোনো বিষয় নেই। পুরুষ হিসেবে এমন সুযোগ সে বরাবরই কাজে লাগাতে চেয়েছে, লাগিয়েও থাকে। মিতু কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। বেশিরভাগই বোঝে না, বোঝা যায় না। অফিসের সহকারী নার্গিসের সাথে খুঁনসুটি অনেক আগে থেকেই শারীরিক মেলামেশার সম্মতির পর্যায়ে গিয়েছে, কিন্তু কখনো সুযোগ হয়নি। আজকের সুযোগটা সজল কাজে লাগাতে চায়। মিতু তিন দিনের জন্য সিলেট গিয়েছে। এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর আসবে না। নার্গিস বাসায় আসার কথা, সজল ছাদে গিয়ে পায়চারি করতে থাকে। ছাদ থেকে দেখতে পেলেই ও নেমে গিয়ে নার্গিসকে নিয়ে আসবে। এই বাসাটার সুবিধা হচ্ছে— শুধু মালিক আর ওরা, তাই কে আসলো কে গেলো এগুলো চোখ পেতে দেখার মতো বিশেষ কেউ নেই। মাতাল মালিক এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। মাঝে মাঝে শুধু দু’এক হাজার টাকা ধার করতে আসে। 

অফিসের সহকারী হলেও এখন নার্গিস বস। একটি গাঢ় নিলচে শাড়ীর ওপর কালো চাদর পরে নার্গিস আসছে। ছিপছিপে শরীর চাদরে ঢেকে গেলেও স্ফিত পয়ধর বক্ষদেশ এবং নাভীদেশের মধ্যে উচ্চতায় সুস্পষ্ট ব্যবধান তৈরি করেছে। সজল শিহরিত হচ্ছে। দ্রুত নেমে গিয়ে গেট থেকে নার্গিসকে বরণ করে নিয়ে আসে। দু’জনই অনেকদিন সুযোগের অপেক্ষায় আছে— নার্গিস রুমে ঢুকতেই সজল হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায়। নার্গিসের আপত্তি নেই, কিন্তু একমাত্র দামী শাড়ীটা সে নষ্ট করতে চায় না। নার্গিস সরে গিয়ে প্রথমে চাদরটা খুলে ভাজ করে রাখে। সজল খাটে হেলান দিয়ে বসে পড়ে, এরপর নার্গিস ধিরে ধিরে শাড়ীর আচল টেনে নামায়, কোমর থেকে কয়েকটা প্যাচ ঘুরিয়ে পুরো শাড়ীটা খুলে ফেলে। এখন ও শুধু প্যাটিকোট এবং ব্লাউজ পরা। চাচ্ছে সজল যেন উঠে এসে খোলার বাকী কাজটুকু করে নেয়। সজল উঠে আসছে না দেখে ব্লাউজটাও নিজে থেকে খোলে। বেরিয়ে সুডৌল বিশাল সাইজের কুমারী দুটো দুধ। 

এবার আর সজল সামলাতে পারে না। দ্রুত উঠে এসে ব্রা’র তল দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দুধ দুটো টেনে বের করে। নার্গিস ফিসফিসিয়ে বলে— খুলে নাও। সজল পিছন থেকে হুক খুলতেই টাইট ব্রা আপনা থেকেই খুলে পড়ে। নারীর এ সৌন্দর্য শুধু পুরুষ নয় নারীও ঈর্ষা করে। নার্গিস সত্যিই সুন্দর। ও যতটা দেখতে সুন্দর, তার চেয়ে অনেক বেশি দৈহিকভাবে সুন্দর। খুব গোছানো শরীর, অকর্ষিত, অক্ষত প্রতিটি প্রান্তর। সজল দিগ্বিদিক হয়ে চুমু খেতে থাকে। নার্গিসও পাগল প্রায়। সজল জানে না যে, এটাই নার্গিসের প্রথম মিলন। অনভিজ্ঞ নার্গিস কিছুই বলতে পারে না, শুধু অপেক্ষা করতে থাকে। ওর ইচ্ছে করে— সজল পেটিকোটটাও খুলে নিক। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হয়। সজল পেটিকোটটা উপরের দিকে তুলে নিয়ে আসে। ভরাট ‍দুই উরুতে চুমু খেতেই নার্গিস কেঁপে ওঠে। পেটিকোটের গিট খুলতে গিয়ে সজল গিট্টু আরো লাগিয়ে ফেলে। একটু সময় লাগিয়ে দাঁত দিয়ে খোলে। নার্গিস ততক্ষণে অধৈর্য হয়ে ওঠে। 

লঞ্চ ছাড়ার সময় হলে এল প্রায়। সারিন কেবিনের বারান্দময় দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে। মিতু বাইরে একটা চেয়ার পেতে বসে সারিনকে খেয়াল রাখছে। সৈকত রুমের ভেতর অপেক্ষা করে চলেছে। মিতু শর্ত দিয়ে রেখেছে— সারিন ‍ঘুমানোর আগে কোনো বজ্জাতি চলবে না। সৈকত যথাজ্ঞা বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। নদীমুখে কেবিন, শরতের বাতাসে হালকা হিমহিম ভাব, তবে শীত নেই, আবার গরমও নয়, খুবই নান্দনিক আবহাওয়া। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চের এ রুটগুলো অসাধারণ, ভয়মুক্ত করতে পারলে, সুন্দর সুন্দর এবং বিশাল লঞ্চ দিতে পারলে বাংলাদেশের এ লঞ্চ যাত্রা হতে পারে পর্যটনের নবদিগন্ত। মিতু এক সময় এসব ভাবত, এখন রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কিছু ভাবতে ওর ভালো লাগে না। ব্যক্তিগত পাওয়া না-পাওয়া গত কয়েক বছর ধরে ওকে গ্রাস করে রেখেছে।

সারিন আলোকিত লঞ্চ, মানুষজন, লঞ্চের বিকটা শব্দ, আবছা আলোতে বয়ে চলা নদী— সবকিছু এতটাই উপভোগ করছে যে, ঘুমোনোর নাম নেই। বয়সটাও এমন যে, একা ছেড়ে দেওয়া চলে না, চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে। সৈকত বাধ্য হয়েই মিতুর সাথে তাল মেলাচ্ছে— যদিও মনে মনে সে বুদ হয়ে আছে মিতুকে কখন সে রুমে একলা পাবে এ নেশায়। কিন্তু মিতুর সাথে ভণিতা করতে হচ্ছে— দেখাতে হচ্ছে— সে বাচ্চাটার প্রতি কতটা সংবেদনশীল। সজল সারিনকে কোলে নিয়ে দূর নদীতে নৌকায় মাছ ধরা বর্ণনা করছে। মিতু সুযোগে মোবাইল স্ক্রিনে স্ক্রল করছে।  

অবশেষে মিতুও অধৈর্য হয়েছে, সারিনকে নিয়ে রুমে গিয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। সৈকত একটা সিগারেট ধরিয়ে কেবিনের বারান্দায় পায়চারি করছে। সারিনকে ঘুম পাড়িয়ে আধাঘণ্টা পরে মিতু বেরিয়ে একটু ন্যাকামো সুরে সৈকতকে ডেকে কিছু একটা খাবার আনতে বলছে। সৈকত চকলেট, বিস্কুট, কোলড্রিঙ্কস্ নিয়ে আসে। কিন্তু কিছুই তাদের খাওয়া হয় না। হঠাৎ একটা ফোনে সজল বিমর্ষ হয়ে যায়। সৈকতের চোখের কোণে পানি দেখে মিতু হাতের বিস্কুটখানা আবার প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখে। সৈকত খুব ধীরে ধীরে বলে, যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের সবার বড় ভাই শামীম ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে কিছুক্ষণ আগে মারা গিয়েছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় মিতু কী বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সৈকত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আচ্ছা, তুমি খাও। আমি বাড়ীতে একটু কথা বলি। রাত চারটা পর্যন্ত সৈকত ভাই-বোনদের সাথে কথা বলে। বন্ধুর বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে দু:খ খুব ছুঁয়ে না গেলেও মিতুও ভারাক্রান্ত হয়েছে। 

ভোর পাঁচটায় ওরা বিছানায় যায়, ততক্ষণে লঞ্চ প্রায় পটুয়াখালি পৌঁছে গিয়েছে। ইনচার্জের সাথে কথা বলে জানা গেল— মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে যাবে। কেউ-ই ওরা আর ঘুমোতে পারলো না। মিতু সৈকতকে কিছুক্ষণ স্বান্তনা দিয়ে ঝিমিয়ে পড়ছে, সৈকত বড় ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছে। লঞ্চ ছয়টার মধ্যে ভিড়লেও ওরা এক ঘণ্টা দেরি করে লঞ্চ থেকে নামে। নাস্তা করার জন্য একটি রেস্টুরেন্ট গিয়ে কারোরই কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, শুধু সারিনকে একটু খাইয়ে বেরিয়ে পড়ে।

সৈকতদের বাড়ি সিলেট। মিতু বলছে তারা ঢাকায় ফিরে যাবে, সৈকত সিলেট চলে যাক, মিতু না হয় দু’টো দিন বড় বোনের বাসাতে বেড়িয়ে যাবে। সৈকত ফিরতে চাইলো না। অবশেষে ওরা পটুয়খালি সদর থেকে একটি প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে কূয়াকাটার উদ্দেশ্য রওনা হয়। সৈকত একটু হালকা হবার চেষ্টা করছে। মিতু সারিনকে বাম পাশে নিয়ে সৈকতের পাশে বসেছে। সৈকত মিতুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে চোখের দিকে তাকিয়ে অনুমতি প্রার্থনা করে। মিতু মুচকি হাসি দিয়ে অনুমতি বুঝিয়ে দেয়ে। সৈকত ড্রাইভারের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে মিতুকে টুক করে একটি চুমু খায়। যেন জীবনের প্রথম চুমু— ভয়ে ‍চুপসে গিয়ে জানালা থেকে বাইরে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।

প্রেমের পরিণতি পর্বটা আগে হয়েই যাওয়াই ভালো। ঠাণ্ডা মাথায় আলাপ আলোচনা করা যায়। নইলে সবসময় একটা ছোক ছোক ভাব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলোচনা করা যায় না। বোঝা যাচ্ছে সজলের খুব কষ্ট হয়ে গেছে— একেবারে ঘেমেঘুমে একাকার! নার্গিস হাসছে, কিছুক্ষণ অবশ্য অতি ভালোবাসায় ব্যথা পেয়েছে বলে খুব অভিমান করে ছিল। সজল নার্গিসকে কিছু বলতে যেতেই নার্গিস থামিয়ে দিয়ে বলে, “ভাবি কবে আসবে?” তিন চারদিন পরে— সজল অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দেয়। “ভাবীর কোন বয়সের ছবি এটা, সজল ভাই?” সজল কোনো উত্তর না দিয়ে বলে, “রেডি হও, কুয়াকাটা যাব আমরা।” নার্গিস বিস্মিত হয়ে বলে— আজকে! “জ্বী, কথা সব পথে হবে, দ্রুতই আমরা রওনা হতে চাই।” নার্গিস একটা মেসে থেকে চাকরি করে, তাই জবাবদিহিতার কিছু নাই। প্রথমে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব করে দ্রুতই রাজি হয়ে যায়। 

মিতুরা পর্যটন মোটেলের ২০৪ নম্বর রুমে উঠেছে। রুমে ঢুকে মিতু একেবারে স্ত্রীসুলভভাবে সৈকতকে বলে, সারিনকে কিছু খাইয়ে নিয়ে আসতে পারবে কিনা। সৈকত হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে সারনিকে নিয়ে নেমে যায়। মিতুর হঠাৎ করে পিরিয়ড শুরু হয়েছে। ব্যাগে প্যাড ছিল বলে সৈকতকে আর কিছু বলতে হয়নি। সৈকত আসতে আসতে গোসল সেরে প্যাড পরে নিতে চায়। এখনও পিরিয়ড হতে চারদিন বাকি, তবুও … মিতু কিছুটা বিরক্ত! 

সারিন রেস্টুরেন্টে ঢুকেই বড় প্লেটে রাখা একটা মাছের তরকারিতে হাত দিয়ে দেখিয়ে বড় মাছের মাথা খেতে চায়। ও মুখে কিছু বলে না, মনের ভাব ইশারা ইঙ্গিতে প্রকাশ করতে চায়। সারিন যে নিজে খেতে পারে না এটা সৈকত জানলেও খেয়াল নেই। সে সারিনকে মাছের মাথাটা এবং এক প্লেট ভাত দিয়ে বসিয়ে দেয়। সারিন মাথাটা উল্টিয়েপাল্টিয়ে দেখতে থাকে, আর অপেক্ষা করতে থাকে কখন সৈকত তাকে খাইয়ে দেবে। সারিনের কাছে আপন পর কোনো ভেদাভেদ নেই, ওর চাহিদা পূরণ হলেই হয়। সৈকত মোবাইলে কথা শেষ করে এসে দেখে সারিন মাছের মাথা নিয়ে ওভাবেই বসে আছে। দ্রুতই হাত ধুয়ে সৈকত সারিনকে খাইয়ে দেয়। 

মিতু গোসল সেরে নতুন কাপড় বের করে পরে একেবারে নতুন বউয়ের মতো বসে আছে। সৈকত সারিনকে সুন্দর মতো ম্যানেজ করে খাওয়া শেষে একটা জুস কিনে ওর হাতে দিয়ে উপরে ওঠে। জুস দেখতেই মিতু সৈকতকে সতর্ক করে বলে, তোমাকে না বলেছিলাম— অটিস্টিক শিশুদের মিষ্টি জিনিস না পারতে দিতে নেই। সৈকত হাসি দিয়ে বলে, “তোমার ছেলে কেমন অটিস্টিক বুঝলাম না, মাছের মাথা সম্পুর্ণ শেষ না করে উঠবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে ও পছন্দ করেছে মাছের মাথা! মিতু চমকে উঠে বলে তুমি ওকে মাছের মাথা খাইয়েছো, অসাধ্য সাধান করেছো! এতক্ষণে মিতুর নান্দনিক সাজগোজ চোখে পড়েছে সৈকতের। একটু চোখ দিতেই মিতু চোখ গরম করে সতর্ক করে দেয়। “সারিন ঘুমাক” বলে স্বান্তনাও দেয়। সৈকত অবশ্য বড় ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে নিজেকে সংযত করেছে— মিতু না চাইলে ও আর চাচ্ছে না এবারের মতো কোনো অন্ধ আলিঙ্গন। 

সজল এবং নার্গিস দু’জনই অপেক্ষা করছে কখন হোটেলে পৌঁছাবে। দু’জন দু’জনকে সারাপথ উত্যক্ত করেছে— একজন করেছে হাবভাবে, আরেকজন করেছে হাত দিয়ে। গাড়ি থেকে নেমেই নার্গিস ওড়না মাথায় হিজাবের মতো করে পরে নিয়েছে। এতে কিছুটা সুবিধা হয়, মানুষ সন্দেহ কম করে। ওরাও ঘুরেফিরে ঐ পর্যটন মোটেলেই যায়। স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ওরা ওঠে ২১৯ নম্বর রুমে। রুমে ঢুকেই কোনোমতে ব্যাগ রেখে ওরা আবার পরিণতি পর্ব সেরে নেয়। এরপর জীবন এবং যাবতীয় সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথাবার্তা। ওদের কথাবার্তা অবশ্য কোনো ছন্দ পাচ্ছে না, ঘুরেফিরে নার্গিস ভাবীর সম্পর্কে জানতে চায়, এটা সজলের ভালো লাগছে না। 

ক্লান্তিতে সারিন ঘুমিয়ে পড়েছে। সৈকত মিতুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে কিছুটা আনমনা হয়ে— মৃদুস্বরে একটা কবিতা আওড়াচ্ছে, একটু পরে মিতুও ঘুমিয়ে যায়। সৈকত একা একা কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। মিতু সৈকতের উঠে যাওয়া টের পেয়েও আধো ঘুমে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরে সৈকত এসেও মিতুর পাশে শুয়ে পড়ে। সারিন পাশের বিছনায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে। 

ওরা কেউই সন্ধ্যেয় আর সৈকতে যায় না। মিতুরা রুমের বাইরে বারান্দায় টি টেবিল নিয়ে বসে কফি খেতে। সারিন ওঠার আগেই ওদের যা একটু একত্রে থাকা। সারিন উঠলে সবটুকু মনোযোগ দিতে হয় ওর দিকে। সজলরাও এখন প্রেমক্লান্ত, তবু নার্গিসের আবদারে সৈকতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দেওয়ার পর্ব শেষ, তাই এবার আর হিজাবের প্রয়োজন নেই— নার্গিস প্লাজ্জোর ওপরে একটা টিশার্ট পরে নেয়। সজলও থ্রি কোয়ার্টার এবং টিশার্টে একেবারে সৈকতের মেজাজ নিয়ে বের হতে চায়। 

সজল এবং নার্গিস মিতুদের প্রায় পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল, কিন্তু অবচেতনে পিঠ এবং পোশাক দেখে সন্দেহ হওয়ায় সজল পিছন ফিরতেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। দ্রুতই সামলে নিয়ে চলে যাবে ভাবছিল, পরক্ষণেই ভাবে— এটার একটা ফয়সালা না করে যাওয়াটা ঠিক হবে না। সজল খুব স্মার্টলি এগিয়ে গিয়ে সৈকতের সাথে হাত মিলায়— “আমি সজল, ২১৯-এ আছি, আপনাদের কোনো প্রয়োজন হলে বা না হলে আসতে পারেন, গল্প করা যাবে।” সৈকত পরিচয় দেয়— “আমি এবং আমার মিসেস মিতু।” সজল গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে সায় দেয়। মিতু যেন কিছুই দেখছে না, কফির মগে চুমুকের পর চুমুক দিতে থাকে।

এভাবেই বিশাল একটি ঘটনার সমাধান বুদ্ধিদীপ্ত এবং বাস্তবিকভাবে ওরা করে নেয়। সত্যিই এ দুই জুটি গল্পগুজবে দুটো দিন খুব চমৎকার কাটায়, পাশাপাশি জীবনের নতুন আলো, একইসাথে নতুন মেঘেরও সন্ধান পায়।  

Next Post

ছোটগল্প: কবি // দিব্যেন্দু দ্বীপ

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে সবাই যখন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে সাধারণ জ্ঞান, হাবিজাবি ইত্যাদি পড়াশুনা করছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে প্রায় সবা-ই যখন আবার মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনায় মনোযোগ দিচ্ছে, এমনকি এই বয়সে চাকরির জন্য কোচিংও করছে, শাওন তখন বিশ্বসাহিত্যে মনোযোগ স্থাপন করেছে। বিশ্বসাহিত্য, বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্য পড়ে বুঝতে […]
ছোটগল্প