চীনের একটি দুর্গম প্রদেশ কিঙ্গালা। এই কিঙ্গালা প্রদেশের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম বিতং। আপনারা নিশ্চয় এটা যেনে বিস্মিত হবেন যে, কীভাবে আমি বিশ্বব্যাপী এই করোনাকালে বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের বিতং গ্রামে পৌঁছুলাম। সে ঘটনাটা পুরো বলতে গেলে যে গল্পটি বলতে চাচ্ছি সেটি আর বলা হবে না। শুধু বলে রাখি, আমি প্রথমে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার গিয়েছি, সেখান থেকে স্থলপথে চীনে ঢুকেছি। এরপর একরকম নিরুদ্দেশ হয়ে একজন অনুরুপার সাথে গিয়েছি কিঙ্গালা প্রদেশ। সেখান থেকে পালাতে গিয়েছি বিতং পর্যন্ত। এই বিতং গিয়ে আটকে গেছি, আটকে গেছি মানে বাঁচতে পেরেছি।
আমি সৌভাগ্যবান, কারণ, হুনানে আমার পরিচয় হয় বিউ নামে এক নারীর সাথে। ক্লান্ত হয়ে আমি একটি থামে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। বিউ এসে আমার পরিচয় জানতে চায়। আমি ভিনদেশী বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে, এখানে আমি কী করছি। আমি সব খুলে বলি। বিউ বলে, তোমাকে তো এখনই পুলিশ পাকড়াও করে নিয়ে যাবে। গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছো ভেবে নিশ্চিত মেরে ফেলবে। ও আমাকে খুব সাবধানে কয়েক কিলোমিটার দূরে তার বাসায় নিয়ে যায়। অভুক্ত আছি বুঝতে পেরে দ্রুত এক বাটি সুপ এবং ডিমের চপের মতো কিছু একটা খেতে দেয়। খেয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
সন্ধ্যার একটু আগে ও আমাকে ডেকে তোলে। বলে, আমি তোমাকে বাঁচাতে চাচ্ছি, আর তুমি বোধহয় মরতে চাচ্ছো! না হলে এভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতে না। আমি বললাম, ঘুমাচ্ছি ক্লান্তিতে, নিশ্চিন্ত হয়ে নয়, আর একবার ঘুমিয়ে পড়লে তো কেউ চিন্তা করতে পারে না। ও একটা ধমক দিয়ে বলে, আছো আশ্রিত হয়ে, আবার তর্কও করছো! আমি সত্যিই এবার চুপসে যাই। ঘরে আর কাউকে দেখতে না পেয়ে ওকে বললাম, তুমি কি বাসায় একা থাকো? ও সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আমাকে খেয়েদেয়ে তৈরি হতে বলল। খাবার টেবিলে তৈরি ছিলো, আমি খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। বেরোনোর আগ মুহূর্তে ও আমাকে হতবাক করে দিয়ে বলে, নাও, এবার আমাকে দীর্ঘ একটা চুমো খাও। আরো বলে, আচ্ছা, তোমার আবার করোনা নেই তো? আমার করোনা থাকতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছো নাতো? আমি প্রকৃতপক্ষেই কিংকবর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমাকে ভ্যাবাচেকা দেখে বিউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসল, উচ্চতায় মিলছে না, তাই ওকে একটু খুড়িয়ে নিতে হলো, আমাকেও একটু নিচু হতে হয়েছে। এরপর মিনিটখানেকে আমরা অদলবদল করে নিলাম হৃদয়ের কিছু রসদ।
বিউ বলল, আমরা একটু ইজি হয়ে নিলাম, তোমার সাথে আমার আগামী এক মাস বা কয়েক মাস থাকতে হবে কিনা। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না— যদিও আমি কীভাবে চীনে পৌঁছুলাম, সবকিছু ওকে বলেছি। আমাকে থতমত দেখে ও ভেঙে বলল পুরো পরিকল্পনাটা। শহরে থাকলেও ওর মন পড়ে থাকে একটি গ্রামে, গ্রামটির নাম বিতং। ওই গ্রামে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় ও খুঁজে বের করতে পারেনি। সুবিধা হয়েছে ও খুব ভালো ইংরেজি বলতে পারে, ফলে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আবার মনে হয় মানুষ হিসেবেও আমরা খুব একই প্রকার— আকাশ খুঁজে নেয় আকাশ, শূন্য চেনে শূন্য, যেন উভয়েই ভীষণ পরিপূর্ণ।
চীন সরকার লকডাউনের মধ্যে একটি সুযোগ দিয়েছিলো যাতে শহরের অধিকাংশ লোক গ্রামে চলে যেতে পারে। কারণ, করোনার প্রাদুর্ভাব কাটতে বেশ কয়েক মাস, এমনকি বছরও লাগতে পারে। সেই সুযোগটাই ও এখন কাজে লাগাচ্ছে। তবে এখন আবার খুব কড়াকড়ি, খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক ছাড়া গণহারে এখন আর যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কীভাবে আমাকে ম্যানেজ করবে জানি না, তবে ও যে খুব বিচক্ষণ সেটি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি। বললো, তোমাকে আমার বান্ধবীর একটি বিউটিপার্লারে বসিয়ে রেখে যাব, যেটি এখন বন্ধ আছে। তুমি আবার আমার বান্ধবীর দিকে নজর দিও না —একথা বলে মুচকি হেসে চলে যায় ও। গিয়েছিলো ট্রেনে একটি বাথ কেবিন বুক করতে। এই সময়টাতে খুব ভিড় নেই, তাই সহজেই একটি বাথ কেবিন পেয়ে গিয়েছে ও।
ট্রেন ছেড়েছে সন্ধ্যা আটটায়। কিঙ্গালা পৌঁছুতে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা লাগবে। রুমে একবার চেকার এসেছিল, বিউ তখন খোলেনি, বলেছে, পরে আসুন। আমাকে ও বলেছে ১২টা পর্যন্ত পাবলিক রুমে সময় কাটাতে, এ সময়টাতে ও চেকারের সাথে দরবার সারতে চায়। এখন আমরা নিশ্চিন্ত। ইতোমধ্যে আমার জড়তা কেটে গিয়েছে। এই কৃতিত্বের পুরোটাই সহজ সুন্দর বিউকে দিতে হবে। বিভিন্ন ধরনের গল্প গুজব এবং ক্ষুধার্ত ভালোবাসা শেষে বাথে আমরা ঘুমিয়েছি শেষ রাতে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দুপুর গড়িয়েছে। গোসল এবং খাওয়া-দাওয়া সেরে দু’জনেই জানালায় বসেছি। অপরূপ চীনের গ্রামগুলো। অবশ্য বাংলাদেশের গ্রামগুলোর মধ্য দিয়ে যখন ট্রেন চলে তখনও অপরূপই লাগে। ক্ষুধা, দারিদ্র, দুঃখের ছবি চলন্ত ট্রেনের বাথ থেকে দেখা যায় না, এরকম কোনো চপল উর্বশী সাথে থাকলে সে চিন্তা মাথায় আনাই তো কঠিন। তবে ওর মধ্যে একটা দ্বৈত সত্তা খুঁজে পেলাম। ও প্রেমের কথা বলে, প্রেম করেও, পরক্ষণেই বলে গণমানুষের কথা– ওর কথা মুগ্ধ হয়ে শোনা যায় কিছুক্ষণ। বাংলার নারীরা এখনো এ পর্যায়ে পৌঁছুতে পারেনি, তাদের সাথে আমার পড়েনি কোনোদিন।
ট্রেন একটু লেট হয়েছে। আমরা কিঙ্গালা পৌঁছুলাম রাত নয় টায়। বিউ কিঙ্গালায় রাত কাটাতে চায় না। বিতং যাওয়ার আগে আমাদের যেতে হবে হানসু নামে একটি শহরে। হানসু এখান থেকে দেড়শো কিলোমিটার। হানসু ওর আপন শহর। ওখানে গিয়ে থাকতে কোনো সমস্যা হবে না। কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। উচ্চ ভাড়ায় একটা গাড়ি নিল ও। আমাকে গাড়ির মধ্যে বসিয়ে রেখেই সরকারি লোকদের সাথে দরবার সেরে নিল। হানসু যেতে আমাদের বারোটার কাছাকাছি বাজলো। সোজা আমরা উঠে গেলাম একটি তিনতলা বাড়ির দোতলায় । বাড়ির ওপাশেই একটি নদীর আভা বোঝা যাচ্ছে। বাড়িটি নীরব, মধ্যবয়সী একজন নারী এসে ঘর খুলে দিলো। ওকে স্থানীয় ভাষায় কিছু বলে দ্রুত নারীটি তার রুমে চলে গেল। সুবিধা হয়েছে করোনার কারণে কেউই কাছে এসে কথা বাড়াচ্ছে না। দু’জনই আমরা ক্লান্ত, খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
খুব ভোরে বিউই আমাকে ডেকে তুললো। বেরিয়ে আমরা মিনিট দুই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েছি। খুব বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর সুযোগ নেই, লকডাউন চলছে, সরকারি লোক চলে আসবে। ও মোবাইল করে একটা অটো ডেকে আনল। হানসু থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বিতং গ্রাম। গ্রামটি বেশ বড়, নব্য প্রতিষ্ঠিত। গ্রামটিতে ঢোকার মুখে একটি গেট রয়েছে। আমরা গ্রামে (গেট পর্যন্ত) পৌছুনমাত্রই দূর থেকে অভ্যর্থনা জানানো হলো। বুঝলাম, বিউ এই গ্রামে খুবই সম্মানিত। কিছু সময় যেতে বুঝেছি, বলতে গেলে ও-ই এই গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা। গ্রামটির বয়স ২২ বছর (প্রতিষ্ঠা সন একটি ফলকে লেখা রয়েছে)। ওর বয়স চল্লিশের বেশি হবে না, তাহলে বিউ কীভাবে এ গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা হয়! অবশ্য পরে ও আমাকে বিষয়টি খুলে বলেছে। গ্রামটি কড়াকড়িভাবে লকডাউন কার্যকর করেছে। বারোজনের একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়েছে, তারাই সবকিছু সামলাচ্ছে।
শুরু থেকেই তারা সজাগ আছে, বাইরে থেকে কাউকে আসতে দেয়নি, আবার কাউকে বাইরে যেতেও দেয়নি। ফলে গ্রামের লোকেরা নিজেদের মধ্যে মেলামেশা করতে পারছে। গ্রামের তিনটি প্রবেশদ্বারের মধ্যে দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটা কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, একটা কুকুরও ঢুকতে পারছে না। যেহেতু গ্রামটি প্রাচীর বেষ্টিত এবং গ্রামের সকল লোক সচেতন তাই বাইরে থেকে কারো পক্ষেই ঢোকা সম্ভব নয়। অবশ্য এমনিতেই গ্রামটিতে প্রবেশ করতে কিছুটা কড়াকড়ি থাকে স্বাভাবিক সময়েও। আমাদের এখন ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। খুব সাবধানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো অতিথিশালায়। আগে থেকেই সেখানে ১৯ জন কোয়ারেন্টিন করছে। কারো সাথে কারো যাতে সংযোগ না ঘটে এজন্য বেরোনোর আগে স্বেচ্ছাসেবীদের ফোন দিতে হয়, তারা অনুমতি দিলেই তবে বেরোনো যায়। খাবার দরজার কাছে রেখে যায় স্বেচ্ছাসেবীরা।
আমার মনটা গ্রামটা সম্পর্কে জানার জন্য আকুলি বিকুলি করছে। তিনতলা থেকে দেখতে পাচ্ছি ছবির মতো এ গ্রামটি। প্রত্যেকটি বাড়ি একই রকম, শুধু কোনোটি ছোট কোনোটি বড়। এ যেন একটি সাজানো ফুলের বাগান। ও আমার কৌতুহল বুঝতে পেরে বলছে, অপেক্ষা করো, তোমাকে সব বলবো। দুপুরের খাবার খেয়ে আমি একটানা ওর কাছে গ্রামটি প্রতিষ্ঠার গল্প শুনলাম। গল্পে গল্পে সন্ধ্যে নেমে আসলো। গ্রামটির প্রতিষ্ঠাতা মূলত ওর পিতা। ওর বয়স তখন ঊনিশ বছর। হুনান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পিতা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন গ্রামের জন্য একটি বাড়ির ডিজাইন করতে, যেটি তৈরি করা যাবে যথাসম্ভব কম খরচে, ডিজাইনটি বড় বা ছোট করা যাবে, তাতে আয়তনের হেরফের হবে কিন্তু বাহ্যিক রূপটি হবে একই প্রকার। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় এই গবেষণাটি করেই শিক্ষা জীবন শেষ করেছি। অবশেষে এই প্রোটোটাইপটি আবিষ্কার করতে পেরেছি, যেটি তুমি এখন দেখতে পাচ্ছো।
এই জায়গাটি ছিলো একটি পতিত ভূমি। এবং আশেপাশের গ্রামগুলি ছিলো দরিদ্র মানুষের পরিপূর্ণ। আমার পিতা একজন নামকরা রাজনীতিক ছিলেন, তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব দেন যাতে তিনি এই পতিত ভূমিতে একটি বিশেষ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। আমার পিতাও ছিলেন একজন স্থাপত্যবিদ। তিনি গ্রামটিকে প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ মুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য প্রয়োজন ছিলো জনসমর্থন। তিনি আশেপাশে গ্রামগুলিতে ঘোষণা দেন— কারা সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে গ্রামটির বাসিন্দা হতে ইচ্ছুক। এলাকায় আমার পিতার জনপ্রিয়তা ছিলো, ফলে দ্রুতই তিনহাজার লোক পাওয়া গেল। ঐ তিন হাজার লোকের ঠিকুজিসহ প্রস্তাব সংশোধন করে আবার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রেরণ করা হলো। অবশেষে পঞ্চাশ বছরের জন্য আমার পিতাকে গভর্নর করে গ্রামটি প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়।
আমার পিতা কিঙ্গালা প্রদেশের গভর্নর হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তার সকল স্বপ্ন এবং পরিশ্রম উজাড় করে দেন ক্ষুধা-দারিদ্র মুক্ত একটি আধুনিক গ্রাম প্রতিষ্ঠার কাজে। দুই বছর আগে তিনি হঠাৎ মারা গিয়েছেন, এরপর বিতং-এর বাসিন্দারা আমাকে গভর্নর হিসেবে মেনে নিয়েছে। তবে আমি এখনো দায়িত্ব বুঝে নিইনি। একজন অন্তবর্তীকালীন গভর্নর দিয়ে গ্রামটি চলছে। শহরে আমার ফার্ম রয়েছে, আলাদা জীবন রয়েছে, বন্ধুবান্ধব রয়েছে, সব ছেড়ে আসতে হবে এই গ্রামটির দায়িত্ব নিতে! এখনো গ্রামটি চূড়ান্ত রূপ পায়নি, তাই দায়িত্ব আমাকে নিতেই হবে। আমি যখন গ্রামে নিয়ে আসার জন্য হন্যে হয়ে একজন বন্ধু খুঁজছি তখন কোথা থেকে তুমি এসে উদয় হয়েছো! অবশ্য প্রথমে আমি তোমাকে দয়া করতে চেয়েছিলাম, পরে আস্তে আস্তে বন্ধু হয়েছো। আচ্ছা, তুমি কি কয়েক মাস এখানে আমার সাথে থাকবে? যদিও কয়েক মাসের মধ্যে তুমি চাইলেও যেতে পারবে না। তাছাড়া তুমি কীভাবে দেশ ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে যাবে সেটিও তো ভাববার বিষয়, যেহেতু এসেছো অবৈধভাবে ।
এই গ্রামের একটি নিজস্ব চ্যানেল আছে, সেখানে গ্রামের সবকিছু দেখানো হয়। ও টিভি দেখিয়ে আমাকে সবকিছু বোঝাচ্ছে। শুরুতে প্রত্যেকটি বাড়ির আয়তন ছিলো একই প্রকার, বাড়িতে ঢোকার গেটটিও একই প্রকার। গাছগুলোতে শুধু ছিল বৈচিত্র। পাঁচ কাঠার একটি বাড়ি প্রত্যেকটি পরিবার পেয়েছিলো। পরবর্তীতে একই ডিজাইনে দশটি বড় বাড়ি তৈরি হয়, যেগুলো গ্রামের কয়েকজন কিনে নেয়। বিউ নিজে এরকম একটি বাড়ির মালিক। টাকাগুলো জমা হয় গ্রাম সরকারের কোষাগারে। নয়শো বাইশটি পরিবার নিয়ে শুরু হয়েছিলো বিতং গ্রামটি। এখন পরিবারের সংখ্যা একটু বেড়ে এগারোশো আশিটি। যেহেতু জন্মনিয়ন্ত্রণের কড়াকড়ি রয়েছে, এবং বাড়ি বিক্রির অনুমতি নেই, ফলে পরিবার বেড়েছে মূলত যৌথ পরিবার ভেঙ্গে কিছু একক পরিবার গঠিত হওয়াতে। বিতং-এর কিছু মানুষ দেশ বিদেশে থাকে, গ্রামে আসে তারা অতিথি হিসেবে, তবে গ্রাম সরকারের কোষাগারে নিয়মিত টাকা দেয়। বাধ্যবাধকতা নেই, তারপরেও বাইরে থেকে প্রচুর টাকা আসে বিতং গ্রাম সরকারের কোষাগারে।
গ্রামটিতে বর্তমানে তিন হাজার নয়শো পঁচিশজন লোক বসবাস করে। প্রতি একশোজন লোকের খাওয়ার জন্য একটি করে গ্রাম সরকার পরিচালিত রন্ধানশালা রয়েছে। সেখানে খাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই, তবে না খাইলেও মাথাপিছু নির্ধারিত পরিমাণ টাকা খাওয়ার জন্য গ্রাম সরকারের কোষাগারে দেওয়া বাধ্যতামূলক। বলতে গেলে প্রায় সবাই-ই এই রন্ধনশালাতেই খায়। খাবার নির্বাচনে স্বাস্থ্যের দিকটি বিবেচনায় রাখা হয়, পাশাপাশি বৈচিত্রও আনা হয়, ফলে কারো কোনো অভিযোগ নেই। কেউ অসুস্থ হলে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং পথ্য গ্রাম সরকারের তত্ত্বাবধানে বাসায় পাঠানো হয়। গ্রামে হাসপাতাল রয়েছে দু’টি, সবার জন্য চিকিৎসা এবং ওষুধ ফ্রি। বড় কোনো রোগ হলে গ্রাম সরকারের তত্ত্বাবধান এবং খরচে কিঙ্গালা থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনা হয়। গ্রাম থেকে বাইরে কোথাও ইচ্ছে মতো টাকা পাঠানোর সুযোগ নেই। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামের স্কুলেই পড়তে হয়। চমৎকার তিনটি স্কুল রয়েছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য কেউ বাইরে গেলে শর্তসাপেক্ষে সে খরচ গ্রাম সরকার বহন করে। শর্ত মানতে না চাইলে নিজ খরচে পড়াশুনা চালাতে হয়।
উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এ পর্যন্ত গ্রামে ফিরে এসেছে অনেকে। তারাই হাসপাতাল এবং স্কুল তিনটি পরিচালনা করছে। তাছাড়া গ্রামটিতে কয়েকটি খামার রয়েছে, যেখান থেকে হানসু এবং কিঙ্গালায় প্রতি সপ্তাহে কয়েকটি ট্রাকে মালামাল যায়। গ্রামে কারো ব্যক্তিগত কোনো সম্পদ বা সম্পত্তি নেই, তবে গ্রাম সরকারের কোষাগার থেকে বড় অংকের ঋণ নেওয়া যায়। অনেকে ঋণ নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে আসে। অতিরিক্ত কাজ করে অথবা ছেলে মেয়েদের পাঠানো টাকায় ঋণ শোধ করতে হয়। এমনিতে বিতং-এ সপ্তাহে তিনদিন ছুটি এবং চারদিন আট ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া যায়, তবে সেটি গ্রামের মধ্যে পরিচালনা করার নিয়ম নেই। বিতং থেকে বাইরে গিয়ে সেটি পরিচালনা করতে হয়। এভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে অনেকে বিভিন্ন জায়গায় সম্পদ করেছে, যেটিতে গ্রাম সরকার হস্তক্ষেপ করে না। এরকম কয়েকটি পরিবার বিতং-এ আছে, যারা প্রকৃতপক্ষেই অনেক ধনী, কিন্তু তারা এই গ্রাম ছেড়ে যায় না, গ্রামটিকে ধনী গরীব সকলে স্বর্গ মনে করে। যেহেতু গ্রামটিতে খাদ্য শিক্ষা চিকিৎসা সবার জন্য একই প্রকার, ফলে ধনী গরীবের ব্যবধান সেখানে চোখে পড়ে না, তেমন কোনো আচরণও কেউ করে না। অথচ এই মানুষগুলোই মাত্র বাইশ বছর আগে ছিলো দরিদ্র, ক্লিষ্ট এবং অস্পৃশ্য। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে মানুষের জীবন বদলে যেতে পারে প্রাণ প্রকৃতিকে প্রতিপক্ষ না করে।
বিতং গ্রামের মানুষের পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙে, রাতে ঝোপে ঝাড়ে শিয়াল ডাকে। গ্রামের কয়েকটি ঝোপঝাড় রয়েছে, একপাশে রয়েছে একটি জঙ্গল, যেখানে কোনোভাবেই মানুষের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। করোনা ভাইরাস এবং এই লকডাউনে গ্রামের মানুষ বিচলিত নয়, তারা সহজ সচেতন এবং সুরক্ষিত। গ্রামের খাদ্য গুদামে কমপক্ষে এক বছরের খাবার সংরক্ষিত আছে। অন্যান্য ব্যবস্থাও সুসংগঠিত। মানুষ বিতং-এ তাই স্বাভাবিকভাবেই খাওয়া দাওয়া করছে, ঘুরছে ফিরছে, পার্কে আনন্দ করছে। এই সংকট মোকাবেলায় বিতং কেন্দ্রীয় সরকারকে অর্থ সাহায্যও পাঠিয়েছে।
দেখতে দেখতে কোয়ারিন্টিনের চৌদ্দ দিন আমাদের কেটে গেছে। আজকে ওর সাথে আমি বের হব সচক্ষে গ্রামটি ঘুরে দেখতে। বিউ রাস্তায় নামার সাথে সাথে মানুষ চিৎকার করে তাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। কেউ এসে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছে, সাথে আমাকেও ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছে। কিছুদূর এভাবে যাওয়ার পর ও সিদ্ধান্ত নেয় গভীর রাতে আমাকে গ্রাম ঘুরে দেখাবে, নইলে মানুষকে বঞ্চিত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ হলে মানুষের ভালোবাসার জবাব দিতেই হয়।
গ্রামে কোনো পঙ্গু বা পাগল লোক দেখলাম না। সবাইকে উচ্চ চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা হয়। গত বছর হানসুতে দুর্ঘটনায় একজনের পা গেছে, এমনভাবে তাকে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে বোঝার উপায় নেই যে, সে পঙ্গু। গ্রামে দু’জন মানসিক রোগী আছে। তাদের রাখা হয় হানসুর একটি মানসিক হাসপাতালে। মাঝে মাঝেই মানসিক রোগী দু’জনকে গ্রামে আপনজনের কাছে ফিরিয়ে আনা হয় গ্রাম সরকারের তত্ত্বাবধানে। অবস্থা খারাপ হলে আবার হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামটির প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে বিউর পিতা থানংউত যে শুধু মেধাশ্রম ব্যয় করেছেন তা নয়, বড় অংকের অর্থও তিনি ঋণ দিয়েছিলেন গ্রাম সরকারকে, যে টাকা বিউ আর ফেরৎ নিতে চায় না। ঐ টাকায় বিতং গ্রাম কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে একটি একশা একরের জায়গা কিনেছে, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
অতিথিশালা ছেড়ে আমি বিউর বাড়িতে উঠেছি। সেখানে ওর মা এবং ভাই থাকে। ভাইটিকে পিতা ইচ্ছে করেই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠায়নি কোথাও। একটি খামার পরিচালনা করে বিটংটাং। খামারটি অভিনব। খামারটিতে গরু, মুরগী এবং হাঁস রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবেই সেগুলো বিচরণ করে বেড়ায়। খামারের মধ্যে বেশ কয়েকটি পুকুর রয়েছে। পুকুরগুলোর সাথে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিকটবর্তী নদীর সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে পুকুরের পানি কখনো মলিন হয় না। খামারে রয়েছে কয়েক ধরনের ফলের গাছ, কিছু ঔষুধী গাছও রয়েছে— অনেক নিমগাছ দেখলাম। একটি গোচারণ ভূমি রয়েছে। গরুর শেডগুলো উন্মুক্ত, স্বাধীনভাবে গরুগুলো বেঁচে থাকে খামারে। এভাবে বিতং গ্রামের মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটায় যথাসম্ভব নিষ্ঠুরতা পরিহার করে।
গ্রামে বেশ কয়েকটি পাঠাগার এবং সংস্কৃতি কেন্দ্র রয়েছে। পাঠাগারগুলো ডিজিটালাইজড্। কয়েকটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে গ্রামের মানুষ বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ শেখে। ব্যায়ামাগারে যাওয়াটা বিতং-এর মানুষের দৈনন্দিন জীবনেরই একটা অংশ। গ্রামের দুই কোণায় দুটি ব্যায়ামাগার রয়েছে, এছাড়া রয়েছে চারটি ইয়োগা সেন্টার। বড়দের জন্য দুটি ফুটবল মাঠ রয়েছে, শিশুদের খেলার মাঠগুলো আলাদা। গ্রামে একটি নিরাপত্তা বাহিনী আছে, যেখানে ষোলো থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে অন্তত এক বছর সেবা দিতে হয়। উচ্চ শিক্ষা এবং চাকরি নিয়ে যারা বাইরে থাকেন তাদের জন্য এ নিয়মটি শিথিল, তবে এজন্য তারা গ্রাম সরকারের কোষাগারে অর্থ দিয়ে থাকে।
বিউ বলল, তুমি আর কিছু শুনতে চেও না। কয়েক মাস থাকলে এমনিতেই সব জেনে যাবে। এখন উপভোগ করো। আজকে ওদের রন্ধনশালায় পিকনিক আছে, তার আগে গান বাজনা হবে। বিউর বন্ধু হওয়াতে আমাকে সবাই খুব খাতির করছে। গান গাইতে বলছে। আমি এ্যাঁড়ে গলায় এবং বেসুরে একটি বাংলা গান গাইলাম। সবাই করতালি দিয়ে বাহবা দিল। ও খুব ভালো কৌতুক করে, চীনা ভাষায় করছে, সবাই হাসছে দেখে আমিও হাসছি, কিন্তু বুঝতে পারছি না কিছুই। সুর সার্বজনীন, ওদের লোকগানের সুর আমার প্রাণ ছুঁয়েছে।
এরপর খাওয়া দাওয়ার পালা। খামারের হাঁসের মাংস, এবং মাছের বিভিন্ন পদ, সবজি এবং শেষে দুধের পায়েশ। গল্পে আনন্দে আড্ডায় রাতটি প্রায় যায় যায়। অবশেষে বিউ মাইক্রোফনে দুই কথা বলে সভা ভঙ্গ করে দিলো। আমিও চলে আসলাম দেশ হতে হাজার হাজার মাইল দূরে নির্জন গ্রাম্য পথ ধরে অচেনা এক দেবশ্রীর সাথে তার সুসজ্জিত বাসরে। আজকে বিউর ভাই এবং মা খামারের বাগান বাড়ীতে আছে। তাই আজকের রাতটা আমাদের জন্য বিশেষ। ওদের বাড়িতে আসার পর থেকে এতদিন আমরা আলাদা রুমে ঘুমিয়েছি।
লেখক: গবেষক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক