ডায়ালাইসিস করে কিডনি রোগীরা ফিরে পেতে পারেন নতুন জীবন

follow-upnews
0 0

কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেলে (প্রায় হারিয়ে গেলে) শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমে যায়। শরীর তখন বিষাক্ত হয়ে যায়। শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দিতে তখন ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। ডায়ালাইসিস করেও সুস্থ জীবনযাপন করা যায়। ডায়ালাইসিস নিয়ে কথা বলেছেন কিডনির চিকিৎসক রাজীব মণ্ডল


রোগী দেখছেন চিকিৎসক রাজীব মণ্ডল
রোগী দেখছেন চিকিৎসক রাজীব মণ্ডল।

প্রশ্ন: এখন অনেক মানুষের মুখেই শোনা যায় ডায়ালাইসিস শব্দটি। এটি আসলে কী?

উত্তর: হ্যাঁ। এখন অনেকের মুখেই ডায়ালাইসিস শব্দটি শোনা যায়। ডায়ালাইসিস আসলে একটি কৃত্রিম প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর যে বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় তা বের করা আনা হয়।

প্রশ্ন: কিন্তু ডায়ালাইসিসের কেন প্রয়োজন হয়? 

উত্তর: আমাদের শরীর থেকে মূত্রের মাধ্যমে বর্জ্য পদার্থ বের করে দিতে কিডনি বা বৃক্ক বড় ভূমিকা পালন করে। যখন আমাদের কিডনি খারাপ, নষ্ট হয়ে যায়, বা ঠিকমতো কাজ করে না তখন আমাদের শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমতে থাকে। এর থেকে বিষক্রিয়া হতে শুরু হয়। তাই কৃত্রিমভাবে বর্জ্য পদার্থ বা বিষগুলি বের করার প্রয়োজন। এর জন্য ডায়ালাইসিসের দরকার পড়ে।

প্রশ্ন: ডায়ালাইসিস কখন শুরু করতে হয়?

উত্তর: প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে কিডনির কাজ করার ক্ষমতা শতকরা দশ ভাগের নীচে নেমে গেলে তখন ডায়ালাইসিস শুরু করা হয়। তবে এই শতাংশ বিচারটি সব দেশে এক হয় না। বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে মাত্রার কিছুটা পার্থক্য আছে।

প্রশ্ন: একজন মানুষের কোন লক্ষণগুলি দেখে বুঝবেন যে, তার ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন রয়েছে?

উত্তর: আগেই বলেছি, ডায়ালাইসিসের কারণ হল কিডনি বা বৃক্ক খারাপ হওয়া বা তার ক্ষমতা কমে যাওয়া। এর উপসর্গগুলি হল, রোগীর যখন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে, বমি বমি ভাব হবে, পুষ্টির ঘাটতি দেখা যাবে, শরীরে অত্যধিক জল জমে যেতে শুরু করবে। এগুলি হলে তখন বুঝতে হবে এ বার ডায়ালাইসিস শুরু করতে হবে। আর শিশুদের ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় তাদের বৃদ্ধি ঠিকমতো হচ্ছে না, তখন ডায়ালিসিস শুরু করা যেতে পারে। তবে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন চিকিৎসক। লক্ষণগুলি দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রশ্ন: কীভাবে ডায়ালাইসিস করা হয়?

উত্তর: শরীরের বর্জ্য পদার্থ দূষিত রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়। শিরা দূষিত রক্ত বহন করে নিয়ে যায়। ডায়ালাইসিস করে এই রক্তকেই শোধন করা হয়। ডায়ালাইসিস সাধারণত দুভাবে করা যায়। ডায়ালাইসিসে আমাদের শরীর থেকে রক্ত বের করে পরিস্রুত করে আবার তা আমাদের শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় হিমোডায়ালাইসিস। অন্য একটি পদ্ধতিটি হল আমাদের পেটের মধ্যে নল ঢুকিয়ে তার মধ্যে দিয়ে ডায়ালাইসিসের সলিউশন দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পরে সেটিকে আবার বের করে নেওয়া হয়। একে বলা হয় পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস। 

প্রশ্ন: আচ্ছা এই ডায়ালাইসিস কি বাড়িতে করা সম্ভব?

উত্তর: পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বাড়িতে বসেই করা সম্ভব। তবে অবশ্যই তা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই করতে হবে।

প্রশ্ন: ডায়ালাইসিসের এই দুই পদ্ধতির মধ্যে কোনটি বেশি কার্যকরী?

উত্তর: দুই পদ্ধতিতেই কিছু ভাল, কিছু খারাপ রয়েছে। যেমন, হিমোডায়ালাইসিসের জন্য ডায়ালাইসিস কেন্দ্রের দরকার পড়ে এবং সপ্তাহে দুই থেকে তিন বার সেখানে যেতে হবে। কিন্তু পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিসের ক্ষেত্রে বাড়িতে বসেই করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ বাড়ি থেকে চিকিৎসাকেন্দ্রে যাওয়ার সমস্যা পোহাতে হয় না।

প্রশ্ন: একজন রোগীর কত বার ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়? একবার এই প্রক্রিয়াটি শেষ করতে কত সময় লাগে?

উত্তর: আগেই বলেছি সাধারণত সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। এবং প্রতি বার প্রক্রিয়াটি শেষ হতে সাড়ে তিন ঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টা করে সময় লাগে।

প্রশ্ন: বহু মানুষই জানতে চান, এই ডায়ালাইসিস কি সারা জীবন করে যেতে হবে?

উত্তর: এটা নির্ভর করে রোগীর কিডনির পরিস্থিতির উপরে। অনেক সময় কিডনি সাময়িক কারণে বা সাময়িক সমস্যার জন্য খারাপ হয় বা তার কাজে সমস্যা তৈরি হয়। একে বলা হয় অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি। এক্ষেত্রে কিছুদিন পরে কিডনি তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায় এবং ডায়ালাইসিসের আর দরকার হয় না। কিন্তু যাদের কিডনি চিরস্থায়ীভাবে খারাপ হয়ে যায় তাদের বাঁচিয়ে রাখতে সারা জীবন ডায়ালাইসিস করে যাওয়ার প্রয়োজন।

প্রশ্ন: কোনও রোগীর ক্ষেত্রে ডায়ালাইসিস কত দিন পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া যায়?

উত্তর: এটির কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। আমার দেখা বহু রোগীই প্রায় কুড়ি বছর ধরে ডায়ালিসিস করে চলেছেন এবং সুস্থ আছেন।

প্রশ্ন: ডায়ালাইসিস শুরুর আগে রোগীর কী করণীয়?

উত্তর: ডায়ালাইসিস শুরুর আগে রোগীর হাতে একটি ফিস্টুলা তৈরি করতে হয়। এটি এক ধরনের অস্ত্রোপচার। এখানে হাতের ধমনী এবং শিরা পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। পরে এই ফিস্টুলা দিয়ে শরীর থেকে রক্ত নিয়ে ডায়ালাইসিস করা হয়।

প্রশ্ন: যে হাতে ফিস্টুলা তৈরি করা হবে, সেই হাত দিয়ে কি কাজ করা যাবে?

উত্তর: কাজ করা যাবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, যেন ওই হাতে আঘাত না লাগে। আর ওই হাত দিয়ে ভারী কোনও কাজ না করাই ভাল।

প্রশ্ন: ডায়ালাইসিসের আগে রোগীকে কি কোনও টিকা দেওয়ার প্রয়োজন হয়? 

উত্তর: আমরা সাধারণত রোগীকে তিন ধরনের টিকা দিয়ে থাকি। ডায়ালাইসিসের আগে এগুলি দেওয়ার প্রয়োজন। প্রথমত, হেপাটাইটিস-বি টিকার চারটি ডোজ, দ্বিতীয়ত, নিউমোনিয়ার টিকা দিতে হয় এবং তৃতীয়ত ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকাও।

প্রশ্ন: ডায়ালাইসিস চলা রোগীর জীবনযাত্রায় কীরকম পরিবর্তন আনতে হয়?

উত্তর: ডায়ালাইসিস চলছে এমন রোগীর সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন ফিরে যাওয়া দরকার। তাই রোগী তার সব দৈনন্দিন কাজ এবং অফিস করতে পারবে। তবে ভারী কাজ না করাই ভাল।

প্রশ্ন: অনেকেই বলেন, ডায়ালাইসিস রোগীদের নানা নিয়ম মেনে চলতে হয়। বিশেষ করে খাওয়ার ক্ষেত্রে। এটা কি ঠিক? ঠিক কী পরিবর্তন আনতে হয়?

উত্তর: সাধারণত কম পটাশিয়াম যুক্ত খাবার খাওয়াই বাঞ্ছনীয়। যারা মোটা নন, তাদের একটু বেশি খাবারের প্রয়োজন। তবে তা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই করতে হবে। একই সঙ্গে কম ফসফেট জাতীয় খাবারও দরকার। প্রতি দিন চার গ্রাম নুন খাওয়া যাবে। প্রতি দিন যতটা প্রস্রাব হয়, সারা দিনে তার থেকে পাঁচশো মিলিলিটার জল বেশি পান করা যেতে পারে। তবে খাদ্যাভাস প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে আলাদা, তাই ডায়াটিশিয়ান ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।

প্রশ্ন: ডায়ালাইসিসের ক্ষেত্রে কী কী জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে?

উত্তর: ডায়ালাইসিস চলার সময়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তার মধ্যে সাধারণত রক্তচাপ কমে যাওয়া, রক্তে শর্করা কমে যাওয়া, কাঁপুনি হওয়া, হার্টের সমস্যা হতে পারে।

প্রশ্ন: এইসব জটিলতা কমাতে রোগীর কী করণীয়?

উত্তর: প্রথমত, ডায়ালাইসিস নিয়ম অনুযায়ী করতে করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ডায়ালাইসিস করতে যাওয়ার আগে পেট ভর্তি করে খেয়ে যেতে হবে। ডায়ালাইসিস চলাকালীন কোনও ভারী খাবার চলবে না। আর তৃতীয়ত, পরিমিত জল ও নুন গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্ন: কখন আর ডায়ালাইসিস করা যায় না? 

উত্তর: ডায়ালাইসিস সব সময়ই করা যায়। কিন্তু যদি শরীর থেকে রক্ত বের করা বা ঢোকানোর রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় তখন হিমোডায়ালাইসিস আর করা যায় না। তখন পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস করা যেতে পারে।

প্রশ্ন: কিডনি প্রতিস্থাপন কখন করা হয়?

উত্তর: চিরস্থায়ীভাবে কিডনি খারাপ হয়ে গেলেই কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়। 

প্রশ্ন: ডায়ালাইসিস করে যাওয়া না কি কিডনি প্রতিস্থাপন, কোনটি ভাল?

উত্তর: কিডনি প্রতিস্থাপন অবশ্যই ভাল। যদি কিডনি দাতা পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, কিডনি প্রতিস্থাপন একটি বড় এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া। আর আমাদের দেশে কিডনি ক্রয় এবং বিক্রয় দু’টিই আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

প্রশ্ন: কোথায় কোথায় ডায়ালাইসিসের সুবিধা মেলে?

উত্তর: সরকারিভাবে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এই সুবিধা পাওয়া যায়। পাশাপাশি, বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও ডায়ালাইসিস করানো হয়।

প্রশ্ন: ডায়ালাইসিস করে কতটা সুস্থ থাকা যায়?

উত্তর: চিকিৎসকদের লক্ষ্য থাকে, ডায়ালাইসিস করে রোগীর সুস্থ পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া। ডায়ালাইসিস মানুষকে নতুন জীবন দেয়। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম মাইলস্টোন।

Next Post

ছোটগল্প: বিতং // দিব্যেন্দু দ্বীপ

চীনের একটি দুর্গম প্রদেশ কিঙ্গালা। এই কিঙ্গালা প্রদেশের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম বিতং। আপনারা নিশ্চয় এটা যেনে বিস্মিত হবেন যে, কীভাবে আমি বিশ্বব্যাপী এই করোনাকালে বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের বিতং গ্রামে পৌঁছুলাম। সে ঘটনাটা পুরো বলতে গেলে যে গল্পটি বলতে চাচ্ছি সেটি আর বলা হবে না। শুধু বলে রাখি, […]
চীন