অটিজমের নীল ভূতেরা

follow-upnews
0 0

শান্তা তাওহিদা

চেয়ারপার্সন
যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


মিতুলের গল্পটা একটা নীল ভূতকে নিয়ে। সারাক্ষণ ওর নীল ভূতের ভয়। যখনই আম্মুর চোখে তাকাতে চায় ভূতটা চোখের সামনে এমন নাচানাচি জুড়ে দেয় যে, মায়ের মায়াভরা চোখটা আর দেখা হয় না। চিৎকার করে আম্মু বলে ডাকতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু ভূতটা এত জোরে গলায় চেপে ধরে যে, গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না। মিতুলের খুব ইচ্ছে হয় বাবার পাশে চুপটি করে বসে রাজারানির গল্প শুনতে। কিন্তু ভূতটা সেখানে এসেও ঝামেলা শুরু করে। চুপটি করে বসে আর গল্প শুনা হয় না তার। পাশের বাসার তুতুলের সাথে ওর খুব খেলতে ইচ্ছে হয়। ভূতটা তুতুলকেও ভয় দেখায়। মিতুল খুব একা হয়ে যায়। ভূতটা বলে আমিতো আছি। কিন্তু মিতুল ওই নীল ভূতের সাথে একদম থাকতে চায় না। মিতুল ভালো নেই। একদিন সে জানতে পারে এ ভূতটার নাম নাকি অটিজম। মিতুল জানে না অটিজম কী!

আমাদের চারপাশে এমন অনেক মিতুল আছে। আমরা চাইলেই আমাদের মিতুলদের নীল ভূতের ভয় কাটিয়ে সুন্দর নীল আকাশ দেখাতে পারি। এই নীল ভূতটাকে যত তাড়াতাড়ি আমারা খুঁজে পাব তত তাড়াতাড়ি আমারা এ ভূত থেকে মিতুলদের মুক্তি দিতে পারব। কিন্তু কীভাবে আমরা অটিজমের এ নীল ভূতকে খুঁজব?
উত্তর খুব সহজ। আমরা আমাদের মিতুলদের সাথে খেলতে খেলতেই তা জেনে নিতে পারি নীল ভূতের আস্তানার খবর।

অটিজম মানসিক রোগ নয়, এটি শিশুর মানসিক, ভাষিক ও সামাজিক যোগাযোগের বিকাশগত সমস্যা। একটি শিশুর দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই অটিজম প্রকাশ পায়। তবে দ্রুত শনাক্তকরনের মাধমে তার সীমাবদ্ধতাগুলো কমিয়ে আমারা এ শিশুদের প্রায় স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্থ করে তুলতে পারি। এক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকার বিকল্প নেই।
খেলার ছলে শিশুর যোগাযোগ ও ভাষা প্বূবর্তী দক্ষতাগুলো পরখ করতে আপনার লাগবে ঘন্টা, ঝুনঝুনি, রঙিন আলোর-বল, বিভিন্ন মাপের পাজল, লেগো ও বিল্ডিং ব্লুক খেলনা, গাড়ি, বল, পুতুল, ছবি, সুইসযুক্ত পাখা, গাড়ি, মুরগী, হাঁস, কলম, লাটিম এর মতো কিছু বিশেষ খেলনা।
শিশুকে একটু দূরত্ব রেখে তার নাম ধরে ডাকুন; পিছনে বা পাশে থেকে ঘন্টা, ঝুনঝুনি বাজিয়ে দেখুন; শিশুর চোখের সমতলে একটি সুতায় ঝুলন্ত রঙিন আলোর-বল ধরুণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে শিশু চোখে চোখে তাকাচ্ছে কিনা তা খেয়াল করুন। আপনার সাথে দৃষ্টি সংযোগের পাশাপাশি সে খেলনার দিকে দৃষ্টি সংযোগ করছে কিনা তাও খেয়াল করুন ।
শিশু কোন খেলনার দিকে কত সময় তাকাচ্ছে তা এখানে দেখুন। শিশুকে বিভিন্ন মাপের পাজল মিলাতে দিন। বিল্ডিং ব্লুক খেলনা দিয়ে খেলতে দিয়ে দেখুন সে কতখানি সময় ধরে একটি খেলনা নিয়ে খেলে বা এক স্থানে বসে কত সময় ধরে খেলে।
শিশুকে দুটি খেলনার থেকে একটি নির্বাচন করতে দিন। সে যদি দুটি বস্তুই পেতে চায় তাহলে এখানে তার সীমাবদ্ধ আচরণ পাবেন।
আগের খেলনা দিয়েই পালাবদল বা দেয়া-নেয়া খেলা খেলুন। প্রথমে শিশুর দিকে বার বার বল গড়িয়ে দিন। তারপর সে কী করছে তা খেয়াল করুন। যেমন: শিশুকে এবার বলটি আপনার দিকে গড়িয়ে ফেরত দিতে বলুন। সে যদি ফেরত দেয় তবে তার পালাবদলের ধারণা আছে। এবার কৌশলে শিশুর গড়িযে দেয়া গাড়ি বা বল আপনি তার দিকে গড়িয়ে না দিয়ে নিজের হাতে কিছু সময় ধরে রাখুন এবং সে অপেক্ষা করে কীনা তা পর্যবেক্ষণ করুন। শিশু বলটি পেতে অপেক্ষা করছে, তারপর অনুরোধ করছে, নাকি ছোঁ মেরে সেটি কেড়ে নিতে চাচ্ছে তাও খেয়াল করুন।
শিশুকে একটি রঙ্গিন সুতায় বাঁধা গাড়ি টানতে দিন, এছাড়াও শিশুকে ঘরের ভেতরের একটি হাল্কা চেয়ার ঠেলে নিয়ে মাকে বসতে দিতে বলুন। পাখা (ফ্যান) ঘুরছে, পাখা কোথায় বলতো? এভাবে মাথার উপরের পাখা দেখাতেও বলুন।
শিশুর সামনে একটি সুইচযুক্ত খেলনা পাখা দিয়ে দেখুন সে সুইচ টিপে পাখা চালাতে পারছে কিনা। সুইচ টিপলে ডিম পারে এমন মুরগী বা হাঁস দিয়েও এর কার্যকারণ সম্পর্ক সে বুঝতে পারে কিনা তা দেখুন।
শিশুকে কোনো খেলনা (গাড়ি, বল) দেখান। তারপর হঠাৎ করেই শিশুর চোখের আড়ালে নিয়ে যান। এতে শিশুর কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কিনা তা খেয়াল করুন। খেলনা খুঁজতে আশেপাশে তাকাচ্ছে কিনা অথবা নিজেই খুঁজতে শুরু করে কিনা তা দেখুন।
শিশুকে এমন কোনো খেলা খেলতে দেয়া হয় যে খেলার একটি শেষ আছে। যেমন: পাজল মিলানো, লেগো দিয়ে গাড়ি/ ঘর তৈরি করা। শিশুটি সে সরল খেলাটি শেষ করতে পারছে কিনা তা দেখুন। পাশাপাশি আপনি শেষ বলার পর সে খেলা শেষ করল কিনা তাও খেয়াল করুন।
হাত-পুতুল ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর সামনে বিভিন্ন মজার অঙ্গভঙ্গি করতে পারেন এবং তাকে অনুকরণ করতে বলুন। আপনি নিজে মজার কোনো মৌখিক অভিব্যক্তি করেন এবং শিশুকে অনুকরণ করতে উৎসাহিত করুন।
শিশুকে দিয়ে শারিরীক অনুকরণের সাথে সাথে ধ্বনি অনুকরণের (ববব, মমম, আআআ) খেলা খেলুন। শব্দ করে এমন বিভিন্ন খেলনার সহায়তাও নেয়া হয়। এর মাধ্যমে শিশুর কণ্ঠস্বরের উপস্থিতি লক্ষ্য করুন।
উপরের খেলাগুলো মাধমে আপনি নিজেই আপনার শিশুর অটিজম আছে কিনা তা প্রাথমিকভাবে পরখ করতে পারেন। আপনার কাছে কোনো কিছু ব্যতিক্রম মনে হলে, দেরি না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। শিশু বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি যোগাযোগ করতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ; বিশেষায়িত স্কুল-প্রয়াস, সোয়াক, তরী ফাউন্ডেশন; সিআরপি, সাভার ও অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সাথেও। আমাদের বিশ্বাস, একদিন আপনার শিশু নিজেই লিখবে তার ‘নীল ভূত জয়ের গল্প’।

Next Post

ডায়ালাইসিস করে কিডনি রোগীরা ফিরে পেতে পারেন নতুন জীবন

কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেলে (প্রায় হারিয়ে গেলে) শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমে যায়। শরীর তখন বিষাক্ত হয়ে যায়। শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দিতে তখন ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। ডায়ালাইসিস করেও সুস্থ জীবনযাপন করা যায়। ডায়ালাইসিস নিয়ে কথা বলেছেন কিডনির চিকিৎসক রাজীব মণ্ডল। প্রশ্ন: এখন অনেক মানুষের মুখেই শোনা যায় ডায়ালাইসিস […]
রোগী দেখছেন চিকিৎসক রাজীব মণ্ডল