টাকা ধার দেবেন, নাকি নেবেন?

এক হাজার টাকার নোট

টাকা ধার দেবেন, নাকি নেবেন?


জীবনে টাকা ধার নেয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না, আবার জীবনে টাকা ধার দেয়নি এমন লোকও খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। অর্থাৎ টাকা ধার নেওয়া এবং দেওয়া সামাজিক জীবনযাপনেরই একটি অংশ। কিন্তু এক্ষেত্রে বিড়ম্বনা কিন্তু কম নয়। প্রথম বিড়ম্বনা হচ্ছে, টাকা ধার চাওয়া মানে এটা জানিয়ে দেওয়া যে আপনার টাকা নেই। আবার সামান্য টাকা ধার চাওয়ার অর্থ হচ্ছে, এই সামান্য কয়টি টাকাও এই মুহূর্তে আপনার কাছে নেই। বিষয়টিকে বাজার অর্থনীতির বর্তমান ব্যবস্থায় মানুষ ভয়াবহ দুর্বলতা হিসেবে দেখে। 

অর্থাৎ টাকা ধার চাওয়া ব্যক্তির জন্য বর্তমানে এক মারাত্মক  বিষয়। এরপরে ধার দাতার কাছে ছোটো হওয়া, কখনও অপমানিত হওয়া, শোধ করতে না পারা –এরকম অনেক ধরনের বিড়ম্বনার বিষয় আছে। আবার অনেকে আবার ধার নেয় অভ্যেসবশত, অনেকে ধার নিয়ে উল্টোপাল্টা খরচ করে, অনেকে প্রতারণা করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপদে পড়েই মানুষ টাকা ধার নেয়।

টাকা ধার যে কারণেই নিক, ধারদাতা কিন্তু এক্ষেত্রে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো। বিপদের সময় টাকা পাওয়াটাকে ধার গ্রহিতা খুব ইতিবাচকভাবে দেখে এবং কৃতজ্ঞ থাকে। অনেক সময় অনেকে আবার কিছুটা নেতিবাচক যে হয় না, তাও নয়, হয়ত কেউ ভাবতে পারে— “চাইলাম দশ হাজার টাকা, কিন্তু দিলো সে দুই হাজার টাকা।” আবার ধার দাতাও দায় ঠ্যাকা ভাব করে অনেক সময় কিছুটা দেয়, যদিও তা মোটেও প্রয়োজন সাপেক্ষ নয়। তখন ধার গ্রহিতাকে আরও কয়েকজনের কাছে ছুটে প্রয়োজনীয় টাকাটা সংগ্রহ করতে হয়। তারপরও যেকোনো প্রাপ্তিকেই অভিনন্দিত করা উচিৎ গ্রহীতার পক্ষ থেকে। 

দিনশেষে ধারদাতাই এগিয়ে থাকে, এমনকি টাকাটা ফেরৎ না পেলেও, কারণ, এক্ষেত্রে সে বেশ কিছু সামাজিক পুঁজি তৈরি করে। কৌশলে সে ধার দেওয়ার বিষটি একে ওকে বলে বেড়ায়, অন্তত কতিপয়কে তো বলেই– এভাবে কিছু সামাজিক পুঁজি সে টাকাটা ফেরৎ পাওয়ার আগেই সংগ্রহ করে ফেলে। এমন একটি ধারণা অবচেতনভাবে ধারদাতার মনে সবসময় থাকে যে টাকাটা সে ফেরৎ নাও পেতে পারে। আবার ফেরৎ পাবার ব্যাপারে নিশ্চিত হলেও সামাজিক পুঁজি লাভের এ সুযোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধারদাতা হাতছাড়া করে না।

একটি হাইপোথিসিসে যাওয়াই যায়– কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে টাকা যে হাতে রাখতে পেরেছে সে আসলে দিয়ে দিয়ে হাতে রাখতে পারেনি, অর্থাৎ সে একজিন সুস্থির এবং/অথবা অনেক কিছু এড়িয়ে যেতে সক্ষম মানুষ বলেই টাকা হাতে রাখতে পেরেছে। মানবিকতার প্রশ্নটি না হয় নাই তোলা গেলো। তবে এই হাইপোথিসিস সব ক্ষেত্রে খাটবে না, কারণ, গতিশীলভাবে এবং অনেকক্ষেত্রে অবৈধ উপায়ে উপার্জন করার সুযোগ যেহেতু রয়েছে।

কারও কষ্ট দেখলেই যে ঝাপিয়ে পড়ে তার কাছে টাকা গচ্ছিত হওয়া শক্ত, ফলে ধার সে দিতে পারবে না, এ কারণে প্রকাশ্যভাবে খুব ভালো মানুষ হওয়াও তার আর হবে না। এটা এক ধরনের প্যারাডক্স– নিঃশর্তে  দিচ্ছে যে দুঃস্থ জনে প্রতি মুহূর্তে তাকে মনে রাখবে না কেউ; কিন্তু যে ধার দিবে, বিশেষ করে ‘নিজ দলীয় বা বলয়ের সক্ষম কারও’ বিপদের সময় সামাজিকভাবে যে এগিয়ে আসবে তাকে প্রশংসায় ভাসাবে সবাই। এরা আবার আপনার মতো লোক চক্ষুর আড়ালে দূরের কোনো মানুষকে, একেবারে অচেনা কাউকে পাঁচ টাকাও দেয় না। আবার অনেকে বিবেকের দায় থেকে সাধ্যমতো সবাইকেই দেয়। অনেকে দিতে চায় কিন্তু নেই বলে দিতে পারে না।

টাকা ধার দেওয়ার মনস্তত্বের একটি অন্তর্নিহীত নেতিবাচক দিকে আসি এবার। সবাই যে শুধু উপকার করার জন্য টাকা ধার দেয় এমনটি নাও হতে পারে। এমন হওয়াটাও অসম্ভব নয়— কোনো কোনো কৌশলী মানুষের ক্ষেত্রে, যে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ করে রাখার জন্য সে অল্প অল্প করে অনেক মানুষকে ধার দিয়ে রাখে। গ্রামের প্রেক্ষাপট হলে এক লক্ষ টাকাই কিন্তু এক্ষেত্রে যথেষ্ট। ৫০০/১০০০/২০০০ করে দিলে অন্তত একশো জনকে দিয়ে রাখা সম্ভব। কেউ কারওটা জানবে না, সবাই দেখবে লোকটাকে সবাই সমীহ করে! বুদ্ধিমান হলে এই লোকটা কিন্তু বড়জোর ধার গ্রহীতাদের কাছে টাকা ফেরৎ চাওয়ার ভাণ করবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে ফেরৎ আশা করবে না। কারণ, ফেরৎ না পেলেই বরং এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে তার কোটি টাকার সামাজিক পুঁজি তৈরি হয়ে থাকছে সারাজীবনের জন্যে।

আর বোকারা যেটা করবে, সে যে এতজনকে টাকা ধার দিয়েছে এটা প্রকাশ্যে এনে সবাইকে বলে বেড়িয়ে ভাব নিতে যাবে, এতে ধার গ্রহীতারা যেমন অপমান বোধ করে তার শত্রু হবে, আবার অন্য মানুষেরা ব্যাপারটি পছন্দ করবে না, কারণ, অন্য কাউকে অপমান করা হলে, বা কারও বদনাম করা হলে এটি মানুষ তাৎক্ষণিক উপভোগ করলেও যে অপমান করে তাকে পছন্দ করে না দিনশেষে কেউই এবং সেটিই বরং বেশি সত্য এবং স্থায়ী। 

তাই সমস্যা টাকা ধার দেওয়ায় না, সমস্যা বেশি বরং টাকা ধার নেওয়ায়। ধার নিলে টাকাটা তো ফেরৎ দিতেই হয়, ইমেজ নষ্ট হয় আরও বেশি। ধরুণ, আমি কারও কাছ থেকে ৫০০০ টাকা ধার নিলাম, আমাদের দেশের মানুষের যে রকম দাঁড়িয়েছে, বা মানুষের যা রকম সত্যি তাতে সে ঢোল দিয়ে বেড়াবে নিরবে হলেও, যে অমুক আমার কাছ থেকে ৫০০০ টাকা নিয়েছে। বিভিন্নভাবে তার এই মহত্বের কথা সে প্রচার করবে।
এরপর টাকা দিতে দেরি হলে আরও প্রচার করবে, এবং এবার করবে আরও বেশি নেতিবাচকভাবে। এরপর টাকা চেয়ে না পাইলে বিভিন্ন পরামর্শ দেবে। বেশি অস্থির এবং সংকীর্ণ হলে ৫০০০ টাকার জন্য অপমানও করবে। এরপর যখন টাকাটা ফেরৎ দেওয়া হলো, তখন কী ঘটলো আসলে? টাকা তো পাঁচ হাজারই দেওয়া হলো, আর এতদিনে ইমেজ নষ্ট হয়েছে ধরতে হবে ৫ লক্ষ টাকার কমপক্ষে! তাহলে ফেরৎ দেওয়া টাকার অংকটা দাঁড়ালো এক লক্ষ পাঁচ হাজার টাকা!

আমি নিজে জীবনে কোনোদিন ফেরৎ পাওয়ার জন্য টাকা ধার দিই নাই কাউকে। আবার টাকা ধার দিয়ে ফেরৎ পাই নাই এমন ঘটনাও খুব কম। তার মানে বেশিরভাগ মানুষই টাকা ফেরৎ দেয়, হয়ত একটু দেরি হয়।
মানুষের আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি, তাই ফেরৎ দেবে না, এমন ঘটনা শতকরা একটির বেশি হবে না। আর আমরা সেই টাকাটাই ধার দিই সাধারণত যেটি আমাদের বেশি— অবশ্য এ যুগে বেশি বলে কিছু নাই। বলতে চাচ্ছি, আমাদের মৌলিক চাহিদার অতিরিক্ত টাকাটাই আমরা ধার দিই, তাই এই টাকাটা কেউ দিতে দেরি করলে বা না দিতে পারলে সহ্য করা উচিৎ।
আর এমন যদি হয় টাকাটা ফেরৎ দিতে পারছে না বলে আমি ‘নৌকা বাইচ’ করতে পারছি না, তাহলে তো কথাই নেই; এরকম মানসিকতার হলে তার টাকা ধার না দেওয়াই ভালো।

আপনি যখন দৃশ্যমানভাবে প্রচুর খরচ করবেন, বিলাসিতা করবেন, দরিদ্র দেশের মানুষের নীরবে আপনার প্রতি কিছু দাবী তৈরি হয়ে যায়, সেই দাবীটা মেটাবেন আশা করে অনেকে ধার নিয়ে ফেরৎ দেবার প্রযোজন বোধই করে না আর।
এজন্য দেখবেন প্রচুর মানুষ আছে যারা প্রকাশ্যে খুবই দীনহীন, কিন্তু গোপনে তাদের ভোগ বিলাসিতার পাহাড়, নিম্ন মানের এ জাতীয় লোক আবার মুক্ত থাকে সামাজিক দায়ব্ধতা এবং সকল ঝামেলা থেকে। মনটা খুব ছোটো বলে তারা এভাবে চলতে পারে, পৃথিবীর সাথে এদের সম্পর্কটা খুবই এক পাক্ষিক এবং তলিয়ে থাকা একটি নর্দমা দিয়ে বহমান। সে তুলনায় আপনি অনেক ভালো এবং অকপট, যা করেন প্রকাশ্যেই করছেন। 

আবার অনেক লোক আছে, যারা প্রকাশ্যে পরিপাটি, কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে ভেতরটা একেবারে সদরঘাট– এদের কাছেও মানুষ ভুল বুঝে দাবিদাওয়া করে; নিজে কষ্ট করে হলেও সেসব দাবি দাওয়া এ প্রকৃতির মানুষেরা সাধ্য মতো মিটিয়ে থাকে। এরা যথাসম্ভব চেষ্টা করে যায় নিজের আর্থিক সমস্যা কাউকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য, যদিও শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হয় না। সমাজ অবশেষে এ প্রকার মানুষদেরও পদানত করে ফেলে।

আপনি যখন মৌলিক চাহিদার অতিরিক্ত অনেক ধরনের ব্যয় করবেন, এবং একইসাথে আপনার কোনো ধরনের সামাজিক কর্ম কাণ্ড থাকবে না, তখন একটি দরিদ্র দেশের মানুষ আপনাকে যুক্তিসঙ্গতভাবেই টার্গেট করে ফেলতে পারে, কৌশলে ধারটার চেয়েও টার্গেট করতে পারে, চুরি ডাকাতিও চলতে পারে আপনার ওপর একসময়।

আপনি যখন সামাজিক দায়িত্ব নেবেন না, কিন্তু স্পষ্টতই আপনার সে সুযোগ আছে বলে মানুষ দেখতে পাবে, মানুষ দেখবে যে আপনি ভোগ বিলাসিতায় মেতে রয়েছেন, তখন নীরবে হলেও মানুষ আপনার ওপর ক্ষিপ্ত হবে, আপনার সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। বাড়ির চারপাশে শক্ত প্রাচীর তুলে নিরাপত্তা বাড়ানো যায় না, নিরাপত্তা বাড়াতে হয় সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে, মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে।

যদিও আজকাল এ ধরনের  মানুষ খরচের পর খরচ করে চলেছে নিজের রাজপ্রাসাদ বানাতে, ব্যুহ রচনা করতে, উড়াল দিতে ইচ্ছেমতো, কিনতে, ভাড়া করতে। কিন্তু টেকসই হয় কি এভাবে এ জীবন অবশেষে, নাকি নিভৃতে কোনো গ্লানিও জমা হতে থাকে প্রতিটি মুহূর্তে? 

তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় মনে রাখতে হবে– অনেকক্ষেত্রেই মানুষ টাকা ধার দেয় নিজের খরচের টাকা থেকে, সেক্ষেত্রে সময় মতো টাকা না দিলে সে বিপদে পড়ে যায়। আবার যখন বলা হয়— “এই তো অমুক দিন দিচ্ছি” তখন সে আস্থা রেখে বিপদে পড়ে যেতে পারে। তাই দেনাপাওনার বিষয়টি হওয়া উচিৎ সুস্পষ্ট এবং দায়িত্বশীল।

নির্দিষ্ট তারিখে টাকা ফেরৎ দিতে না পারলে জবাবদিহিতা থাকা উচিৎ, এবং কখনই মিথ্যা কথা বলে টাকা ধার নেওয়া উচিৎ নয়, তার চেয়ে বিপদের বিষয়টা খোলাসা করা ভালো। বিপদে পড়লে কেউ না কেউ আপনাকে সহযোগিতা করবেই, সংক্ষেপে সেটি অর্জন করতে মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়াই ভালো। বরং বলুন, হয়ত টাকাটা আমি আর ফেরৎ দিতেই পারব না, এভাবে আপনি পেয়ে যেতে পারেন একজন খাটি মানুষ বিপদের দিনে। তাহলে উল্টোটা কেন করবেন? 


দিব্যেন্দু দ্বীপ