বিখ্যাত যেসব গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছে

বই মানুষের চিন্তা প্রকাশের প্রধানতম মাধ্যম। কিন্তু কবে থেকে মানুষের চিন্তা প্রকাশের এই মাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলো –এ প্রশ্নের উত্তর পেতে তাকাতে হবে সেই প্রাচীন গ্রিসের দিকে। সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ব্লাসফেমির অভিযোগে। সম্ভবত এই ঘটনার মাধ্যমেই মুক্তচিন্তায় লাগাম পরানো শুরু হয়।

৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক ও লাতিনদের জন্য ‘বাইবেল’ নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে সম্রাট জাস্টানিয়ান বই নিষিদ্ধকরণ নীতির প্রবর্তন শুরু করেন। সম্ভবত ওটাই ছিল বইয়ের ওপর প্রথম রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ। ১২৪৪ সালে ইহুদিদের ধর্মীয় শিক্ষমূলক বই ‘তালমুদ’ পোড়ানোর মাধ্যমে খ্রিস্টানরাই প্রথম বই পোড়ানো শুরু করে।

মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগকে শিল্প-সাহিত্য তথ্য মুক্তচিন্তার স্বর্ণযুগ হিসেবে ভাবা হলেও এ সময়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, এ সময়ই বারবার মুক্তচিন্তার ওপর আক্রমণ নেমে এসেছে। শিল্প-সংস্কৃতির তীর্থস্থান বলে বিশ্বে পরিচিতি আছে ফ্রান্সের। সেই ফ্রান্সেই বই নিষিদ্ধ হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

১৫৩৫ সালে রাজা প্রথম ফ্রান্সিস ক্ষমতায় এসেই বই প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি ডিক্রি জারি করেছিলেন তার স্বাক্ষর ছাড়া কোনো বই প্রকাশিত হতে পারবে না। তারপর থেকে বহুবার রাজদ নেমে এসেছে বই প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর। নিষিদ্ধের আগুনে পুড়েছে বিশ্বসাহিত্যের অমর অনেক সৃষ্টি। পোড়ানো হয়েছে দান্তের ‘ডি মনার্কিয়া’। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ‘ডিভাইনা কমেডিয়া’র মতো বিখ্যাত ধ্রুপদী সাহিত্য। নিষিদ্ধ হয়েছে রুশোর বই।

আধুনিককালের সব থেকে প্রভাবশালী ও অস্তিত্ববাদী ফরাসি চিন্তাবিদ জ্যাঁ পল সাত্রেঁকে কমিউনিস্টপ্রীতির জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। রাজরোষে পড়ে নিষিদ্ধ হন বালজাক ও এমিল জোলার মতো লেখকরা। ১৮৫০ সালে জার প্রথম নিকোলাস নিষিদ্ধ করেন ভিক্টর হুগোর সমুদয় রচনা।

আধুনিক ফ্রান্সের সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি বোদলেয়ারও নিষিদ্ধ আওতার বাইরে যেতে পারেননি। ‘লে ফ্লর দ্য মল’ প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল; নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তার বই। এলিজাবেথিয়ান সময়ে ছিল ইংরেজি সাহিত্যের নাটকের সুবর্ণ সময় কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না তারাও শেক্সপিয়ারের নাটকে ছুরি চালিয়েছিল।

রানী এলিজাবেথের পরামর্শে ‘দ্য ট্র্যাজেডি অব কিং রিচার্ড দ্য সেকেন্ড’ নাটকের একটি দৃশ্য কেটে দেওয়া হয়েছিল। যে রোমান্টিক কবিকে নিয়ে ইংরেজদের গর্বের শেষ নেই সেই শেলিকেও ‘দ্য নেসেসিটি অব এথিসম’ বইটির জন্য আধুনিক জ্ঞানের পীঠস্থান অক্সফোর্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। নিরীশ্বরবাদের অভিযোগে এ বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় যুগান্তর এসেছে। মানুষ ক্রমশ নিজেকে অধিকতর সভ্য দাবি করছে। তবু বই নিষিদ্ধ হওয়া কমেনি, থামেনি। ১৯২৯ সালে চীন সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছিল কাল মার্কসের ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ ও ‘দাস ক্যাপিটাল’ যেন পাঠকের কাছে পেঁৗছতে না পারে।

আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ বইটিও নিষিদ্ধ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় মুক্তবুদ্ধি চর্চার আদর্শ স্থান। ১৯৭১ সালে মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে বার্তা দেয় মত প্রকাশের ক্ষেত্রে তারাই এগিয়ে, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অন্য দৃশ্য।

মার্ক টোয়েন রচিত ‘হাকলবেরি ফিন’ গ্রন্থটি যুক্তরাষ্টের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয় উইলিয়াম ফকনারের ‘অ্যাজ আই লে ডাইনিং’ বইটি। জেমস জয়েসের বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘ইউলিসিস’ ১৯১৮ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ছিল। দীর্ঘ ১২ বছর নিষিদ্ধ থাকার পর ১৯৩৩ সালে আইনি লড়াইয়ের পর ‘ইউলিসিস’ যুক্তরাষ্ট্রে বই আকারে প্রকাশের অনুমতি পায়।

ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের বিখ্যাত বই ‘কাঁদিদ’-এর একটি চালান ১৯৩০ সালে আটক করে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বিভাগ। তাদের মতে কাঁদিদ অশ্লীল বই। গ্রন্থগুলো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আনা হচ্ছিল। পরবর্তীতে ‘কাঁদিদ’ বইটির কিছু পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে বইগুলো ছাড়ে তারা।

১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করে। এর তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৭ সালে বিখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ বইটি বাজেয়াপ্ত করে সানফ্রান্সিসকোর শুল্ক বিভাগ। আরেক বিখ্যাত লেখক ড্যানিয়েল ডিফো রচিত ‘মল ফ্ল্যান্ডার্স’ ও জন ক্লেল্যান্ড রচিত ‘ফ্যানি হিল’ বহু দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ছিল।

১৯৬৬ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গ্রন্থ দুটি নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বই নিষিদ্ধ হওয়ার সংস্কৃতি প্রচলন ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। বিখ্যাত মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের কাব্যগ্রন্থ ‘লিভস অব গ্রাস’ যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়। এই কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতার জন্য সরকারি আইনজীবী কবির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন।

১৯৩৫ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশোর সব দার্শনিক রচনা নিষিদ্ধ করা হয়। জার্মান লেখক কাফকার সব লেখাই নিষিদ্ধ করে হিটলারের নাৎসি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। এমনকি চেক ভাষায় লিখতে অস্বীকৃতি জানানোয় চেকোস্লোভাকিয়াতেও তার বই নিষিদ্ধ করা হয়।

এবার আলোচনা করা যাক কিছু নিষিদ্ধ তালিকায় থাকা সাড়া জাগানো এবং বিপজ্জনক বই প্রসঙ্গে। এসব বই এক দিকে যেমন বিতর্কিত তেমনি জনপ্রিয়। এসব বইয়ের কারণে দাঙ্গা ও মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

লেডি চ্যার্টলিজ লাভার: ডেভিড হারবার্ট লরেন্সকে বলা হয় একবিংশ শতকের অন্যতম সৃষ্টিশীল ঔপন্যাসিক, দার্শনিক ও বিশুদ্ধ লেখক। অথচ তাকে পড়তে হয়েছে একের পর এক সরকারি হয়রানি ও সেন্সরশিপের বেড়াজালে। অজস্র ভুল ব্যাখ্যায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। অশ্লীলতার দায়ে তাকে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল বিকৃত পর্নোগ্রাফি লেখকদের দলে।

মাত্র ৪৪ বছর বয়সে লরেন্স বিশ্বসাহিত্যের অকপট ও অতিসংবেদনশীল নগ্ন বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন সহজাত প্রতিভায়। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত দ্য রেইনবো উপন্যাসে অশ্লীলতার দায়ে তার বিরুদ্ধে প্রথম তদন্ত শুরু হয় এবং সে বছরই বইটি নিষিদ্ধ হয়। মৃত্যুর দুই বছর আগে লেখেন বিশ্বজুড়ে ঝড় তোলা উপন্যাস ‘লেডি চ্যার্টালিজ লাভার’।

জন্মভূমি ইংল্যান্ডে উপন্যাসটি প্রথম থেকেই অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ হয়। তার মৃত্যুর ৩০ বছর পর ১৯৬০ সালে এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ওই একদিনে ব্রিটেনে বইটির ২ লাখ কপি বিক্রি হয়।

দ্য স্যাটানিক ভার্সেস: ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় সালমান রুশদির উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। এরপরই মুসলিম বিশ্ব ঝড় ওঠে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে এক বছর পরই বইটি নিষিদ্ধ হয়। সম্ভবত এই বইটি বিশ্বসাহিত্যে সবচেয়ে রোষের মুখে পড়া বই। স্যাটানিক ভার্সেস লেখার অপরাধে ১৯৮৯ সালে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড জারি করে ফতোয়া দেন।

সেই সময় থেকেই রুশদি ভারতে আসতে পারেননি। তখন মুসলিমদের বিক্ষোভ ও দাঙ্গার পর ভারতে তার উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করা হয়। এ বইটির জন্য অনেকে হত্যা ও হামলার শিকারও হয়েছেন। হিতোশি ইগারাশি –যিনি স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন তাকে ছুরিকাঘাতে মেরে ফেলা হয় ১৯৯১ সালে।

ইতালির অনুবাদক ইতোরে ক্যাপ্রিওলোকে একই মাসে ছুরিকাঘাত করা হয়, যদিও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। নরওয়ের প্রকাশক উইলিয়াম নাইগার্ড অল্পের জন্য বেঁচে যান আততায়ীর গুলি থেকে।

ট্রপিক অব ক্যান্সার, ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্ন, সেক্সাস, প্লেক্সাস, নেক্সাস ইত্যাদি বহুল আলোচিত ও একই সঙ্গে বহু বিতর্কিত গ্রন্থের রচয়িতা হেনরি মিলারের পরিচয় ওয়াকিবহাল পাঠকের কাছে অজ্ঞাত নয়। ট্রপিক অব ক্যান্সার মার্কিন ঔপন্যাসিক হেনরি মিলার রচিত একটি উপন্যাস যা আদিতে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হলেও বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে একটি মার্কিন ধ্রুপদী সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

এতে মানুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা এবং যৌনকর্মের দ্বিধাহীন বর্ণনা থাকায় প্রকাশের পর সমালোচনার ঝড় উঠেছিল এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৭ বছর নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৬১ সালে বইটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৬৪ সালে উপন্যাসটিকে অশ্লীলতার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়।

স্লটার হাউস-ফাইভ: বরেণ্য মার্কিন ঔপন্যাসিক কুর্ট ভনেগাটসের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত এ উপন্যাসে আপত্তিকর ভাষা ব্যবহারে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

আমেরিকান সাইকো: ব্রেট এস্টন এলিসের বিখ্যাত উপন্যাস আমেরিকান সাইকো। সেক্স, ভায়োলেন্স আর সাইকোপ্যাথির মিশেলে একটা অন্য রকম উপন্যাস। নায়ক প্যাট্রিক ২৭ বছর বয়সী বেইটম্যান জব করে ওয়ালস্ট্রিট কোম্পানিতে। একে একে সে খুন করে কলিগ থেকে শুরু করে বান্ধবী পর্যন্ত। এক্কেবারে ভয়ঙ্কর মানসিক বিকারগ্রস্ত একজন সিরিয়াল কিলার বনে যায় প্যাট্রিক।

১৯৯১ সালে এটি সাইমন অ্যান্ড স্কাসটার প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু এরপরই বইটি প্রকাশে অস্বীকৃতি জানায় সংস্থাটি। এরপর এটির স্বত্ব কিনে নেয় ভ্যানিটেজ বুক। কিন্তু ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত বইটি যুুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল। এরপর নিষেধাজ্ঞ তুলে নিলেও শর্ত হিসেবে দাঁড় করানো হয়– ১৮ বছরের কম বয়সি কারও কাছে এটি বিক্রি করা যাবে না। ২০০০ সালে বইটি অবলম্বনে একটি মুভি নির্মিত হয়।

ললিতা: এটি ভ্লাদিমির নবোকভের লেখা একটি উপন্যাস। প্রথমে লেখক ইংরেজি ভাষায় উপন্যাসটি রচনা করেন, ১৯৫৫ সালে প্যারিসে এবং ১৯৫৮ সালে নিউইয়র্কে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সালেই বইটি ফ্রান্সে নিষিদ্ধ হয়। অভিযোগ ছিল অশ্লীলতা। একজন বিবাহিত মধ্যবয়স্ক পুরুষের সঙ্গে একটি ১২ বছর বয়সী বালিকার যৌন সংসর্গের ঘটনা হলো এই উপন্যাসটির মুখ্য উপাদান। ললিতাকে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাসও বলে থাকেন কেউ কেউ।


মাহফুজ রাহমান