প্রাণতোষ তালুকদার, ঢাকা
আজ থেকে ঢাকার রামসীতা মন্দিরসহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাংলার ঐতিহ্যবাহী যথযাত্রা উৎসব শুরু হয়েছে। রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন মন্দিরে কীর্ত্তন, পূজা অর্চনা, যজ্ঞসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালিত হচ্ছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের ঢল রথপ্রাঙ্গণ উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও রামসীতা মন্দিরে রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। বিকাল ৪টায় রামসীতা মন্দিরের সভাপতি শ্রীযুক্ত বাবু গণেশ ঘোষ রথযাত্রা উদ্বোধন করেন।
প্রতি বৎসর সনাতন ধর্মীয় রথযাত্রা উৎসবে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দের সমাবেশ ঘটে। সকল ধর্ম বর্ণ শ্রেণি পেশার মানুষ এ আনন্দ আয়োজনে অংশগ্রহণ করে থাকে। সনাতন ধর্মের পুরাণ থেকে জানা যায়, রথ যাত্রার ইতিকথা। স্কন্দ পুরাণ থেকে জানা যায় ইন্দ্রদ্যন্ন নামে এক রাজা ছিলেন উতকল রাজ্যে (বর্তমান উড়িষ্যা) তিনি ছিলেন পরম ভক্ত। তিনি একদিন স্বপ্নাদিষ্ট হন একটি মন্দির নির্মাণের জন্যে। পরে দেবর্ষী নারদ এসে জানান স্বয়ং ব্রহ্মার ও তাই ইচ্ছা, তিনি নিজের সেটা উদ্বোধন করবেন। এভাবে কাজ হল এবং নারদ বললেন ব্রহ্মাকে আপনি নিমন্ত্রণ করুন। পরে রাজা ব্রহ্মলোকে গেলেন এবং নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু ব্রহ্ম লোকের সময় এর সাথে তো পৃথিবীর মিল নাই। পৃথিবীতে কয়েক শত বছর পার হয়ে গেছে। ফিরে এসে রাজা দেখলেন তাকে কেউ চেনে না। যা হোক তিনি আবার সব করলেন। দৈবভাবে রাজা জানতে পারলে সমুদ্র সৈকতে একটি নিম কাঠ ভেসে আসবে; সেটা দিয়েই হবে তৈরি দেব বিগ্রহ। পরের দিন পাওয়া গেল সেই নিম কাঠের গুল বা দারুব্রহ্ম। সেটাকে নিয়ে আসা হল প্রাসাদে। কিভাবে মূর্তি তৈরি হবে, এই চিন্তু হচ্ছে যখন, তখন একজন অজ্ঞাত পরিচয় লোক এসে বললেন যে তার নাম বাসুদেব মহারানা তিনি বিগ্রহ তৈরি করবেন। কিন্তু নিভৃতে তৈরি করবেন; তৈরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে বিরক্ত করা যাবে না মন্দিরে যাওয়াও যাবে না।
এদিকে মূর্তি তৈরি শুরুর কিছু দিন পর রাজা কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে মন্দিরে যান এবং দেখেন কেউ নেই ভিতরে আর আমরা যেরূপে এখন জগন্নাথ দেবকে দেখি সেই মূর্তিটি পড়ে রয়েছে। পরে ঐ ভাবেই স্থাপিত হয় মূর্তি। ইন্দ্রদুন্ন রাজা জগন্নাথ দেবের মূর্তিতিই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ এবং জগন্নাথ দেব একই সত্ত্বা চিন্তা করে একই আদলে তার পাশে তাই বলরাম এবং আদরের বোন সুভদ্রার মূর্তি স্থাপন করা হয়। আমাদের এখানে এক রথ যাত্রা হলেও পুরীতে তিনটি রথে হয় রথযাত্রা উৎসব। প্রথমে বলরাম, তারপর সুভদ্র এবং শেষে জগন্নাথ। ১১৯৯ খ্রীষ্টাব্দে রাজা অনঙ্গভীমদেব তিনি রথের রথযাত্রা প্রচলন করেন।
জগন্নাথ দেবের মূর্তির রূপ নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন আছে। কেন এই রূপ তার। এখন তারই কিছু বিশ্লেষণ দেখা যাক। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে না আত্মানং রখিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেবতু।
এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। আর ঈশ্বর থাকেন অন্তরে। রথযাত্রার রূপক কিন্তু এমনই। যাহোক সৃষ্টিকর্তা আমাদের অন্তরে থাকেন। তার কোন রূপ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজিত অর্থাৎ ঈশাব্যাসমিদং। বেদ বলছে, আবাঙমানষগোচর, মানে মানুষের বাক্য এবং মনের অতীত। আমরা মানুষ তাই তাকে মানব ভাবে সাজাই। এ বিষয়ে কৃষ্ণ যজুর্বেদিয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে- অপাণিপাদ্যে জাবানো গ্রহীতা পশ্যতাচক্ষুঃ স শৃণ্যেত্যকর্নঃ। স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম। অনুবাদ ঃ তার লৌকিক হস্ত নাই, অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তার পদ নাই অথচ সর্বত্রই চলেন। তার চোখ নাই অথচ সবই দেখেন। কান নাই কিন্তু সবই শোনেন। তাকে জানা কঠিন; তিনি জগতের আদিপুরুষ। এই বামনদেবই বিশ্মাত্মা, তার রূপ নেই, আকার নেই। উপনিষদের এই বর্ণনার প্রতিকী রূপই হল পুরীর জগন্নাথদেব।
তার পুরো বিগ্রহ তৈরি সম্ভব হয়নি, কারণ তার রূপ তৈরিতে আমরা অক্ষম। শুধু প্রতিককে দেখান হয়েছে মাত্র। তাছাড়াও আর একটি পৌরানিক কাহিনী আছে সেটা হল ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২ বছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করেন; তারপর তিনি আর বৃন্দাবনে আসেননি। কিন্তু একবার রথে করে পাশ্ববর্তী গ্রামে এসেছিলেন বৃন্দাবনবাসিদের সাথে দেখা করতেন। বৃন্দাবনবাসীরা শ্রীকৃষ্ণকে প্রাণাধিক ভালোবাসত; তাই তার বিরহে তার প্রিয়জনদের অবস্থা দেখে কিছুক্ষণের জন্যে কৃষ্ণ-বলরাম সুভদ্রা তিনজন নির্বাক হয়ে যান এই ভালোবাসা দেখে। তখন তাদের অমূর্ত রূপ ফুটে ওঠে। এই রূপই বর্তমান জগন্নাথ দেবের রূপ।
রথযাত্রা এবং সামাজিক ঐক্য ঃ পুরীকে পুরুষত্তোম ক্ষেত্র বলা হয়। এখানকার রথ যাত্রায় দিন কোন ভেদাভেদ থাকে না। ধনী, দরিদ্র, উঁচু, নিচু, সৃষ্প, অসৃষ্প সবাই এক কাতারে ভগবানকে নিয়ে রাজপথে নামে। আর আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভগবান সবার এবং সবাইকে একত্রিত হতে। কারণ ভগবান সকলের; ভগবানে সবার সমান অধিকার।
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু সবাইকে নিয়ে কীর্তন করতে রথযাত্রায় অংশ নিতেন। তাছাড়া প্রভাষখন্ড থেকে জানা যায় যে পুরীতে অভক্তু থেকে বিগ্রহ দর্শন করা যাবে না। আগে প্রসাদ খেতে হবে পরে দেব বিগ্রহ দর্শন। এখনও এ নিয়ম চলে আসছে। পুরীকে শঙ্খক্ষেত্রও বলা হয় কারণ মানচিত্রে এক শঙ্খের মত দেখতে লাগে। প্রতিবছরের আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে রথযাত্রা উৎসব পালন করেন হিন্দুধর্মালম্বিগণ।
আরও জানা গেল যে হিন্দুদের পুরাণ অনুযায়ী কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রাঙ্গণ থেকে শ্রীকৃষ্ণকে রথে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই প্রথম শুরু হয়েছিল রথযাত্রা। শুধু বাংলাদেশে নয়। সারা বিশ্বের প্রায় ১০০টি শহরে পালিত হয় রথযাত্রা। প্রতি বছর রথযাত্রায় পুরীতে তৈরি করা হয় তিনটি নতুন কাঠের রথ। দুই মাস ধরে তৈরি হয় ৪৫ ফুট উঁচু, ৩৫ বর্গফুটের একেকটি রথ। রথ ঢাকতে লাগে ১২০০ মিটার কাপড়। ১৪Ñ১৫ জন দর্জি সেলাই করেন সেই কাপড়।
উল্টোরথের দিন ফেরার পথে মাসিমা মন্দিরে দাঁড়ায় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার রথ। যেখানে তাদের দেওয়া হয় পোড়া পিঠা। পরে সেই পোড়া পিঠে প্রসাদ হিসেবে বিলি করা হয় ভক্তদের মধ্যে।
রথের রশিতে টান দিলেই হবে পূণ্যলাভ এটি হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস চিরকাল থেকেই চলছে হিন্দুদের মনে। জগন্নাথদেবের রথের রশি একটিবার স্পর্শ করার জন্য আকুল হয়ে পড়েন ভক্তরা। রথের রশি ধরার জন্য মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। হিন্দুদের বিশ্বাস জগন্নাথদেবের রথের রশি স্পর্শ করলে পুনর্জন্মের কষ্ট সহ্য করতে হয় না।
শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম প্রিয় শিষ্য সনাতন গোস্বামী অসুস্থতার কারণে একবার রথযাত্রার দিন জগন্নাথদেবের চলন্ত চাকার তলে প্রাণ বিসর্জন দিতে চেয়েছিলেন। তখন মহাপ্রভুই তাঁকে বলেন সনাতন! এ রকম দেহত্যাগে যদি কৃষ্ণকে পাওয়া যেত তাহলে এক মুহূর্তের মধ্যে আমিও আমার লক্ষ জন্ম তাঁর শ্রীচরণে সমর্পণ করতাম। কিন্তু দেহত্যাগে কৃষ্ণকে পাওয়া যায় না। এরকম দেহত্যাগ হচ্ছে তমোগুণ। তমোগুণে কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে না। ভক্তি ছাড়া, ভজন ছাড়া তাঁকে পাওয়ার উপায় নেই।
ইন্দ্রনীলময় পুরাণের মতে, জগন্নাথের রথের রশি সামান্য স্পর্শ করলেও পুনর্জন্ম হয় না। ‘পুনর্জন্ম না ভূঞতে’! শ্রীজগন্নাথের বামন অবতার রথে। সেই রথ দর্শন করার পর একটু টানতে পারলেই পুনর্জন্মের কষ্ট ভোগ করতে হয় না।
সূতসংহিতায় রয়েছে- রথে তু বামনাং দৃষ্টা, পুনর্জন্ম ন বিদতে। অতএব, ধার্মিক হিন্দু বিশ্বাস করেন যে, রথের রশি ছোঁয়ার থেকে বড় পূণ্য আর কিছুতে হয় না।
রথযাত্রার এই মহাযাত্রা নিয়ে কপিল সংহিতায় আছে- গুন্ডিচাখ্যং মহাযাত্রা যে পশ্যন্তি মুদনিতাঃ/সর্বপাপ বিনির্মুক্তা তে যান্তি ভুবন মম। অর্থাৎ, জগন্নাথদেব বলেছেন- গুন্ডিচা মহাযাত্রায় যে ব্যক্তি আমাকে দর্শন করবে সে কালক্রমে সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে আমার ভুবনে যাবে।
রথের রশি ধরে রথ টাকা শুধু নয়, বেশির ভাগ মানুষ রথের রশি যতটুকু পারে ছিঁড়েও নেন। টুকরো টুকরো রথের রশির সুতো মাদুলি ক’রে ছোট ছেলে-মেয়েদের হাতে ও গলায় পরিয়ে দেন। বড়রাও পরেন। হিন্দু ধর্মালম্বিদের বিশ্বাস এই মাদুলি সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাবে। অসুখ-বিসুখ হলেও তাড়াতাড়ি আরোগ্য লাভ করবে। অনেকেই রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন; ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে ওঠে। এ রকম কারও মাথায় রশির টুকরো অংশ ছুঁইয়ে দিলে কিংবা তার বালিশের নীচে রেখে ঘুমোলে দুঃস্বপ্ন আসে না।
স্কন্দপুরাণ, বামদেব সংহিতার প্রসঙ্গ টেনে বলা যায় যে, জগন্নাথদেবের রথের দড়ি ধরে টান পারলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। আসলে হিন্দু ধর্মালম্বিদের বিশ্বাস; বিশ্বাসটাই বড় কথা।