আষাঢ় মাসের মাঝ দুপুর। মধ্যরাত থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরছে। সকালে একবার সূর্যিমামা মেঘের ফাঁকে উঁকি মেরে আবার কোথায় যেন লুকিয়ে গেছে। কখনও টিপ টিপ কখনও মুশলধারে বৃষ্টি ঝরছে। মেঘের ভারে অবনত আকাশ। গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে মেঘের পাল। চারপাশটা অদ্ভুত ভাবে আঁধার হয়ে আসছে। মাঝ দুপুরটাকেও মনে হচ্ছে যেন সাঁঝবেলা। ঝুম বৃষ্টিতে উঠোন জুড়ে কাদা জলের মাখামাখি। বৃষ্টির দিনে চ্যাপচ্যাপে কাদাজল মাড়িয়ে এঘর-ওঘর ছোটাছুটি করে কাক ভেজা হয়ে রান্না করতে হতো আম্মাকে। ঐদিনও তাই করতে হয়েছিল। আম্মার পরনের শাড়ীটা আধ ভেজা। তিনি রান্না ঘরে বেশ বড় একটা পাতিলে ভাত বসিয়ে দিয়ে সবজি কুটতে বসেছেন। সবজি কুটার পাশাপাশি মাটির চুলায় লাকড়ি ঠেলতে হচ্ছে আম্মাকে। আমাদের ছিল বারো/চৌদ্দ জনের যৌথ পরিবার, তার ওপর সব সময় দুএকজন মেহমান তো থাকতই । চাচারা কেউ তখন বিয়ে করেননি। দাদুও বাড়িতে নেই। আম্মাকে আজ একা হাতেই অনেক সবজি কুটতে হবে, আম্মা খুব দ্রুত হাত চালাচ্ছেন। আমি আর আমার ছোট ভাই মোস্তফা মিলে আম্মার চারপাশটা ঘিরে ছোটাছুটি করছি। ছুটতে ছুটতে কখনও বটির কাছে চলে যাচ্ছি, আম্মা একহাতে আমাদের সরাচ্ছেন আরেক হাতে বটি সামলাচ্ছেন।
আমরা দুজন বটির উপর যেন পড়ে না যাই সেদিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে আম্মার কাজ একদমই এগুচ্ছে না। সময় অপচয় হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দুভাই বোনের সে বোধবুদ্ধি কি আর তখন ছিল!
আমাদের দুষ্টুমিতে আম্মা অতিষ্ট, ছোটাছুটি ছেড়ে এবার অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমরা, বার বার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত পেতে বৃষ্টির জল ধরে দুজন দুজনের গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছি। মোস্তফা কিছুক্ষণ পর পর বৃষ্টির জলে পা বাড়িয়ে দিয়ে পা ভিজাচ্ছে। দুদিন হলো মোস্তফা জ্বর থেকে উঠেছে— ওকে নিয়ে আম্মার চিন্তার শেষ নেই, বৃষ্টিতে ভিজলে যদি জ্বরটা আবার ফিরে আসে তাহলে আর রক্ষে নেই। আম্মা অনেক বার নিষেধ করার পরও আম্মার কথা কানে তুলছি না আমরা। আমরা আমাদের মতো দুষ্টুমি করেই যাচ্ছি। এক সময় আম্মা বিরক্ত হয়ে জোরে ধমক দিলেন। আম্মার ধমক শুনে মোস্তফার সে কি কান্না। তখন আম্মা আরো রেগে গেলেন, বিড় বিড় করে বললেন, যা দুষ্ট হয়েছিস তোরা আজকাল একদমই কথা শুনিস না। মোস্তফাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিয়ে আম্মা বললেন, ওঘরে চল, তোদেরকে তোর আব্বার কাছে দিয়ে আসি। ওখানে গিয়ে যতো পারিস দুষ্টুমি করিস। আমাকে একটু শান্তিতে রান্নাটা শেষ করতে দে।
কিন্তু মোস্তফা জেদ করছে আব্বার কাছে যাবে না, রান্না ঘরে আম্মার কাছেই থাকবে। আব্বার আজ অফিস নেই বাহিরে বের হতে চেয়েও বের হতে পারেননি। বৃষ্টির জন্য বাড়িতেই আটকা পড়ে গেছেন। আব্বা সব সময় খুব ব্যস্ত সময় কাটাতেন। সরকারি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করতেন। তাই আব্বাকে আমরা খুব একটা কাছে পেতাম না। সেই সকাল বেলা বেরিয়ে যেতেন ফিরতেন রাত নয়টা দশটার পর। গ্রামের বিদ্যুৎহীন রাত, দশটা মানে অনেক রাত। আর আমরা দুভাই বোন ছিলাম অনেকটা ঘুম কাতুরে, সন্ধ্যার পর দাদার কাছে কিছুক্ষণ পড়তাম, পড়া শেষ হতে না হতেই নিদ্রাদেবী অপেক্ষারত থাকতেন চোখের কোণে। আব্বা বাড়ি ফিরে দেখতেন আমরা গভীর নিদ্রায়। আব্বা যেদিন খুব সকালে বেরিয়ে রাতে বাড়ি ফিরতেন সেদিন আমাদের দুই ভাই বোনের আর আব্বার মুখটা দেখা হত না। চাকরি, ব্যবসা, সংসার —এসবের দায়-দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে আমাদের চোখে আব্বা কখন যেন হয়ে ওঠেন অন্য জগতের একজন। খুব ব্যস্ত আর গম্ভীর একজন মানুষ। আমাদের সাথে দুদণ্ড কথা বলারও যেন ফুসরত ছিল না আব্বার। এভাবেই আস্তে আস্তে আব্বা আর আমাদের মাঝে এক সুক্ষ্ম দূরত্বের সৃষ্টি হয়। অদ্ভুতভাবে আব্বার সঙ্গ আমাদের কাছে অচেনা লাগতে শুরু করল। কেমন যেন ভয় পেতাম আব্বাকে। আব্বাকে খুব কঠিন মনের একজন মানুষ ভাবতাম। মোস্তফাকে জোর করলেও আব্বার কাছে যেতে চাইত না। আমিও আব্বার কাছে যেতাম না, দূরে দূরে থাকতাম।
আব্বা শুয়ে আছেন, কানের কাছে রেডিও বাজছে। সম্ভবত রেডিওতে খবর শুনছিলেন। আম্মা আমাদের দুজনকে আব্বার পাশটায় বসিয়ে রেখে বিড় বিড় করে কী যেন বলে আব্বার ওপর কিছুটা রাগ ঝেড়ে নিলেন। আবার চট-জলদি রান্না ঘরের দিকে ছুটলেন।
মোস্তফার কান্না থামছেই না। আব্বা কোলে নিয়ে আদর করে খুব চেষ্টা করছেন কান্না থামাতে, কিন্তু কিছুতেই পারছেন না। কান্না ক্রমেই বাড়ছে। আম্মার কাছে যাব বলে চেচাচ্ছিল মোস্তফা। মোস্তফার কান্না আমার ভেতরে কোথাও হয়ত ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সহ্য করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে আব্বার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললাম— আব্বা, মোস্তফা শেয়ালরে খুব ডরায় ওরে শেয়ালের ডর দেহালেই কান্না বন্ধ অইয়া যাইব। আমার কাছে এটাই ছিল মোস্তফার কান্না থামানোর পরীক্ষিত একটি ঔষধ। ওকে অনেক বার শেয়ালের ভয় দেখিয়ে কান্না থামিয়েছি।
তবে মোস্তফাকে আর শেয়ালের ভয় দেখানোর প্রয়োজন হয়নি আব্বার। হঠাৎ বৃষ্টি বেড়ে গেল। টিনের চালে ঝমঝম শব্দটা আরও বেড়ে গেল। ঘরের ভেতরটা হালকা অন্ধকার। হঠাৎ বিকট শব্দের বজ্রপাত শুরু হলো, সাথে সাথেই অদ্ভুত আলোচ্ছটা এসে ঘরটা আলোকিত হয়ে আবার ধপ করে আঁধার নেমে এলো। আমরা দুভাই বোন ভয়ে চিৎকার দিয়ে আব্বাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। মোস্তফা ভয়ে আব্বার বুকে মুখগুঁজে দিয়ে চুপটি করে গেল। আব্বাও মোস্তফাকে বুকের সাথে শক্ত করে ধরে বসে আছেন। আমি আবার আব্বার কানের কাছে গিয়ে বললাম, আব্বা, অন্ধকারে ভয় লাগছে, হারিকেন নিয়ে আসি? আব্বা বললেন তুমি হারিকেন খুঁজে পাবে? আমি বললাম, আমি জানি আম্মা কোথায় হারিকেন রাখছে। দেয়াশলাই আর হারিকেন নিয়ে এসে আব্বাকে দিলাম, মোস্তফা ভয়ে আব্বার বুক থেকে সরতে চাইছে না। আব্বা মোস্তফাকে বললেন, আব্বু ভয় পেয়ো না একটু বসো, আমি হারিকেন জ্বালিয়ে নিই। অন্ধকার চলে গেলে আর ভয় পাবে না। খচখচ করে দেয়াশলাইয়ের কাঠি ঘঁষে আব্বা হারিকেন জ্বালালেন। অন্ধকার পালালো সাথে আমার ভয়ও।
আব্বা খুব নরম গলায় বললেন, গান শুনবে তোমরা? আমি প্রথমে মনে করেছি রেডিওতে গান শোনার কথা বলছেন আব্বা। মোস্তফা কিছু বলল না, আমি মাথা নাড়লাম। দুই ভাই বোনকে দুপাশে শুইয়ে দিয়ে মাঝখানে আব্বা শুলেন। আব্বার দুবাহুতে আমাদের দুজনের মাথা। বৃষ্টির সাথে হালকা ঝড়ো বাতাস বইছে। শীত শীত লাগছিলো। আব্বা আমাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আহ্! কী যে প্রশান্তির সে স্পর্শ। বাবাদের স্পর্শ এত কোমল হয়! আমরা দুই ভাই বোন চোখ বন্ধ করে আছি। হঠাৎ আব্বা গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলেন—
ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে ….
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়
নারীর মন মর ছুইরা রয় রে …
ওকি গাড়িয়াল ভাই …
হাঁকাও গাড়ি তুই চিল মারির বন্দর এ রে …
আমি অবাক বিস্ময়ে একবার আব্বার মুখের দিকে তাকালাম, আব্বা চোখ বন্ধ করে আপন মনে গাইছেন! কী অসাধারণ গানের গলা আব্বার! নিজের চোখ-কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অঝোর ধারার বৃষ্টিও আব্বার গানের সাথে সাথে সুর মিলিয়ে টিনের চালে সেঁতার বাজাতে থাকল। আব্বা গাইছেন খুব দরদ দিয়ে। বৃষ্টির শব্দে হয়ত আমরা দু ভাই বোন ছাড়া আর কারো কানে পৌঁছেনি সেদিনের সে গান। আমরা দুই ভাই বোন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। ভাবছিলাম— এটা কী করে সম্ভব! এমন গম্ভীর ব্যস্ত একটা মানুষও এত সুন্দর গান গাইতে পারেন! পুরোটা গান শেষ করলেন আব্বা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আরেকটা গান শুনবে মা? আমি মাথা নেড়ে বললাম হ্যাঁ শুনব। আব্বা আবার গাইতে শুরু করলেন—
আমার সোনার ময়না পাখি
কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে
দিয়া মোরে ফাঁকি রে
আমার সোনার ময়না পাখি ….
এ গানটা আরও দরদ দিয়ে গাইলেন আব্বা। আমি নিজেই নিজেকে বোকার মতো প্রশ্ন করছিলাম— আচ্ছা আব্বা কি রেডিওতে গান গায়? পুরুষ কণ্ঠের যে গানগুলো শুনি সব গান কি আব্বা গায়? এবার বুঝেছি আব্বাকে কেন খুঁজে পাওয়া যায় না। অফিসের কাজ শেষে হয়ত আব্বা রেডিওতে গান গাইতে চলে যান।
আমি তখন ছোট ছিলাম, অতটা বোঝার ক্ষমতা ছিল না, তারপরও যেন নতুন করে ঐদিন আব্বাকে চিনেছিলাম। উপলব্দি করেছিলাম আব্বার ভেতরের লুকানো অন্য একটা মানুষকে। সেদিন নতুন করে অনুভব করেছিলাম আব্বার বুকের সুশীতল ছায়া! বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের মতো বাবার বুকেও সন্তানদের জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসার সোঁদা গন্ধ আছে আমি সেদিন প্রথম সে গন্ধ পেয়েছিলাম। আব্বার তুমুল ব্যস্ততায় আমাদের মাঝখানে যে সূক্ষ্ম দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল সেদিনের পর থেকে কীভাবে যেন আস্তে আস্তে গুঁচে গিয়েছিল সে দূরত্ব।
সেদিনের পর থেকে কোনো দিন আর আব্বাকে গম্ভীর, কঠিন মনের মানুষ মনে হয়নি। তারপর থেকে বৃষ্টি এলেই মন চাইত আব্বা আজও বাইরে না যাক আমাদের দুজনকে নিয়ে সময় কাটাক, সেই গানগুলো আবার শোনাক। ঐদিনের পর আব্বাকে আর কখনও এভাবে গলা ছেড়ে গাইতে শুনিনি, এক আধ দিন গুন গুন করতে শুনেছি। সেদিনটি আজও ভুলিনি, আসলে কিছু স্মৃতি অমলিন, ভোলা যায় না। এখনও বৃষ্টি এলে বৃষ্টির রিমিঝিমি ছন্দের সাথে চোখ বন্ধ করলে আব্বার গান শুনতে পাই।
২
শীতের সকাল কুয়াশা আচ্ছন্ন প্রকৃতি। আব্বা দ্রুত সাইকেলের প্যাডেল মারছেন। আমি পেছনে বসে শক্ত করে সাইকেলের সিটের নিচের দিকটায় ধরে বসে আছি। আমার দৃষ্টি স্থির আব্বার পায়ের দিকে। আব্বার এক পায়ে প্যান্টের ওপরে রুমাল দিয়ে বেঁধে নিয়েছেন। মাথায় একটা প্রশ্ন বার বার ঘোর পাক খাচ্ছে— আচ্ছা! আব্বা এক পায়ে রুমাল বেঁধে রেখেছেন কেন? দুপায়ে বাঁধলেন না কেন? আব্বাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েও জিজ্ঞেস করা হয়নি। উদ্দেশ্য যাই হোক, এ প্রশ্নের উত্তরটা বাড়ি ফিরে আম্মার কাছ থেকে শুনব। আম্মা নিশ্চই জানেন সাইকেল চালানোর সময় আব্বার এক পায়ে রুমাল বাঁধার রহস্য!
টুংটাং টুংটাং ঘণ্টি বাজিয়ে আব্বা সাইকেল চালাচ্ছেন। রাস্তার দুপাশে গাছের সারি। ডালে ডালে পাখি ডাকছে। সবুজ গাছগাছালি আর ফসলে ভরা মাঠ পেছনে ফেলে আব্বার সাইকেল ছুটে চলেছে মেঠোপথ ধরে। গন্তব্য আমাদের বাড়ি থেকে সাত কিমি দূরে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আব্বার অফিস। মাসের দুই তারিখ আজ। আব্বা বেতন উঠাতে যাচ্ছেন। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল আব্বা কোথা থেকে বেতনের টাকা আনেন আমি দেখব। আমি ভাবতাম আব্বার অফিসে টাকা তৈরী হয়। টাকা তৈরীর মেশিন কেমন হয় দেখব। আমার ইচ্ছে পূরণ করতেই আব্বা আমাকে উনার অফিসে নিয়ে যাচ্ছেন।
খুব দ্রুত সাইকেল চালাচ্ছেন আব্বা। উঁচুনিচু মেঠোপথ একটু ঝাকি তো লাগছেই। তবে এসবে আমার কোনো খেয়াল নেই। বরং আমি বেশ আনন্দে আছি। আজ টাকা তৈরীর মেশিন দেখব। তার ওপর আবার মজার মজার সব খাবার খাওয়াবেন আব্বা।
সিনেমা হলে নাকি ছুটির ঘণ্টা সিনেমা চলছে, সিনেমাও দেখাবেন।
কিছুক্ষণ পর পর আব্বা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, তোমার বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে আম্মা? আমি বলছি না কষ্ট হচ্ছে না। আম্মা সাইকেলের সিটের উপর মোটা তোয়ালে ভাঁজ করে বিছিয়ে সুন্দর করে বেঁধে দিয়েছেন যাতে আমি আরাম করে বসতে পারি।
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বড় এবং বেশ উঁচু বিল্ডিংয়ের সামনে এসে আব্বা সাইকেল থামিয়ে আমাকে নামালেন। সাইকেলে তালা লাগিয়ে নিদিষ্ট এক স্থানে সাইকেলটা রেখে আসলেন আব্বা। ওখানে আরো অনেক সাইকেল রাখা ছিল। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থায় সাইকেল অনেকটা ভরসার জায়গায় ছিল। আব্বার অফিসের আরো অনেকেই সাইকেল নিয়ে এসেছেন। আব্বা হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেলেন একটা রুমের সামনে। আমি দরজায় উঁকি দিয়ে দেখি রুম ভরতি লোকজন কী নিয়ে যেন তাদের মধ্যে আলাপ চলছে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম— আব্বা টাকা তৈরীর মেশিন এ ঘরে আছে? টাকা তৈরী করতে এতোগুলো মানুষ লাগে?
আব্বা বললেন, এখানে মিটিং চলছে, চল রুমের ভেতরে গিয়ে বসি, একদম দুষ্টুমি করবে না, চুপ করে আমার সাথে বসে থাকবে। আমি মাথা নাড়ালাম। আব্বার পাশে চুপটি করে বসে আছি। কেউ কেউ আমার নাম, কোন ক্লাসে পড়ি —এসব জিজ্ঞেস করছিলেন। মিটিং চলছে, আমি বিরক্ত বোধ করছি। কারণ, এত সময় এক জায়গায় বসে থাকার মানুষ আমি নই। মিটিং শেষ। কলিগদের মধ্যে কুশল বিনিময় চলছে। হঠাৎ কেউ একজন আমার পেছন থেকে চুলের জুটি ধরে টান দিলেন। আমি আৎকে উঠলাম। এত সুন্দর করে বাঁধা ঝুটি নষ্ট হয়ে গেল কিনা কে জানে? আসার সময় আম্মা সুন্দর করে লাল ফিতে দিয়ে দুটি ঝুটি বেঁধে দিয়েছেন। আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি একজন মহিলা দাঁত বের করে হাসছেন। আমি বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে মহিলার দিকে তাকালাম। মহিলা আমার নাম জানতে চাইলেন। আমি নাম বললাম না।
আব্বা বললেন, তোমার নাম বলো, তারপরও আমি চুপ করে থাকলাম। মহিলাটি আমার হাত ধরে টেনে ওনার পাশে নিয়ে বসালেন, আমাকে আদর করলেন। আরো দুজন মহিলা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
মোটামুটি লম্বা সময় ধরে মিটিং চলল। অবশেষে আব্বার বিরক্তিকর মিটিংরুম থেকে বাইরে বের হলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে আব্বা আবার আরেকটা রুমে ঢুকলেন। মোটা গোঁফওয়ালা একজন লোক সামনে টেবিল নিয়ে বসে আছেন। টেবিলের উপর মোটা মোটা সব খাতা রাখা। একজন করে যাচ্ছেন আর একটা মোটা খাতায় সই করে টাকা নিয়ে বাইরে বেরুচ্ছেন। আমি চারপাশটায় টাকা বানানোর মেশিন খুঁজছিলাম। কিন্তু পেলাম না। এবার আব্বার পালা, আব্বা এগিয়ে গেলেন মোটা একটা খাতায় সই করলেন। আব্বা গোঁফওয়ালা লোকটাকে বললেন, টাকাগুলো আজ আমার মেয়ের হাতে দেন। লোকটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মুচকী হেসে বললেন, বাবার বেতন নিতে এসেছ? আমি মাথা নাড়ালাম। হাতে টাকা পেয়েও আমি খুশী হতে পারলাম না। টাকা বানানোর মেশিন দেখতে না পারার দুঃখ আমাকে ঝাপটে ধরল। রেস্তোরাঁয় গিয়ে আব্বা রসগোল্লা, সিঙ্গারা আর পুরি অর্ডার করলেন। খাওয়া সেরে আমরা সিনেমা হলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সাড়ে বারোটার শো শুরু হয়ে গেছে। সিনেমার প্রথম দিকের অনেকটাই দেখতে পারিনি।
ঈদের ছুটি ঘোষণার দিন স্কুলের বাথরুমে সকলের অজান্তে তালা বন্ধ হয়ে আটকে পড়ে একটি বারো বছর বয়সের ছাত্র। আর তালা বন্ধ বাথরুমে দীর্ঘ এগারো দিনের ছুটি শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে করতে হৃদয় বিদারক নানা ঘটনা ও মুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে দশ দিন অমানবিক কষ্ট সহ্য করার পর কীভাবে ছেলেটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে —এমনই একটি করুণ কাহিনী দেখেছিলাম ছুটির ঘণ্টা সিনেমায়। দেখে আমার সেকি কান্না। আব্বাকেও দুএকবার চোখ মুছতে দেখেছি, হয়ত আব্বাও কেঁদেছিলেন আমাকে বুঝতে দেননি।
হাসনা হেনা
গাজীপুর, ঢাকা