দ্য গ্রেট ডিক্টেটর ১৯৪০ সাল প্রকাশিত একটি ব্যঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র, যেটি লিখেছিলেন, পরিচালনা এবং অভিনয় করেছিলেন নির্বাক দৃশ্যের কিংবদন্তী অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিনের (১৮৮৯ – ১৯৭৭) এটিই একমাত্র সবাক চলচ্চিত্র। এটির শেষ দৃশ্যে তিনি মানব জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন, যেটি পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষণ।
আমি সম্রাট হতে চাই না
দুঃখিত, আমি সম্রাট হতে চাই না। এটি আমার কাজ নয়। আমি কাউকে শাসন বা কারো ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাই না। যতটুকু সম্ভব আমি সবাইকে সহযোগিতা করতে চাই— ইহুদি, বিধর্মী, কালো, সাদা সবাইকে। আমরা একে অপরের পাশে দাড়াতে চাই, এটাই মনুষ্যসত্তা। আমরা একে অপরের সুখ সহে বেঁচে থাকতে চাই, দুর্দশা দেখে নয়। আমরা কাউকে ঘৃণা ও তুচ্ছ করতে চাই না। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকের জন্য জায়গা রয়েছে। এবং সুন্দর এ পৃথিবী যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং প্রত্যেককে সে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। জীবন হতে পারে মুক্ত, স্বাধীন এবং সুন্দর, তবে পথটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
লোভ মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলেছে, পৃথিবীকে ঘিরে ফেলেছে ঘৃণার আচ্ছাদনে, ধীরে ধীরে আমাদেরকে টেনে নিয়ে গেছে দুর্দশা ও রক্তপাতের দিকে। আমরা গতিপ্রাপ্ত হয়েছি, কিন্তু নিজেদেরকে আমরা বন্দী করে ফেলেছি। যন্ত্রপাতি প্রচুর প্রাচুর্য তৈরি করেও আমাদেরকে অভাবের মধ্যে রেখেছে। আমাদের জ্ঞান আমাদের দুষ্ট করে তুলেছে। আমাদের চালাক, কঠোর এবং নির্দয় করেছে। আমরা খুব বেশি ভাবি, কিন্তু অনুভব করি খুব সামান্য। যান্ত্রিক উন্নয়নের চেয়ে মানবতা আমাদের বেশি দরকার। চতুরতার চেয়ে আমাদের মমত্ববোধ এবং নম্রতা বেশি প্রয়োজন। এই গুণগুলি ছাড়া জীবন হয়ে উঠবে হিংসাত্মক এবং সমস্ত অর্জন বিফলে যাবে।
বিমান এবং রেডিও আমাদের আরও কাছাকাছি এনেছে। এই আবিষ্কারগুলো চিৎকার করে মানুষকে কল্যাণকামী হয়ে উঠতে বলে, সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের জন্য চিৎকার করে, আমাদের সকলকে একত্রিত করে। এমনকি এখন আমি যা বলছি তাও পৌছে যাচ্ছে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে— লক্ষ লক্ষ হতাশ মানুষ, নারী এবং শিশুদের কাছে, যারা এমন একটি ব্যবস্থার শিকার যেখানে নিষ্পাপ মানুষ নির্যাতিত হয়, তাদেরকে বন্দী করে রাখা হয়।
যারা আমাকে শুনতে পাচ্ছ, তোমাদেরকে বলি— নিরাশ হইও না। লোভ-লালসার শিকার হয়ে এ দুর্ভোগের মধ্যে আমরা পড়েছি— তাদের ঘৃণায় এরকম হয়েছে যারা মানব জাতির সামষ্টিক উন্নতিতে ভয় পায়। মানুষের ঘৃণা নিঃশেষ হয়ে যাবে, স্বৈরশাসকরা পরাজিত হবে, এবং জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরে আসবে। যতদিন মানুষের মৃত্যু হবে, ততদিন স্বাধীনতার বিকল্প কিছু নেই।
সৈনিকেরা, নিকৃষ্ঠ মানুষের কাছে নিজেদেরকে তুলে দিও না, যারা তোমাদেরকে ঘৃণা করে, ক্রীতদাস বানায়, কী করতে হবে বলে দেয়, কী ভাবতে হবে, কী অনুভব করতে হবে বলে দেয়। যারা তোমাদেরকে চরায়, গবাদিপশুর মতো গণ্য করে তোমাদেরকে খাওয়ায়, তোপের মুখে কামানের গোলার মতো তোমাদেরকে ব্যবহার করে। সেইসব অস্বভাবিক মানুষ— কুৎসিত অন্তর-আত্মার যান্ত্রিক মানুষের কাছে নিজেদেরকে তুলে দিও না। তোমরা মেশিন নও! তোমরা গবাদি পশু নও! তোমরা মানুষ! তোমাদের হৃদয়ে মানবতা এবং ভালোবাসা রয়েছে, তোমরা ঘৃণা করতে পারো না। হৃদয়হীন, অস্বাভাবিক এবং অপ্রকৃতিস্থ মানুষেরাই শুধু ঘৃণা করতে পারে। সৈনিকেরা, দাসত্বের জন্য লড়াই করো না, মুক্তজীবনের জন্য লড়াই করো।
সেইন্ট লুকের সপ্তদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছেঃ “মানুষের ভেতরেই ঈশ্বর রয়েছে”— শুধু একটা মানুষের ভেতরে নয়, শুধু একদল মানুষের ভেতরে নয়, বরং তা সবার ভেতরে! তোমার ভেতরেও! মানুষের সে ক্ষমতা আছে— যন্ত্র তৈরির ক্ষমতা, সুখ সৃষ্টির ক্ষমতা! জীবনকে মুক্ত ও সুন্দর করার ক্ষমতা তোমাদের আছে, জীবনকে এক অসাধারণ অভিযানে পরিণত করার ক্ষমতা তোমাদের আছে।
তাহলে এসো, গণতন্ত্রের নামে আমরা সে ক্ষমতা ব্যবহার করি, আমরা একত্রিত হই। একটা নতুন পৃথিবীর জন্য লড়াই করি— একটি রুচিশীল পৃথিবী, যেখানে পছন্দ মতো কাজের নিশ্চয়তা থাকবে, তরুণদের ভবিষ্যত এবং বৃদ্ধদের জন্য নিরাপত্তা থাকবে। এই প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েই নিকৃষ্ট লোকগুলো ক্ষমতায় আরোহণ করে। কিন্তু তারা মিথ্যা বলে! তারা এই প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করে না। তারা কখনও তা করবে না।
আধিপত্যবাদীরা নিজেদেরকে মুক্ত করেছে, কিন্তু তারা জনগণকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছে। এসো, এবার আমরা সে প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণে লড়াই করি। পৃথিবীটাকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করি— সীমান্তের বাধা অতিক্রম করে, লোভ, ঘৃণা এবং অসহিঞ্চুতা থেকে দূরে থেকে। আমরা যৌক্তিক একটা পৃথিবীর জন্য লড়াই করি, এমন এক পৃথিবী যেখানে বিজ্ঞান এবং অগ্রগতি সকল মানুষের জন্যে সুখ বয়ে আনবে। সৈনিকেরা, এসো, আবার আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।