এ ধরনের পরিকল্পনা মার খাওয়ার অর্থ হচ্ছে সমাজে শুধু টাকাওয়ালারা এবং কালো টাকা সুযোগ পায়। তারা হাতুড়েও হয়েও ছড়ি ঘুরায় সমাজে। তাই অর্থনীতি তথা সমাজের সু-স্বাস্থ্যের জন্যেই ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।
মনে হল তো করলাম —এতে সাময়ীক সুখ (মুহূর্তের সুখ) থাকলেও জীবন সঠিক পথ ধরে এগোতে পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে ছন্দবদ্ধ জীবন-যাপনই সুখের হয়। মেধাবীরা অগোছালো এবং এলোমেলো হয় —এ কথার কিছু ভিত্তি রয়েছে। তবে এখান থেকেই মেধাবীরা সতর্ক হওয়ার রশদ খুঁজতে পারে যে এলোমেলো এবং অগোছালো হওয়া যাবে না, তাহলে মেধাটা কাজে লাগবে। পৃথিবীতে মধ্যম মানের মানুষেরা বাস্তব জীবনে ভালো থাকে, সুখে থাকে, পৃথিবীর রক্ষকও তারা ভক্ষকও তারা, যদিও তারা আবিষ্কারক নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আবিষ্কারকরা কেন ব্যবস্থাপক হিসেবে ভালো নয়? অাসলে ‘আবিষ্কারকের’ ব্যবস্থাপক হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে হলে যে খারাপ —এমন সিদ্ধান্তও সঠিক নয়। দলের সেরা ক্রিকেটার অধিনায়ক হিসেবে ভালো নাও হতে পারে। আবার হতেও পারে। তাই বিষয়টি এমন নয় যে ভালো শিক্ষক ভালো প্রশাসক হতে পারবে না। বরং তা-ই হওয়ার কথা। গোলক ধাঁধা অন্যখানে, সৃজনশীল মানুষেরা কম কৌশলী হয়, চালাক কম হয়, চক্রান্তের জায়গাটিতে এসে তারা পিছিয়ে পড়ে। সুযোগটা নিয়ে নেয় কেউ না কেউ। অন্যরা ভলো হলে একজন সৃজনশীল মানুষই সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থাপক বা প্রশাসক হত। মধ্যম মানের মানুষ প্রশাসক বা ব্যবস্থাপক হিসেবে ভালো করছে, কারণ, ভূত পিটাতে ভূতেই পারঙ্গম বলে।
মেধাবীদের যে সমস্যাটি নিয়ে এই প্রবন্ধের অবতারণা- মন চাইলেই কোনোকিছু করা যাবে কিনা? আমি এক্ষেত্রে নিজেকে কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়ে আলোচনাটা করি। আমি নিজে জানি যে ছাত্র হিসেবে আমি মন্দ নই, কিন্তু সে হিসেবে কিছুই করতে পারিনি। এর জন্য পারিবারিক কারণ দায়ী, আর দায়ী হচ্ছে নিজের মনকে বসে রাখতে না পারা। স্বেচ্ছাচারী হইনি, তবে পরিকল্পিত জীবন-যাপন করতেও পারিনি। রাত দুইটার সময় মনে হল, যাই বেরিয়ে পড়ি, পড়লাম, ঢাকা মেডিকেলের সামনে গিয়ে চা খাইলাম, সিগারেট খাইলাম। এরকম মাঝে মাঝে হতেই পারে, কিন্তু দিনে যদি দুই তিনটা ঘটনা অনিয়ন্ত্রিত মানসিক অবস্থার কারণে হয়, তা সমস্যাই বটে। এ তো গেল দিনের হিসেব; জীবনে যদি বড় কিছু ভুল অংশগ্রহণ থাকে, অনিয়ন্ত্রিত অংশগ্রহণ থাকে, তাহলে পিছিয়ে পড়তে হবেই।
ব্যক্তি পিছিয়ে পড়া মানে সমাজ পিছিয়ে পড়া। হয়ত বলবেন, আপনি যা পারেননি অন্যে তা করবে। তা হয় না, প্রত্যেকের কর্মের স্বতন্ত্র মূল্য আছে। ব্যক্তি যা হওয়ার জন্য, যে যা হতে পারত তাকে তা হতে দিতে হবে, হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে -এটাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
কখনো মনে হল চাকরি করি, কখনো মনে হল না করব না। কখনো মনে হল আরো পড়ি, কখনো মনে হল প্রাতিষ্ঠানিক এ শিক্ষায় আর দরকার কী? এই দোদুল্যমানতা মানুষের থাকে। এখান থেকে বেরিয়ে আসা শক্ত। বেরিয়ে আসতে হলে, কিছু জিনিস জানা থাকতে হবে, সেটি হল- বড় কিছু করতে খুব বেশি সময় কাজ করা লাগে না, কিন্তু ভাবা লাগে অনেক। আইডিয়া এবং পরিকল্পনা থাকলে কাজগুলো অন্যকে দিয়েও করিয়ে নেওয়া যায়। তাই বৈষয়িক সমৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। বৈষয়িক সমৃদ্ধির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চাকরি বা ব্যবসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই জায়গাটিতে হেলা-ফেলা করে বড় কিছু বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় করা কঠিন।
উপরের এই পরামর্শ ব্যক্তিকে কোনো মনোবিজ্ঞানী দিতে পারেন, কোনো শিক্ষক বা অভিভাবক দিতে পারেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি হওয়ার দরকার ভিন্ন। সমাজে এই ভাবনাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার যে মেধাবীকে দেখভাল করতে হবে, আবিষ্কারক, গবেষক, উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোশকতা করতে হবে। তাহলে সমাজের উন্নতি হবে।
পৈতৃকের সূত্রে অনেকে ধন-সম্পত্তি হাতে পেয়ে যায়, তাদের কথা ভিন্ন, তবে তারা খুব একটা কাজের হয় না। অতি আদরে এবং প্রাচুযে তাদের গড়াপেটা হয়নি বলে বিশেষ কিছু করার ক্ষমতা তাদের তৈরি হয়নি। তাই এটা পৃথিবীতে একটা প্যারাডক্স যে যার মেধা আছে তার টাকা নেই আর টাকা আছে তার মেধা নেই। দুটোই আছে, এরকম নজির খুব কম।
আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার এই জায়গাটিতে বিশেষভাবে কাজ করার কথা ছিল, কিন্তু এখনো এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সফল নয়। এথনো ব্যাংক ব্যবস্থা বিনা জামানতে শুধু আইডিয়া এবং পরিকল্পনার উপর বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হতে পারছে না। এখনো ব্যাংক ব্যবস্থা অলাভজনক, কিন্তু সেবামূলক খাতগুলোতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে পারছে না, ব্যাংক ব্যবস্থা রিসার্স প্রপোজালের উপর ঋণ প্রদানে এগিয়ে আসতে পারছে না। এই জায়গাগুলোতে যদি ব্যাংকগুলো কাজ করতে পারত, তাহলে পৃথিবী নিশ্চয়ই আরো দ্রুত এগিয়ে যেত।
নিরপেক্ষতা বজায় রেখে এসব জায়গায় কাজ করা কঠিন, তবে অসম্ভব হওয়ার কথা নয়। আমাদের ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে মেধাবীরা নিয়োগ পাচ্ছে। তাদের দিয়ে শুধু হিসেব-নিকেষ করানোর কোনো মানে হয় না। কীভাবে ব্যাংক-ব্যবস্থাকে আরো কার্যকরভাবে ঢেলে সাজানো যায়, সে ভাবনায় শুধু শীর্ষ কর্মকর্তাদের নয়, সদ্য নিয়োগ পাওয়াদেরও যুক্ত করতে হবে।
সবকিছু পশ্চিমা বিশ্ব থেকে শুরু হতে হবে কেন? আমরাও তো কিছু চেষ্টা করে দেখতে পারি, নাকি? অামদের দু’একটি ব্যাংক এগিয়ে আসুক না। সরকারি ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপী হয়, দুর্নীতি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত অবলোপনসহ (রাইট অফ) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা! বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিনা জামানতে তরুণদের জন্য কয়েক শো কোটি টাকা প্রতি বছর ঋণ হিসেবে বরাদ্দ করেই দেখুক না কী ফল হয়। অর্ধেক বিফলে যাক, বাকী অর্ধেকে হয়ত অভাবনীয় কাজ হবে, যার সুফল ভোগ করবে তো সবাই।
একটা উদারণ দিই—
আমি একজন উদ্যোক্তার কথা জানি যিনি গত পাঁচ বছর ধরে আইডিয়া নিয়ে বসে আছেন, খেয়ে না খেয়ে কাজ করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু টাকার অভাবে এগোতে পারছেন না। সামাজিকভাবে ঋণগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছেন। জীবন থমকে যাচ্ছে।
একজন তরুণ প্রকাশকের কথা জানি, যিনি একাডেমিক বই বলতে শুধু গাইড বই এবং বইমেলায় যাচ্ছেতাই বই দেখে প্রকাশক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভুল মুক্ত, প্রয়োজনীয় ভালো ভালো বই করার সিদ্ধান্ত নেন, কী কী বই করবেন তার একটি খসড়াও তিনি তৈরি করেছন, যেহেতু নিজে লেখক তাই অনেক পাণ্ডলিপিও তৈরি করেছেন। কিন্তু টাকার অভাবে বই বের করতে পারছেন না। একাডেমিক বইয়ের পাশপাশি ভিন্নধর্মী কিছু সৃজনশীল (মূলত জীবনমুখী) বই করার কথা তিনি বললেন। শুনে আমি মুগ্ধ হলাম, কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। তিনি এই আলোচনাটি যদি কোনো ব্যাংকারের সাথে করার সুযোগ পেতেন, ব্যাংকে যদি এমন একটি সেল থাকে যেখানে এ ধরনের বক্তব্য এবং প্রপজাল পেশ করার সুযোগ থাকবে, তাহলে আইডিয়াগুলো মার খাবে না। শুধু ঋণ প্রদান কেন, অলোচনা সাপেক্ষে ব্যাংক তার পার্টনার হয়ে যেতে পারে। এমনটি হলে অসুবিধা কোথায় যে ব্যাংকই ব্যাক্তির সাথে পার্টনারশিপে যাবে?
এ ধরনের পরিকল্পনা মার খাওয়ার অর্থ হচ্ছে সমাজে শুধু টাকাওয়ালা মানুষেরা এবং কালো টাকা সুযোগ পায়। তারা হাতুড়েও হয়েও ছড়ি ঘুরায় সমাজে। তাই অর্থনীতি তথা সমাজের সু-স্বাস্থ্যের জন্যেই ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।