সময়টা ছিলো গত শতকের নয়ের দশকের প্রথম দিকে— ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের একদম প্রথম দিকে। আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে মধ্য প্রদেশ ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম | যতদূর মনে পড়ে দীপালি সরকার বলে একটি মেয়ে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলো | দীপালি অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতো, বড় মনের মানুষ ছিলো এবং একই সঙ্গে ফিজিক্সের খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল ও। দীপালি ছিল প্রবাসী বাঙালি, রাঁচির মেয়ে। আমার সঙ্গে বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল | ও বর্তমানে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের অধ্যাপিকা | দীপালি যাকে বিয়ে করেছিল সে-ও ছিল ফিজিক্সের গবেষক | তার নাম মানস ঘোষ এবং এই ভ্রমণের আমাদের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলো। মানস এখন কলকাতার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর টি কাল্টিভেশন অফ সাইন্স-এ কাজ করে | যতদূর মনে পড়ে আরো তিন জন ছিলো আমাদের সঙ্গে | তবে শুধু মানসকে বাদ দিয়ে এদের কারো সঙ্গেই তেমন যোগাযোগ নেই আমার।
যাইহোক প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমাদের মধ্যে দীপালিই সমস্ত প্রোগ্রাম ঠিক করেছিলো। কবে কোথায় কীভাবে যাবো, কোথায় থাকবো সেসব চিন্তার ভার দীপালি নিজেই নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলো। আমাদের কাউকে কোনো চিন্তা করতে হয়নি | খুব সম্ভবত আমরা পয়লা ডিসেম্বর হাওড়া থেকে ট্রেনে করে ভোপালের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। দিনটা ছিল মঙ্গল বার | পরেরদিন, অর্থাৎ কিনা বুধবার রাতের দিকে আমরা ভোপাল পৌঁছালাম। ভোপালে তখন কনকনে ঠাণ্ডা। কেন জানি না আমি যত জায়গাতে বেড়াতে গিয়েছি ঠাণ্ডাতেই গিয়েছি। এমনকি শীতপ্রধান জায়গাতেও আমি শীত কালেই ঘুরতে গেছি! শীত কালের সঙ্গে আমার অলিখিত এক গভীর সম্পর্ক যে কবে থেকে গড়ে উঠেছিলো তা আমি নিজেও জানি না। নাহলে কেনই বা ঠাণ্ডার জায়গাতে আমি কনকনে শীতকেই আমার সঙ্গী করেছি! আমার একথা বলতে আজ কোনো দ্বিধা নেই যে, প্রকৃতিও যেন শীতের সহজ ও সারল্যের কাছে হার স্বীকার করে তার নিস্তব্ধতাকে বয়ে এনে আমার মনকে বার বার ভাবাতুর করে তুলতো | এই শীতকে সঙ্গে নিয়েই আমি আমার জীবনে এমন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, যা আমার জীবনকে নুতন করে ভাবতে শিখিয়েছে। আমরা দু’জন দু’জনকেই ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম, যা আমাদের ভালোবাসাকে গভীর থেকে গভীরতর করে তুলেছিলো। একথা বলতে আমার কোনো সংকোচ নেই যে, আমি আমার সবথেকে প্রিয় সঙ্গিনী শীতের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি | তবে আমি জানি না আমি শীতকে কিছু শেখাতে পেরেছি কিনা | তবে এটুকু অনুভূত হয় যে, শীতও আমার সঙ্গ ভীষণ পছন্দ করে |
যাইহোক ভোপালে পৌঁছে আমরা হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে পরের দিনের পরিকল্পনা করছিলাম। ঠিক হলো যে, ভীমবেটকা আর গিন্নারগড় ফোর্ট ঘুরবো পরের দিন। পরিকল্পনা মাফিক আমরা গাড়ি করে ভীমবেটকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম | ভীমবেটকা ভারতের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যা প্রাগৈতিহাসিক প্যালিওলিথিক এবং মেসোলিথিক সময়কালের অনেক নিদর্শন বহন করে। কিছু কিছু আশ্রয়স্থল এক লক্ষ বছরের ও বেশি পুরোনো। এখানে এসে মানব জাতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রম বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায় যে কোনো চিন্তাশীল মানুষকে ভাবাতুর করে তুলবেই। আমিও তার ব্যতিক্রমী হতে পারিনি। আমরা সারাদিন ভীমবেটকা ঘুরে বেড়িয়েছি । এরপর আমরা গিন্নারগড় ঘুরেছি। গিন্নারগড় প্রাসাদটি ভারতীয় প্রাসাদ স্থাপত্যের অন্যতম রত্ন। এই প্রাসাদটি এক গণ্ড যোদ্ধা নিজাম শাহ নির্মাণ করেছিলেন বলে ইতিহাসে বর্ণিত আছে। পরের দিন অর্থাৎ চৌঠা ডিসেম্বর আমরা ভোপাল শহর ও তার আশে পাশে ঘুরে বেড়িয়েছি |
এ প্রসঙ্গে বলে রাখি যে, ভারতবর্ষে তখন রাম জন্মভূমি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর বেশ কিছুদিন আগে সংঘ পরিবারের বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এবং তৎকালীন বিজেপি— প্রেসিডেন্ট এলকে আদবানীর নেতৃত্বে রাম রথযাত্রা সংগঠিত হয়েছিল। এই আন্দোলন রাজনৈতিক স্বার্থেই সংগঠিত হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। যাইহোক ৪ ডিসেম্বর (১৯৯২) ভোপাল ঘুরে বেড়ানোর সময় আমাদের বেশ কয়েকটি মুসলিম মহল্লার (ইব্রাহিমপুর ও জাহাঙ্গীরবাদ) মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। ঐ সমস্ত মহল্লায় কিছু লোককে ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনিতে মিছিল করতে দেখেছি। এই ধ্বনি দেওয়ার ধরনের মধ্যে এক ঔদ্ধত্ব ও রণহুংকারের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলাম। ঐ মহল্লার লোকদের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক ও মৃত্যু ভয় দেখেছি। এত বছর পরেও তাদের সেই আতঙ্কগ্রস্ত চোখমুখ এখনো আমার সামনে ভেসে ওঠে এবং মনকে ভীষণ পীড়া দেয়। এই ভারতকে আমি চিনতাম না যেখানে নিজভূমিতে একদল নিরপরাধ নাগরিক তাদের বিশেষ ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার জন্য আর এক দল উন্মত্ব মনুষত্বহীন নির্বোধ লোকজন দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হন।
আজ আমরা বাহাত্তরতম প্রজাতন্ত্র দিবস ধুমধাম সহকারে পালন করছি, যে সংবিধান আমাদের দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ভারতীয় সংবিধান আমাদের কাছে গর্বের সংবিধান, যেখানে মানবতাকে সবার উর্ধে তুলে ধরা হয়েছে। ধৰ্ম তো শুধু জীবনযাত্রাপ্রণালী নির্ধারণ করে। এর বেশি আর কিছু না। সেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থান ভারতীয় সংস্কৃতিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিজ্ঞানে একটা কথা আছে এককেন্দ্রাভিমুখতা কোনোদিন সৃজনশীলতা আনতে পারে না। বরঞ্চ বলা যেতে পারে ব্যবর্তন নুতন নুতন সৃষ্টিকে আহ্বান করে।
যারা আজ মতের বিভিন্নতা, ধর্মের বিভিন্নতা, ভাষার বিভিন্নতাকে অস্বীকার করে এককেন্দ্রাভিমুখতার পক্ষে ওকালতি করছেন তারা হয় ভারতীয সংবিধানের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করেননি, অথবা তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতীয় সংবিধানকে কলংকিত করছেন।যাইহোক, ৫ ডিসেম্বর আমরা পাঁচমারি রওনা দিলাম। পাঁচমারি একটি শৈল শহর। পাঁচমারি নামটি হিন্দি শব্দ পাঁচ (পাঁচ) এবং মারি (গুহাগুলি) থেকে উদ্ভূত বলে বিশ্বাস করা হয়। জনশ্রূতি আছে যে, এই গুহাগুলি তেরো বছরের প্রবাসকালীন সময়ে মহাভারত যুগের পাঁচ পাণ্ডব ভাই দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। আমরা পাঁচ ও ছয় ডিসেম্বর পাঁচমারি ঘুরেছি। সাত তারিখ খুব ভোরে খবর পেলাম যে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। প্রায় সবকিছু বন্ধ। আমরা তখনো পরিস্থিতির ভয়াবহতার উপলব্ধি করতে পারিনি। আমরা ইন্দোরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাস্তায় দেখলাম প্রায় সব বন্ধ। মাঝে মধ্যে দু’একটি ট্রেন চলছে। আমরা কোনোক্রমে ইন্দোরে পৌঁছালাম। ইন্দোরে পৌঁছে আমরা কিন্তু স্টেশন থেকে বের হতে পারলাম না। চারিদিকে কারফিউ এবং এক আতঙ্কের পরিবেশ। তখন আমরা সবাই তরুণ হওয়াতে কারফিউ এবং চারিদিকে আতঙ্কের পরিবেশ আমাদেরকে খুব একটা বিচলিত করতে পারেনি। আমাদের কলকাতাতে ফেরার ট্রেন ছিলো ভোপাল থেকে। আমরা শুনলাম তখুনি একটি ট্রেন ভোপাল যাবে। আমরা আর সময় নষ্ট না করে ওই ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেন খুব আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল, গোটা ট্রেন প্রায় ফাঁকা। মনে হলো গোটা ট্রেনে ৫০ জন যাত্রীও ছিল না। আমরা খুবই ঝুঁকি নিয়ে একটা কম্পার্টমেনে উঠে গেলাম। দরজা জানালা সব ভালো করে বন্ধ করে দিলাম এবং সঙ্গে কম্পার্টমেন্টের সব আলো নিভিয়ে দিলাম। আমাদের সঙ্গে আরো কয়েকজন যাত্রী ছিল। যতদূর মনে পড়ছে আমরা বেলা তিনটের দিকে ট্রেনে উঠেছিলাম। এক সহযাত্রী বললেন যে, গতকাল ঠিক এই ট্রেনেই জেনারেল কম্পার্টমেনটে প্রায় ৫০ লোককে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আমরা একটু ভয়ে কুঁকড়িয়ে গিয়েছিলাম।
আমরা ঠিক করলাম আমরা দু’টো কম্পার্টমেন্টে ছড়িয়ে বসবো। যে স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে সেখানে আমি এবং আরো একজন ছেলে পাশের কম্পার্টমেনটে যাবো। আমাদের এই সিদ্ধান্তের পর যখন ট্রেনটি পরবর্তী স্টেশনে পৌঁছালো— আমি এবং আর একজন নেমে পড়লাম। গোটা প্লাটফর্ম ঘন অন্ধকার, কোনো রকম আলো নেই প্লাটফর্ম চত্বরে। কিছুটা দূরে দেখলাম দাও দাও করে আগুন জ্বলছে, সঙ্গে মানুষের আর্তনাদ। বুঝলাম দাঙ্গা চলছে। এর মধ্যেই ট্রেনে ছেড়ে দিয়েছিলো, আমরা পরবর্তী কম্পার্টমেন্টে ওঠার সময় পাইনি। এর মধ্যে আমাদের বন্ধুরা তাদের গেট বন্ধ করে দিয়েছিলো। আমরা বন্ধ গেটের দরজাতে উঠে বন্ধুদের জোরে ডাকাডাকি শুরু করলাম দরজা খোলবার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর বন্ধুরা দরজা খুললো। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি— সেদিনের মৃত্যু ভয় আমি আজও ভুলিনি বা বলা যায় সেই দুঃস্বপ্নের রাত আমাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়।
আমরা স্পেশাল ট্রেনে পরেরদিন কোলকাতা রওনা দিলাম। কোলকাতা পৌঁছে হাওড়া স্টেশন থেকে আমরা বের হলাম। গোটা স্টেশনে মিলিটারি ও পুলিশে ভর্তি। আমাদের বলা হলো দু’হাত উর্ধগামী করে স্টেশন থেকে বের হতে। পশ্চিম বাংলা সরকার বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করেছিলো শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে যাবার জন্য। রাস্তাঘাট ফাঁকা, গোটা শহরে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। এই কল্লোলিনী শহরের এই দৃশ্য আমি আমি জীবনে কোনোদিন দেখিনি।
এতদিন পর এই ঘটনা লিখতে বাধ্য হলাম এই কারণে যে, সেই রণহুঙ্কার যা আমি শুনেছিলাম ২৯ বছর আগে, যেখানে মানবতাকে অস্বীকার করে, ভারতীয় সংবিধানের মূল ধ্বনিকে ভুলুণ্ঠিত করে আমাদেরকে সংকীর্ণতার মোড়কে মুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো— যা মানবতার ও মানব সভ্যতার অগ্রগতির পরিপন্থী, সেই রণহুঙ্কারের প্রতিধ্বনি আবার শোনা যাচ্ছে।
আমরা কি এমন সমাজ গড়তে পারি না যেখানে আমাদের সবার বাক স্বাধীনতা থাকবে? আমি কী খাবো, কী করব সেখানে কারো খবরদাড়ি থাকবে না, আমি কাকে বিয়ে করব সেখানে কেউ অযাচিত হস্তক্ষেপ করবে না। এমন সমাজ কি আমরা চাই না যেখানে ধৰ্ম বা জাতপাতে কোনো বিভেদ থাকবে না? যেখানে কোনো শোষণ থাকবে না, মানুষের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য থাকবে না? প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষার সমান অধিকার থাকবে, খাদ্যের অধিকার থাকবে, কাজের অধিকার থাকবে, সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ হবে বিজ্ঞানমনস্ক।
হ্যাঁ, আমাদের সংবিধানে এর প্রত্যেকটির সংস্থান রয়েছে। আসুন আমরা সবাই আমাদের সংবিধানকে সন্মান করি। আমাদের সংবিধানের মূল ভাবধারাগুলোকে বাস্তবায়িত করি। মানবতাবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি। এটাই হোক আমাদের বাহাত্তরতম প্রজাতন্ত্র দিবসের মূল শপথ ।
লেখক:
প্রাক্তন বরিষ্ঠ অধ্যাপক, বসু বিজ্ঞান মন্দির (বোস ইনস্টিটিউট), কলকাতা, ভারত । বর্তমানে ভিজিটিং প্রফেসর, রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি, পশ্চিম বাংলা ।