আনন্দ বেদনার বিশ্বায়ন এবং স্থানীয়করণের গুরুত্ব // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0
একজন কিংবদন্তি শিল্পীর মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মারা যাওয়াটা অবশ্যই দুঃখের, কষ্টের। আবার সমর্থক হিসেবে মাত্র দুই দিন পরেই আর্জেন্টিনা জিতে যাওয়াটা হয়ে ওঠে ভীষণ আনন্দের। প্রসঙ্গটা আনছি ভারতের এ প্রজন্মের জনপ্রিয় গায়ক কৃষ্ণকুমার কুন্দনের হঠাৎ মৃত্যু এবং তার দুইদিন পরেই আর্জেন্টিনা-ইতালী ম্যাচে আর্জেন্টিনার জয়কে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনন্দ বেদনার যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সে সূত্র ধরে।
মানুষ হিসেবে আনন্দ বেদনার এ প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে, মানবিকতার স্থানীয় প্রতিবেশ থেকে সরে গিয়ে বৈশ্বিকভাবে বা জাতীয়ভাবে বিখ্যাত কেউ মারা গেলে বা বিপরীতক্রমে সমর্থীত কেউ জিতে গেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের যে প্রতিক্রিয়ার ঢল বয়ে যায় সেটি আসলে কতটা স্বাভাবিক?
অল্প সময়ের ব্যবধানে, এমনকি একই দিনে একই মানুষের কাছ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনন্দ বেদনার এই যে অভিব্যক্তি এর কোনো সামাজিক মূল্য কি আসলে আছে? মূল্য থাক বা না থাক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই দুঃখ সুখে সয়লাভ। এটা কি আগেও একইভাবে ছিল, হয়ত মাধ্যম ছিল না বলে মানুষ প্রকাশ করতে পারত না, নাকি এটা একটা বদলে যাওয়া পৃথিবী? প্রচার মাধ্যমই কি এখন মানুষের আনন্দ বেদনার জায়গাটা ঠিক করে দিচ্ছে? মানুষ কি তার সহজাত মনস্তত্ত্ব— আনন্দ বেদনার মূল জায়গাটি হারিয়ে ফেলেছে?
যদিও আদি থেকেই স্থানীয়করণই মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন, কিন্তু মানুষ মানসিকভাবে স্থানীয়করণ থেকে সরে গেছে। মানুষ ধরে নিয়েছে হাতে টাকা থাকলেই নাগালের মধ্যে সব চলে আসবে। প্রকৃতপক্ষেই দীর্ঘদিন ধরে এটা ঘটে চলায় মানুষের মনস্তত্ত্বে পরিবর্তন ঘটা অস্বাভাবিক নয়। মানুষ তার প্রতিবেশের মানুষটাকে ইগনোর করার সুযোগ এবং সাহস পাচ্ছে। এখন প্রতিবেশী বা পরিচিত কেউ, এমনকি বন্ধু মারা গেলেও দুঃখ খুব দ্রুত সয়ে নেয় মানুষ, কিন্তু শেন ওয়ার্ন বা এরকম সেলিব্রেটি কেউ মারা গেলে দুঃখটা সইতে তার চেয়ে একটু হলেও বেশি সময় নেয়। সময়টা নেয় সে প্রচার মাধ্যমে (যেমন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম), একইসাথে রেস্টুরেন্টে বসে বন্ধুদের সাথে মাস্তি করতে কোনো অসুবিধা হয় না তার? তাহলে এই অবষাদের রূপটা আসলে কী? ব্যাখ্যাটা কী হবে?
আপনি আমি মানসিকভাবে হয়ে যাচ্ছি গ্লেবালাইজড্, কিন্তু আমাদের প্রয়োজন মেটে স্থানীয়ভাবে। টাকার বিনিময়ে পাচ্ছি মনে করি বলে সেটি আমরা টের পাই না, বা অস্বীকার করি। স্থানীয়ভাবে আমরা একে অপর থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অর্থ ভেতরে ভেতরে মানুষ হয়ে উঠেছে হিংসাত্মকভাবে আরও স্বার্থপর এবং আরও অমানবিক। বাইরে শুধু একটা মেকি চরিত্র ধরে রেখেছে সবাই। আমরা কিছু থাকলে আমরা ধরে নিচ্ছি নিজ পরিবেশে সহমর্মী হতে গেলে আমাকে হয়ত শুধু দিতে হবে, নিতেও যে হয়, এবং নিজ বলয়ে মানবিক এই দেওয়া নেওয়াটাই যে জীবন সেটি আমরা ভুলতে বসেছি।
তবে সময়টা বদলাবে। এমন একটা সময় হয়ত আসবে যখন টাকা থাকলেই প্রয়োজনীয় সবকিছু আপনার ঘরে পৌঁছে যাবে না। একটা সময় আসবে যখন ক্ষুদ্র পরিসরগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যেমন, একটি ইউনিয়ন- স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়বে, গ্রামের সাথে গ্রামের, ইউনিয়নের সাথে ইউনিয়নের প্রতিযোগিতা বাড়বে, সহযোগিতাও বাড়বে, এখন যেটি দেশের সাথে দেশের আছে।
এটি জরুরী। স্থানীয় পর্যায়ে এই আর্থিক প্রতিযোগিতা সমৃদ্ধি বাড়াবে এবং দারিদ্র্য কমাবে। প্রশ্ন হচ্ছে- মানুষ মানুষের জন্য প্রকৃতপক্ষেই মানবিক এবং পাশের মানুষটির জন্য সহমর্মি হয়ে উঠবে কিনা? স্থানীয়করণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান যে সহজে করা সম্ভব এবং সমৃদ্ধি আনা সম্ভব বিশ্বে সেরকম উদাহরণ রয়েছে।
আমার ধারণা— মানুষ এদিক থেকে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হবে, না হলে মানুষের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। এখন গ্রাম থেকে যত সহজে শহরে খাদ্যপণ্য এবং অন্যান্য সামগ্রী আসছে, অদূর ভবিষ্যতে সেটি না-ও হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে— কতদিন পরে এই পরিবর্তনগুলো আমরা দেখবো? আমার ধারণা এক দুই দশকের বেশি নয়। পরিবর্তনটা শুরু হবে। বিশেষ করে কাগুজে মুদ্রা উঠে গেলে এবং সবখানে ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বায়ন আরও বিকশিত হওয়ার চেয়ে স্থানীয়করণই আরও জোরদার হবে। এবং মানুষের টিকে থাকার জন্য, দারিদ্র্য শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য, সর্বোপরি মানুষ তার বলয়ের মানুষের জন্য আরো বেশি মানবিক এবং সহমর্মি হওয়ার জন্য সেটি প্রয়োজনীয়।
টাকা হলে হাজার মাইল দূর থেকেও প্রয়োজনীয় জিনিসটা হাতের মুটোই চলে আসবে, এ সত্য এত বেশি বাহুল্যতা বাড়িয়েছে যে, মৌলিক চাহিদায় টান পড়বে, পড়েছে। আর মৌলিক চাহিদা যত বেশি স্থানীয়ভাবে পূরণ করা সম্ভব হবে মানুষের জীবন তত সহজ হবে। এবং এটা শুধু জীবন সহজ হওয়ার বিষয় নয়, অদূর ভবিষ্যতে মানুষ এই বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়বে।
বাংলাদেশ এখনো ডেমোগ্রাফিক উইনডো-এর মধ্যে রয়েছে, অর্থাৎ বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের অভাব নেই। এটি আর বড়জোর দশ বছর থাকবে। এটি সত্য যে, ডেমগ্রাফিক্যাল এ সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার একেবারে যে ব্যর্থ হয়েছি তা-ও নয়, লক্ষ লক্ষ যুবক বিদেশে গিয়ে কাজ করছে বলেই বাংলাদেশ বিশ্বমন্দার এ সময়েও মহা সংকটে পড়েনি। বিদেশে কাজ করতে যাওয়া এ যুব সমাজ গ্রামেরই, তারা নিরবে গ্রামের উন্নয়নে অবদান রাখছে।
কিন্তু দেশে যারা থাকছে তারা কর্মবিমুখ বা কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। তাই গ্রাম নিয়ে আশাবাদী হওয়ার পাশাপাশি গ্রামে একটি সুশিক্ষিত, সচেতন যুব সমাজ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। গ্রামে কার্যকর বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। গ্রামের ব্যাংকগুলো থেকে ডাটা নিয়ে দেখা গেছে ব্যাংকগুলোতে যত টাকা মানুষ সঞ্চয় করছে তার অর্ধেক টাকাও মানুষ লোন হিসেবে পাচ্ছে না, অর্থাৎ গ্রাম থেকে শহরে টাকা পাচার হচ্ছে। এটা শুধু একটা উপায় মাত্র।
২০৫০ সাল নগাদ বিশ্বকে নয়শো কোটি মানুষকে ভরণপোষণ করতে হবে। সেদিক থেকে দেশের মানুষকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কোনো বিকল্প নেই। জনবহুল দেশ হলেও সদিচ্ছা থাকলে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে একটি বাড়ি একটি খামারের মতো কর্মসূচি সফল করা সম্ভব। গ্রামের টাকা গ্রামে রাখতে পারলে এটি খুব ভালোভাবে সম্ভব। যদিও দেশের বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং দায়সারা মনোভাব আমলে নিলে সেটি সম্ভব হবে বলে মনে করতে কষ্ট হয়।
বিনোদনের কথা বাদ দিলে আধুনিক সময়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা উৎপাদনকারী তারা প্রধানত জ্ঞান এবং তত্ত্বের জন্য, শিক্ষার জন্য শহরের প্রতি, অন্য দেশের প্রতি দ্বারস্থ হয়েছে। ইন্টারনেট দুনিয়া জ্ঞানের দরজা এমনভাবে খুলে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো দিবে যে গ্রামের মানুষের শহরের মানুষের ওপর নির্ভরতা কমবে, কিন্তু শহরের মানুষের গ্রামের মানুষের ওপর নির্ভরতা বাড়বে।
ডিজিটালাইজেশনের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের আর প্রয়োজন হবে না। কাগজপত্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনের জন্য গ্রামের মানুষের শহরে ছুটোছুটি কমবে। বরং মুক্ত বাতাস, বিশুদ্ধ খাবার এবং বিনোদনের জন্য শহরের মানুষ এখনকার তুলনায় আরও বেশি গ্রামে আসবে। গ্রামগুলো সেভাবে সাজাতে পারলে গ্রাম হয়ে উঠবে পর্যটনেরও নতুন নতুন ক্ষেত্র। আধুনিক গ্রামের এ গুরুত্ব সমগ্র পৃথিবীর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনবে। অবশ্যম্ভাবি এ বাস্তবতা মেনে নিলে হতাশ হবার কিছু নেই। বরং একটা সুন্দর বিশ্বব্যবস্থার দিকেই আমরা ধাবিত হচ্ছি বলে মনে হয়। হচ্ছি কি আসলে?
শেষ কথা হচ্ছে— গ্রামে বিনিয়োগ করুন। গ্রামেও এখন ভালো শিক্ষক রয়েছে, শিক্ষার সমান সুযোগ রয়েছে। জেলা উপজেলার হাসপাতালের আধুনিকায়ন সম্ভব হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংকটটাও মোটামুটি কেটে যাবে। ফলে শহর নয়, গ্রামেই বরং আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ সহজ এবং সুন্দর। আপনি নিজের শেষ বয়সটাও গ্রামেই ভালো কাটবে। বড় শহরে একটি বড় বাড়ি রেখে সেটি ভাড়া দিয়ে উপার্জন করার বাস্তবতা অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আর থাকবে না। কিছু শৈল্পিক ধনী বাদ দিলে এমন একটি সময় আবার পৃথিবীতে আসবে যার কৃষি জমি বেশি সে বেশি ধনী। কৃষক, ডাক্তার এবং এমন কিছু অত্যাবশ্যকীয় পেশার কথা বাদ দিলে অনেক পেশাই পৃথিবীতে আর থাকবে না। বিষয়গুলো অনুধাবন করার এবং সে অনুযায়ী কাজ করার এখনই সময়।
Next Post

ফিরে দেখা একটি ঘটনা এবং বর্তমানের শপথ // ড. তাপস ঘোষ

সময়টা ছিলো গত শতকের নয়ের দশকের প্রথম দিকে— ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের একদম প্রথম দিকে। আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে মধ্য প্রদেশ ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম | যতদূর মনে পড়ে দীপালি সরকার বলে একটি মেয়ে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলো | দীপালি অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতো, বড় মনের মানুষ ছিলো এবং একই […]
ভারত