তৃণমূল কংগ্রেসের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ মূলত শহিদ স্মরণের অনুষ্ঠান৷ ১৯৯৩ সালে যুব কংগ্রেসের বিক্ষোভ মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চালানোয় ১৩ জন কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যু হয়৷ সেই সময় থেকে, এবং ১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করার পর এই দিনটি ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়৷ এই বছর, পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয় এবং দ্বিতীয়বার রাজ্যে ক্ষমতায় ফেরা উপলক্ষে এই দিনটি ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে পালনেরও ডাক দেওয়া হয়েছিল৷ প্রত্যাশা ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির ইঙ্গিত দেওয়ার পাশাপাশি, কিছু প্রশাসনিক বক্তব্যও রাখবেন৷ বিশেষ করে সম্প্রতি রাজ্যে আবাসন ও নির্মাণ শিল্পে সিন্ডিকেট চক্র এবং তোলাবাজির বিরুদ্ধে তিনি যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সেই নিয়ে আরও সুস্পষ্ট কিছু নির্দেশ থাকবে৷ সেই সঙ্গে থাকবে রাজনৈতিক বক্তব্যও, যেমনটা থাকে৷
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট বার্তা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
কিন্তু কার্যত দলীয় রাজনৈতিক সমাবেশের এই মঞ্চকে তৃণমূল নেত্রী বেছে নিলেন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এক স্পষ্ট বার্তা দেওয়ার জন্য৷ এবারে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী বামফ্রন্ট এবং বিজেপি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, বিশেষ করে বামেরা৷ যাঁকে তারা এবার বিরোধী রাজনৈতিক জোটের মুখ হিসেবে তুলে ধরেছিল, গত বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা সেই সূর্যকান্ত মিশ্র নিজেই এবার জিততে পারেননি৷ ঠিক যে দুর্দশা হয়েছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের, ২০১১ সালের পালাবদলের ভোটে৷ রাজনৈতিকভাবে এমন অপ্রাসঙ্গিক এবং বাতিল হয়ে যাওয়া বিরোধী বাম-কং জোট সম্পর্কে মমতা যে বেশি কথা খরচা করবেন না, সেটাও প্রত্যাশিত ছিল৷ বাকি থাকে বিজেপি, যাদের ক্ষমতা পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্বহীন হয়েও হতে পারে না, কারণ কেন্দ্রে ক্ষমতায় বিজেপি সরকার৷ সেই বিজেপির মোকাবিলা করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু হাতুড়িটা মারলেন একেবারে মাথায়! যে হিন্দুত্ববাদী ভাবনাকে বিজেপি সুকৌশলে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন৷
কেউ ছাগলের মাংস খায়, কেউ গরুর – তাতে অন্যের কী?
এবং মমতার বিরুদ্ধতা লোকের কাছে পৌঁছাল একেবারে সোজাসাপ্টা ভাষায়, যে ভাষাটা সাধারণ মানুষ, এমনকি নিরক্ষর মানুষও বুঝতে পারে৷ মমতা বললেন, আপনারা সাবধান থাকবেন৷
বিজেপির মদতে ওদেরই কিছু শাখা সংগঠন বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানতে চাইছে, বাড়িতে কটা গরু আছে৷ আপনারা পাল্টা জানতে চাইবেন, আপনি কেন জানতে চাইছেন? আপনাদের কী অধিকার আছে এ সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার? এর পরই মমতার স্পষ্ট উচ্চারণ, কেউ ধুতি পরবে, কেউ লুঙ্গি৷ যে পরবে, তার ইচ্ছা৷ কেউ ছাগলের মাংস খেতে ভালোবাসে, কেউ গরুর৷ অন্য কেউ কেন বলে দেবে আমি কী পরব, কী খাব! এ রকম যদি চলতে থাকে, তা হলে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা পথে নামবে৷ রাজনৈতিকভাবে এই বদমাইশির মোকাবিলা করা হবে৷ এখানে লক্ষ্যণীয় যে মমতা প্রশাসনিক মোকাবিলার কথা কিন্তু একবারও বলেননি৷ বরং বুঝিয়েছেন, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ করার দরকারও মনে করছেন না তিনি৷ তার আগে মানুষের সচেতন প্রতিরোধেই আটকে যাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর এই অপচেষ্টা৷
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে, থাকতে হবে সজাগ
সামগ্রিকভাবে নিরাপত্তা, সুরক্ষার দায়িত্বও মমতা তুলে দিতে চেয়েছেন মানুষের হাতে৷ প্রতিবেশী বাংলাদেশে সম্প্রতি যে হিংসাত্মক জঙ্গিপনা চলছে, তার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, সমস্ত পাড়া, মহল্লাকে সজাগ, সতর্ক থাকতে হবে৷ কোনো সন্দেহজনক লোকজন, কাজকর্ম, গতিবিধি দেখলেই খবর দিতে হবে পুলিশকে৷ অচেনা কাউকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আগে, তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে স্থানীয় থানাকে যাচাই করার জন্য দিতে হবে৷ সন্ত্রাসবাদ, বা সন্ত্রাসী প্রবণতা রোখার কাজ যে কেবল প্রশাসনের না, সামাজিক স্তরেও তার প্রতিরোধ থাকতে হবে, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর এই উদ্যোগ এই কারণেই অসাধারণত্ব দাবি করছে যে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থান এর আগেও নিশ্চিত করতে চেয়েছে সরকার, বা দল৷ কিন্তু এভাবে তার দায়িত্ব সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে, তাদেরকেও সমান দায়িত্বশীল করে তোলার এই সহজিয়া চেষ্টা আগে চোখে পড়েনি৷ কারণ, এ কথা কে না জানে যে প্রতিরোধের ময়দানে দাঁড়িয়ে তত্ত্বকথা নয়, মানুষের সচেতনতাই একমাত্র অস্ত্র৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সেই অমোঘ অস্ত্রেই শান দিয়ে রাখছেন৷