প্রাণতোষ তালুকদার
রাজধানী ঢাকার রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের ২য় তলার সেমিনার কক্ষে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক’ প্রদান, স্মারক বক্তৃতা ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। ২৬ জুন সকাল ৮টায় মিরপুর জাহানারা ইমামের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়।
২৬ জুন ২০১৮, বিকাল সাড়ে ৩টায় রাজধানী ঢাকার রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের ২য় তলার সেমিনার কক্ষের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ নাসিম এমপি। তিনি বলেন, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। তিনি স্মরণ করেন, সেই যে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের বিরুদ্ধে একটি প্রতিকী ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করেছিলো এবং সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটেছিলো। তৎকলীন সরকার সেখানে ১৪৪ ধারা জারী করে এবং পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে রেখেছিলো। এসব করে বিএনপি সরকার এদেশের জনগণকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। ১৪৪ ধারা ও পুলিশ বেষ্টনী ভেঙ্গে এদেশের জনগণ সেই প্রতিকী ফাঁসির মঞ্চ দেখতে গিয়েছিলো। মাননীয় মন্ত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অবদানের কথা প্রশংসাভরে স্মরণ করেছেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ নাসিম এমপি আরও বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সহায়তায় ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে এবং তা আজও চলমান আছে। তিনি বলেন, ’৭১-এর খুনীদের ক্ষমা নেই। আগামী নির্বাচনেও যাতে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসতে পারে সেদিকে সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি এই বাংলাদেশে আবারও সেই অপশক্তি ক্ষমতায় আসে তাহলে আবারও এদেশে সেই মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক, জঙ্গীবাহিনী গড়ে উঠবে। তাই নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামীলীগকে জয়যুক্ত করতে হবে।
লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ২৭ বছর আগে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের যে নাগরিক আন্দোলন সূচিত হয়েছিল বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে আজ তা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। আমাদের আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে এবং ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছে। তবে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কর্তৃক জারিকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সাম্প্রদায়িক উপাদান সংবিধানে রয়ে গেছে যা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থী। সংবিধানের এই গোঁজামিল এবং সমাজ ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, সাময়িকভাবে মাত্র আড়াই বছর আমাদের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন জাহানারা ইমাম। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪-এর ২৬ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২৬ জুন শহীদজননীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছর আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’, আলোচনা সভা এবং ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক’ প্রদানের আয়োজন করি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রতি বছরের মতো এ বছরও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক’ প্রদান করা হয়েছে। এ বছর ব্যক্তি হিসেবে বরেণ্য কথাশিল্পী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক-কে এবং সংগঠন হিসেবে ‘ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ট্রাস্ট’-কে জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক প্রদান করা হয়েছে।
এ বছর ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’ প্রদান করেছেন বরেণ্য কথাশিল্পী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক। তাঁর বক্তৃতার বিষয়: ’৪৭-এর দেশভাগ এবং বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।’ এটি ১৬ পৃষ্ঠায় পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের মানচিত্র বার বার কাটাছেঁড়া হয়েছে। সাধারণ চলিত একটা কথা আছে- ‘লাশ ভাসা বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা।’ তবে বার বার এই বিভাজনের দায় বাংলার জনসাধারণের নয়। সাম্প্রদায়িক রাজনীরিত ঘূর্ণাবর্তের দুষ্টচক্রের ফলেই বার বার এই বিভাজন। ১৯০৫ সালে বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ ঘটেছিল ইংরেজ শাসকদের উপনিবেশী স্বার্থে।
১৯৪৭-এর বিভাজন ছিল মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, ভারতবর্ষে মুসলিম আর হিন্দু দুটি পৃথক জাতি, অখণ্ড ভারতে তারা একসঙ্গে থাকতে পারে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যূপকাণ্ঠে বলি দেয়া হয়েছিল ধর্ম-ভাষা-বর্ণ-বিত্ত নির্বিশেষে ভারতবর্ষের প্রায় ২০ লক্ষ নিরীহ মানুষকে।
তবে আমরা সবাই জানি সর্বশেষ যে বিভাজন তাকে কেউ বিভাজন বলে না, মুক্তিযুদ্ধ বলে। এই বিভাজনের ফলে উপনিবেশী শোষণ উচ্ছেদ করে এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়ছে, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক এক রাষ্ট্র এখন বাংলাদেশ। প্রণয়ন করা হয়েছে এক অনন্যসাধারণ সংবিধান। সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, কাজী মুকুল, সাধারণ সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক কাজী কামরুজ্জামান, রিসার্চ ইনিসিয়েটিভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক শহীদ সন্তান ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা ও নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া। সভায় সভাপতিত্ব করেন নির্মূল কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক অজয় রায়।