শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুল হত্যাচেষ্টা মামলায় আটক আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য সুমন হোসেন পাটোয়ারি জঙ্গি সংগঠনটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, “আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আপাতত কৌশল হলো, তারা বড় কোনো অপারেশনে যাবে না। ছোট ছোট স্লিপার সেল দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটাবে। এরপর তাদের বড় আক্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা।”
গত বছর রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে ঢুকে টুটুলকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় বুধবার রাতে ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সুমনকে (২০)। আনসারুল্লাহ সদস্য এই তরুণ সিহাব, সাকিব, সাইফুল নামেও পরিচিত বলে পুলিশ জানিয়েছে।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর বিকালে শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলার সময়ই শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে খুন করা হয়েছিল প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে। দুটি হত্যাকাণ্ডেই আনসারুল্লাহ সদস্যরা জড়িত বলে গোয়েন্দারা সন্দেহ করে আসছিলেন।
সুমনকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, “সুমন প্রকাশক দীপন হত্যার ব্যাপারেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।”
ওই দুটি হামলার পর সন্দেহভাজন যে ছয় জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে গত মে মাসে পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে, তাদের মধ্যে সুমনও ছিলেন। তার বিষয়ে তথ্য দিতে দুই লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
গত দেড় বছরে দীপন ও টুটুলের উপর হামলার আগে শাহবাগে হত্যা করা হয় লেখক অভিজিৎ রায়কে। লেখালেখির জন্য হুমকির মুখে থাকা প্রবাসী অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন টুটুল ও দীপন উভয়ই।
অভিজিতের পর বেশ কয়েকজন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট খুন হন। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত হন বিদেশি, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান যাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষু, শিয়া ও আহমদিয়া মুসলিম। সর্বশেষ একই কায়দায় চট্টগ্রামে খুন হন পুলিশ সুপারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু।
এসব হামলা-হত্যাকাণ্ডের জন্য নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও জেএমবিকেই দায়ী করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এই আনসারুল্লাহ দলে সুমন দেড় বছর ধরে যুক্ত বলে তারা তথ্য পেয়েছেন।
ছয় বছর ধরে নিষিদ্ধ আনসারুল্লাহর সাংগঠনিক কাঠামো, কীভাবে তারা কাজ করছে, এসব নিয়ে সুমন তথ্য দিচ্ছেন বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা মাশরুক।
আনসারুল্লাহর কৌশল সম্পর্কে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল সাংবাদিকদের বলেন, “তারা হত্যার পরিকল্পনার আগে নিজেদের গঠন করা একটি বোর্ডে বসে কাকে হত্যা করা হবে, কারা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে, সেটা ঠিক করে। এরপর তারা ঠিক করে, কারা হত্যায় সরাসরি অংশ নেবে। তাদের মোটিভেট করা হয়, প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।”
দুই প্রকাশকের উপর হামলার আগে সুমনসহ কয়েকজনকে মহাখালীর একটি বাসায় ‘মোটিভেশনাল ট্রেইনিং’ দেওয়া হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
“সুমন প্রায় দেড় বছর ধরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িত। তার নেতারা তাকে ফোন করে বলেছিল, তোমাকে একটি ‘বড় কাজ’ করতে ঢাকায় আসতে হবে। সুমন রাজি হলে তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।”
ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডে দণ্ডিত হয়ে কারাবন্দি মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানী আনসারুল্লার মূল নেতা হলেও তাদের আরও নেতা রয়েছেন বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।
জঙ্গিরা হত্যার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই চাপাতির মতো ধারাল অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। টুটুলের উপর হামলার সময় তাকে চাপাতির তিনটি আঘাত সুমন করেছিলেন বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাশরুক জানান।
এই উপ-কমিশনার বলেন, “টুটুলকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে (সুমন) স্বীকার করেছে।
“জিজ্ঞাসাবাদে সে বলেছে, টুটুলকে সে নিজে তিনবার কোপ দিয়েছিল। ওই ঘটনায় তারা অংশ নিয়েছিল পাঁচজন, ব্যবহার করেছিল চাপাতি। পরে পাশের একটি মসজিদে ঢুকে সেই রক্তাক্ত চাপাতি ধোয়ার কথাও সুমন বলেছে।”
লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে টুটুলের উপরের হামলার সময় সেখানে তার সঙ্গে থাকা ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকেও কুপিয়ে জখম করা হয়।
মাশরুক বলেন, সেদিন আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের সদস্যরা দুই জায়গায় দুজন প্রকাশককে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। একটিতে তারা সফল হতে পারেনি। ওই দলেই ছিলেন সুমন।
“সুমনের দলের সমন্বয়কারী ছিলেন শরীফ। দীপনকে হত্যাকারী দলের সমন্বয়ক ছিলেন সেলিম। তারা আনসাররুল্লাহ বাংলা টিমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে।”
তার কয়েক মাস আগে তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি এলাকায় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যার পরিকল্পনারও শরীফ সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে শরীফ বলেও জানান তিনি।
টুটুলের উপর হামলার পর সুমন চট্টগ্রামে গিয়ে একটি ওষুধের দোকানের বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, সুমনের বাড়ি চাঁদপুরে হলেও তিনি বড় হয়েছেন চট্টগ্রামের হালিশহরে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন তিনি।
গত ১৯ ফ্রেব্রুয়ারি রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুল ও মোহাম্মদপুরে দুটি ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযান চালানোর পর তার সূত্র ধরে সুমনকে গ্রেপ্তারের পথ তৈরি হয় বলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল জানান।
আনসারুল্লাহর ‘সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ ও ‘বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহৃত ওই দুই আস্তানা থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যে ঢাকার আশকোনা ও দক্ষিণখানে এবং ট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আরও সাতজনকে।
এরপর এ সপ্তাহে কামরাঙ্গীরচর থেকে গ্রেপ্তার দুই আনসারুল্লাহ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যেই ঢাকার বিমানবন্দর থানার ওভারব্রিজ এলাকার একটি বাসস্ট্যান্ড থেকে বুধবার রাতে সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে পুলিশ জানায়।
সুমনের কাছ থেকে কোনো অস্ত্র পাওয়া না গেলেও আস্তানা দুটি থেকে অন্তত আটটি চাপাতি উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা।