সম্প্রদায় ভিত্তিক পর্যটন সম্ভবত পর্যটন পরিচালনার প্রাচীনতম উপায়। এক্ষেত্রে সম্প্রদায় বলতে বোঝায় একদল লোক একই জায়গায় বসবাস করে এবং যাদের মধ্যে অনেক কিছুতে মিল রয়েছে, তা সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বা কেবল ফসলি জমি এবং এর বাস্তুতন্ত্রের মাধ্যমেও হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা কৃষক, জেলে, আদিবাসী, কারিগর বা প্রত্যন্ত, সুন্দর এবং ভালোভাবে সংরক্ষিত গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে। তাদের জমি এবং ঐতিহ্যের মধ্যে পর্যটন সম্ভাবনা এতটাই স্পষ্ট থাকে যে, তারা ভ্রমণকারীদের হোস্ট করার জন্য অবকাঠামো তৈরি করার এবং সম্প্রদায়-নেতৃত্বাধীন বা এককভাবে কিছু প্রকল্প স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রায়শই তাদের লক্ষ্য থাকে এটার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা এবং পর্যটনের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ করা।
কোনো একটি বিশেষ সম্প্রদায় (প্রধানত পেশাগত) বা লোকালয়-ভিত্তিক পর্যটন হলো এক ধরনের পর্যটন যেখানে স্থানীয় সম্প্রদায় পর্যটকদের তাদের লোকালয়ে আমন্ত্রণ জানায়, তাদের সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার জন্য এবং উপভোগ করার জন্য। এটি টেকসই পর্যটনের একটি রূপ যা ভ্রমণকারীদের স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযোগ এবং ভাব বিনিময়ের সুযোগ দেয়, একইসাথে ভ্রমণকারীরা স্থানীয় সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ট হয়। ভ্রমণকারীরা অন্য সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং রীতিনীতি অনুভব করতে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। হোমস্টে, খামার পরিদর্শন, একসাথে রান্না করা এবং কারুকাজ করা, গল্প বলা, গ্রাম ভ্রমণ এবং আরও অনেক কিছু সম্পর্কে চিন্তা করা যায়, যা ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে। এ ধরনের কার্যকলাপ অন্য সংস্কৃতি, এর বিশ্বাস এবং সামাজিক নিয়ম সম্পর্কে সচেতনতা এবং জ্ঞান বৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি করে। আমরা যদি ভবিষ্যতে একটি টেকসই পর্যটন শিল্প তৈরি করতে চাই, যেখানে আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্থানীয় সংস্কৃতি এবং প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখতে চাই, তবে সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন আমাদের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার— যে জিনিস এবং বিষয়গুলো কোনো একটি লোকালয়ের জন্য খুব স্বাভাবিক বিষয় সেটিই দূরের ভ্রমণকারীদের জন্য হয়ে উঠতে পারে আশ্চর্যজনক এবং ভালোলাগার বিষয়। এ ধরনের ভ্রমণ প্রকল্পগুলি আবাসন, ভ্রমণ (পাখি দেখা, মাছ ধরা, ট্র্যাকিং, ঘোড়ায় চড়া ইত্যাদি), ঐতিহ্যবাহী গ্যাস্ট্রোনমি, ইকোট্যুরিজম এবং সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মতো পরিষেবাগুলি অফার করে। এক্ষেত্রে সম্প্রদায় তাদের পরিবেশ এবং উপার্জন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একটি ন্যায্য-বাণিজ্য যুক্তি প্রয়োগ করে, তাই পর্যটকরা স্বচ্ছতা এবং সমতার প্রেক্ষাপটে উচ্চ মানের পরিসেবা পেয়ে থাকে। বিনিময়ে ভ্রমণকারীরা ন্যায্য মূল্য প্রদান করে। ভ্রমণকারীদের জন্য এটি একটি প্রকৃত এবং সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা। তারা স্থানীয় ঐতিহ্য জানতে পারে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় এবং অবারিত প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্র দেখার সুযোগ পায়।
চিলির আতাকামা মরুভূমি ভ্রমণে (চিলি) ভ্রমণকারীরা মরুভূমির মাঝখানে লিকান আন্তে আদিবাসীদের সাথে থাকে। প্রামাণিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দর্শকরা লিকান আন্তের পৈতৃক ঐতিহ্য এবং প্রকৃতির সাথে তাদের দৃঢ় যোগসূত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। অনুরূপ অভিজ্ঞতা কলম্বিয়ার আমাজন রেইনফরেস্ট এবং সিয়েরা নেভাদা এবং মেক্সিকোর মায়ান রিভেরার আদিবাসীরা বা সালটা (আর্জেন্টিনা) এর সুন্দর মরুভূমিতে বা অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভূমি কোস্টারিকাতে গ্রামীণ সম্প্রদায়ের দ্বারা অফার করা হয়। এ ধরনের ভ্রমণ আয়োজনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ দিক হলো ভ্রমণকারীদের তাদের হোস্টদের সাথে ব্যক্তিগত লিঙ্ক তৈরি করা এবং এই পর্যটন কীভাবে সম্প্রসারিত হয় এবং কীভাবে তাদের এবং তাদের সম্প্রদায়কে (এলাকাবাসী) ক্ষমতায়ন করছে তা দেখার সুযোগ।
সম্প্রদায়-ভিত্তিক পর্যটন সফল হওয়ার জন্য নিম্নলিখিত তিনটি মানদণ্ড অবশ্যই পূরণ করতে হবে:
১. সম্প্রদায়কে ভালোভাবে প্রস্তুত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, কারণ, এটি সম্প্রদায়ের ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলবে। এজন্য সম্প্রদায়কে প্রস্তুত করে নিতে হবে। তাদের মধ্যে স্বতস্ফুর্ততা তৈরি হতে হবে।
২. সম্প্রদায়ের সদস্যদের হাতে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব থাকতে হবে।
৩. এবং অবশেষে, এটি সম্প্রদায়ের জন্য সুবিধা তৈরি করবে। একটি উদাহরণ যেমন, একটি স্কুল যা পর্যটন লাভের অংশ দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। এতে একাধিক উদ্যোক্তা একসাথে কাজ (যেমন, গাইড, কারিগর, রেঁস্তোরা এবং কৃষকরা তাদের কাজ দেখায় এবং জেলেরা পর্যটকদের মাছ ধরতে শেখায়, বিনিময়ে হয়ত ঐ মাছটা একটু বেশি দামে কিনে নিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়, বা কেউ কেউ জেলে পল্লীতে কোনো সাহায্য করতে তৎপর হয়) করতে পারে, যাতে সবাই উপকৃত হয়।
যদিও সম্প্রদায়-ভিত্তিক পর্যটনে অনেক উপাদান জড়িত থাকতে পারে, সাধারণভাবে বলতে গেলে চারটি প্রধান বিভাগ রয়েছে, যা তাদের অবস্থান এবং কার্যকলাপের দৈর্ঘ্য অনুসারে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে:
১. একা একা অভিজ্ঞতা নেওয়া (ঘন্টা কয়েক বা পুরো দিন পর্যন্ত)
২. হোমস্টে অভিজ্ঞতা (১-৩ রাত)
৩. একাধিক সম্প্রদায়ের সাথে অভিজ্ঞতার একটি সফর (৭-১৪ রাত)
৪. স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তাদের সাথে কাজ করা (যে কোনো সময়কাল)।
একইসাথে কমিউনিটি বেসড্ ট্যুরিজম হতে পারে কোনো সম্প্রদায়ে সাংস্কৃতিক উপাদান নির্ভর পর্যটন, যেটাকে বলা হচ্ছে কালচারাল ট্যুরিজম, প্রকৃতি নির্ভর পর্যটন, যেটাকে বলা হচ্ছে নেচার ট্যুরিজম, এবং আরেকটি হচ্ছে অ্যাডভেঞ্চারাস ট্যুরিজম।
বাংলাদেশেও কমিউিনিটি ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ হওয়ায় গ্রামগুলোর রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট। বাংলাদেশ ছোট্ট দেশ হলেও রয়েছে ২৪টি নৃগোষ্ঠী. মতান্তরে ৩২টি। প্রতিটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর রয়েছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। সংস্কৃতির এ মেলবন্ধন বাংলাদেশকে এক বিশেষ বৈশিষ্ট দান করেছে। কমিউিনিটি ট্যুরিজমই পারে কোনো এলাকার নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট এবং সংস্কৃতির কোনো ক্ষতি না করে প্রতিটি এলাকাকে ট্যুরিস্ট স্পটে পরিণত করতে।
ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ খুব বড় দেশ না হলেও বাংলাদেশের রয়েছে সেইন্ট মার্টিনের মতো একটি দ্বীপ, সুন্দরবনের মতো একটি ম্যানগ্রোভ বন, এবং তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য অঞ্চল, একইসাথে রয়েছে দুটি সমুদ্র তট। চা বাগান এবং ছোট ছোট টিলা পাহাড় নিয়ে সিলেট অঞ্চলেরও রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট। শুধু দর্শনীয় স্থানগুলোকে কেন্দ্র করেই নয়, কৃষিকে ভিত্তি হিসেবে ধরতে পারলে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম হতে পারে এক একটি কমিউনিটি ট্যুরিজমের কেন্দ্র।
এক্ষেত্রে খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের ঢাংমারি গ্রামের কথা বলা যায়। সুন্দরবন ঘেষা এ গ্রামটিতে একটি এনজিও কয়েক বছর আগে বেশ কয়েকটি ক্লাস্টার ইকো ফ্রেন্ডলি কটেজ তৈরি করেছিল। পরিবেশের কোনোরূপ ক্ষতি না করে এ কটেজগুলো তৈরি হয়েছিল। নয়টি ক্লাস্টার ব্যর্থ হলেও একটি ক্লাস্টার টিকে আছে। যেটি টিকে আছে, সেটি টিকে থাকার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়— এলাকার দুটি পরিবার, কয়েকটি ট্যুর গ্রুপ এগিয়ে আসার কারণেই এটি টিকে গেছে। পাশাপাশি ট্যুরিস্টদের খাবার যখন গ্রামের বাড়ি থেকে আসছে তখন বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে কমিউনিটি বেজড্ হয়েছে। এখানে ট্যুরিজমের জন্য কোনো দোকান বা রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠেনি। প্রাকৃতিক পরিবেশ, নির্জনতা এবং এলাকার মানুষকে কোনোরূপ প্রভাবিত না করেই গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে একটি ট্যুরিস্ট স্পট। একইসাথে কমিউনিটি বেজড্ এ ট্যুরিস্ট কটেজের কারণে কমিউনিটি লাভবান হচ্ছে। একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে, পাশাপাশি গ্রামের পিছিয়ে থাকা মানুষ সুযোগ পাচ্ছে কম বেশি দেশ বিদেশের বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে মেশার।
কমিউিনিটি ট্যুরিজমের আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ বান্দরবানের রুমা উপজেলার মুনলাই পাড়া। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িই এক একটি কটেজ। ট্যুরিস্টরা গিয়ে যেকোনা বাড়িতে থাকতে পারে, তাদের সাথে পছন্দমাফিক খাবার অর্ডার দিয়ে খেতে পারে, গ্রামটা ঘুরে দেখতে পারে। পাহাড়ি রান্না, ট্রেকিং, কায়াকিং সহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা তারা ট্যুরিস্টদের জন্য রেখেছে। মুনলাই গ্রামটিকেই বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম বলা হচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে ঐ গ্রামের মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায়।
শুধু এই একটি গ্রাম নয়, সঠিকভাবে পরিকল্পনা করতে পারলে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠতে পারে এরকম এক একটি মুনলাইপাড়া। পরিচ্ছন্নতা দিয়েই শুরু করা যেতে পারে, এরপর একটি গ্রামের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং শিক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করার পর ভাবা যেতে পারে কীভাবে গ্রামটি বাইরের মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক খাবারের কারণে হতে পারে, নির্জন পরিবিশে কয়েকদিন থেকে প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে গ্রামের মানুষের সাথে সন্ধ্যায় তারা বিনোদনমূলক গান-বাজনায় অংশ নিতে পারে। এভাবে বিভিন্ন সৃষ্টিশীল চিন্তা করে বাংলাদেশের গ্রামগুলো পরিবর্তন করে দেওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকারও এখন এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। গত ২৮ জুলাই (২০২০) বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড আয়োজিত এক অনলাইন কর্মশালা থেকে বলেন, শেরপুর জেলার পাহাড়ী এলাকার জীবনযাত্রা ও প্রকৃতি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে চায় সরকার। এজন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সেখানকার একটি গ্রামে কমিউনিটি ট্যুরিজম চালুর নির্দেশনা দেন তিনি। এ ধরনের নির্দেশনার প্রায়োগিক গুরুত্ব থাক বা না থাক, এর ফলে কমিউনিটি ট্যুরিজমের জন্য এলাকাভিত্তিকভাবে কাজ করার জন্য অনেকে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার পাশাপাশি ইউরোপও গত কয়েক দশক ধরে কমিউনিটি ট্যুরিজমের বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে। ফলে ভালোভাবে প্রচার করতে পারলে এক্ষেত্রে আমাদের দেশ অনেক বিদেশী পর্যটক টানতে সক্ষম হবে। এশিয়াতে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে এ ধরনের বেড়ানোর চল অনেক পুরনো, তবে কাঠামোবদ্ধভাবে বা ঠিক ‘কমিউনিটি ট্যুরিজম’ নাম নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে এটি ঘটছে মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রসার লাভ করার পরে। গোটা বিশ্বেই প্রযুক্তি দুনিয়ার অগ্রসরের সাথে কমিউনিটি ট্যুরিজমের অগ্রগতির একটি সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে কমিউনিটি ট্যুরিজম জনপ্রিয়তা লাভ করছে মাত্র কয়েক বছর হলো। ভ্রমণপ্রেমী তরুণদের হাত ধরেই মূলত এ ভিত্তি গড়ে উঠছে।