Headlines

অব্যক্ত বিষাদ ।। সন্ধ্যা নাথ

বাংলাদেশ

গণহত্যা

শশুরবাড়ি যাবার সময় বাবা তানপুরাটা সঙ্গে দিয়ে দিলেন। গান ছাড়া আমার জীবন চলত না। বাগেরহাট থেকে দড়াটানা নদী পেরিয়ে বিলকুল বা পিঙ্গেরিয়া আমার জন্মভূমি, আমার বাপঠাকুরদাদার গ্রাম। মাটির রাস্তার ধারে দিগন্ত জোড়া ধানের মাঠ। শীতের ফসলহীন শূন্যমাঠে খেলার বন্ধুদের নিয়ে ছোটা আর ছোটা, না জিরিয়ে যতদূর যাওয়া যায়। ফেরার পথে খোলা গলায় গান। বর্ষার ঘন কালোমেঘ ঝমঝম করে ঝরে পড়ত ঘরের টিনের চালে। জানালা দিয়ে দেখা যেত বৃষ্টির তালে তালে হাওয়ায় দুলছে বাঁশবন, গলা খুলে গান ধরতাম। গ্রামের প্রাইমারিতে পাঠ শেষ করে শহরে এলাম, বাগেরহাট শহরে। বাবা বাগেরহাট হাইস্কুলের শিক্ষক মণীন্দ্র নাথ। আমাকে ভর্তি করে দিলেন মনমোহিনী গার্লস হাইস্কুলে। গান শেখার ব্যবস্থাও করে দিলেন। কিছুদিন বাদেই গুরু পেলাম শুকলাল চক্রবর্তীকে। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে তখন উনিই বাগেরহাটের ওস্তাদ। গ্রাম থেকে শহরে এনে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে আসার সংগীতগুরু শুকলাল চক্রবর্তী বাবাকে সব সময় ধন্যবাদ জানাতেন।
হায়ার সেকেন্ডারি শেষ করার আগেই বাবা আমাকে পাত্রস্থ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিয়ে হলে গান বন্ধ হয়ে যাবে, এই দুর্ভাবনায় আমার মন বিষণ্ন হয়ে যেত। বিএ ক্লাসে পড়বার প্রথম বছরে ১৯৬৮-র মার্চে আমার বিয়ে হলে গেল। স্বামীর বাড়ি চাকসি বারুইপাড়া। তিনি খুলনার সেন্ট জোশেপ স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক, নৃপেন দেবনাথ।
মার্চ মাস ফাল্গুন মাস, বসন্ত কাল। স্বামী আমাকে বিষণ্নতার জট থেকে বের করে স্বপ্নের মায়াজাল বুনে দিলেন চোখে। খুলনায় ছোট্ট ভাড়া করা বাসার জানালা থেকে সন্ধ্যাবেলা শুক্লপক্ষের একফালি চাঁদের আলো তেরছা হয়ে এসে পড়ত ঘরের কোণে। আমি তানপুরাটা কোলের ওপরে তুলে চোখ বন্ধ করে গান ধরতাম—‘লহ তুমি পূজা মেরি শ্যাম গিরিধারি।’ উনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর আর ভালো মেয়ে আমি, আর আমার গানই সব শিল্পীদের থেকে শ্রেষ্ঠ গান। আমি গান গাইতাম, উনি কাছে বসে হাত দিয়ে ধরে থাকতেন আমাকে, যতক্ষণ গাইতাম, সবটা সময়। সারা বাড়িতে আর কেউ নেই, শুধু আমরা দু’জন। কোনও কোনও সন্ধ্যায় দু’জনে উঠে যেতাম ছাদে। অন্ধকারে রূপসা নদী দিয়ে সারি সারি নৌকায় জ্বলতে থাকা আলোর মালা দূরে চলে যেত। ভেঁপু বাজিয়ে ঢেউ তুলে দূরে চলে যেত একের পর এক লঞ্চ। মাঝে মাঝে আমাদের ছোট্ট সংসারে এসে হাজির হতেন সেন্ট জোসেপ স্কুলের বয়স্ক শিক্ষক, মুরারী দেবনাথ। উনি প্রথম যেদিন এলেন, তখন সন্ধ্যা নেমেছে। এ সময় তাঁকে মোটেই আশা করিনি, কিন্তু ক্রমে তিনি আমাদের দু’জনের সংসারের অভিভাবক হয়ে গেলেন। তাঁর অভিভাবকত্বে আমার লেখাপড়াটা আবার শুরু হল, আমি খুলনার বয়রা গার্লস কলেজে ভর্তি হলাম। দিনের পর দিন কাটল, সপ্তাহের পর সপ্তাহ। কেটে গেল পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, সম্মান আর আশ্বাসের এক বছর। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে আমার একটা ফুটফুটে ছেলে হল। একটু সুস্থ হয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে গরম কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলাম। ঘুমের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট পায়ের তলায় আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলে পা’টা মুড়িয়ে নিত। ছেলে পেয়ে ওর বাবা খুব খুশি, মা-বাবা ছিল না, সন্তান এবার তাঁকে নতুন বাঁধনে বেঁধে ফেলল।
১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে আমি এক কঠিন অসুস্থতায় আক্রান্ত হলাম। প্রকৃতপক্ষে আমার কী হয়েছিল, মানসিক ভারসাম্য হারাবার কারণে তা আমার জানা ছিল না। আর যাঁর কাছ থেকে জানতে পারতাম আমার স্বামী, তিনি এসব জানবার সুযোগই পেলেন না। পরে মা-বাবার কাছ থেকে কিছু কিছু জেনেছিলাম যে, শুধু মানসিক ভারসাম্য নয়, আমার শরীরও পক্ষঘাতাক্রান্তদের মতো অচল হয়ে গেছিল। মাসখানেকের চিকিৎসায় আমি আস্তে আস্তে হাঁটাচলার শক্তিটুকু ফিরে পাই। ছেলেকে দেখবার দায়িত্ব নিলেন আমার এক নিকটাত্মীয়া। এই সময় বাংলাদেশ গণআন্দোলনে উত্তাল। কিন্তু সে সকল কথা আমার কিছুই মনে নেই। শুনেছি পাকিস্তানি সৈন্যরা খুলনা দখল করার আগেই মরারী দেবনাথ আর সেই নিকটাত্মীয়ার সহযোগিতায় আমার স্বামী আমাকে ও ছেলেকে নিয়ে তাঁর নিজের গ্রামের বাড়ি বারুইপাড়া যান। কিছুদিন পরে সেখান থেকে পিঙ্গরিয়া আমার বাপের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। তখন সমস্ত বাংলাদেশ একদিকে খুন, রাহাজানি, লুঠপাট, ধর্ষণে উন্মত্ত, অন্যদিকে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। হিন্দুগ্রামগুলো রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে ছন্নছাড়া। দিনেরাতে অতর্কিত হামলা চলছে। রাতে পুরুষেরা প্রাণভয়ে ঘরে থাকতে সাহস পান না। আমার বাবা এবং বাড়ির অন্য পুরুষরা রাতে জঙ্গলে বসে থাকেন। কিন্তু যেহেতু আমি অসুস্থ, তাই ছেলেকে ফেলে আমার স্বামী একদিনও তাঁদেও সঙ্গী হলেন না। তখন আমি বেশ হাঁটাচলা করতে পারছি। এই সময় একদিন হঠাৎ আমার চেতনা ফিরে এল, এ জীবনে সে চেতনা আমি আর হারাইনি!
একাত্তরের জুলাই মাসের কোনো এক রাত ছিল। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। বাপের বাড়ি আসা থেকে ছেলে দেখাশুনা করতেন মা। সে রাতে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম। আমাদের কাঠের দোতলা বাড়িটার ভিতরে তখন অনেকগুলো লোক। ছেলেটা মায়ের কোলে, সেই অবস্থায় মা’কে ধরে কয়েকজন খুব মারধর করছে; জিজ্ঞাসা করে উত্তর চাইছে কিছুর। আমি তাড়াতাড়ি মা’র কাছে পৌঁছালাম। আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা তখন মা’কে ছেড়ে আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করল। আমি বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরতে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। বুঝতে পারলাম বাড়িতে আছি। চারপাশে তাকিয়ে দেখি—ঘরে কেউ নেই। স্বামীর কথা মনে পড়ল। আমার স্বামী কোথায়, ছেলে? মা-বাবা কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালাম। খোলা দরজা দিয়ে মা’কে ডাকতে ডাকতে বাইরে বেরিয়ে দেখি আধা আলো অন্ধকারে কে যেন পড়ে আছে উঠোনে। দু’একজন কারা নিশ্চুপ হয়ে বসে।
উঠোনে নেমে জিজ্ঞাসা করলাম—‘কী হয়েছে? তোমরা এত রাতে বাইরে কী করছ?’ আমার সাড়া পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন ঠাকুরমা। ছুটে এসে দু’হাত বাড়িয়ে ধরলেন আমাকে।
ঠিক সেই সময় আমার পুরো সম্বিৎ ফিরে এল। ঠাকুরমার বিলাপে বুঝলাম, এ বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসে রাজাকারদের হাতে নৃশংসভাবে আক্রান্ত হয়েছেন আমার স্বামী। তাই তিনি উঠোনে কাটা কলাগাছের মতো পড়ে আছেন। ভাবলাম ওকে বাঁচাতে হবে; এক্ষুণি একজন ডাক্তার দরকার। প্রাণ তুচ্ছ করে যে দু’চারজন পাড়া প্রতিবেশী বসেছিলেন, শোক বুকে চেপে, আমি তাদের প্রত্যেকের পায়ে ধরলাম, একটুখানি ওষুধ আর একজন ডাক্তারের জন্যে। কেউ জায়গা থেকে এক পা’ও নড়ল না। কেন না তারা জানত তাদের কিছু করার নেই। তাই আমি একুশ বছরের ‘নারী’, বুলেটে ঝাঁঝরা আমার স্বামীর রক্তমাখা শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে উঠোনে পড়ে রইলাম বাকি রাত। অন্ধকার পাতলা হল। ওঁর শান্ত বিস্মিত পলকহীন খোলা দুটো চোখ আর চারপাশের স্তব্ধ মানুষের ভিড় দেখে বুঝলাম, আমার অব্যক্ত বিষাদ বইতে হবে চিরকাল।
সেদিন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসে সমস্ত গ্রাম ভীত সন্ত্রস্ত। শুধু আমার স্বামীকে নয়, আমাদের পাশের গ্রাম বিছটের লোচন দত্তকেও সে রাতে নর-পিশাচেরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তবু পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন মুসলমান প্রতিবেশী বাড়ির এক পাশে গর্ত খুড়ে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল তাঁকে। আমি জ্ঞান হারালাম।
আমার স্বামী নৃপেন দেবনাথ, প্রকৃত শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ছাত্রদের বলতেন—‘জ্ঞান মানুষের অন্ধকার দূর করে। জ্ঞানের আলোয় নিজেকে উজ্জ্বল করো, মানুষকে ভালোবাসো। দেশকে ভালোবাসো।’
গ্রামের জীবন অসহ্য হয়ে গেল। দিশেহারা হয়ে গেলেন বাবা। চারপাশের বর্বরতা তখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। লুটপাট খুন জখমের ভয়ে মানুষ একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এখান থেকে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছে।
বাবা আমাকে নিয়ে ফিরে এলেন বাগেরহাট। বাগেরহাটে তখন প্রায় সব হিন্দু বাড়ি লুট হয়ে গেছে। আমাদের বাসা লুঠ হবার সময় ছুটে এসেছিলেন তালুকদার বাড়ির মজনু আর আমার খেলার সঙ্গী তহমিনার বাবা খয়ের চাচা। তাঁরা আমাদের কিছু লুঠ হতে দেয়নি। বাসাবাটি স্টেডিয়ামের কাছে ভাড়া করা বাসাটা ছিল একেবারে বড় রাস্তার সঙ্গে। প্রাণভয়ে বাবা সব ফেলে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছিলেন; এখন বাবা মৃত্যুভয়কে জয় করেছেন। আমরা বাসায় এসেছি শুনে ছুটে এলেন খয়েরচাচা। আমার চোখের জল মুছে দিলেন তাঁর কাঁধের গামছার খোট দিয়ে। মা’র কাছ থেকে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে আমার কোলে দিয়ে বললেন— ‘ধর, এই তোর ধনসম্পদ, ওকে বুকে জড়িয়ে নে।’
কথাটা কেমন যেন লাগল। তাই তো, ছেলের কথা তো একটুও ভাবছি না। ওর বাবাই যে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে! অন্য কাউকে দেখতে পাই না, কিছু শুনতে পাই না। ছেলে কী খাচ্ছে, কেমন আছে? ছেলের দিকে তাকালাম। খুব রোগা মনে হল। আমার বুকে দুধ তো শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। ওর বাবা কী নাম রেখে গেছে, জানা হল না আমার। এরপর থেকে ছেলে কোলে করে বসে থাকি আর ভগবানকে ডাকি, আমার বুকে একটুখানি দুধ দাও ঠাকুর, ছেলেটা খেয়ে বাঁচুক। ওকে বাঁচাতে না পারলে আমি যে নিঃস্ব হয়ে যাব। খয়েরচাচা কোত্থেকে দুধের সন্ধান পেয়েছেন। রোজ একটুখানি দুধ দিয়ে যান। বাগেরহাটে পাকসেনা রাজাকারদের আতঙ্কে ডাক্তার বলতে কিছু নেই। আর ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে কে! শহরের কোথায় কোন ডাক্তার আছেন তা-ও তো জানা নেই। বাবা ভাবনাচিন্তা করছিলেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছিল, তাই ছেলে আর সুযোগ দিল না। খয়েরচাচা দু’বেলা খবর নিতেন। আশেপাশে লোকজন তেমন ছিল না। আমাদের বাড়িওয়ালা মাসিমা একটু শুচিবায়গ্রস্থ—হিন্দুদের ধর্মীয় রীতি ঘরে মৃতদেহ না রাখা। উনি ঠিক সময় এসে হাজির হলেন। ঘরের বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে বললেন— ‘সন্ধ্যা, আমার ঘর অপবিত্র হবে, তোর মরা ছেলেকে এখনই বাইরে বের কর।’ মা-বাবা অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছু বললাম না। শান্তভাবে নয় মাসের মরা ছেলে বুকে করে উঠে দাঁড়ালাম। ওকে কোথাও শুতে দিতে হবে শেষবারের মতো। এখানে সে জায়গা কোথায়? শীতে জন্মেছিল, একটা লাল টুকটুকে কম্বল এনেছিল ওর বাবা। কম্বলটা হলে বেশ হত, জড়িয়ে নিতাম। মনে হল, ওকে তো আমি কিছুই দিইনি। বুকের দুধটুকুও না। তাই আমাকে ছেড়ে ওর বাবার কাছে চলে গেছে। ভাইবোনগুলোর অসহায় চাপা কান্না দরজা ভেদ করে বাইরের বারান্দা পর্যন্ত যাচ্ছে না। কেউ আমাকে বাধা দিল না। ওকে বা হাতে বুকের সঙ্গে ধরে, ডান হাতটা দিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখি দরজার বাইরে খয়েরচাচা দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে চাচার মুখ থেকে গোঙানির মতো শব্দ বের হল। আমার পথ আটকে উনি বললেন— ‘কোথায় যাচ্ছিস মা!’ আমি দরজার মুখে ছেলেকে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। খয়েরচাচা পরিস্থিতিটা বুঝে দু’হাত বাড়িয়ে আমার কোল থেকে নিয়ে নিলেন ওকে। কেউ তাকে কোনও অনুরোধ করল না। তিনি বললেন— ‘আমার তহমিনার বাচ্চাটা যেখানে মাটি পেয়েছে (দুটো বাচ্চা তহমিনার অকালে মারা যায়) তোর ছেলেও সেখানে মাটি পাবে।’ মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। খয়েরচাচা আমাকে ভারমুক্ত করলেন। বাবা-মা, ভাই-বোন বা আমি কেউ তাঁর সঙ্গে গেলাম না। নিজের বাড়ির উঠোনের পাশে কদম গাছের তলায় খয়েরচাচা তার শেষশয্যা পাতলেন। আজও কদম কেশরে ঢেকে যায় তার সমাধি, সাতচল্লিশ বছর ধরে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রাম যা-ই হোক, সেটা শুরু হবার চার মাসের মধ্যে আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সেনা, রাজাকার, দালালবাহিনীকে পরাজিত করে বাগেরহাট শহরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করল। বারান্দার নিচ দিয়ে রাস্তা। মার্চ করতে করতে আমার চোখের সামনে থেকে শহর দখল করে নিচ্ছে তাঁরা। আমি যেন অন্ধ, অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মনে পড়ছে একটি মাত্র গানের লাইন— ‘লহ তুম পূজা মেরী শ্যাম গিরিধারী।’
শ্বাপদের দাপাদাপি ছাড়া শহরের পথে এতদিন লোক চলাচল ছিল না বললেই চলে। সেই পথ দিয়ে শরণার্থী হয়ে যাওয়া হাজার হাজার মানুষ কাফেলার মতো ফিরতে শুরু করল লুটে নেওয়া পুড়ে যাওয়া ভিটেয়। রাস্তার পাশে বারান্দায় বসে তাদের ফিরে আসা দেখতাম। কত মানুষ ফিরল! কিন্তু সে তো ফিরল না! হাহাকার করত বুকের মধ্যে। হাতের কর গুণে হিসেব করতাম— এতদিন ছেলে নিশ্চয়ই ‘মা’ বলে ডাকতে শিখত। বুকের পরে রেখে দুলিয়ে দুলিয়ে গানের সুরে সুরে ঘুম পাড়াতাম। মানুষের সহানুভূতি সহমর্মিতা অসহ্য লাগত। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতাম।
সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে দেশবিদেশের সরকারি বে-সরকারি বহু সংস্থা দুর্গত মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে এল। ‘সেভ-দ্যা-চিলড্রেন ফান্ড’ ক্যাম্প খুলল আমাদের শহরে। সেখানে একটা কাজ মিলল আমার। শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে আসা অসংখ্য শিশু অপুষ্টিজনিত নানা রোগে ধুকছে তখন ঘরে ঘরে। এক মুঠো খাবার নেই। জমিতে চাষ হয়নি, খাঁ খাঁ করছে মাঠের পর মাঠ। ঘরের খাবার লুঠে নিয়ে ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছে ধর্মান্ধ হানাদার রাজাকার আলবদর আল শামসের দল। দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনও অস্তিত্ব নেই। হতভাগ্য শিশুরা কী খাবে! রোগ-জর্জর চর্মসার দেহের চিকিৎসাই বা কী করে হবে! এই শিশুদের নব্বই শতাংশই ভারতের শরণার্থী শিবিরের থেকে ফিরেছে। অপুষ্টিতে গায়ের চামড়া খসে পড়েছে কারও, কেউ বা বয়স পেরলেও বসতে দাঁড়াতে পারে না।
সকাল আটটা বাজতে না বাজতে এসব শিশুকে সঙ্গে নিয়ে মা-বাবা ক্যাম্পের লাইনে দাঁড়াত। বিদেশ থেকে আসা চাল-ডালের খিচুড়িতে কিছু ওষুধ মিশিয়ে ওদের খেতে দেওয়া হত। মায়েদের হাতে কলমে শিখিয়ে দেওয়া হত, কী করে অল্প খরচে পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে হবে! ডাক্তাররা ওষুধ দিয়ে শিশুদের চিকিৎসা করতেন।
আমার কী যে হল—ক্যাম্পে আসা প্রতিটি বাচ্চাকে দেখলেই মনে হতো, ওইটিই আমার নাড়ি ছেড়া ধন! দেশের দুর্দিনে তাকেও তো আমি কিছু দিতে পারিনি। আমার মরুভূমি হওয়া বুকে যে এক ফোঁটা দুধও ছিল না। ডাক্তার দেখাতে পারিনি। এক চামচ ওষুধও তার জোটেনি। অযত্নে অবহেলায় অভিমানী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! চোখ দুটো অনবরত জ্বালা করত। বাসায় ফিরে ছুটে যেতাম খয়ের চাচার বাড়ি। কদম গাছের তলায় উঠোনের একপাশে মাটিতে ঘুমিয়ে আছে ও। কী জানি, মাটিতে কি ওর কষ্ট হচ্ছে! তৎক্ষণাৎ মনে হতো, না না, ওর বাবা আছে তো, নিশ্চয়ই ওকে বুকে তুলে নিয়েছে।
রোজ রোজ মস্তিষ্কের উপর এই চাপ সহ্য হচ্ছিল না। সেভ-দ্যা-চিলড্রেন ফান্ডের কাজটা ছেড়ে দিলাম।
বুঝতে পারি, একুশ বছরের বিধবা মেয়েটাকে নিয়ে বাবা বিপদাপন্ন। চারপাশে লোভী, লোলুপ দৃষ্টির গোলকধাঁধা। আমি যেন একটা ‘বেওয়ারিশ মাল’। একটা অস্বস্তি কেন্নোর মতো কিলবিল করে। বাবা শাড়ী কিনে আনলে তাতে লালের ছোঁয়া থাকলে সংস্কারাবদ্ধ মা আঁতকে ওঠেন। যার জীবনের সব রঙ মুছে অন্ধের চোখের মণির মতো সাদা হয়ে গেছে, তার তো লাল পরা নিষেধ! সারাদিন ভাবি, কেন এমন হল! কী করে হল! মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই তো আমার অসুস্থতায় মানসিক ভারসাম্য ছিল না। দেশব্যাপী এই যে আলোড়ন—স্বামীর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার তো কিছুই আমার চেতনায় ছিল না। আমার শিক্ষক-স্বামী তরুণ সমাজকে শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে মানবিকতার দিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। আর আমি চেয়েছিলাম রঙে রঙে সুরে সুরে ভরা ছোট্ট একটি গৃহকোণ! গিরিধারীকে জোর করে কেড়ে নিয়ে গেল নিষ্ঠুর পাষণ্ডের দল। এতবড় অন্যায় অত্যাচারের কোনও বিচার হলো না। কার কাছে বিচার চাইব? খুনী ধর্ষক লুটকারী রাজাকার আলবদর অমানুষের দল সাধারণ ক্ষমা পেয়ে গেল। কে শুনবে মনের এই অতলান্ত বেদনার কাহিনী! অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। এই মাটি জলহাওয়া আমাকে জ্যন্ত পোড়াতে লাগল।
নিজের মনকে প্রস্তুত করলাম। পিঙ্গরিয়ায় বাপ-ঠাকুরদার ভিটের এক পাশে ঘুমিয়ে রইলেন তিনি, আর খয়েরচাচার বাড়ির উঠোনের এক পাশে ছেলে। মা-বাবা, ভাই-বোন রক্তের আলপনায় রাঙানো স্বাধীনতা, সব ফেলে চলে আসবার আগে চাচার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। চাচি পিঁড়ি পেতে দিলেন বারান্দায়। গাছ থেকে গামছার খোটে করে পেয়ারা পেড়ে আনলেন চাচা। পাশে বসে আমার হাতে একটা তুলে দিয়ে বললেন— ‘খা খা। এগুলো সব তোর।’ এ কথা, সে কথা! গল্প শেষই হয় না! অনেকক্ষণ হল, এবার উঠতে হবে! বললাম, ‘ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছি, চাচা। জন্মের মতো চলে যাচ্ছি! আমার ছেলেটা রইল তোমাদের কাছে’। কেন জানি না, গলাটা বুঝে এল। চাচার চোখের তারাটা বিস্ময়ে নিষ্কম্প হয়ে গেল। আমাকে জড়িযে ধরলেন বুকে। তাঁর কণ্ঠস্বরটা আর্ত চিৎকারের মতো মনে হল। কেঁপে উঠলাম— ‘খবরদার যাবি না। কথা শোন, একবারও যাবি না।’ হা হা করে উঠলেন চাচা—‘মাগো এই এত বড় দেশে আমরা স-বা-ই থাকব, তুই কেন চলে যাবি?’ আমার বুকের মধ্যে উপুড় হয়ে ভেঙে পড়ল একটা আস্ত জলপ্রপাত।
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-এ এসে ৩০টাকায় একখানা বাসা ভাড়া করলাম। জিনিসপত্র বলতে তাঁর একটা ছবি আর দু’চারটে কাপড়চোপড়। ছেলের কোনও ছবি ছিল না। এখানে দেশের বহুলোক আছেন, তাঁরা বেশ ক’টা টিউশনি যোগাড় করে দিলেন। না মরে বেঁচে রইলাম। হঠাৎ একদিন ছেলেবেলার বন্ধু অঞ্জলি আর তাঁর স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল শিয়ালদা স্টেশনে। ওদের সহযোগিতায় দক্ষিণ দিনাজপুরের একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরি মিলল। পিঙ্গরিয়া থেকে বহু বহু কিলোমিটার দূরে আত্মীয় পরিজনহীন রামপুরে। মালদা থেকে বালুরঘাট যাওয়ার পথে রাস্তার ধারেই স্কুল। অঞ্জলিরা গঙ্গারামপুরে থাকত। আমিও ওদের পাশে একটা বাসা নিলাম। মাটির বাড়ি, উপরে টিনের ছাপড়া দেওয়া। দেওয়াল কেটে ঘুলঘুলি তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে ভোরের আলো সার্চলাইটের মতো বিছানার পরে এসে পড়ত। ঘরের একপাশে ঠাকুরের আসনের মতো আসন তৈরি করে তাঁর ছবিটা রাখলাম। আমার সকাল শুরু হত তাঁকে স্মরণ করে। কয়লার উনুনের আঁচে টগবগ করে ভাত ফুটত, তার সোঁদা গন্ধে স্বাধীনতা আমার বুকের মধ্যে মাছের মতো ঘাই মারত!
স্কুলে পড়তে আসা ছেলেমেয়েরা এবং শিক্ষকদের বেশিরভাগই সীমান্তের ওপার থেকে দেশভাগের স্রোতে ভেসে আসা পরিবারের। এ ছাড়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সাঁওতাল ওঁরাও রাজবংশী সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাও ছিল প্রচুর। প্রায় সব পরিবারগুলোই চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত। স্কুলের পাশে বিস্তীর্ণ ফসলের খেত আর মাটির গন্ধ লেগে থাকা এই সকল ছেলে মেয়েরা আমার প্রাণমন জুড়িয়ে দিল।
সেদিন স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান। সকাল সকাল স্কুলে পৌঁছতে হবে, তৈরি হচ্ছি। বাইরের দরজায় কড়া নড়ে উঠল জোরে জোরে। দরজা খুলতেই একটা লোক বেশ ভারিক্কি চালে আমাকে তোয়াক্কা না করে ভিতরে ঢুকে নিজে নিজেই বারান্দায় বসা মোড়াটায় গিয়ে বসলেন। আমি কী বলব ভাবছি। এর মধ্যে নিজেই তাঁর পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি DIB (ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ) থেকে এসেছেন। আমাকে একটা অফিসিয়াল চিঠি ধরিয়ে, আগামীকালের মধ্যে অফিশে হাজিরা দেবার কথা বলে তিনি চলে গেলেন।
সারাদিন সারারাত ভেবে কূল পেলাম না। কোন বিপদ ওঁত পেতে আছে কে জানে! পরদিন যথা সময়ে বালুরঘাট DIB’র জেলা অফিশে পৌঁছলাম। অফিসের বারান্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রইলাম। বিকেল চারটার দিকে আমার ডাক পড়ল। অফিসার একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। তারপর একটা চিঠি হাতে তুলে নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন— ‘এই চিঠি সম্পর্কে কিছু জানেন?’ মাথা নেড়ে বললাম— ‘স্যার, স্পষ্ট কিছু জানি না।’
আপনি একজন বাংলাদেশী । বে-আইনিভাবে এ দেশে অবস্থান করছেন, এ কথা কি সত্যি!’ বুঝলাম, অস্তিত্বের ঘোর সংকটের জালে জড়িয়ে গেছি। মৃদুস্বরে বললাম— ‘হ্যাঁ, স্যার। আমার জন্মভূমির নাম বাংলাদেশ। এর আগে এটা পাকিস্তানের একটা প্রদেশ ছিল। তার আগে ছিল অখণ্ড ভারতের অংশ। আমার বাপ-ঠাকুরদাদা অখণ্ড ভারতের —, উনি আমাকে থামিয়ে দিলেন— ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। সেগুলো পুরানো ঘটনা। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ১৯৭১-এর মার্চের পরে কোনও বাংলাদেশি এখানে আর অধিবাসী হতে পারবেন না!’
— ‘জানি স্যার।’
— ‘আপনাকে তো এখান থেকে পুশব্যাক করা হবে।’
অত্যন্ত ক্লান্তবোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সামনের টেবিলটার পরে মাথা রেখে চোখ দুটো একটু বন্ধ করি। তবু তাকে প্রশ্ন করলাম— ‘কোথায় যাব?’
অফিসার গভীরভাবে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন— ‘এখানে যে একটা চাকরি পেলেন তার উপযুক্ত কাগজপত্র আছে?’
— ‘আছে স্যার।’ ভদ্রলোক একটু নরম হয়ে বললেন— ‘আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি কেন জানেন?’
আমি কোনও উত্তর দিলাম না। উনি বললেন— ‘দেখুন, আপনার সমস্ত খবর সংগ্রহ করেছি আমরা। কাগজপত্র যা আছে আইনত কোনও অসুবিধা নেই। তবে আন-অফিসিয়ালি বলছি, আপনি একটু সতর্ক থাকবেন। কেননা আপনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ জানিয়েছে আপনার সহকর্মীরা।’ অস্ফুটে বলে ফেললাম— ‘সহকমীরা!’ তবে তারা কে বা কারা জিজ্ঞেস করলাম না। অফিসারের আশ্বাস পেয়ে অফিশ থেকে বেরিয়ে এলাম। সহকর্মীদের সঙ্গে আমার তো কোনও বিবাদ নেই! আমি তো কারো কোনও ক্ষতি করিনি! তবু তাদের মধ্যে কোনও একজন বা ততোধিক মিলে আমাকে আশ্রয়চ্যুত করতে চাইছে। চাচার হাহাকার মনে পড়ল— ‘এত বড় বাংলাদেশে আমরা সবাই রইব, তুই কেন চলে যাবি মা!’
দিনরাতের সন্ধিক্ষণে জন্মেছিলাম বলে বাবা আমার নাম রেখেছিলেন সন্ধ্যা। আমি বড় হতে বাবা আমাকে এ নামের অনেক রকম তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আমি জানি, সন্ধ্যা হল অন্ধকারের শুরু, যা ক্রমশ জমাট হয়ে নিকষ কালোয় পৃথিবীকে ঢেকে দেয়। বাবা বলতেন, অন্ধকার শুধু অন্ধকার নয়, তার গভীরে থাকে আলোর ঠিকানা। কিন্তু জীবনের বহুপথ পেরিয়ে এসেও অন্ধকারে হাতড়ে চলেছি। তবু প্রার্থনা করি, ভগবান আমার দেশের সবকিছু ভালো করে দাও। হিংসা, ধর্মান্ধতার পাপ থেকে মুক্ত করে আমাদের মনুষ্যত্বের আলোয় ফিরিয়ে দাও।


লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা, বর্তমানে কোলকাতার দক্ষিণ দিনাজপুর নিবাসী