Headlines

আগ্নেয়গিরি // সুকান্ত ভট্টাচার্য

সুকান্ত ভট্টাচার্য

কখনো হঠাৎ মনে হয়ঃ

আমি এক আগ্নেয় পাহাড়।

শান্তির ছায়া-নিবিড় গুহায় নিদ্রিত সিংহের মতো

চোখে আমার বহু দিনের তন্দ্রা।

এক বিস্ফোরণ থেকে আর এক বিস্ফোরণের মাঝখানে

আমাকে তোমরা বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছ বারংবার

আমি পাথরঃ আমি তা সহ্য করেছি।

 

মুখে আমার মৃদু হাসি,

বুকে আমার পুঞ্জীভূত ফুটন্ত লাভা।

সিংহের মতো আধ-বোজা চোখে আমি কেবলি দেখছিঃ

মিথ্যার ভিতে কল্পনার মশলায় গড়া তোমাদের শহর,

আমাকে ঘিরে রচিত উৎসবের নির্বোধ অমরাবতী,

বিদ্রূপের হাসি আর বিদ্বেষের আতস-বাজি–

তোমাদের নগরে মদমত্ত পূর্ণিমা।

 

দেখ, দেখঃ

ছায়াঘন, অরণ্য-নিবিড় আমাকে দেখ;

দেখ আমার নিরুদ্বিগ্ন বন্যতা।

তোমাদের শহর আমাকে বিদ্রূপ করুক,

কুঠারে কুঠারে আমার ধৈর্যকে করুক আহত,

কিছুতেই বিশ্বাস ক’রো না–

আমি ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর।

তোমাদের কাছে অজ্ঞাত থাক

ভেতরে ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠা আমার অগ্ন্যুদ্‌গার,

অরণ্যে ঢাকা অন্তর্নিহিত উত্তাপের জ্বালা।

 

তোমার আকাশে ফ্যাকাশে প্রেত আলো,

বুনো পাহাড়ে মৃদু-ধোঁয়ার অবগুণ্ঠন:

ও কিছু নয়, হয়তো নতুন এক মেঘদূত।

উৎসব কর, উৎসব কর–

ভুলে যাও পেছনে আছে এক আগ্নেয় পাহাড়,

ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার জাগ্রত বংশধর।

আর,

আমার দিন-পি কায় আসন্ন হোক

বিস্ফোরণের চরম, পবিত্র তিথি।।


সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৫ই আগস্ট, ১৯২৬ – ১৩ই মে, ১৯৪৭) বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি।

পিতা-নিবারন ভট্টাচার্য, মা-সুনীতি দেবী। ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট মাতামহের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়ীতে তার জন্ম।। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। 

সুকান্তের বাল্যবন্ধু ছিলেন কবি অরুনাচল বসু। সুকান্ত সমগ্রতে লেখা সুকান্তের চিঠিগুলির বেশিরভাগই অরুনাচল বসুকে লেখা। অরুনাচল বসুর মাতা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রস্নেহে দেখতেন। সুকান্তের ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাকে সেই অভাব কিছুটা পুরন করে দিতেন। 

কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়ীতে। সেই বাড়িটি এখনো অক্ষত আছে। পাশের বাড়ীটিতে এখনো বসবাস করেন সুকান্তের একমাত্র জীবিত ভাই বিভাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুকান্তের নিজের ভাতুষ্পুত্র।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই বছর আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।

পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।