একটু জোর পায়েই হাঁটছে মোকাব্বের, যথাসম্ভব মানুষের গা ঘেষাঘেষি এড়িয়ে। ওষুধ কিনতে হবে, নানান ধরনের ওষুধ কিনতে হয় মোকাব্বেরকে— মায়ের জন্য ডায়েবেটিক এবং প্রেসারের ওষুধ, স্ত্রীর জন্য আয়রন এবং ক্যালসিয়াম, বাচ্চাকে শান্ত করার ওষুধ। নিজের জন্য ঘুমের ওষুধ, সাথে সদ্য যোগ হয়েছে প্রেসারের ওষুধ, আপাতত পঁচিশ পাওয়ারের ঘুমের ওষুধেই চলে, প্রেসারের ওষুধের পাওয়ারও ঐ পঁচিশ। ডাক্তারের কাছে গেলে নিশ্চিত প্রেসারের ওষুধের পাওয়ারটা বাড়িয়ে দেবে।
মোকাব্বের ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না, এর চেয়ে ঐ টাকাটা দিয়ে বাচ্চার জন্য একটা কিছু খেলনা বা খাবার কিনতে চায়। গত বছর রিক্সার পিছনে গাড়ি ধাক্কা দিলে মা এবং বাচ্চা দুজনেই রাস্তায় ছিটকে পড়ে যায়। বাচ্চাটা গুরুতর জখম হয়েছিল। একটা হাত কনুয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। বাচ্চাটার ডাক নাম বেদু। মোকাব্বের নাম রাখতে চেয়েছিল বেদুঈন, কিন্তু বাচ্চার মা কোনোভাবে মেনে না নেওয়ায় নামটা ‘বেদু’ হয়েছে।
গত বছর মোকাব্বেরের একটা গুরুতর অসুখ হয়েছিল— কিছু খেলেই বমি হয়ে যেত। উচুলম্বা মানুষটা দুই মাসের মধ্যে শুকিয়ে একেবারে লিকলিকে হয়ে যায়। ছুটোছাটা কিছু চাকরি করত সে, চাকরিগুলোও আর থাকে না। স্বামীর অসুস্থতার মধ্যেই নাজনীন একটি হাসপাতালে চাকরি নেয়। মূলত সে বুয়ার চাকরিই নিয়েছিল, কিন্তু শিক্ষিত জানতে পেরে মালিক তাকে প্রধান নার্সের অ্যাসিসট্যান্ট করে দেয়। এভাবে তার নার্সিং ট্রেনিংটা হতে থাকে, যে বেতন পায় তা দিয়ে সংসারটাকেও কোনোমতে সামলে রাখে। আরেকটা সুবিধা হয়েছে, স্বামীর চিকিৎসাটাও একটু কম খরচে করাতে পারছে। অসুবিধাটা হয় চল্লিশোর্ধ পোক্ত শরীরটা নিয়ে— ডাক্তার, ম্যানেজার, মালিক, রোগী, রোগীর স্বামী, বাচ্চা, বুড়ো সবাই চোখ দিয়ে শরীরটা গিলে ফেলতে চায়। নাজনীন বিরক্ত হয়, আবার আপামর পুরুষের এ দুর্বলতা বাধ্য হয়ে একটু কাজে লাগাতেও আজকাল শিখেছে। স্বামীর চিকিৎসাটা অন্তত ভালোয় ভালোয় করিয়ে নিতে পারছে।
মোকাব্বেরের মরণযাত্রা এবারের মতো রহিত হলেও কোথাও গিয়ে কাজ করার মতো অবস্থা না। তাছাড়া বাসায় বৃদ্ধা মা, এবং বিকলাঙ্গ সন্তান রয়েছে। কাজে গেলে তাদের দেখাশুনা কে করবে? চেষ্টা করছে ঘরে বসে কিছু উপার্জন করতে। সারাজীবন ছোটখাটো চাকরিই সে করেছে, পরিচয়ও ওরকম ছোটখাটো মানুষের সাথে। আগ বাড়িয়ে কারো সাথে খাতির করতে সে কোনোদিনও পারে না, রোগেশোকে দারিদ্র্যে জর্জরিত এখনো সে একই রকমই আছে। তাও ভালো যে, এই সময়ে ঘরে বসে দুটো ছাত্র পড়ানোর কাজ সে পেয়েছে। বলা চলে একরকম তাকে উপকার করার জন্যই দোতালার এক সাংবাদিক দম্পতি তাদের বাচ্চা দুটোকে মোকাব্বেরের কাছে পড়তে পাঠায়। আবার তাদের দিক থেকেও প্রয়োজন আছে— সন্ধ্যের এ সময়টায় দুজনই বাইরে থাকে, তাই বিশ্বস্ত কারো কাছে ঘণ্টা দুই বাচ্চারা থাকলে তাতে বিশেষ উপকারই হয়, পড়াশুনাটা এক্ষেত্রে মুখ্য নয়।
বেদুর বয়স এখন সাড়ে তিন বছর, ঘরে ভরে টইটই করে বেড়ায়, দরজা ঠেলে ছাদে যেতেও সে শিখেছে— এক হাত এবং শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বেদু যখন ছাদের দরজাটা একটু খুলতে পারে, মোকাব্বের তখন কিছুতেই শিশু সন্তানের এ বিকলাঙ্গতা মানতে পারে না। বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা মেরে কান্না লুকায়, পুরুষ মানুষ কাঁদতে চায় না, ভেতরের আবেগী মানুষটাকে লুকাতে চায়— শাষণ করতে গেলে আবেগ লুকাতে হয়। বেদুকে এক হাতে তুলে ঘরে এনে ছাদের দরজাটা আটকে দেয়। দুর্ঘটনার পর থেকে সবকিছুতেই তার ভয়, ছাদে উঁচু প্রাচীর আছে, তারপরেও বেদুকে সে একা ছাড়তে চায় না। নাজনীন অফিশ থেকে না আসা পর্যন্ত বেদুকে সে চোখে চোখেই রাখে। একজন ছুটা বুয়া আছে, সে এসে মায়ের কাপড়-কাঁথা পাল্টে দিয়ে খাওয়ায়ে চলে যায়। সারাদিনে কয়েকবার মায়ের রুমে গিয়ে মোকাব্বের দেখে আসে কোনো অসুবিধা হলো কিনা। মায়ের জন্য ভালোমন্দ কোনো অনুভূতি নেই তার, শুধু রোবোটের মাতো দায়িত্বটুকু পালন করে।
করোনা ভাইরাসের এ দুর্যোগকাল বলেই নাজনীন চাকরিটা পেয়েছে, নইলে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া হাসপাতালে একটা চাকরি তার পাওয়ার কথা নয়। ভয় একটু লাগে সত্য, কিন্তু বাঁচিয়ে রাখার তাগিদটা এত তীব্র যে, মাস শেষে বেতনটা হাতে পেলে সে ভয় নিমিষে মিলিয়ে যায়।
বাসায় ফিরে নাজনীন সোজা ঢুকে যায় বাথরুমে। নিজেকে ঘষামাজা করে, সব কাপড় চোপড় ধুয়ে বেরিয়ে আসতে বেশ সময় লাগে। বেদু ততক্ষণ বাথরুমের দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকে। কান্নাকাটি করে না, তিনবছরের এ শিশুটি যেন সবকিছুই বুঝে নিয়েছে— এক হাত হারিয়ে ফেলায় বয়সটা যেন শিশুটির এক লাফে কয়েক বছর বেড়েও গিয়েছে। সবকিছুতেই তার বড় বড় ভাব। মাকে বলে, “মা, কী খেতো? অফিত দেয়?” বাবা মায়ের আলোচনা থেকে অনেক কিছু সে মনে রাখে এবং ঠিকই সময় মতো এবং জায়গা মতো প্রয়োগ করে।
অফিশ মাঝে মাঝেই ভালো খাবার দেয় এখন। করোনা ইউনিটে কাজ করাতে কিছু অতিরিক্ত আয়ও হচ্ছে। আজকে এক রোগীর আত্মীয় এক হাজার টাকা জোর করে দিয়ে গিয়েছে। অফিশের বরাদ্দ খাবার বাদেও প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ বিরানি বা ভূনা খিচুড়ি খাওয়ায়। বেতন হতে আরো এক সপ্তাহ বাকী, এ সময় এক হাজার টাকা হাতে পাওয়া বিশাল ব্যাপার। বাসায় ফেরার সময় ভালো দেখে কয়েক কেজি আম, আর একটি দেশি মোরগ কিনে নিয়ে এসেছে নাজনীন। কালকে ডিউটি নেই, প্রাণভরে স্বামী সন্তানের জন্য বিরানী রান্না করতে চায়।
কেবল ফ্রেস হয়ে ছেলেকে খাইয়ে একটু টিভির সামনে বসেছে। হঠাৎ মোবাইলে ফোন আসে, অফিশের ম্যানেজার ফোন করেছে। “আপা, জরুরী একটু আসতে হবে, রাতে থাকতে হবে, সেভাবেই আসবেন।” নাজনীন কিছু বলার সুযোগ পায় না, কিছু সে বলতেও চায় না— এ চাকরিটা কোনোভাবেই হারানো যাবে না। আধোঘুম ছেলেটাকে কোল থেকে একরকম জোর করে নামাতে হয়েছে। তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে সে বেরিয়ে পড়ে।
বেদু ঘুমোচ্ছে। ছুটা বুয়া এসেছে মায়ের কাপড় চোপড় পরিবর্তন করতে, খাইয়ে দিয়ে দশটার মধ্যে বুয়া চলে যাবে। মোকাব্বেরের মনটা আজ খুব খারাপ, অত রাতে নাজনীনকে আবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে, এটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। আসলে বর্তমান বিশ্বব্যাবস্থা পৃথিবীতে যে ন্যূনতম সেবাটুকু বজায় রেখেছে তা ঠিক স্বতস্ফুর্ত মানব সেবা নয়, জীবিকার তাগিদে হন্যে হওয়া মানুষকে কব্জা করে সেবাগুলো কোনোমতে জারি রাখা হয়েছে। হয়ত এটা ছাড়া কিছু করারও নেই, তবে ব্যাবস্থাটা আরো বৈষম্যহীন হতে পারত। নিচে নেমে এসব ভাবতে ভাবতে হাসপাতালের দিকে হাঁটতে থাকে মোকাব্বের। নাজনীন এ পথ দিয়েই আসে, দেখা না হয়ে যায় আবার! স্ত্রীর জন্য বিশেষ কোনো ভালোবাসা সে প্রকাশ করতে চায় না। ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষমতা তার নেই বলেই সে মেনে নিয়েছে। দশটার মধ্যে ফিরে আসতে হবে, বুয়ার সময় জ্ঞান এমন যে, পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেলে পরের দিন আর আসবে না নিশ্চিত।
অনেক দূর থেকে দেখেও ঠিক বুঝতে পারে— নাজনীন আসছে। দ্রুত হেঁটে আসছে, মোকাব্বের পাশ কাটিয়ে গেলেও সে দেখতে পায় না, মোকাব্বেরও কিছু না বলে আবার তার পিছু নেয়। যেন আঠারো বছরের কোনো যুবক উদভ্রান্ত হয়ে কোনো উর্বশীর পিছু নিয়েছে। সাবধানে দূরত্ব বজায় রাখছে সে, যেন নাজনীন কিছুতে বুঝতে না পারে। অবশেষে সিঁড়িতে এসে তাদের দেখা হয়। আধা মিনিট তারা দুজন দোতলার সিঁড়িতে দাড়িয়ে থাকে। গত দুই বছর এভাবে এতটা করে সে নাজনীনকে দেখেনি। করোনকাল ভুলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। সম্বিত ফেরে উপরে কারো পায়ের শব্দে।
বাইরে থেকেই বেদুর কথা শোনা যাচ্ছে— “মা কোন থোমায় আতবে? বাবা কোতায় গেতে?” দরজা খোলাই ছিল, মা-বাবা দুজনকে এক সঙ্গে দেখে বেদু দুই হাত প্রসারিত করে দৌড়ে আসে, এক হাত বড় এক হাত ছোট —এ এক অপূর্ব সৌন্দর্য, শুধু মা-বাবাই তা উপভোগ করতে পারে। দুজনেই পিছিয়ে আসে, নাজনীন পাশ কাটিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। মোকাব্বের হাত ধুয়ে বেদুকে কোলে নেয়। শিশুটির কথা যেন কিছুতেই ফুরোচ্ছে না— বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, “বাবা, তুমি মাকে আনতে গিছিনে?” মাকে নিয়ে এসেছে বলে সে কৃতজ্ঞতায় বাবাকে আজকে একটু বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। কাটা হাতটা দিয়ে যখন চাপ দিয়ে ধরার চেষ্টা করে ও, মোকাব্বেরের বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা হতে থাকে।
রান্না করে খেতে হবে এখন। অন্যদিন সকালে সে রান্না করে রেখে যায়। বেদু মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, নাজনীন নির্বিকার! রান্না ঘরে ঢুকে তাকে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মোকাব্বের বেদুকে নিয়ে ছাদে চলে যায়। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। খুব দ্রুত কাজ করতে পারে সে, দুই বেলার খাবার— ভাত, ভাজি, ডাল এবং একটা মাছের ঝোল রেঁধে ফেলেছে। ছেলেকে খাইয়ে, নিজে কয়টা নাকেমুখে দিয়ে রুমে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
অঘোরে ঘুমিয়েছে, বেদু কয়েকবার এসে নাকি গায়ের উপর লুটোপুটি খেয়েছে। মোকাব্বের আজকে খুব রোমান্টিক, মেপে মেপে বউয়ের ঘুমের বর্ণনা দিচ্ছে!
দুপুরে বিরানী রান্নার কথা ছিল। গত রাতের ডিউটির কারণে সম্ভব হয়নি। সন্ধ্যারাতে আয়েশ করে রাঁধতে চায়। মোকাব্বেরকে কিছু মশলা আনার ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে বিরানী রান্নার বন্দোবস্ত করতে লেগে যায় নাজনীন।
শহরে খুব একটা সন্ধ্যা নামে না, নিয়নের আলোয় ঢেকে যায় সূর্যের গোধুলী আলো। আজকে একটু ব্যতিক্রম। রাস্তায় মনে হয় বিদ্যুৎ নেই। ঝড়ো বাতাস, গোধুলী সন্ধ্যাটুকু গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে যেন। টানাপোড়েনের গলিপথ থেকে হঠাৎ একটু বেরিয়ে মোকাব্বের হাঁটতে থাকে শহরের গলিপথ ধরে । এগারো বারো বছরের একটা ছেলেকে সামনে দেখে সম্বিত ফেরে, ছেলেটি ভিক্ষা চায়, কিন্তু কোনোভাবে ওকে ভিক্ষুক মনে হচ্ছে না। করোনা ভাইরাসের এ প্রলয়কাল সবাইকে যেমন গৃহবন্দী করেছে, অনেককে তো আবার পথে ছুড়েও দিয়েছে।
মোকাব্বের দশটা টাকা বের করে ছেলেটিকে দিতে গিয়ে আবার ফিরিয়ে নেয়। নাম জানতে চাইলে ছেলেটি নাম বলে— নয়ন। মোকাব্বের ভাবে, নয়নকে দিনে বাসায় রাখলে মন্দ হবে না, তাহলে আরও দুএকটা ছাত্র পড়ানো যাবে। পাশের বাসার ভাবি কয়েকদিন ধরেই বলছে তার ছেলেটিকে পড়াতে। কাজের প্রস্তাব দিতেই নয়ন রাজি হয়ে যায়। আসলে তার আর একা একা বাসায় ভালো লাগে না। দরদামও এমন কিছু করতে চায় না। কয়টা খেতে দিলে নগদ টাকা যা হাতে পাবে তাতেই হবে। মোকাব্বের ওকে দুই বেলা খাওয়া এবং দুই হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলে। নয়ন তো বেজায় খুশি। কাল থেকেই কাজ করতে চায়। মশলা কিনে নয়নকে নিয়েই বাসায় ফেরে মোকাব্বের।
নাজনীনকে জানাতেই সে রাজি হয়ে যায়। পড়ার কথা বললে যদি কাজটা না হয়, এজন্য নয়ন বলে, সে আর পড়ে না। আসলে সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। নাজনীন খুশি হয়, ভাবে, তাহলে তো বেদুকে একটু পড়াতেও পারবে। ওর মা যে সদ্য মারা গেছে এই কথাটি নয়ন এড়িয়ে যায়। শুধু ‘বাবা নেই’ বলে। নাজনীন ওকে দুটো বিস্কুট খেতে দেয়, প্লেটে করে দেওয়াতে ও খুব বিস্মিত হয়, কোনোদিন তো কেউ প্লেটে করে ওকে খেতে দেয়নি কিছু।
কালকে থেকেই নতুন চাকরি, কিছু গোছগাছের বিষয় আছে। কিন্তু বাসায় এসে কিছুতেই ও আর নিজেকে মানাতে পারে না। মায়ের একটি ছবি আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মায়ের খুব স্বপ্ন ছিল— নয়নকে পড়াশুনা করাবে, বড় হবে, চাকরি করবে। নিজে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন বাসায় কাজ করত, কিন্তু ছেলেটিকে কখনো কাজে দেওয়ার কথা ভাবেনি। তারপরও শেষ পর্যন্ত মায়ের বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে ও একটি রেস্টুরেন্টে বিকেল বেলায় কাজ নিয়েছিল।
শারমীনের বয়স বেশি নয়, আবার কমও নয়, বিয়ের দশ বছর পর নয়ন হয়েছে। এজন্য ছেলেটে খুব আদরের, তার ওপর স্বামী মারা যাওয়ার পর একমাত্র অবলম্বনও তো বলতে গেলে এই ছেলেটা।
বয়স কেবল চল্লিশ পার হয়েছে, এ বয়সেই শারমীনের ডায়েবেটিক ধরা পড়েছে, খুব সাবধানে চলতে হয়। হাঁটাহাঁটির কাজটা অবশ্য বিভিন্ন বাসায় কাজ করতে গেলে এমনিতেই হয়ে যায়। তারপরও খাওয়া দাওয়া সে সাবধানে করে, ইদানিং ডায়েবেটিক খুব আর ওঠে না। তারপরও শরীরটা ভালো ঠেকে না, দুর্বল লাগে। বাসায় খুব একটা কিছু রান্না করা লাগে না, সে সময় হয়ও না, কাজের উছিলায় বিভিন্ন বাসা থেকে যে খাবার দেয় তা দিয়েই এক প্রকার চলে যায়। তাই বলে নিজে কিছু রান্না করে ছেলেকে খাওয়াতে কার না ইচ্ছে করে, এজন্য সুযোগ পেলে কিছু না কিছু রান্না করে ছেলেকে খাওয়ায়। বাইরের মানুষ জানতেও পারবে না যে, ছেলেটা তার কত আদরের! বলতে গেলে নয়ন এখন হাত লাগিয়ে খেতেই শেখেনি। তবু এখন সে বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্টে কাজ নিয়েছে।
করোনা ভাইরাসের দুর্যোগ আসার পর নয়নের কাজটি চলে গেছে। শারমীনেরও দুটো কাজ চলে গিয়েছে, বাকী দুটো কাজেরও কোনো গ্যারান্টি নেই। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে সে। জমানো তেমন কিছু নেই, কাজ না থাকলে মা ও ছেলের চলবে কীভাবে!
যে দুটো বাসায় আগে কাজ করত তাদের এক বাসা থেকে শারমীনকে এক মাসের খোরাকি পাঠিয়েছে। পৃথিবীতে সবাই তাহলে এখনও অমানুষ হয়ে যায়নি! এক মাসের চালডাল পেয়ে শারমীনের আনন্দের অন্ত নেই। এই মানুষগুলো এমনই, বাঁচার আনন্দটুকু তারা খুব ভালোভাবে উপভোগ করে, করতে পারে।
সামান্য খেয়েদেয়ে তবুও মা ছেলের ভালোই কাটছে। দুজনে একসাথে টিভি দেখে, গল্প করে, শারমীন ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে, ফলে নয়নকে একটু আধটু পড়াতেও পারে। ছেলেকে সে তার স্বপ্নের কথা শোনায়, নয়ন এসব শুনে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, পড়াশুনা তাকে করতেই হবে।
কিন্তু স্বপ্নসাধ সবকিছু ধুলিসাৎ হয়ে যায় মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে। হঠাৎ একদিন জ্বরজ্বর বোধে করে শারমীন। একদিন পরেই জ্বর-সর্দি-কাশি অনেক বেড়ে যায়। ঘরে মাত্র পাঁচশো টাকা আছে, পাঁচশো টাকা সম্বল করে নয়ন এক ডাক্তারের কাছে যায়, ডাক্তার সব শুনে কিছু ওষুধ লিখে দেয় এবং করোনা টেস্ট করতে বলে। প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে নয়ন আশা করে ডাক্তার হয়ত ভিজিট তার কাছ থেকে নেবে না, কিন্তু ডাক্তার অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে অমনোযোগে নয়নের হাত থেকে পাঁচশো টাকার নোটটি নিয়ে দেরাজে রেখে দেয়, যেন পৃথিবীর কোনোকিছু সে দেখেনি-বোঝেনি-শোনেনি।
পাশাপাশি দশ বারোটা ছাপড়া ঘর— বস্তিই বলা চলে, ওরা অতটা সাবধান হতে জানে না, চায়ও না। বস্তিবাসী কেউ কড়াকড়িভাবে নয়নদের কিছু বলছে না, তবে সবাই একটু এড়িয়ে চলার চেষ্ট করছে। নয়ন চেষ্টা করে আশেপাশের কয়েক জনকে বলে কয়ে কিছু টাকা যোগাড় করতে। তবে বস্তিবাসী সবারই প্রায় একই অবস্থা— আক্ষরিক অর্থেই ওরা দিন আনে দিন খায়। তারপরেও শেষ পর্যন্ত সাতশো টাকা যোগাড় করতে পেরেছে ও, এই টাকাটা দশ বিশ টাকা করে সবাই এমনিই দিয়েছে।
একটুও দেরি না করে ও চলে যায় ফার্মেসিতে, সব মিলিয়ে চারশো আশি টাকার ওষুধ, একটা পাউরুটি আর দুটো মাল্টা কিনে নিয়ে বাসায় ফেরে। মা একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। জ্বরটা হঠাৎ খুব বেড়েছে, খুব ক্ষীণ কণ্ঠে মা ডাকে— নয়ন, নয়ন …। নয়ন ঢুকেই মায়ের কপালে হাত রাখে, জ্বরে একেবারে গা পুড়ে যাচ্ছে। আশেপাশের সবাই উঁকি দিচ্ছে, অনেকের কষ্ট হলেও কারোরই সাহস হচ্ছে না কাছে এসে সেবাযত্ন করার। নয়ন চেষ্টা করছে মায়ের মাথায় পানি দিতে, পাশের ঘর থেকে এক আন্টি একটা বালতি এবং পলিথিন দিয়ে ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে কীভাবে মাথায় পানি দিতে হয়। থেকে থেকে কাঁশি উঠছে, এখন বলতে গেলে আর কথাও বলতে পারছে না মা। নয়ন পানি দেওয়া বন্ধ করে ভালো করে মায়ের মাথাটা মুছিয়ে দেয়, কানের কাছে মাথা নিয়ে জানতে চায়— “মা, ক্ষুধা লেগেছে না?” শারমীন দুইদিকে মাথা নেড়ে জবাব দেয়।
নয়ন একটা মাল্টা কেটে চিপড়ে রস করে নিয়ে এসে মাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। কিছুটা গলায় যেতেই আবার কাঁশি, কিছুতেই গলা দিয়ে কিছু নামছে না। মা হাত নেড়ে নয়নকে খেতে বলে। ছেলে কিছুতেই আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না, মা-ও কাঁদছে। এভাবে মা-ছেলে কিছুক্ষণ জড়াজড়ি করে থাকে, বারে বারে শারমীন চেষ্টা করছে নয়নকে কিছু বলতে, কিন্তু কথা বলতে পারছে না, কথা বলতে গেলেই কাঁশি ওঠে।
রাত বাড়তে থাকলে শারমীনের শ্বাঃসকষ্ট শুরু হয়। নয়ন বাইরে এসে সবাইকে ডাকাডাকি করতে থাকে, কিন্তু কেউই খুব একটা সাড়া দেয় না, কারোরই কিছু করার নেই, সবাই-ই পরিণতি জেনে গিয়েছে যেন। তিনচার রুম পর থেকে সোহেল ভাই বের হয়ে আসে, নয়নের সোহেল ভাই। সোহেল বলে, নয়ন, চল, কোনো হাসপাতালে নেওয়া যায় কিনা চেষ্টা করি। ওরা নিকটবর্তী সব হাসপাতালে যায়, কিন্তু কোথাও ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। ফিরে আসে হতাশ হয়ে, যত জায়গা ফোন করা যায় করে, কোনো উপায়ই মেলে না। অবশেষে সোহেল বলে, নয়ন, যা, মায়ের কাছে গিয়ে থাক।
এখন রাত দুইটা, মায়ের বুকটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে, মা নয়নের হাত শক্ত করে ধরে রাখে। চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে, নয়নও কাঁদছে। মা ছেলে চোখে চোখেই যেন সব কথা বলতে পারছে! এক অপার্থিব সময়— দুজনেই জেনে গিয়েছে, দুজনেই মেনে নিয়েছে পরিণতি। রাত চারটা বিশ মিনিটে শারমীন মারা যায়।
সকালে অবশ্য লোকজনের আর অভাব হচ্ছে না। এলাকার কমিশনার চলে এসেছে, পুলিশও এসেছে। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে লাশ বিশেষ কায়দায় মুড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছে, নয়ন যেন চৌদ্দদিন ঘরেই থাকে, আশেপাশের সবাইকে খেয়াল রাখতে বলেছে নয়ন যাতে কড়াকড়িভাবে চৌদ্দ দিনের কোয়ারেন্টিন মেনে চলে।
মা মারা যাওয়ার পর নয়ন একটুও কাঁদেনি— একেই বোধহয় বলে শোকে পাথর হয়ে যাওয়া। সারাদিন ও একরকম না খেয়েই থেকেছে। পাশের রুমের আন্টি রাতের বেলায় তরকারী আর ভাত দিয়ে গেছে, কোনোমতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ও। ঘুম থেকে উঠতে বলতে গেলে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। রাতজাগা এবং ক্লান্তির ঘুম, বাইরে থেকে কে যেন দরজায় অনেক ধাক্কাধাক্কি করছে, নয়ন দরজা খুলে দেখে একটা বস্তা সামনে, দূরে একজন লোক দাঁড়ানো। ‘এইটা রাখো’ বলে চলে যায় লোকটা। বস্তাটায় দশ কেজি চাল, দুই কেজি আটা, এক লিটার তেল, এক কেজি চিনি এবং একটি সাবান রয়েছে। নয়ন পাশের রুমের আন্টিকে ডেকে বস্তাটা নিতে বলে। আশা করছে যে, আন্টি অন্তত প্রতি বেলায় তাকে খাবারটা দেবে।
প্রথম দুইদিন দিলেও আর কোনো খোঁজ খবর নিচ্ছে না কেউ, রুমের সামনে দিয়ে যাওয়া সময় সোহেল ভাই শুধু একটা ডাক দিয়ে যায়।
আসলে আন্টি ঠিকই দিতে চেয়েছিল, ঝামেলাটা বেধেছে তার স্বামী বাধা দেওয়ায়। নয়নের দেওয়া বস্তাটাতে সে অবশ্য হাত দেয়নি, ওটা ওভাবেই রয়েছে। তার ঘরেও খাবার নেই, তাই বলে মা-মরা ছোট্ট ছেলেটাকে খাবার দিতে না পারলে তার ঐ সংস্থানটুকু ব্যয় করার মতো বেঈমান তিনি নন।
কোনো উপায়অন্তর না দেখে অবশেষে নয়ন সোহেল ভাইকে বলে, “ভাই, আমি বের হতে না পারলে খাব কী? আমার কাছে তো কোনো টাকাও নেই।” নয়নের কথা শুনে পাশের রুমের আন্টি বের হয়ে এসে সোহেলকে বলে, সোহেল, এই বস্তাটা নিয়ে তোমার মাকে দাও, দেখো, তোমার মা ওকে দুটো রেঁধে দিতে পারে কিনা। সোহেল জানে তাদের ছোট্ট একটা রুমে কী লঙ্কাকাণ্ড চলছে, তারপরও ‘না’ করতে পারে না, ‘না’ করা যায় না।
অনেক কষ্টে চৌদ্দটা দিন পার হয়েছে। এই কয়দিনে ধারদেনাও হয়েছে কিছুটা, মায়ের অসুস্থতার সময়েও কিছু ধার করা হয়েছিল। নয়ন এখন করবে কী? যাবে কোথায়? কোনো বাড়ীঘর তো ওর নেই। সারাটা দিন নানান কিছু ভেবেচিন্তে কেটেছে, মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু বেঁচে থাকার দাবী তো মানুষের দুঃখ শোককে পাত্তা দেয় না। বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে নয়নকে, মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। এভাবেই মোকাব্বেরের সাথে দেখা।
খুব সকাল সকাল কাজে চলে এসেছে নয়ন। নাজীনন কেবল বেরোচ্ছে। “চা বানাতে পারো নয়ন? শিখে নিও, তোমার আংকেলকে দুএকবার চা করে দিও।” একথা বলে মাথায় হাত দিয়ে নয়নকে একটু আদর করে দ্রুত বের হয়ে যায় সে।
মোকাব্বের নয়নকে কাজ বুঝিয়ে দেয়। বেদুর সাথে থাকাটাই ওর মূল কাজ। মোকাব্বের জানে যে, কাজটা খুব কঠিন, তাই মাঝখানে আরও কিছু কাজ দিয়েছে নয়নকে, যাতে বেদুর সাথে থাকতে থাকতে ও বিরক্ত না হয়ে যায়। টুকিটাকি কাজ, বিশেষ কঠিন কিছু নয়।
নয়নের মায়ের সাথে কথা বলতে চাইলে ও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান কথা বলেছে মোকাব্বেরকে। বলে, “মা তো বাড়িতে গিয়ে আটকে গেছে। কবে আসবে ঠিক নাই।” মোকাব্বের মেনে নিয়েছে।
এক সপ্তাহ হলো নয়ন কাজ করছে, খুবই নিয়ম মেনে এবং দায়িত্বের সাথে ও কাজ করছে। নাজনীন তো খুবই খুশি, সত্যিই তার ভার অনেক কমে গিয়েছে। এমনকি নয়ন বেদুকে গোসলও করিয়ে দেয়, সময় মতো খাইয়ে দেয়। বেদুও নয়নকে খুব সহজে আপন করে নিয়েছে। প্রকৃত ভালোবাসার ছোঁয়া সবাই বুঝতে পারে, শিশুরা যেন সহজাতভাবেই এটা বুঝে ফেলে।
মোকাব্বের এবং নাজনীনকে নয়ন আঙ্কেল আন্টি ডাকলেও ওদেরকে একরকম ও পিতামাতার আসনে বসিয়ে ফেলেছে। পরিবারের সকল সুবিধা অসুবিধা নিজের অজান্তেই ও মাথায় তুলে নিয়েছে। বেদু হয়ে উঠেছে আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি। আর্থিক টানাপোড়েনের বিষয়টি টের পেয়ে ও ভেবে রেখেছে— যেকোনো অজুহাতে বেতনটা সব নেবে না। করেছেও তাই, প্রথম মাসের বেতনটা খুব কষ্ট করে মোকাব্বের গুছিয়েছে। দুই হাজার টাকা ওকে দিতে গেলে, নয়ন বলে, “আঙ্কেল, আমার তো মাসে পাঁচশো টাকার বেশি লাগবে না, খাওয়া দাওয়া সব তো আপনাদের সাথেই করছি, আপনি আমাকে পাঁচশো টাকা দেন, বাকী টাকা আপনার কাছে জমা থাক, আমি আবার কোথায় রাখবানে!”
আবার একদিন মায়ের সাথে কথা বলার জন্য খুব ধরলে নয়ন চাপে পড়ে যায়। বলেছে, কালকে মায়ের সাথে মোবাইলে কথা বলিয়ে দেবে। ঘরে ফিরে পাশের রুমের আন্টিকে ম্যানেজ করে। মোবাইলে মোকাব্বেরের সাথে আন্টিকে ‘মা’ হিসেবে কথা বলিয়ে দেয়। মোকাব্বের বলে, “আপনার ছেলের বেতনের পনেরোশো টাকা আমার কাছে প্রতি মাসে রেখে দেয়, যখন লাগবে একটু আগে বলবেন।” তিন মাসে নয়নের সাড়ে চার হাজার টাকা মোকাব্বেরের কাছে জমেছে, সে জানে না আসলে কীভাবে টাকাটা হঠাৎ দিতে পারবে— যদি ঠিকই নয়নের মা চেয়ে বসে!
গত দুতিন দিন ধরে শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, গলাটাও ব্যথা ব্যথা করছে, নাজনীন পাত্তা দেয় না। কিন্তু আজ আর অফিশে যেতে পারলো না। নিচে নেমে দোকান থেকে এক পাতা নাপা কিনে আবার উঠে এসেছে। খুব জ্বর জ্বর লাগছে, মাথাটাও ব্যথা করছে। ঘরে এসেই শুয়ে পড়ে। মোকাব্বের মাথায় হাত দিয়ে দেখে, বেশ জ্বর। এভাবে দুই দিন কেটে যায়। অফিশের ম্যানজারকে ফোন করে জানালে সে এক গাদা পরামর্শ দিয়েছে, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার মতো কিছু বলেনি।
আজকে করোনা টেস্টের রিপোর্ট এসেছে। পজেটিভ এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই নাজনীন একটু ভেঙ্গে পড়েছে। মোকাব্বের সাহস দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিয়মমাফিক রুম আলাদা করা হয়েছে। বৃদ্ধ মাকে নিয়ে এসেছে ডাইনিং রুমে পড়ানোর জায়গায়, আপাতত পড়ানো বন্ধ।
গত ছয়সাত দিনে নাজনীনের অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। নয়নই দেখাশোনার কাজটা মূলত করছে। মোকাব্বের বাইরে দৌড়াদৌড়ি করছে, চেষ্টা করছে কিছু পয়শাপাতি যোগাড় করতে। ফোনে কেউ-ই তেমন কোনো সাড়া দিচ্ছে না। দেখা করেও লাভ হচ্ছে না। সবাই এখন কেমন যেন নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। মৃত্যুভয় কি তাহলে মানুষ আরও বেশি নিষ্ঠুর করে তোলে?
কাঁশির প্রকোপ বেড়েছে। শরীরটা এত দুর্বল হয়েছে যে, নাজনীন উঠে বসতেই পারছে না। বেদু বারে বারে মায়ের রুমে চলে আসে, ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। মায়ের গায়ের উপর উঠে আসে, নয়ন চেষ্টা করে ওকে সামলাতে। সাগু দানা রান্না করে নয়ন নাজনীনকে খাইয়ে দিচ্ছে, ওর নিজের মাকেও মাত্র কয়েক মাস আগে এভাবেই খাইয়ে দিয়েছিল। প্রতিবার চামচ নাজনীনের মুখে দেওয়ার সময় নয়নের বুকটা ধক করে উঠছে। ওর মন বলছে— এই মাও হয়ত বাঁচবে না।
অফিশ থেকে এক মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে দায় সেরেছে। আর কোনো যোগাযোগ করছে না। আজকে মোকাব্বের পরিচালকের সাথে দেখা করে নাজনীনকে হাসপাতালে ভর্তি করার কথা বলেছে। সাড়া মেলেনি তাতে। অন্য কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেও ফল হয়নি। সময়টা যে আসলে কতটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে।
দুপুরে খাওয়ার পর নাজনীনের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। শ্বাঃস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। শরীরে খিুঁচনি হচ্ছে। মোকাব্বের হাসপাতালের ম্যানেজারকে ফোন করে অনেক কাকুতি মিনতি করলে ম্যানেজার নাজনীনকে নিয়ে যেতে বলে। বাসা থেকে হাসপাতাল খুব দূরে নয়, তবু এ ধরনের একজন রোগীকে কীভাবে নিয়ে যাবে? দ্রুত বের হয়ে মোকাব্বের হাসপতাল থেকে একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসে। বারো বছরের নয়ন এখন বাইশ বছরের যুবকের মতো শক্তিমান হয়ে উঠেছে। নাজনীনকে দুজনে স্ট্রেচারে করে বের করে ঘরে বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়, বেদু ঘরেই থাকে। দারেয়ান একটা ভ্যান ডেকে এনেছে। নাজনীনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, যে নার্সের সাথে নাজনীন কাজ করত, তিনি দয়াপরবশ হওয়াতে দ্রুত একটি বেড এবং অক্সিজেনের ব্যবস্থা হয়।
নয়ন হাসপাতালে দেরি করে না, বাসায় এসে বেদুকে গোসল করিয়ে খাইয়ে দেয়। নাজনীনের জ্বর হওয়ার পর থেকে ছুটা বুয়াও আর আসছে না, ফলে বুড়িকেও সামলাতে হচ্ছে নয়নকেই। এতটা কঠিন সময়ও নয়ন উপভোগ করছে, যেন নিজের মা-বাবার জন্যই করছে। নিজেকে উৎসর্গ করতে পারলে খুব কঠিন কাজও নেশাগ্রস্তের মতো করা যায়, নয়নের ক্ষেত্রে সেরকমই হয়েছে।
হাসপতালে মোকাব্বেরই নাজনীনকে দেখাশোনা করছে, নার্স ডাক্তাররা খুব একটা কাছে আসে না। খুব দরকার হলে অবশ্য আসে। সবখানেই তো একটা ভয় এবং সংকট এখন আছে। চারদিন হলো নাজনীন হাসপাতালে, শরীরের খুব একটা উন্নতি নেই। অক্সিজেন দিয়েই রাখতে হচ্ছে।
বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দিয়ে ডাক্তাররা চেষ্টা করছে। জ্বর পড়লেও কাঁশি কমছে না, শ্বাঃস প্রশ্বাসও স্বাভাবিক হচ্ছে না।
নাজনীন মোকাব্বেরকে একটা খাতা-কলম এনে দিতে বলে। শুয়ে শুয়ে থেমে থেমে এলোমেলোভাবে মোকাব্বেরকে একটা চিঠি লেখে— “যদি আমি মরে যাই, তুমি কীভাবে চলবা জানি না। ভেঙ্গে পড়ো না, উপায় একটা হবেই। নয়নকে নিজের ছেলের মতো করে কাছে রেখো। আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওর মা বাবা কেউ নেই। এই কয়দিনে ও আমার নিজের সন্তান হয়ে উঠেছে। বেদুর জন্য কষ্ট হচ্ছে। নয়নের জন্যও খুব কষ্ট হচ্ছে।”
ডাক্তার মোকাব্বেরকে বলে, বেদুকে একবার নাজনীনের সামনে আনতে। অবস্থা খুব ভালো না।
নয়ন দ্রুত বেদুকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যায়। ওদেরকে পিপিই-মাস্ক পরিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। বেদুকে নাজনীনের পেটের উপর বসিয়ে দেয় নয়ন, নাজনীন এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বেদু ‘মা মা’ বলে অস্থির করে তুলেছে। নাজনীন নয়নের হাত ধরে বেদুর হাতটা নয়নের হাতে গুজে দেয়।
নার্স এসে খুব রাগারাগি করে— কেন বেদুকে পেটের উপর বসানো হলো। নয়ন বেদুকে নিয়ে বাসায় চলে আসে।
সন্ধ্যের পর থেকে নাজনীনের অক্সিজেন লেভেল আরও নামতে থাকে। ফুসফুসের অবস্থা খুবই খারাপ, অক্সিজেন দিয়েও আর কাজ হচ্ছে না। মোকাব্বের ওর কপালে হাত রাখে। নাজনীনের দুচোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকে। কাঁশিটাও খুব ক্ষীণভাবে উঠছে এখন। ডাক্তার মোকাব্বেরকে বলে, “উনি মৃত্যুপথযাত্রী।” রাত দশটার দিকে নাজনীন মারা যায়। তবুও বিভিন্ন নিয়ম কানুনের কারণে ঐদিন হাসপাতালেই লাশ রাখতে হয়। পরের দিন সরকার নির্ধারিত গণকবরে দাফন করা হবে।
সকালে সরকারি লোক এসে লাশ প্যাকেট করে নিয়ে যায়। মোকাব্বের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। হঠাৎ রাস্তায় পড়ে থাকা পত্রিকার একটা ছেঁড়া পাতায় চোখ পড়ে, তাতে লেখা— “রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা করোনা থেকে যেভাবে সেরে উঠলেন।” মোকাব্বের ভাবে, কোনো পত্রিকায় ছাপা হবে না, কেউ জানবেও না— “কাল রাতে একজন ‘নগন্য স্বাস্থ্যকর্মী’, একজন একহাতকাটা-শিশু সন্তানের মা করোনাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ঘরে তার অসুস্থ-বেকার স্বামী এবং বৃদ্ধা শাশুড়ি রয়েছে।”
লেখকঃ
সাহিত্যিক ও গবেষক