নুপুর ভুলেই গেছিল যে, ওটা ওদের-ই পুকুর। ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বাবার মৃত্যুর পর থেকে মাছের ঘের এবং পুকুরটা শরীকরা দখল করে খাচ্ছে।
নুপুররা সবাই ছোট, ওগুলো বুঝে খাওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওরা এখন থাকে পাশের গ্রামে মামা বাড়িতে। মাঝে মাঝে বাড়িতে বেড়াতে আসে।
ও গতকাল মায়ের সাথে বাড়িতে এসেছে। শেষ রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ওর খুব ভাল লাগে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার ঝপঝপ শব্দ শুনতে ভালো লাগে, হাঁসগুলোর মাটিতে ঠোঁঠ বিলি করে কেচো খোঁজা দেখতে ভাল লাগে।
বর্ষাকালে গ্রামের দরিদ্র মানুষের সমস্যা বাড়ে, পাশাপাশি নতুন কিছু সুযোগও তৈরি হয়। বর্ষকাল গ্রামের চেহারাটা একেবারে বদলে দেয়। এখানে মানুষের জীবনের বৈচিত্র ঋতু বৈচিত্রের সাথে সম্পরকিত, ঋতু বদল হলে মানুষের জীবন বদলে যায়, জীবিকা বদলে যায়।
নুপুরের একটি বর্শি আছে। মাঝে মাঝে ও নিজেদের পুকুরে লুকিয়ে বর্শি ফেলে। বর্ষার সময় পুকুরে বর্শি ফেললে মাছ উঠবেই। চিকন সুতোর ছোট্ট বর্শি, এমন অনেক হয়েছে, সুতো ছিড়ে বর্শিসহ মাছ চলে গিয়েছে।
কোনোভাবে পাঁচমিনিট বর্শি ফেলতে পারলেই হাফ কেজি ওজনের একটা মাছ পাওয়া যাবেই। বর্শিতে আধার হিসেবে ভাত দিলেই হয়। বাড়ির পুকুর, তিন শরিকের পুকুর, সবাই পুকুরে থালা-বাসন ধোয়, খাবার হিসেবে ভাত মাছগুলোর অতিপরিচিত।
নুপুর একমুঠ ভাত এবং বশি নিয়ে পুকুরে যায়। বৃষ্টি পড়ছে, বেশ জোরেই পড়ছে, এসময় কেউ বাইরে বেরোনের সম্ভাবনা কম। ও পুকুরে বর্শি ফেলে।
বৃষ্টির কারনে খোট বোঝা যাচ্ছে না, এমনিতেই পাখনা ডুবছে ভাসছে। ও মাঝে মাঝে আন্দাজ করে ছিপ টান দিচ্ছে, তাতেই উঠে আসছে বড় বড় তেলাপিয়া মাছ।
দখলদাররা এবার মনে হয় পুকুরে তেলাপিয়া মাছ ছেড়েছিল। চার মাসে সেগুলো বেশ বড় হয়েছে। প্রতি মিনিটে চার পাঁচটি করে তেলাপিয়া মাছ পাচ্ছে ও। মাছ রাখার কিছু নেই। আনতে যাওয়ার সময়ও নয়। ও এখন ভীষণ উত্তেজিত। এভাবে কোনোদিন মাছ ধরার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। মাছগুলো পিছনে ঝোপের মধ্যে ছুড়ি দিয়ে আবার বর্শি ফেলছে।
মনে ভেতর লোভের সাথে পাল্লা দিচ্ছে ভয়। দশ বারো বছর বয়সে সরল লোভ এবং অহেতুক ভয়, দুটোই প্রবল থাকে। মিনিট দশেক বর্শি ফেলে বিয়াল্লিশটা সাইজমত তেলাপিয়া মাছ ধরে ফেলে ও ।
খালে বিলে বন্ধুদের সাথে বর্শি ফেলে একটি মাছও ধরতে পারেনি কোনোদিন। খালের মাছ ধরা সহজ না, নিখুঁতভাবে খোট বুঝে বর্শি টান দিতে হয়। নুপুরের অত মনোযোগ নেই, সে শুধু পুকুরের মাছ-ই ধরতে পারে।
মাঝে মাঝে নিজেদের পুকুরের মাছ ও চুরি করে। একদিন ধরা পড়েছিল, খুব অপমানিত হতে হয়েছিল সেদিন। পুকুরটা তিন শরিকের, নুপুরদের অর্ধক, বাকি দুই শরিকের অর্ধক। নুপুরের বাবা মারা যাওয়ার পর গত চার বছর ধরে শরিকরা পুকুর এবং ঘেরটা দখল করে নিয়েছে। জমিজমা-বাড়িও নিতে চেয়েছিল। জাল দলিল করে মামালা করেছিল, শেষ পর্যন্ত কোর্টের রায় নুপুরদের পক্ষে যায়।
দুর্বলের উপর অত্যাচারের নির্মম উদাহরণ তৈরি করে রেখেছে মসনী গ্রামের কিছু মানুষ। ছোট ছোট এতিম ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তারা না তাকিয়ে শরিকদের সাথে তারাও জোটবদ্ধ হয়েছিল। শরিকরা জোর করে তালগাছ কেটে নিয়েছে। গ্রামের মানুষ সালিস করে শরীকদের পক্ষ নিয়েছে।
সবখানেই যে এখনো শয়তানেরা ক্ষমতায় এবং বিত্তে এগিয়ে রয়েছে নুপুর তা ঐ বয়সেই বুঝতে পেরেছিল। গ্রামের মাতব্বর শ্রেণির মধ্যে একজনও ভাল মানুষ নেই! বিষয়টা ওকে তখন ভাবিয়েছিল।
তারপর থেকে ওরা মামাদের বাড়িতেই থাকে। বাড়ি এবং জমিজমা উদ্ধার হয়েছিল নুপুরের বড় মামা নিমাই চাঁদ মামলা লড়ায়।
যেহেতু ওরা ভাই-বোনরা সবাই নাবালক ছিল তাই সরকারি উকিল মামলা চালিয়েছিল। মামলায় জিতলেও সবকিছু দেখাশুনার মানুষ নেই। নুপুরের মা অসুস্থ, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন, বিষয়টি শরিকদের আরো বেশি করে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
মাছগুলো ঝোঁপের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। ও বর্শি রেখে একটি মাটির ঠিলে নিয়ে আসে মাছগুলো তুলে নেওয়ার জন্য। একটা একটা করে তুলতে থাকে। যত দ্রুত সম্ভব মাছগুলো তুলে নিতে হবে। দখলদাররা দেখে ফেললে অপমানের সীমা থাকবে না। পাড়া প্রতিবেশীরা শরিকদের পক্ষ নেবে, কেউ বলবে না যে, পুকুরে নুপুরদের ভাগ আছে, বরং ওদের ভাগ-ই বেশি।
চরম উত্তেজনায় ও মাছগুলো তুলে নিতে থাকে। হঠাৎ নুপুর চমকে ওঠে। একটি সাপ ওর ডান হাতের এক বিগত দূরত্বে ফণা তুলেছে। দেখার সাথে সাথে এক পা উঁচু করে মাছ ধরার ভঙ্গিতে ও স্টাচু হয়ে রয়েছে। চিৎকার দিতে পারছে না, নড়তেও পারছে না। চিৎকার দিলে সাপটি হয়ত কামড়ে দেবে। দৌঁড়ে পালাতে গেলে সাপটা ছোবল দিয়ে দেবে।
হিন্দুরা সাপকে দেবতা জ্ঞানে পূজো করে। সাপদের নেত্রী হচ্ছে মঁনশা। নুপুর মঁনশাকে স্মরণ করে। পূজো দেয়ার কথা বলে। সাপটাকে দুধ-কলা খাওয়ানোর কথা বলে। নুপুর দু’হাত জোড় করে। সাপটা নড়ে না, ওভাবে ফণা তুলে বসে থাকে।
ভয়ে ও চোখ বন্ধ করে রাখে। পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে “হরে রাম হরে রাম” করতে থাকে। ওর দিদিমা বলেছিল, “হরে রাম হরে রাম” করতে হয়। তখন ও “হরে রাম হরে রাম” করবে না বলেছিল। এখন বিপদে পড়ে চোখ বুঝে “হরে রাম হরে রাম” করছে।
কয়েকবার “হরে রাম হরে রাম” করে আর করে না। “করবা না বলেছিলাম তো করবই না। শয়তান সাপ কামড় দিলে দিক!”
এভাবে দশ মিনিট কেটে যায়। ও নতুন একটা মন্ত্র আবিস্কার করে। বলে, “সাপ, কামড় দিস না, তোরে দুটো মাছ দিব, কারণ, তোরও তো খাওয়া দরকার, আমার বন্ধু সাইফুলদের দশটা মাছ দিব, ওদের কোনো মাছ নেই।
“সাপ, কামড় দিস না।” এভাবে আরো পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকার পর নুপুর চোখ খুলে দেখে সাপটি ওখানে নেই, ছড়ানো ছিটানো মাছগুলো অাছে, একটি মাছ হয়ত সাপটি মুখে করে নিয়ে গেছে। ঠিলের মাছগুলো আছে।
ঠিলে নিয়ে বাড়িতে আসে ও। রান্নাঘরের মেঝেতে ঢেলে গুণে দেখে ঠিক বিয়াল্লিশটা মাছ! ও তেতাল্লিশটা মাছ ধরেছিল। সত্যিই সাপটি একটি মাছ মুখে করে নিয়ে গেছে।
নুপুর এখন ভাবছে, তাহলে যার যার প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দিলেই বরং কাজ হয়, “হরে রাম হরে রাম” করে কোনো কাজ হয় না।
এটি দিব্যেন্দু দ্বীপের লেখা একটি ছোটগল্প।