খোলা চিঠি: চিঠিটি নিজের কাছেই লেখা

follow-upnews
0 0

দুটো মানুষ

দীর্ঘদিন ধরে আমি খুব নাই হয়ে আছি। তা অন্তত পাঁচ বছর। সব সময় যদি দার্শনিক চিন্তা দিয়ে জীবনকে মেনে নিতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে ভেতরে ভেতরে ভয়ঙ্কর অভিযোগ তৈরি হচ্ছে, সবকিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে সময় কাটাতে থাকলে শারীরিক মানসিক বিপর্যয় হওয়া অসম্ভব নয়। সেই ফল আমি এখন ভোগ করছি, মন না ভাঙলেও, শরীর চুরমার হয়েছে। অথবা সবই ভেঙ্গেছে ‘অহমিকার’ কারণে আমি দেখতে চাচ্ছি না।

আমার ক্ষেত্রে একটা সুবিধা হচ্ছে, সবচে খারাপ সময়টা আমি দেখে ফেলেছি অনেক আগে, ফলে যাই ঘটুক, একটা মানসিক প্রস্তুতি সবসময় থাকে। কিন্তু রিটার্ন না পেতে থাকলে একসময় মানুষ রিটার্ড করে। আমার সবসময় মনে হচ্ছে, আমি সেরকম একটি সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি হয়ত। আমার উচিত এখন নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, অন্তত কিছু দিনের জন্য, কয়েক বছরের জন্য।

পড়াশুনার অজুহাতে দেশের বাইরে যাওয়া একটা ভালো অপশন হতে পারে। দেশে আর যা যা হতে পারে সেগুলো খুব মিনিংফুল কিছু মনে হচেছ না, মন ভরছে না। প্রভাব নিয়ে না সামনে আসলে এদেশে খুব কিছু হবে না। কনটেন্ট কনসেপ্ট বা পণ্য ভালো হলেই শুধু তো লাভ নেই, যদি সাজসজ্জা এবং বিজ্ঞাপন সেইভাবে করা না যায়, বিপণন না করা যায়, সময়মতো এক্সপোজ করা না যায়। মানুষের একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট হচ্ছে মানুষ সবসময় শক্তির সাথে থাকতে চায় সে বৈধ হোক আর অবৈধ হোক, এটা সবকালেই ছিল, হয়ত এতটা দৃশ্যমান ছিল না, কারণ, দৃশ্যমানতার যুগ এখনকার মতো এরকম তো আর কখনও ছিল না।

এজন্য আমি সবসময় শক্তিশালী হওয়ার পক্ষে। শক্তিশালী না হয়ে আপনি কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু ইমেজ ধরে রেখে শক্তিশালী হওয়াটা একটা ব্যাপার, নিজের অবস্থান ধরে রাখতে না পারলে আবার হবে না। সব কূল ঠিক রেখে আমাদের মতো পরিবার থেকে আসা মানুষের সামাজিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা অনেক সময় ভাগ্যের ওপরও কিছুটা নির্ভর করে, যদিও আমি ভাগ্যে মোটেও বিশ্বাসী নই। লক্ষ্য নির্ধারণ করলে, প্রয়োজনীয় সামার্থ থাকলে এবং পরিকল্পনা ঠিক হলে তা অর্জন হবেই। দৈব দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু দৈব কোনো সুবিধা হয় এটা আমার মনে হয় না। লটারি টটারি ওগুলো তো ভিন্ন বিষয়।  

বর্তমানে বারে বারে মনে হয়, বয়স যথেষ্ট হয়েছে, এখন আর গড়িমসি চলে না, আবার ডেসপারেট হওয়ারও সুযোগ নেই, ফলে এটাই এখন মনে হচ্ছে, রিটায়ার্ড একটা অপশন। ঝামেলাটা হচ্ছে, জীবন চালানোটা, একা হলে অসুবিধা ছিল না, এরকম পাঁচ ছয়জনকে নিয়ে চলতে গেলে এইসব সামাজিক জীবনযাপন করাই লাগে, নইলে টাকাটা আসবে কোথা থেকে? যতই একাকীত্ব খুঁজি না কেন, দিনশেষে ‘বাজারে’ আসতেই হয়। কিন্তু মিনমিন করে বাজারে থেকে লাভ কী? তাতে ঐ প্রান্তিক জীবনযাপনই করে যেতে হবে লাগাতার। এতকিছুর পরে সেটি খুব বেশি কতদিন মেনে নেওয়া সম্ভব?  

কিন্তু সব বুঝেও আপনি কিছু করতে পারবেন না। এজন্যই বোধহয় বলা হয়, গরীবের দু:খবোধও এক প্রকার বিলাসিতা, কারণ, সে থাকবে সারাক্ষণ দৌড়ের উপর! সবকিছু মিলিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি যে উপসংহার হচ্ছে, তরী এভাবেই বাইতে হবে এখন পর্যন্ত। যখনই কোনো সুযোগ তৈরি হচ্ছে সেটি সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু সুযোগ তো আর টপ করে এসে হাতে পড়ে না, পদাধিকার থাকলে যেমন কিছু সুযোগ মেলে, আবার প্রভাবশালী কারো পিছে পিছে থেকেও কিছু সুযোগ তৈরি করা যায়, দুটোই আমার ক্ষেত্রে অকার্যকর। আমার মতো মন্তব্যধর্মী মানুষের তাই বেঁচে থাকা, এবং তাও এ ধরনের একটি পরিবার কাঁধে নিয়ে, তারউপর এ ধরনের একটি বিয়ে সাথে করে, আমিই মাঝে মাঝে বিস্মিত হই।

সম্ভব হচ্ছে মূলত বিশেষ কিছু দক্ষতার কারণে, কিন্তু এভাবে প্রান্তিকভাবে দীর্ঘদিন চলতে চলতে সবই একেবারে অসহ্য হয়ে গেছে। মানুষ উপভোগ বা ভোগ করে অতিরিক্তটুকু, ক্রমাগতভাবে ঘাটতি পড়লে অন্তত বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের জন্য খুব টর্চার হয়ে যায়, কারণ, তারা খুব স্থুলভাবে যখন তখন জীবন উপভোগ করতে পারে না। আমার সমস্যাটা হয়েছে ’পড়াশুনায়’। এত বহুমাত্রিক পড়াশুনার অভ্যেস কোনো দরকার ছিল না। এটা ক্ষতিকর হয়েছে। গবেষণার জন্য ভালো, কিন্তু স্বাভাবিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়া কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকলে এই বিশ্বব্যবস্থা কোনো কাজেরই আর মূল্য দেবে না। অথরাইজড্ করিয়ে নেওয়ার বিষয় আছে। হয় বেস্ট সেলার হতে হবে, অথবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হতে হবে। কোনো দিকে না হলে এইসব পড়াশুনার আসলেই কোনো মূল্য নেই।  

একটা নির্দিষ্ট দিকে হাঁটতে থাকলে অনেক পথ যাওয়া যায়, কিন্তু দশ রাস্তায় হাঁটলে সেই একই সময়ে যাওয়া যাবে ঠিক কতটুকু যদি কারও সামার্থ থাকে অনেক বেশিও?

কিন্তু আপনি না হেঁটে পারবেন না, পরিস্থিতির কারলে আপনাকে এটা করতে হবে। পরিস্থিত মানে শুধু পারিবারিক পরিস্থিতি নয়, আপনার মস্তিষ্কের গড়নও একটা পরিস্থিতি। আপনি নিজের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন, কিন্তু খুব বেশি নিতে থাকলে রিঅ্যকশন পেতে শুরু করবেন। তাই নিজের সাথেও একটা ব্যালান্স করা লাগে। প্রত্যেকার মাঝে দুটো মানুষ থাকে কমপক্ষে, এই দুটো মানুষকেই জেতাতে হয় সমানভাবে, না হলে খুব কষ্ট হবেই।

আমার ক্ষেত্রে যেটা করা প্রয়োজন হয়, প্রত্যেকটা পথের মাথায় একটা করে গন্তব্য সেট করা লাগে। হাঁটতে যখন হচ্ছে তাহলে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে লাভ কী? এটা কিন্তু অসম্ভব নয় যে একটা সময়ে গিয়ে সবগুলো গন্তব্যেই আপনি পেঁৗছে যাবেন, কিন্তু বিপদটা হচ্ছে সেক্ষেত্রে সময়টা দীর্ঘ হবেই। সে সময় পর্যন্ত মানুষ কি আপনাকে মেনে নেবে? সে সময় পর্যন্ত আপনি কি বেঁচে থাকবেন? সে সময় পর্যন্ত টিকে থাকাটাও তো একটা বিপর্যস্ত বিষয়। সাথে এরকম সব ঝামেলা যুক্ত থাকলে কী হতে পারে? কত বেশি স্টামিনা প্রয়োজন হয়? ধৈর্যের প্রয়োজন হয়? আদৌ কি সম্ভব? আমার কেন জানি মনে হয়, সম্ভব!  


 লেখক: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

Next Post

সরকারি পি.সি. কলেজে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদযাপিত

শুভ দত্ত সৌরভ, বাগেরহাট প্রতিনিধি “গ্রন্থাগারে বই পড়ি, আলোকিত মানুষ গড়ি” এই শ্লোগানে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এ দক্ষিণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ বাগেরহাটের সরকারি পি.সি. কলেজে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ২০১৯ উদযাপিত। উক্ত অনুষ্ঠানটি অত্র কলেজের কলেজ গ্রন্থাগারে অনুষ্ঠিত হয় সকাল ১১.০০ ঘটিকায়। উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অত্র কলেজ গ্রন্থাগারের আহবায়ক অনিমেষ […]
সরকারি পিসি কলেজ, বাগেরহাট

এগুলো পড়তে পারেন