Headlines

সাক্ষাৎকার: মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ কামরুজ্জামান টুকু

Sheikh Kamruzzaman Tuku

Sheikh Kamruzzaman Tuku


সংক্ষিপ্ত পরিচয়

শেখ কামরুজ্জামান টুকু, পিতা: এস.এম. বদিউজ্জামান,  মাতা: মোসাম্মৎ রৌফননেছা। জনাব টুকু জন্মগ্রহণ করেন বাগেরহাট জেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের সুনগর গ্রামে ১৪ই মাঘ ১৩৫০ সালে। 

ছাত্রাবস্থা থেকেই কামরুজ্জামান টুকু রাজনীতিতে জড়ান। দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতেন। ’৬২-’৬৩ সালে বাগেরহাট পি.সি. কলেজে পড়াকালীন সময়ে গণতন্ত্রের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে জনাব টুকু বিশেষ ভূমিকা রাখেন, এবং মূলত ঐ সময় থেকেই তিনি ছাত্রলীগের সংস্পর্শে আসেন। 

রাজনীতির পাশাপাশি তিনি পত্রিকা প্রকাশসহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। ’৬৪ সালে খুলনা আজম খান কমার্স কলেজের ছাত্র থাকাকালীন গণতন্ত্রের দাবি এবং সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা নেন। একই বছর তিনি খুলনা জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ’৬৫ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ’৬৬ সালে জেলে থাকাবস্থায় আবার খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ’৬৮ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সাথে ছিলেন। ’৬৬ সাল থেকেই ৬ দফা আন্দোলনে যোগ দিতেন। গোপনে ৬ দফার জন্য কাজ চালাতে থাকেন।  

’৬২ সাল থেকে ‘৬৮ সাল পর্যন্ত ১০/১১ বার কারারুদ্ধ হন। ’৬৬ সালের আগস্ট থেকে ’৬৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কারারুদ্ধ থাকাকালে— চিন্তা-ভাবনা করার সময় পান এবং স্বাধীনতার মন্ত্র আরো গভীরভাবে লাভ করেন। ’৬৯ সালে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী খুলনা জেলার দায়িত্ব পান এবং স্বাধীনতার প্রশ্ন সামনে রেখে বৃহত্তর খুলনা জেলায় স্বেচ্ছাসেবক মিলিট্যান্ট সাথীদের সংগঠিত করেন। ছাত্রলীগের জয়বাংলা বাহিনীতে একই কাজের তত্ত্বাবধান করেন। ’৭০-এর নির্বাচনে বৃহত্তর খুলনায় নির্বাচন পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ’৭০-এর নির্বাচন পরবর্তীতে ৬ দফা দাবী প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে অত্যন্ত সচেতনতা এবং সাবধানতার সাথে বাঙালি জাতিয়তাবাদের প্রশ্ন এবং সমগ্র স্বাধীনতার প্রশ্নকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং জয়বাংলা বাহিনীতে— এ ব্যাপারে প্রধান বাহক হিসেবে কাজ করেন।

এরই মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলে জনাব কামরুজ্জামান টুকু সামনে থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। ৩ মার্চ খুলনায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গুলি চলে এবং তিনজন নিহত হন। কামরুজ্জামান টুকু বিক্ষুব্ধ জনতাকে সাথে নিয়ে বন্দুকের দোকান লুট করে ২৭টি অস্ত্র যোগাড় করেনভ স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য পূর্ব থেকে সুসংগঠিত সাথীদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেন। এভাবে জড়িয়ে পড়েন মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বে এবং সন্মুখযুদ্ধে। তিনি মুজিব বাহিনী গঠনে এই অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন এবং বৃহত্তর খুলনা জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। 

সাক্ষাৎকার

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট এবং মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে করা দিব্যেন্দু দ্বীপের প্রশ্নের জবাবে শেখ কামরুজ্জামান টুকু বলেন,

আমি মূলত ১৯৬৬ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য যে সেলটি গড়ে উঠেছিল সেই সেলের সাথে আমি জড়িত হয়েছিলাম। আমরা রক্ত শপথ করেছিলাম। ৬৬ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র, জাতিস্বত্তার ভিত্তিতে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার জন্য আমরা একত্রিত হই। 

তারপর থেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি হচ্ছিল, ১৯৬৯ সালের দিকে আমাদের একটা ধারণা দেওয়া হয়েছিল বিদেশে আমাদের অস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া হবে। ধরে নেওয়া হয়েছিল কিউবা বা রাশিয়াতে আমাদের ট্রেনিং হবে। পরবর্তীতে ট্রেনিংটা আর হয়নি। ট্রেনিংটা বাতিল করা হয়। আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। এ সময় ছাত্রলীগ সিদ্ধান্ত নিল স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ।

এদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফার আন্দোলন, এবং ৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রস্তুতি পর্ব শুরু হলো। ভোট পর্যন্ত আমরা অস্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করিনি। নির্বাচনের পর থেকে অস্ত্রের ব্যপারটা মাথায় আসে। তখনকার সময়ে পটাশ … দিয়ে বোম বানাতে পারাটা একটা বড় ব্যাপার ছিল। বাংলাদেশ ম্যাচ ফ্যাক্টরি থেকে পটাশ মোমছাল যোগাড় করে আমরা বোমাটোমা বানাবার চেষ্টা করতে থাকলাম। এটা আমি ’৭১ এর মার্চের আগের কথা বলছি। ’৭০ এর নির্বাচন এবং ২৫ মার্চ -এর মাঝামাঝি সময়। 

আমি তখন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে কাজ করতাম। আমি স্বেচ্ছাসেব বাহিনীর ট্রেনিং শুরু করেছিলাম, গ্রামে গ্রামে, স্কুলে স্কুলে। এভাবে অস্ত্র ট্রেনিং চলতে থাকে। মার্চের মাসের ৩ তারিখ সম্ভবত খুলনা শহরে গুলি হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওখানে গুলি হয়েছিল। মুজিবর বলে একটা ছেলে মারা গিয়েছিল, ওকে আমি কোলে করে তুলে নিয়ে এসেছিলাম। ঐদিন আমরা বন্দুকের দোকান লুট করলাম। পাঁচটা বন্দুকের দোকান লুট করলাম। অস্ত্রপাতি গোছাতে গোছাতে, মোটামুটিভাবে সাতটা এমএম রাইফেল পেলাম, গুলি পেলাম, কতগুলো শর্টগান পেলাম। ২ মার্চ  থেকে, তার আগের থেকেই আমরা খুলনা শহর পাহারা দিচ্ছিলাম।

২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে যখন ঘটনা ঘটল তখন আমরা খালিশপুরে ছিলাম। খালিশপুর ফায়ার ব্রিগেড থেকে গাড়ি থামিয়ে ওরা বলল, ঢাকাতে আর্মি  নেমেছে, ঢাকাতে গোলাগুলি হচ্ছে, বহু লোক মারা গিয়েছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ হেয়েছে ইত্যাদি। এটা শোনার পর আমরা চেষ্টা করলাম ঢাকার সাথে যোগাযোগ করতে। করতে পারলাম না। তখন আমরা মনে করলাম যে ফিরে আসি, জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট আজীজ সাহেবের () কাছে আসলাম।

ওনার বাসার কাছে এসে দেখি যে ওনার বাসাও আর্মি ঘিরে ফেলেছে। এটা রাত দেড়টা দুটো এরকম সময়ে। এরপর মহসীন সাহেবের বাড়ির পাশ দিয়ে আসলাম আমার জিভটা গাড়িটা নিয়ে। আমার কাছে ঐ সময় একটা জিভ গাড়ি ছিল। আরেকজনের একটা জিভ গাড়ি আমরা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ব্যবহার করছিলাম। আলিয়া মাদ্রাসার পিছনে এসে আমরা আস্তানা গাড়লাম। ওখানে আমাদের অস্ত্রপাতিগুলো ছিল। ওটা নিয়ে আমরা আবার টহল শুরু করলাম। ঐদিন রাতে আমরা আরেকটা গাড়ি হাইজ্যাক করলাম। কারণ, জিভটা সণাক্ত হয়ে গিয়েছিল। জিভটা ফেলে রেখে নতুন গাড়িটা ব্যবহার করতে শুরু করলাম। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা বেরিকেড তৈরি করি এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিই। 

সেটার জন্য আমরা যশোর খুলনা রাস্তা কাটার জন্য খালিশপুর শিরোমণি গেলাম, সেখানে সুফিয়ান সাহেবের সাথে দেখা হলো। সুফিয়ান সাহেব তখনো জেগে ছিলেন। রেল লাইন উপড়ে ফেলা হলো। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় আমরা আমাদের স্বেচ্ছাসেবি বাহিনী কাজে লাগালাম। তারা কাজ করতে থাকলো, তারা রাস্তাঘাট উপড়ে ফেলতে থাকলো, ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলতে থাকলো। অন্য বড় রোডগুলোতেও আমরা বেরিকেড দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বেরিকেড দিয়ে যে বিশেষ কিছু হবে না -এটা এখন বুঝি তবে তখনকার হিসেবে বেরিকেড দিতে থাকলাম। ফিরে আসার পথে আর্মি আমাকে চেজ করলো। আমাকেই খুঁজছিলো, ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, টুকি কোন হ্যায়। আমি বললাম, শালা মাদার* হ্যায়। এরপর গাড়িটাড়ি ফেলে দিয়ে চলে আসলাম। 

পঁচিশ মার্চ রাত এভাবে চলে গেলো, ২৬ মার্চ রাতও চলে গেলো। ২৭ মার্চ রাতে আমি আমার সংগঠিত শক্তি নিয়ে খুলনা সার্কিট হাউজ আক্রমণ করলাম। এখানে অফিসার্স ক্লাব (সাবেক ইউএফডি ক্লাব) এবং সার্কিট হাউজ মিলে পাক আর্মির যে কনটিজেন্টটা ছিল তারা তখন এখানে অবস্থান করছিলো। ঠিক রাত আটটার সময় যখন ওরা খাবার নেয়, নিরস্ত্রভাবে খাবার লাইনে দাঁড়ানো ছিলো, আমি ঐ নিরস্ত্র খাবার লাইনে আঘাত করলাম, হিট করলাম, গুলি করলাম। ওর বেশ কিছু সৈন্য, কতজন স্পষ্ট করে মনে নেই, তবে আমার ধারণা পনেরো-ষোলোজন সৈন্য নিহত হয়েছিল। আমরা ঝটিকা আক্রমণ করে বেরিয়ে আসলাম। 

পরে শহরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে গেলো। এর মধ্যে আরেক দিন শান্তিধামের মোড়ে পাক আর্মির গাড়ি অ্যামবুশ করলাম। গোলাগুলি করে আমরা বেরিয়ে আসলাম। তখন ইতোমধ্যে পাক আর্মি যশোর থেকে ঢুকে গেছে। ফুলবাড়ি গেটে বাধা দেওয়ার চেষ্ট হয়েছিল, কিন্ত সফল হয়নি। দৌলতপুরে  বাধা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, সেটিও ফেল করেছে। বয়রায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা হয়, সেটিও ফেইল করে। আমি অবশ্য সেখানে ছিলাম না। 

এরপর আমি আমার কন্টিজেন্ট নিয়ে চলে আসলাম। আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে রুপসার ওপারে পার হয়ে গেলাম। জাহানারা লজে ঘাঁটি গাড়লাম। ওখানে ক্যাম্প করলাম। এর মধ্যে অনেক বিডিআর, অনেক পুলিশের লোক, অনেক আর্মির লোক আমাদের সাথে যোগ দেয়। এরমধ্যে পিরোজপুর থেকে একসময় মেজর জলির আসলেন। মেজর জলিলের সাথে কথাবার্তা বলে আমরা খুলনা বেতার (তখন খুলনা বেতারের ট্রান্সমিশন সেন্টার ছিল এখন যেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও দিকটায়) আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ২ এপ্রিল আমরা খুলনা বেতার কেন্দ্র আক্রমণ করি। আমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ট্রেইন্ড লোক ছিলেন সুবেদার মেজর জয়নাল আবেদিন, ওনার বাড়ি ছিল চিতলমারী। আমি যেহেতু ট্রেইন্ড না, তাই ওনার উপর নেতৃত্বের ভার অর্পণ করেছিলাম। সেখানে হাবিব সহ আরো কয়েকজন মারা গেলো। আমরা ভুলের জন্য রুপসা বেতার কেন্দ্র দখল করতে পারলাম না।

বেতার কেন্দ্রের চারপাশে ছিল কাঁটাতারের বেড়া। আমাদের কাছে অনেক অস্ত্র ছিল, কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া কাটার জন্য কিছু আমরা নিয়ে যায়নি। পুলিশ লাইনের সব অস্ত্র আমরা নিয়ে গেছি। তখন আমাদের কাছে প্রায় আড়াইশো তিনশো অস্ত্র ছিল। যাইহোক, অভিযানটায় আমরা সফল হলাম না, ফিরে আসলাম। তখন আমার আস্তে আস্তে মনে হতে থাকলো, এতদিন যা করেছি আবেগে, এভাবে যুদ্ধ হবে না, ট্রেনিং লাগবে। হয় নিজেকে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরিয়েয নিতে হবে, অথবা নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। ডিসিশন নিলাম, যুদ্ধের জন্য আমি তৈরি হব। 

এরমধ্যে বাগেরহাটে গেলাম। নাগেরবাড়িতে ক্যাম্প করলাম। আর্মি আসার খবর পেলাম। আর্মিকে প্রতিহত করার জন্য ছুটলাম ডেমার দিকে। পঁচা দিঘীর পাড়ে আমরা আর্মির মুখোমুখি হয়ে গেলাম। সেখানে আমাদের তিনজন স্পট ডেড। আমিও পাশে পড়ে গেলাম। আরো কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলল। এরপর আমি আমার বাহিনী নিয়ে বাগেরহাট দড়াটানা নদীর ওপারে চলে গেলাম। ওখানে স্কুলে আমরা ক্যাম্প করি। একটা তথ্য দিতে ভুলে গিয়েছি, জাহানারা লজে ক্যাম্প করার পর একটু পিছিয়ে দেবিপুর স্কুলেও আমরা একটা ক্যাম্প করেছিলাম। তখন খুলা বাগেরহাটের পুরনো যে রাস্তা, এই রাস্তায় আমরা যাতায়াত করতাম। 

এরপর মধু ভাইয়ের (কবির আহমেদ মধু) নেতৃত্বে এক দলকে মোরেলগঞ্জের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি ইন্ডিয়ায় গেলাম। ভারতে গিয়ে আমি সাত দিনের একটি শর্ট ট্রেনিং নিলাম। শর্ট ট্রেনিংটা শেষ করে কিছু অস্ত্রপাতি নিয়ে আবার ঢুকলাম। যাদের সাথে একসাথে আসলাম তারা ছিল বরিশালের লোক। আমি বরিশাল পর্যন্ত গেলাম। সেদিন ওখানে আবার এয়ার রেইড হয়েছে। এয়ার রেইড দেখে বুঝলাম আমার যে ট্রেনিং আছে তা দিয়ে এসব ঠেকানো যাবে না। কোলকাতায় যে আট দশদিন ছিলাম, সে কয়দিনে শুনেছিলাম যে দেশে ট্রেনিং-এর পুরোপুরি ব্যবস্থা হচ্ছে। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখলাম সবাই ডিজলোকেট (স্থানচ্যুত) হয়ে গেছে। শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে। রাজাকার সংগঠিত হচ্ছে, তাদের প্রস্তুতি চলছে। আমি আর বাগেরহাটে ঢুকতে পারলাম না তখনই। এরপর শুনি অজিয়র ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে।

এই খবর শোনার পর আমার সাথে যে কয়জন ছিল তাদের নিয়ে রফিক ভাইয়ের (রফিকুল ইসলাম খোকন) সাথে যোগাযোগ কলাম। অজিয়র ভাইকে ছাড়িয়ে নিতে আমরা বাগেরহাট থানা এবং ট্রেজারি আক্রমণ করি। আমরা থানার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সম্ভবত আমাদের কাছে ভুল তথ্য ছিল। কারণ, আমরা পৌঁছে দেখলাম উনি থানায় নেই। কোথাও ওনাকে শিফট (সরিয়ে নেওয়া) করা হয়েছিল। থানা থেকে ওনাকে আর বের করতে পারলাম। পরে তো ওনাকে মেরে ফেলেছিল। 

ওটাই আমার ট্রেনিং ছাড়া শেষ যুদ্ধ। আবার হাঁটা পথে ইন্ডিয়ায় চলে গেলাম। যাওয়ার পথে লুটেরারা জামাকাপড় সব রেখে দিল। একেবারে খালি পকেটে ওপার পার হলাম। ট্রেনিং এ সবাই চলে গেছে, আমি একেবারে শেষ ম্যান হিসেবে দেরাদুন পৌঁছুলাম। দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং হচ্ছিল। মুজিব বাহিনীর পঞ্চাশ দিনের একটি ফুল কোর্স ট্রেনিং, ট্রেনিংএ অংশগ্রহণ করলাম। সে এক কঠিন ট্রেনিং, সকাল আটটা থেকে রাত আটটা, মাঝখানে শুধু খাওয়া।  দেরাদুন ক্যান্টনমেন্টে আমাদের যে জায়গাটায় রাখা হয়েছিল সে জায়গার নাম ছিল চাকারাতা। ওখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে আবার ফিরলাম। কোলকাতায় আসলাম। আমি সাত দিনের মধ্যে আবার দেশে প্রবেশ করি। সম্ভবত জুলাইয়ের কোনো এক সময়ে ফেরৎ আসি। মাঝে মাঝে ভারতে গিয়েছি, তবে আমি দেশেই ক্যাম্প করি। আমার বাহিনীতি চৌদ্দশো ট্রেইন্ড সৈন্য ছিল।

পুনরায় দেশে প্রবেশ করে মুক্তাঞ্চল গঠনের কাজে হাত দিই। বর্তমান আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা, কলারোয়া— সাতক্ষীরার একটা অংশ; দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া— খুলনার একটা অংশ জুড়ে দুই মাস তিন মাসের মধ্যে আমরা মুক্তাঞ্চল গঠন করে ফেলি। এসব অঞ্চলের রাজাকারেরা সব পালিয়ে যায়, এখানকার সব রাজাকার ক্যাম্পগুলো যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা উচ্ছেদ করি। তার মধ্যে বাড়োয়ারি রাজাকার ক্যাম্প, পাইকগাছা রাজাকার ক্যাম্প উচ্ছেদ হয়ে যায়, শেষের দিকে এসে সবচেয়ে বড় রাজাকার ক্যাম্প— কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প উচ্ছেদ হয়ে যায়। এসময় নেভাল ফোর্স আসে, বটিয়াঘাটায় তাদেরকে আমরা জায়গা দিয়ে এবং আরো বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করি। আশাশুনিতে বেশ কয়েকটি রাজাকার ক্যাম্পে আমরা আক্রমণ পরিচালনা করি। পাটকেলঘাটায় একটি আর্মি ভ্যানে আক্রমণ করি। মোংলা বন্দরগামী পশুর নদীতে দুইবার আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর গানবোটে আঘাত করি। এরপর আমরা খুলনা শহরের দিকে অগ্রসর হই। ইতোমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমরা আগেই খুলনার চারপাশে জড়ো হয়েছিলাম। ঘোষণা আসার আগেই আমরা খুলনা ঘিরে ফেলেছিলাম— আমাদের তিন চারটে কেন্দ্রীয় দল খুলনা শহরের মধ্যে প্রবেশ করে। ভারতীয় আর্মি অ্যাটাক করার পর পাকিস্তানি আর্মি সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে, ফলে আমাদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। খুলনা শহর দখল করতে একদিন দেরি হয়েছিল, তার কারণ ছিল— যশোর থেকে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পাকিস্তানি আর্মিরা সব খুলনায় চলে আসে এবং তারা মংলায় চলে যায়। তাদের ধারণা ছিল— আমেরিকার সপ্তম নৌবহর আসবে এবং তাদেরকে উদ্ধার করবে। কিন্তু রাশিয়া এবং ভারতের তৎপরতায় যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেনি। অবশেষে ১৭ ডিসেম্বর আমরা খুলনা শহরের দখল নিতে সক্ষম হই, এবং যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এরপর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। যে যার কাজে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকে। জাতির জনকের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা অস্ত্র জমা দিয়ে দিই। তবে মুক্তি বাহিনীর একটা বিরাট অংশ নেভি এবং আর্মিতে যোগ দিয়েছিল। বাকিরা তাদের স্কুল এবং কলেজ জীবনে ফিরে যায়। আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসি। আবার নতুন ধরনের এক লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করি।

ব্যক্তিগত কথা বলতে— ’৬৬ সালে আমার পড়াশুনা শেষ হয়ে যায়। তখন আমি জেলে চলে যাই। জেল থেকে বের হয়ে ঢাকা গেছিলাম ভর্তি হওয়ার জন্য, কিন্তু ঢাকাতেই অ্যারেস্ট হয়ে যায়। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দু’টো সেশন কেটে যায়। ততৃীয় সেশন পর্যন্ত আমার পরিবার আর আমাকে সাপোর্ট দিতে পারে না, ফলে আমার আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া হয় না। সংসার জীবনে আমি প্রবেশ করেছি অনেক দেরীতে। এ প্রসঙ্গে এখানে আর কিছু বলছি না। আসলে তখন রাজনীতি করেছি আমরা দেশের জন্য, ফলে ব্যক্তিগত জীবনে সেজন্য আমাদের অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে— ’৬৬ সালে জেলে বসেই আমি রক্ত শপথ করেছিলাম যে, যতদিন না দেশ স্বাধীন হবে ততদিন আমি সংসার জীবনে প্রবেশ করব না। আমার একটি সম্পর্ক ছিল, তবে রাজনীতির কারণেই আমি তার সাথে আর যোগাযোগ রক্ষা করে যেতে পারিনি। এছাড়াও  জীবনে অনেক কিছু আমাদের বিসর্জন দিতে হয়েছে— ’৬৮ সালে এসকেএফ কোম্পানির কাছ থেকে ইংল্যান্ডে মার্কেটিং-এ ডিপ্লোমা করার জন্য একটি স্কলারশিপ পেয়েছিলাম, স্কলারশিপের সেই চিঠিটা পদ্মায় ফেলে দিয়ে আমি আবার রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অনেক কিছু করতে হয়েছে। এগুলো আরও সময় নিয়ে বলতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা— যে লক্ষ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম সে লক্ষে পৌঁছুতে গিয়ে আমাদের ত্যাগ শুধু বেড়েই চলছে। দেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে— আমরা সংবিধানে লিপিবদ্ধ যে মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে একটি দেশ গড়তে চেয়েছিলাম, সেটি কার্যত এখনও হয়নি। অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্র আমরা কায়েম করতে পারিনি, আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কাঙিক্ষত একটি পরিবেশও দেশে এখনও সৃষ্টি হয়নি। আরবীয় এবং পশ্চিমা সম্রাজ্যবাদের ভূত এখনও আমাদের কাঁধে চেপে আছে। ধর্মনিরপেক্ষতা সকল জনসাধারণ ধারণ করে না, অনেকেই নিজস্ব ধর্মীয় চিন্তা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, অনেকেই সংখ্যালঘুদের নির্মূল করতে চায়, অনেক দল এখনও ধর্মের নামে মরুভূমির আদলে একটি রুক্ষ খটখটে মধ্যযুগীয় সমাজ বাস্তবতা নির্ভর একটি দেশ গড়তে চায়। অনেকেই নারীদের গৃহবন্দী করতে চায়। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে আমরা নৈতিক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক শিক্ষার যথেষ্ট বিস্তার ঘটাতে পারিনি। এতসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেটি দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, সারা বিশ্বে অনুকরণীয়। আমাদের ভাতের ক্ষুধা মিটে গেলে সমাজ গঠনের কাজ আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণভাবে করা যাবে। যদিও কিছুটা দেরি আমাদের হয়েছে, তারপরও আমি খুব আশাবাদী— বাংলদেশ এগিয়ে যাবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ নির্মিত হবে আপনাদের মতো নতুন প্রজন্মের আলোকিত মানুষের হাত ধরে।