ছোটগল্প: উপার্জন

ছোট গল্প

স্বামী দুই বছর পর পর দেশে আসে। মাস খানেক থাকে, এই সময়ে তার প্রধান কাজ হচ্ছে স্ত্রীকে গর্ভবতি করে রেখে যাওয়া। এভাবে সে খানিকটা নিশ্চিন্ত থাকতে চেষ্টা করে। ইয়ারুন চায় না, তার টাকায় স্ত্রী দেশে ফূর্তি করে বেড়াক অন্য পুরুষদের সাথে। মধ্যপ্রাচ্যে থাকে সে, বাঙালির আবহমান পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীলতার সাথে তার ভাবনায় নতুন যুক্ত হয়েছে নারীর প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের দৃষ্টিভঙ্গি।

সায়রা আপাতভাবে স্বামীর প্রতি ভীষণ অনুগত, তবে জীবনের মানে সে কিছুটা হলেও বুঝতে চায়। সে বুঝে নিয়েছে হিংস্র বাঘকে ভুলানোর চেয়ে পালানো ভালো। সে পালিয়ে বাঁচে। জীবনকে সে অভুক্ত রাখতে চায় না, তাই বলে পারে না সীমা ছাড়াতে, অতটা শিক্ষা এবং সাহস কোনোটিই তার নেই। সাত বছরে তিনটি বাচ্চা! এতদিন মুন্সিগঞ্জে শশুরালয়ে থাকত ওরা, সেখানে এক দেবরের অত্যাচার সইতে না পেরে দূর সম্পর্কের এক ননদের সাথে চলে এসেছে ঢাকায়। স্বামীর সাথে পরামর্শ করেই এসেছিল।

রুবিলা অনেকদিন ধরে ঢাকায় থাকে। বাড়িতে অসুস্থ পিতা-মাতার জন্য কাজ করে টাকা পাঠায়। বিয়েথা করার সুযোগ হয়নি, বলতে গেলে ছোটবেলা থেকে পিতা-মাতাকে তারই দেখা লাগে। বড় তিনভাই একসাথে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সেই থেকে মা একরকম শয্যাশায়ী। পিতাও বেশিরভাগ সময় সুস্থ থাকে না। এ অবস্থায় রুবিলা গ্রামে কোনোভাবেই আর পেরে ওঠে না। পিতা-মাতার জন্য একজন লোক রেখে সে ঢাকায় চলে এসেছে দুই বছর হলো। তার তো শিক্ষাদিক্ষা এমন কিছু নেই, কী এমন আয় করবে যা দিয়ে সেও চলবে, পরিবারও চালাবে!

খুব কষ্ট করে প্রথম প্রথম বাড়িতে তিন-চার হাজার টাকা পাঠাত। ও দিয়ে তো বাড়িতে চলে না। ঢাকায় তারও চলে না। গার্মেন্টসে চৌদ্দ ঘণ্টা ডিউটি করে ওর ক্লান্ত লাগে খুব, অভ্যেস তো নেই এতটা, পেরে ওঠে না। তার ওপর শরীরটাকে তার বোঝা মনে হয়। চোখ টাটায় শহুরে সব পুরুষেরা, নাখাভূখা, ভদ্র-অভদ্র কেউ বাদ যায় না।

গার্মেন্টসে অনেকবার সে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছে। মালিককে একদিন নালিশ করে বিপত্তি আরো বেড়ে যায়। মালিক বলে, “ও তো একটু এ বয়সে হয়ই, মিলেমিশে থাকো। আসিও মাঝে মাঝে কোনো সমস্য হলে।” রুবিলা পুরুষের রকম বুঝে পায় না, শরীর-মনের, পরিবারের কোনোকিছুর খবর জানে না, সিনতাইকারীর মত ছো মেরে নিতে চায় শুধু তার যা দরকার।

কয়েকদিন আগে ম্যানেজারের কাছে সে টাকা ধার চেয়েছিল, ঠিক ধার না, বেতনের টাকা অগ্রীম চেয়েছিল। বেতন নেওয়ার সময় দেখে ম্যানেজার টাকাটা আর কেটে রাখেনি। পিতা ভয়ানক অসুস্থ থাকায় সেও আর কিছু বলেনি। ভেবেছে সামনের মাসে দিয়ে দেবে। ম্যানেজারটিকে তার বেশ ভালো মনে হয়েছে। গতকাল কামরায় এসে একবার খোঁজ নিয়ে গেছে।

হঠাৎ পিতা-মাতা দুজনই অসুস্থ হওয়ায় রুবিলা ভেঙ্গে পড়েছে, ওভারটাইম করছে প্রায় পুরো মাস, তাতেও বেতন মাস শেষে আট হাজার টাকার বেশি হয় না। শোষণে পিষণে সবাইই এখানে নিগৃহীত। সবারই একরকম স্বাস্থ্য ও মনের অবস্থা, পারিবারীক অবস্থাও খুব বেশি হেরফের নয়।

রুবিলার আঁটোসাটো শরীর ভাঙতে একটু সময় লাগছে। ও ভাবে, শরীরটা পড়লেই বরং বাঁচি। দরিদ্র নারীর উচ্ছন্ন শরীরে চারপাশের পুরষের যেন একচ্ছত্র অধিকার–ছেলেবুড়ো সবারই দৃষ্টি একই!

ম্যানেজার আবার তাকে দুই হাজার টাকা ধার দিয়েছে। খুব একটা বাজে দৃষ্টিতে তাকায় না সে, রুবিলার ভালো লাগে। রাক্ষসের রাজ্যে কাউকে একটু আলাদা পেলে মানুষ বিশেষভাবে বিগলিত হয়।

আজীবন প্রচলিত হয়ে আছে–নারীকে চেনা দায়, আসলে পুরুষেরই অনেক রং, নারীর নয় অতটা। আজকে ম্যানেজার সকালে রুবিলাকে ডেকেছে। বলে, “মালিকের একটি বাংলো আছে সাভারে, সেখানে বিশেষ একটি আলোচনা আছে কারখানার কর্মীদের প্রমোশন এবং বেতন নিয়ে, রুবিলা চাইলে তার সাথে যেতে পারে।”

ম্যানেজার খুব একটা জোর করে বলে না। ভাবটা এমন, যাবা কিনা ভাবো। রুবিলা রাজি হয়, তার অভাগা জীবনে কোনো সুযোগ তো সহজে আসবে না, তাই ‘ভালো ম্যানেজারের’ সাথে সে যেতে রাজি হয়।

ম্যানেজার সারা পথ তেমন কোনো কথা বলে না। সাভার থেকে আরো বেশ কিছু দূরে নবীনগরের একটি গ্রামে নিয়ে যায় সে। ওখানে একটি বাড়িতে নাকি মিটিং। কিছুটা গ্রাম্য পরিবেশে মাঝে মাঝে সময় কাটায় গার্মেন্টসের মালিক অলিউল্লা আহমেদ। বাড়িটি আসলেই চমৎকার একটি বাগানবাড়ি। উঠানের দুইধারে ফলফুলের বাগান, বাড়িটার পিছনটাতে অনেকখানি জায়গাজুড়ে কাঁঠাল গাছ। বাগানে একজন নারী একজন পুরুষ কাজ করছে। বেশ স্বাভাবিক পরিবেশ।

রুবিলাকে দোতালার ঘর খুলে দারোয়ান বসায়, ম্যানেজার কিছু বাজার করার কথা বলে চলে যায়। একটু পরে মধ্য বয়সী একজন নারী এসে তার সাথে কুশল বিনিময় করে। বলে, বাড়িটি সে-ই দেখাশুনা করে, কেয়ারটেকারকে ডেকে এক বোতল পানি এবং কিছু স্নাক্স জাতীয় খাবার দিতে বলে। রুবিলা বিস্মিত হয়, গার্মেন্টসের পরিবেশের সাথে এসব মেলে না। তবু সে স্বাভাবিক থাকে, বাড়িতে অন্য লোকজন রয়েছে এবং বাড়িটিতে সেই অর্থে তেমন কোনো ভূতেুড়ে পরিবেশ নেই।

কিন্তু অনেক লোক থেকে লাভ কি যদি সবাই আপনার জন্য শিকারী হয়? একটু পরে মালিক আসে। ঐ নারীটিকে সাথে নিয়ে মালিক ঘরে ঢোকে। রুবিলাকে দেখে বলে, “ও তুমি, আমি জানতাম তুমি আসবে। না এসে পারবে না। আমি মাইন্ড করি না, ওরা কী নিয়েছে তুমি কী দিয়েছ -এসবে আমি মাইন্ড করি না। এত মাইন্ড করলে মালিক হইতে পারতুম, বলো? শিক্ষাদিক্ষা অত লাগেনি আমার, শুধু মাইন্ড করিনি আমি। আরে, চুপ কইরা আছো যে, আমি ফুসলাইতেও মাইন্ড করি না, ফাঁসাইতেও মাইন্ড করি না, প্রয়োজনে সরাইতেও পারি।”

হঠাৎ পকেট থেকে পিস্তল বের করে পাশের টেবিলে রাখে। রুবিলা কাঁপতে থাকে, কিছু বুঝতে পারে না। বারে বারে ঐ নারীর দিকে তাকায়। জনৈকা তাকে স্বান্তনা দেয়, বলে, “স্যার ড্রিঙ্কস করেছে, আমার শীরর খারাপ, আজ একটু তুমি তাল দাও বোন আমার।” রুবিলা উঠে যেতে চায়, নারীটি তাকে হ্যাচকা টানে আবার বসায়ে দেয়, বলে, “বোন, এখানে ঢোকা যায় বেরোনো যে যায় না।”

ঐ ভালো ম্যানেজরাটি আর আসে না। রুবিলা ঢাকায় ফেরে, পিতা-মাতার কথা ভাবতে থাকে বারে বারে। শীরর ধুয়ে ফেলতে চায় বাথরুমে কষ্টে রক্ষিত সবটুকু পানি ঢেলে, ক্ষতগুলোতে যেন রাজ্যের বিষ মিশেছে, বারে বারে ধুয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে চায়।

অনেক রাতে সায়রা ভাবি এসে দরজায় নক করে। ও জেগেই ছিল, দরজা খুলে দেয়। কই, রোজ এসে তো একবার দেখা করো, আজ তোমার কোনো সাড়া পেলাম না যে। ভাবি, শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল।

খেয়েছো। নাহ! আজকে আর খাব না।

দুজনে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে। সায়েরা তার নিজের কথাই বলতে চায়। তাতে খানিকটা লাভই হয়, রুবিলা ভুলে থাকতে পারে কিছুটা। সায়েরার স্বামী জানিয়েছে, ওদেশে সে একটি বিয়ে করবে, সে অনুমতি দিলেও করবে না দিলেও করবে। পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছে। সায়েরা টাকা নিতে রাজি হয়নি।

কোলে একটা পিঠে একটা, বড় সন্তানটা নানার কাছে থাকে। টাকা নেওয়ার প্রয়োজন আছে কিন্তু উচিৎ জিদটুকু সে ছাড়তে পারছে না কিছুতে। এত বছরে স্বামী তার কাছে থাকেনি বললেই চলে, অপেক্ষার ভূত এতদিন আগলে রেখেছে তাকে, আর সে আগলে রাখত তিনটি সন্তানকে। ভাবত, স্বামী বিদেশ বিঁভুইয়ে কাজ করে কষ্ট করে টাকা পাঠায়, যতটুকু খরচ না করলে নয়, এভাবেই সে চলেছে এতদিন।

সব সমস্যার কথা সে ভুলে গিয়েছে, অভিমান মানুষকে তার ন্যায্য দাবী থেকে বঞ্চিত করে। সায়েরাও তার স্বামীকে নি:শর্তে অব্যাহতি দেয়। ইয়ারুন মাঝে মাঝে সন্তানদের জন্য সায়েরার একাউন্টে টাকা পাঠায়, সে টাকাগুলো তোলে না, আসলে খবরও রাখে না আর। পাঠায় কিনা জানে না। ওদিকে ইয়ারুন ভাবে, সায়েরা নাগর জুটিয়ে ভালোই আছে, টাকা পেয়ে একটা ফোনও তো করে না তাকে, তাই এক সময় টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

গত তিন মাস ধরে গয়না বেঁচে চলছে সায়েরা। রুবিলা ঐ গার্মেন্টসে আর যায়নি, শরীরটাকে মন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে জোর করে, কেউ চোখ টাটালে সেও তাকিয়েছে, এভাবে চলছে মাস দুই ধরে। পুরুষের প্রতি ভীষণ ঘৃণা তার, ফাঁদে ফেলতে চায় জঘন্য এসব পুরুষদের, পারে না, উল্টে সে নিজেই ফাঁদে পড়ে যায়। এসব পুরুষ বেশ্যাকে দুই পয়শা বেশি দিতেও জানে না। রুবিলা বুঝতে পারে, সমাজের ঘাড়ে কতটা পাপ জমে আছে নারীকে এভাবে নিগৃহীত করে আবার বেশ্যা বলে গালি দেওয়ায়।

শরীর একটুও সাড়া দেয় না তার এসবে, কেনোভাবেই আর পেরে ওঠে না। অবশেষে ভিন্ন বুদ্ধি আঁটে। খদ্দের ধরতে গিয়ে ওর পরিচয় হয়েছিল সানজানা নামে বেশ চটপটে একটি মেয়ের সাথে। ওকে রুমে ডাকে, দুজনে একটা ফন্দি করে। কেউই আর শোবে না, তবে আয় করতে হবে, ভদ্রদের ফাঁদে ফেলতে হবে।

বুদ্ধিটা কাজে দেয়। একজনে একটা খদ্দের ধরতে পারলে তাকে নিয়ে রিক্সায় ওঠে। এরপর রুমের চাবি নিতে হবে বলে খানিক দূরে গিয়ে রিক্সাটা দাঁড় করায়, এরপর লাফ দিয়ে উঠে পড়ে অন্যজন, প্রায় পুরুষটির কোলে বসে তাকে রিক্সায় উপর উঠে বসতে বাধ্য করে। রিক্সালা থাকে কন্টাকটের, এরপর আস্তে আস্তে কথা বলে হাতিয়ে নেয় টাকা পয়শা মোবাইল। একটু পরে নামিয়ে দেয় লোকটিকে। এক এলাকায় একটি বা দুইটি খ্যাপ মেরে চলে যায় ওরা অন্য এলাকায়।

ওদের ফাঁদে উকিল মোক্তার সর্দার অনেকেই পড়েছে, তবে কোনো ছা-পোষা মানুষকে কখনো ফাঁদে ফেলেনি। খুব বিপদের সময় শুধু টাকাটা রেখে ছেড়ে দিয়েছে। মোবাইলটাও নেয়নি। একবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে ছেড়ে দিয়েছিল পাঁচশো টাকা রেখে, সাথে উপদেশও দিয়েছিল, বলেছিল, “কাউকে ভালোবেসে এসব করতে হয়। এভাবে না।”

ইদানিং সায়রা ভাবি প্রায়ই অসুস্থ থাকে। কোলের ছেলেটিও দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ কোনো সমস্যা তা না, দুশ্চিন্তায় ভাবির এই অবস্থা হচ্ছে। রুবিলা যতটুকু পারা যায় সময় দেয়, টাকা পয়শাও দেয়। সে ভাবিকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছে গত পরশুদিন। বড় একটা ইলিশ মাছ কিনে এনেছিল জজ কোর্টের সামনে থেকে, দুজনে ঘটা করে রান্না করে খেয়েছে। ভাবির মনটা একটু ভালো হয়েছে এই দুইদিনে। সেলাই মেশিনটা নিয়ে সে কত কী যে করছে!

রুবিলা স্বাভাবিক থাকতে পারে না মোটেও, কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না। ভাবি গুনাক্ষরেও টের পায় না কিছু। ভেতরটা তার ভেঙ্গেচুরে যায়, তবু বেঁচে থাকে, পিতা-মাতার জন্য, সায়রা ভাবি এবং তার বাচ্চা দুটোর জন্য।


দিব্যেন্দু দ্বীপ-এর গল্প সংকলন থেকে গল্পটি নেওয়া হয়েছে।