ছোটগল্পঃ ভয় // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0

একবার মরুদেশ ফৈরাতে ভয়ঙ্কর কিছু রোগ দেখা দেয়। শিশুরা বাড়ছে না, নারীদের ত্বকে এবং চুলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। অনেকে লিভার এবং কিডনি ফেইলিউর হয়ে মারা যেতে থাকে। সে অনেককাল আগের কথা। ৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের কথা। ফৈরাতের সরকার তখন বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তিত। ফৈরাত তখন চলত একটি দ্বিস্তরের সরকার ব্যবস্থা দ্বারা। উচ্চকক্ষে ছিল বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং চিকিৎসকেরা এবং নিম্নকক্ষে ছিল রাজনীতিকেরা। কিন্তু ৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে সেখানে একটি বিপ্লব সংগঠিত হয়, এটি ছিল একটি ধর্মবিপ্লব। ঐ বিপ্লবের পরে ফৈরাতের উচ্চকক্ষে প্রধান হিসেবে আসীন হন একজন ধর্মগুরু। নাম তার সিনভেগ।

বর্তমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য সফর মাসের দশ তারিখে সিনভেগ একটি সভা আহ্বান করেন। সভায় উচ্চকক্ষের একশোজন সদস্যের সবাই হাজির হয়। সিনভেগ সভার সভাপতি, যদিও বর্তমান সমস্যা বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞ নন, আবার তিনি বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক বা দার্শনিকও নন, কিন্তু তার রয়েছে অসাধারণ নেতৃত্ব গুণ এবং অদৃষ্টের ভয় দেখিয়ে জনগণকে ভুলিয়ে রাখার ক্ষমতা। ফলে জনগণ এখন তার কব্জায়। বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকেরাই মূলত আজকের সভার কেন্দ্রবিন্দু। তারা সিদ্ধান্ত দেন যে, আমিষ জাতীয় খাবারের অভাবেই ফৈরাতে বর্তমান রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে।

ফৈরাতের বেশিরভাগ মানুষ তখন মাছ মাংস খায় না বললেই চলে, আবার মরুদেশ হওয়াতে সকল ধরনের শাক সবজিও যথেষ্ট নয়। ফলে মাঝে মাঝে খাদ্যাভাব চরমে ওঠে। আছে উঠ আর দুম্বা, কিন্তু সেগুলো মানুষ খায় না। মানুষ কিছু পশুপালন করে— কিছু উঠপাখি, মুরগী পালিত হয়, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। তাছাড়া মরুভূমি হওয়াতে পালিত পশুগুলো বাঁচিয়ে রাখাও খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণেই মূলত ফৈরাতের মানুষের মাঝে আমিষের অভাব দেখা দিয়েছে। 

সিনভেগ সফর মাসের সতেরো তারিখে রাজনীতিকদের নিয়ে আরেকটি সভা আহ্বান করেন। এই সভায় উচ্চ কক্ষ থেকে সিনভেগ তার মাত্র কয়েকজন বিশ্বস্তকে রেখেছেন। আজকের আলোচনার বিষয়, কীভাবে আমিষের অভাব দূর করা যায়। রাজনীতিকরা সবাই সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, উট এবং দুম্বা কেটে খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই, কারণ, এ দুটো থেকেই এক সঙ্গে বেশি মাংস পাওয়া যাবে এবং তারা মরুভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে বেঁচেও থাকে। আরও সিদ্ধান্ত হলো, আগামী মাসের পনেরো তারিখে একশো দুম্বা হত্যা করে মাংস বিতরণ করা হবে।

এর আগের এত বড় প্রাণী কখনো হত্যা করা হয়নি। ফলে হত্যা করার দিন বাঁধলো বিপত্তি। অনেকেই এ হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারছে না। বেশিরভাগ মানুষ এ মাংস নিলো না, প্রায় সব মাংসই আরব সাগরে ভাসিয়ে দিতে হলো।

সিনভেগ আবার সভা আহ্বান করলেন। এবার বসলেন কিছু ধর্মতাত্ত্বিকদের নিয়ে। তখনও ফৈরাতে কোনো প্রতিষ্ঠিত ধর্ম নেই, কিন্তু ইতোমধ্যেই কিছু ধর্মগুরু বিচ্ছিন্নভাবে আছে। তবে সিনভেগই প্রধান ধর্মীয় নেতা হয়ে উঠেছেন সেখানে। সভা থেকে সিদ্ধান্ত হলো একযোগে জিলহজ্জ্ব মাসে গাছতলায় একশো দুম্বা বলি দেওয়া হবে। তার আগে ঘোষণা দেওয়া হবে যে, সিনভেগ স্বপ্নে পেয়েছেন ঈশ্বরের নামে এই বলি দিয়ে মাংস বিতরণ করলে ফৈরাতের মানুষের রোগমুক্তি ঘটবে। তখন গাছতলায় একটি পাথর রেখে পূজো করত ফৈরাতের মানুষ। বলির দিন লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। নারী, শিশু, পুরুষ সব লোকে ভীড় করে আনন্দের সাথে দেখতে লাগলো বিশাল বিশাল দুম্বা বলি দেওয়া। আজ আর কেউ ভয় পাচ্ছে না, সবাই হাত তালি দিয়ে আনন্দ করছে, আনন্দ করতে করতে মাংস নিয়ে সবাই বাড়ী ফিরে যায়।

এরপর থেকে নিয়মিতই ফৈরাতের মানুষ উট এবং দুম্বা বলি দিয়ে ভক্ষণ করতে থাকে। সত্যি সত্যি কয়েক বছরের মধ্যে রোগের প্রাদুর্ভাবও কমে গেল। সিনভেগ চলে গেলেন অন্য এক উচ্চতায়। বলতে গেলে সবাই সিনভেগকেই এখন ঈশ্বর ভাবে। কেউ জানে না উচ্চকক্ষের সেইসব বিজ্ঞানী এবং ডাক্তারদের নাম। এরপর থেকে ফৈরাতের রাজনীতি এবং ধর্মীয় আচারে নতুন মেরুকরণ হতে থাকে। সে ইতিহাস দীর্ঘ এবং জটিল।

Next Post

তোমাকে দেখার পরে

নারী, কী এমন হয়? কবির কাব্য কথায় হয় কি তোমার কোনো ক্ষয়? এত স্বর্গ তোমার লুকিয়ে রেখেছো সযতনে, কেউ কি নাই পৃথিবীতে যে তোমাকে চাইতে পারে অপার্থিব সে ঐকতানে? তোমায় দেখে দেখে অবিরত নেশার ঘোর আমার, মরূভূমিতে এবার উপচে পড়ুক বিন্দুতে প্রস্ফুটিত মহাসিন্ধু তোমার।
Tanima Zaman