বাইরে শেষ পর্যন্ত আমারই যাওয়া লাগে, আবার অভিযোগের তীরও আসে আমার দিকে। ভাবটা এমন যে, আমি যেন করোনা আনতে বাইরে যাচ্ছি! অথচ যাই কিন্তু মাছ তরকারী, চাল ডাল ওষুধ ইত্যাদি আনতে।
ভেবে রেখেছি, আমি আর বাইরে যাব না, দেখি ওরা কী করে। আমার ভাবান্তর দেখে কেউ আর কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। সকালে উঠে একজন আপন মনে বলতেছে, তরকারী তো কিছু নেই, কী দিয়ে যে কী রান্না করি! আমি শুয়ে শুয়ে শুনতেছি, উঠব তো বারোটায়। উঠে ঈশপের সাথে একটু ধস্তাধস্তি করে, কম্পিউটারে বসব— আজকে নেত্রকোণায় ঢুকব।
ভাবনা অনুযায়ী বারোটায় ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকর্ম সেরে খেয়ে নিলাম, চা বানিয়েও খেলাম। ঈশপের সাথে জমানো খুব কঠিন, তারপরও চেষ্টা করলাম। দুইটার দিকে কম্পিউটারে বসলাম। এবার শুনতেছি মাসি বলতেছে (চিকিৎসা করতে এসে আটকে গেছেন উনি, সাথে মেয়েটাও)— ফিলমেট আর রেনামাইসিন লাগবে, তার মেয়ের পেটের অসুখ কমতেছে না, আমাকে অবশ্য বলতেছে না।
আমাকে আজকে আর কেউ কিছু বলবে না। দেখলাম, আমার নিজের ওষুধও শেষ। ঠিক আছে, অভিমান সরায়ে রেখে যাই তাহলে নিচেয়।
নামলাম, নেমে দেখি বৃষ্টি বেশ জোরেই হচ্ছে, ছাতা নিয়ে তো নামি নাই —এখন কী করি? সাইনোসাইটিসের সমস্যা আছে, বৃষ্টির পানি মাথায় পড়ার সাথে সাথে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে।
যাগগে, আবার কে অত উপরে উঠবে, দিলাম একটা দৌড়, এক দেড়শো মিটার দৌড়ে পৌঁছে গেলাম সবচেয়ে কাছের ওষুধের দোকানে। হায়! দোকান বন্ধ। কিছুক্ষণ দাঁড়ায়ে থাকলাম। কিছুদূরে একটা রিক্সা দেখে ডাক দিলাম— পাত্তা দিল না। বৃষ্টি পড়লে রিক্সালারা আমাদের মতো হোমড়া চোমড়াদের পাত্তা না দেবার একটা সুযোগ পায়, সে সুযোগ তাদের দিক থেকে বৈধ। মেনে নিলাম।
আবার একটা দৌড়— হঠাৎ অনুভব করলাম পায়েল তলা হালকা হয়ে গেল, স্যান্ডেলের সোল খুলে ঝুলে গেছে। এবার? খালি পায়ে দৌড় দিলে পুলিশ পিছন থেকে এসে বাড়ি দিতে পারে, বাটার স্যান্ডেল পায়ে থাকলে বাড়ি দেয়ার আগে দুইবার ভাববে, ততক্ষণে কিছু একটা বুঝ দেওয়া যাবে।
আশেপাশে তাকায়ে সুতলি খুঁজছি, করোনার ভয়ও পাচ্ছি। এক হাত পরিমাণ একটু সুতলি দিয়ে কোনোমতে সোলটা বেঁধে নিলাম, এরপর খুড়িয়ে খুড়িয়ে পৌঁছে গেলাম ওষুধের দোকানে। গিয়ে দেখি, যুবক বয়সী একটি ছেলে কেবল দোকান বন্ধ করতেছে। বললাম, ভাই দোকান খোলা যাবে না? খুলবে না। বললাম, অনেক ওষুধ নিব। যুবক তো, তাই মান সম্মানে লেগেছে খুব, বলে, এক হাজার টাকার ওষুধ নিলেও খোলা যাবে না।
অনেক টাকার ওষুধ নিব শুনে তার যে ইচ্ছেও করছে খুলতে তা কথাটা বলার সুরের মধ্যেই অন্তর্নিহীত ছিল। তার সম্মানে প্রলেপ বুলাতে বললাম, ভাই, খুব জরুরী দরকার। বর্তমানে আপনারাই তো ত্রাতা। কাজ হলো, দোকান খুলে ওষুধ দিল।
এবার খুড়িয়ে খুড়িয়ে গেলাম তরকারীর ভ্যানের কাছে। গিয়ে দেখি ঝিঙে আছে, ঝিঙে খুঁজতেছি গত পনেরোদিন ধরে। বাসায় কিডনি রোগী, বাজার করতে হয় হিসেব করে, কিডনে রোগীর ফর্দ মেনে, ঝিঙে খাওয়ায় নিষেধ নেই, দুই কেজি কিনলাম, আরো তরকারী কিনতে হবে।
ইতোমধ্যে একজন আসছে, এসেই বলতেছে দশ টাকার মরিচ দিতে। ছোকড়া দোকানদার তাকে কোনো পাত্তাই দিল না। পাত্তা দেবেই বা কেন? বৃষ্টির মধ্যে একশো টাকা দিয়ে দুই কেজি ঝিঙে যে কিনেছে সে তো তার কাছে তখন দেবতা, দশ টাকার মরিচ যে কিনবে তার কোনো মূল্য আছে তখন?
আমি বললাম, এই ছেলে, মরিচটা দিয়ে দাও। জীর্ণ শীর্ণ মলিন পোশাক পরা লোকটা তখন বলল, না, ওনাকে আগে দিয়ে দাও। বুঝলাম, লোকটা হয়ত ভাবতেছে আমি চলে গেলে সে দরদাম করে কিছু কম দামে কিনতে পারবে। আমার সামনে তো আর দোকানদার আমাকে যে দামে দিয়েছে তার চেয়ে কম দামে তাকে দিতে পারবে না।
এই সাইকোলজি যারা বাজার করেন তাদের নিশ্চয়ই জানা আছে। দেখবেন, আপনি যখন কিনতেছেন তখন আশেপাশে দুএকজন চুপ করে দাঁড়ায়ে থাকে, মানে আপনি যে দামে কিনছেন তার চেয়ে কিছু কমে কেনার চেষ্টা করবে। আমিও যে জীবনে এটা করি নাই তা না।
মোট তিনশো টাকার তরকারী কিনলাম, তাতে যে খুব ভারী হয়েছে এমন নয়। কিন্তু কিছুদূর এসে বিপত্তি বাধলো— সম্ভবত পলিথিনটায় ছোট্ট ফুটো ছিল। ফুটোটা বড় হয়ে লাউ অর্ধেক বেরিয়ে গেছে।
আপনারা হয়ত ভাবতেছেন, এগুলো কোনো সমস্যা হলো— কিন্তু তখন আমি যে কতটা অসহায় তা টের পেয়েছিল মাথার উপর থেকে পর্যবেক্ষণরত থাকা দোতালার এক নারী।
আমি যখন বিভিন্নভাবে তরকারীগুলো বহন করার চেষ্টা করছি, এবং একটা ঠিক করতে আরেকটা উল্টে পড়ছে, তখনই গ্রিক দেবী যেন উড়ে এসে আমার মাথার উপরে হাজির হলো। পড়ল দুইটা পলিথিন।
সুন্দর মতো তরকারীগুলো এঁটে গেল তাতে। উপরে তাকাতেই দেখি গ্রিক দেবি উধাও! হইলো কিছু এইডা? দেখবোনা একটু? নিরুপায় হয়ে বাসার নম্বরটা দেখে রাখলাম, এই পথ দিয়ে আসা যাওয়ার সময় উপরে তাকাতে তাকাতে যাব।
জীবন এমনই, দুঃখ কিছুতেই নিবারণ হয় না, একটা কাটতে না কাটতে মানুষ দুঃখ আরেকটা বানিয়ে নেয় তৎক্ষণাৎ, নইলে কেন সে নারীর জন্য বুক ধুক ধুক করবে আমার?
যাক, নিজেকে ক্ষমা করে দিলাম— বৃষ্টির দিন তো, মন একটু উচাটন হতেই পারে।
বাসার গেটে এসে আরেক ঝামেলা— দারোয়ান খুব বিনয়ের সাথে বলে, দাদা, হাত-পা ধুয়ে ওঠেন, খালি আপনিই ধোন না, আর সবাইতো ধুয়ে ওঠে। বললাম, হাত পা ধুতে গিয়ে করোনা বাধানোর ইচ্ছে আমার নেই। উঠে গেলাম।
হাতের জিনিসগুরো কোয়ারিন্টিনে রেখে বাথরুমে ঢুকলাম। অনেকক্ষণ ধরে গায়ে পায়ে বেধে থাকা করোনাগুলো সব মেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে অনুভব করলাম খুব একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে— আচ্ছা অনলাইনে এক প্যাকেট সিগারেট অর্ডার দেওয়া যাবে না?
[আমাদের উচিৎ নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা। ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাওয়ার অভ্যেস করতে হবে। একমাত্র ক্রেতা সচেতন হলেই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হবে।]