“কষ্ট পাচ্ছি, তবে অভিজিতের পিতা হতে পেরে গর্বিত”

09Sayantan4_222714
হত্যাকাণ্ডের শিকার লেখক অভিজিত রায়ের পিতা পদার্থ বিজ্ঞানী অজয় রায়।
09avi_224623
লেখক এবং প্রকৌশলী অভিজিত রায়, তিনি বাংলাদেশে সরকারের সেন্সরশিপ এবং ব্লগারদের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের সমন্বয়কারক ছিলেন। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় অজ্ঞাত ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা তাকে কুপিয়ে হত্যা ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা কে আহত করে।

অজয় রায় সব সময় ঘরের কোণে পড়ে থাকা ক্রিকেট ব্যাটটির দিকে তাকিয়ে থাকেন, তার মনে পড়ে যায়, খেলোয়াড়টি আর বেঁচে নেই। অজয় রায়ের পুত্র, অভিজিত রায়, আমেরিকা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার, এসেছিলেন তার অসুন্থ মাকে দেখতে। বইমেলা থেকে ফেরার পথে তিনি মৌলবাদীদের হাতে খুন হন।
অভিজিতের পিতা অজয় রায়, ৮০, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেছেন, “দুঃখটা আমার ব্যক্তিগত, তবে আমি মনে করি আমার পুত্র সবদিক থেকে আমাকে ছাড়িয়ে গেছে। অভিজিতের পিতা হতে পেরে আমি গর্বিত।”
অভিজিৎ, ৪২, স্কুল জীবনে ক্রিকেট খেলতে পছন্দ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েও অভিজিৎ রায় মাঝে মাঝে ক্রিকেট খেলতেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অজয় রায় বলেন, “আমি যখন ওর জন্য ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে আসতাম, ও আমাকে ‘ভালো বাবা’ বলে সম্মোধন করত।”
ব্যাট পড়ে আছে, মানুষটি নেই। অজয় রায় এখন তার শান্তিনগরের বাসায় তার স্ত্রী এবং ছোট ছেলে অনুজিৎ রায়ের পরিবার নিয়ে থাকেন।
দুঃখ তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এখনো তিনি মানবাধিকারের দাবিতে সংগঠিত র‌্যালিতে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি বলেছেন, “ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। যেভাবে বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গায় মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সেটি খুব উদ্বেগজনক। আমরা যদি অসাম্প্রদায়িকতার জন্য আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত না রাখি তাহলে কতজন অভিজিৎ খুন হবে তার কোনো ঠিক নেই।
পিছন থেকে তিনবার চাপাতি দিয়ে আঘাত করে তার সন্তানকে খুন করা হয়েছে বলে তিনি বর্ণনা করেন।
“আমি ভাবতে পারি নাই যে, অভিজিৎকে খুন করা হতে পারে, আমি ভেবেছিলাম লেখালেখির জন্য তাকে বড়জোর কেউ শারীরিকভাবে হেনস্থা করতে পারে।
এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ রায় হামলার স্বীকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থানের পর জানতে পারেন প্রিয় সন্তান, অভিজিৎ রায় আর নেই।
রাত একটার দিকে বাসায় ফিরে তিনি একটি ফোন পান। ফোনে অচেনা ভাষায় (সম্ভবত আরবি ভাষায়) তাকে কিছু একটা বলা হয়। এরপরে একই ফোন আবার তিনি পেয়েছিলেন। ফোনে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল— তিনি অভিজিতের পিতা কিনা। একইসাথে তাকে স্বর্গীয় বার্তা শুনতে বলা হয়।
অভিজিৎ রায়, বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া আমেরিকান লেখক এবং ব্লগার, নাস্তিকতার জন্য পরিচিত ছিলেন, বইমেলা (একুশে বইশেলা-২০১৫) থেকে ফেরার পথে খুনির চাপাতির আঘাতে খুন হন। একই হামলায় তার স্ত্রী এবং সহযোদ্ধা রাফিদা সুলতানা বন্যা আহত হন।
অভিজিৎ রায় মুক্তমনা নামে একটি ব্লগ পরিচালনা করতেন এবং লেখালেখি করতেন। উল্রেখ্য, ব্লগটি শুরু করেছিলেন তার পিতা অজয় রায়।
অজয় রায় বলেন, “ব্লগটি আমি শুরু করেছিলাম, তবে অভিজিৎ যেহেতু সফটওয়ার প্রকৌশলী ছিল, তাই আমি তাকে ব্লগটির দায়িত্ব নিতে বলি।”
সফটওয়ার প্রকৌশলী অভিজিৎ রায় বাংলাদেশে ফিরেছিলেন তিনবছর পর।
“বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিভিন্ন সময় তাকে মৃত্যু হুমকি দেওয়া হত, আমি তাকে দেশে না ফেরার জন্য বলেছিলাম।”
কিন্তু একটি মেইল পাঠিয়ে অভিজিৎ আমাকে দেশে আসার কথা বলে। মেইলের শেষে অভিজিৎ লিখেছিল, “মাকে অনেকদিন দেখি না, মাকে দেখতে ইচ্ছে করে।” বলেন অজয় রায়।
অভিজিৎ রায়ের মা, শেফালী রায় অসুস্থতার কারণে হুহল চেয়ারে চলেন।
অজয় রায় বলেন, “অভিজিৎ সবসময় সুন্দর, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখত।”
অজয় রায় নিজেও আজীবন অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য কাজ করে গেছেন। ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০১২ সালে শিক্ষাবিদ অজয় রায়কে একুশে পদক দেওয়া হয় দেশের জন্য তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে।
অজয় রায় মনে করেন, দেশে সামাজিক আন্দোলন আরো বাড়ানো দরকার, না হলে মৌলবাদ দমন করা সম্ভব হবে না।
“প্রশাসন মৌলবাদ কিছুটা নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারে, কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে মৌলবাদ নিশ্চিহ্ন করতে হবে।” বলেন অজয় রায়।
মুক্তিযোদ্ধা অজয় রায় মনে করেন, শেখ হাসিনার সরকার জামাত ইসলাম নিষিদ্ধ করবে। অনেকে মনে করে তাতে তাদের গোপন কার্যক্রম বেড়ে যাবে। গোপন কার্যক্রম তো তাদের আছেই, নিষিদ্ধ হলে অন্তত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হবে।
রায় প্রতিদিন মুক্তমনা ব্লগ দেখেন, যেটি এখন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা বন্যা পরিচালনা করেন।
হত্যাকান্ডের স্বীকার হওয়ার পূর্বে, জানুয়ারি মাসে পেশোয়ার হত্যাকাণ্ড এবং শার্ল হেবদো প্রসঙ্গ ধরে অভিজিৎ রায় ধর্মকে ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করে মুক্তমনা ব্লগে একটি লেখা দিয়েছিলেন।
হত্যার পর কিছুদিন সমগ্র ঢাকা তথা বাংলাদেশ জুড়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। তবে হত্যাকরীদের এখনো বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
“লোকে এখন আমাকে অভিজিতের পিতা বলে চেনে। আমি গর্বিত, তবে নিশ্চয় এমনটি আমি কখনো ভাবিনি এবং চাইনি।” বলেছেন অজয় রায়।