যথেচ্ছাভাবে এন্টিবায়োটিক খেলে সমূহ বিপদ

follow-upnews
0 0

লিখেছেন জয়নাল আবেদীন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ


আগামী ৫০ বছর পর অকালে মানুষ মারা যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ কি হবে?

যুদ্ধ, বিগ্রহ, দুর্যোগ, এইডস, কলেরা, সোয়াইন ফ্লু….??

মোটেই না। যে কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবে সেই কারণটা নন মেডিকেল মানুষদের কাছে অদ্ভূত লাগতে পারে। এমনকি কারো কারো কাছে অবিশ্বাস্যও মনে হবে।

এন্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স!

জিনিসটা কি?

আমার আশেপাশে যেহেতু নন মেডিকেল মানুষ বেশি তাই খুব সহজভাবেই ব্যাখা করার চেষ্টা করছি।

তার আগে কয়েকটা পরিচিত দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিই।

আপনার জ্বর হয়েছে। কিংবা শরীরের কোথাও ব্যথা।

বড় ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার ঔষধ দিল। ব্যথা তিন দিনেও কমে না। তারপরই শুনলেন অমুক ফার্মেসীতে বসা ক্লাস নাইন পাশ অমুক ডাক্তারের ঔষধ খেলেই রোগী ভালো হয়ে যায়। একদিনেই ব্যথা কমে।

আপনি গেলেন এবং তিন চারশ টাকার ঔষধ খেয়ে ভালো হয়ে গেলেন। তারপর পাড়ার বা মোড়ের চায়ের দোকানে বসে ডাক্তারের গোষ্ঠী উদ্ধারবশত আপনি সেই অমুক ডাক্তারের কেরামতির বিজ্ঞাপন দিলেন।

এটাও বলতে ভুললেন না এসব গরু ছাগল ডাক্তারের চেয়ে ফার্মেসীতে বসা অমুক ডাক্তার, তমুক ডাক্তার হাজার গুণ ভালো।

খুবই পরিচিত ঘটনা।

কিন্তু আপনি জানেন না, একদিনে ব্যথা কমাতে গিয়ে আপনি বিষ খেয়ে ফেলেছেন। বিষ না, বিষের চেয়েও ভয়ানক জিনিস।

আপনি মারা যাওয়ার পথে এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন।

বাংলাদেশের মানুষ মুখে মুখে বিজ্ঞাপনে চরম বিশ্বাসী। কেরামতি এবং মৌখিক স্বীকৃতিকে মাঝে মাঝে ধর্ম বিশ্বাসের মতোই বিশ্বাস করে বসে। তার উপর “আমি কি কম বুঝি” চিন্তাও একটা বিরাট বড় ফ্যাক্ট।

সামান্য জ্বর হলো। দৌড় দিয়ে ফার্মেসীতে গেলেন। দুইটা প্যারাসিটামল আর দুইটা এন্টিবায়োটিক কিনে হাসিমুখে ফিরে আসলেন।

পেট ব্যথা হলো। আবার ফার্মেসীতে দৌড়। ফার্মেসীওয়ালা দুই প্রজাতির চারটা এন্টিবায়োটিক দিল। ব্যথা সাথে সাথে শেষ। আপনি আকাশ পাতাল খুশি।

অথচ আপনি বুঝতেই পারছেন না, আপনি বিষ খাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে।

পুরোপুরি ক্লিয়ার করার চেষ্টা করছি।

জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে এন্টিবায়োটিক। আপনি সিপ্রো, জিমেক্স নামে যা চিনেন তা কেবল ঔষধ না, আপনার জন্য জীবনযুদ্ধের মহা হাতিয়ার।

কিন্তু এই হাতিয়ারের ব্যবহার বিধি আছে। যে কারো পরামর্শে আপনি হাতিয়ার নিতে পারবেন না। কখন কয়টা গুলি করবেন তারও নিয়ম আছে। শত্রু বুঝে গুলি করতে হবে। করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক। কারণ গুলি সংখ্যা সীমিত।

এন্টিবায়োটিক নির্দিষ্ট কোর্সে খেতে হয়। একটা দুইটা করে নিজের ইচ্ছামতো খেলে আপনার শরীরে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে।

শরীর এই ঔষধে পরিচিত হবে। তারপর আর কাজ করবে না। আবার যে কোন সামান্য অসুখেই ধৈর্য না ধরে যদি আপনার সবচেয়ে বড় গুলিটা ব্যবহার করেন তবে পরে বড় শত্রুকে মারতে গিয়ে কোন উপায় পাবেন না।

কখন কবে কোনটা খাবেন তার একমাত্র সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখেন ডাক্তার।

ডাক্তার মানে আপনার বাড়ির পাশে তিন তাকের ফার্মেসীতে বসা এইট পাশ অমুক মিয়া না, ডাক্তার মানে কেবল এমবিবিএস, বিডিএস কিংবা যে কোন রেজিস্টার্ড ডাক্তার।

এর বাইরে এন্টিবায়োটিক ব্যাপারে কারো কোন সিদ্ধান্ত নেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। আমি আবার বলছি, দণ্ডনীয় অপরাধ।

হাঁ, আমাদের দেশে সব আইন মানা হয়না, সম্ভবও হয়না। হাতের কাছেই ডাক্তার পাওয়া যায় না। সে জন্য ফার্মেসীর সাহায্য নিতেই হয়।

কিন্তু এটা বলেই পার পাবেন এমন না। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ মানুষ ২০০ টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা রাখেন।

যারা পারেন না তাদের জন্য সরকারি হাসপাতাল আছে। সেখানে একটু কষ্ট করে দেখান।

রোগ বুঝে ঔষধ দেয়ার জন্য ডাক্তার লাগে না।

আসলেই বেশিরভাগ রোগের ঔষধ মুখে মুখে জানা আছে।

তাহলে এত কষ্ট করে ডাক্তার হওয়ারই বা কি দরকার? টাকা নষ্ট করে ডাক্তারের কাছে যাওয়ারই বা কি দরকার?

আর দরকার আছে।

ডাক্তার কোন রোগে কোন ঔষধ দেয়ার পাশাপাশি কোন সময় কোনটা দেয়া উচিত না এটা জানেন।

সাধারণ মানুষ, ফার্মেসী বা কোয়াকরা এটা জানেন না। পার্থক্য আর প্রয়োজনীয়তা এখানেই।

এরপরও নিম্নবিত্ত মানুষকে তাদের ভুলের জন্য ছাড় দেয়া কিন্তু। কিন্তু কোন যুক্তিতেই মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তদের ছাড় দেয়া যায় না।

এলাকায় গেলে এক ডাক্তার ভাইয়ের চেম্বারে বসে আড্ডা দিই।

একদিন দেখলাম ঐ ভাই এক ফার্মেসীওয়ালার বিরুদ্ধে বিচার বসিয়েছেন। কারণ ঐ লোক প্রেসক্রিপশনের ঔষধ চেঞ্জ কনে ফেলে। কোম্পানী না, ডিরেক্ট গ্রুপ চেঞ্জ।

কি রকম চেঞ্জ একটা উদাহরণ দিই।

একবার এফসিপিএস স্যার এক রোগীকে দুইটা এন্টিবায়োটিক আর একটা ওমিপ্রাজল দিলেন। ফার্মেসীওয়ালা ওমেপ্রাজল বদলে আরেকটা এন্টিবায়োটিক দিল।

তিনটা এন্টিবায়োটিক, ওমিপ্রাজল নেই!!

এটা গলা টিপে মারার চেষ্টার চেয়েও ভয়ানক।

ভুল উচ্চবিত্তরাও অনেক সময়েই করে থাকেন।

আমার পরিচিত অনার্স পড়ুয়া এক ছোট বোনের কানে ব্যথা। আমি পরের দিনই ইএনটি ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিলেন।

উচ্চশিক্ষিত আঙ্কেল ঘটনা শুনলেন এবং দৌড় মেরে উনার পরিচিত ফার্মেসীতে চলে গেলেন।

ফার্মেসীতে বসে চা খেয়ে তিনটা এন্টিবায়োটিক আর একটা পেইন কিলার সমেত ৮০০ টাকার ঔষধ নিয়ে ফিরলেন।

ব্যথা একদিনেই উড়ে চলে গেল।

তবে সমস্যা রোগীর শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। খেতেও পারছে না।

ঔষধের নাম শুনে আমি সাথে সাথে ডাক্তার দেখানোর জন্য বললাম। স্যার বকাবকি করে দুইটা এন্টিবায়োটিক কমিয়ে দিলেন।

৪০০ টাকা ভিজিটের সাথে ১৫০ টাকার ঔষধ। টোটাল ৫৫০ টাকা।

অথচ ফার্মেসীতে গিয়ে ডাক্তারের ৪০০ টাকা বাঁচানোর জন্য উল্টো আরো ২৫০ টাকা বেশি দিতে হলো।

এই ঘটনা কিন্তু বারবার ঘটে।

যে রোগে ডাক্তার সর্বোচ্চ ২০০ টাকার ঔষধ দিতেন সেখানে ৪০০-৫০০ টাকা বাঁচানোর জন্য মানুষ ফার্মেসী থেকে ১০০০ টাকার বিষ কিনে নিয়ে আসে।

আরেকটা ঘটনা। প্রায় ১০ বছর আগের।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাই কোয়াক ডেন্টিস্টের কাছে গেলেন। বিডিএস বিহীন ডেন্টিস্ট। কোয়াক চোখ বন্ধ করে দাঁত তুলল। তারপর একটা এন্টিবায়োটিক আর একটা পেইন কিলার দিল।

কোন ওমিপ্রাজল নেই। এমনকি পেইন কিলার যে খালি পেটে খাওয়া যায় না সেটাও বলে দিল না।

গভীর রাতে ব্যথা শুরু হলে ভাই পেইন কিলার খেলেন। খালি পেটেই। দুই তিন পর পেট ফুলে গেল। অহস্য যন্ত্রণা নিয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হলেন!

এরকম কেস স্ট্যাডি হাজারটা।

আপনিও প্রত্যক্ষ করেছেন, জানেন কিংবা শুনেছেন।

একদম সিরিয়াসলিই আমরা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছি।

মুড়ির মতো যখন তখন এন্টিবায়োটিক খাওয়া আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের কোন ধারণা নেই।

একটা তথ্যই জেনে রাখুন, এই এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের কারণেই প্রতি বছর সাত লাখ মানুষ মারা যায়।

৭ লাখ কিন্তু…

তিন বছর আগে আমার ভাইরাল জ্বর হলো। ৭ দিন পরও জ্বর না কমার কারণে আমাদের মেডিসিন আরপি স্যারকে বললাম, স্যার এন্টিবায়োটিক দেন, প্লিজ। কেবল প্যারাসিটামল খেয়ে কমছে না।

স্যার বললেন, চড় দেব? সাহস কম না, আমার কাছে এন্টিবায়োটিক চায়!!

সেদিন কথাটা শুনে যতটা খারাপ লেগেছিল আজকে সেই কথার প্রয়োজনীয়তা তত বেশি বুঝতে পারছি।

আরেকজন স্যারকে সে দিন শুনলাম বারবার আফসোস করে বলছেন “সিপ্রো এত সুন্দর একটা ঔষধ। কিন্তু মানুষ নষ্ট করে দিল। এত ভালো একটা ঔষধ। ইস!

স্কুল পালিয়ে ১০ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে দুই তাকের একটা ফার্মেসী খোলা ছেলে কেবল “এন্টিবায়োটিক” নামের বিষ বিক্রি করে পুরো ফ্যামেলী চালাতে পারে।

খেয়াল করেছেন এটা?

সব ব্যবসাতে মার খাওয়ার সিস্টেম থাকলেও ফার্মেসী ব্যবসায় কেউ মার খায় না। একমাত্র কারণ এন্টিবায়োটিক বিক্রি।

ঔষধ বিক্রি মহান ব্যবসা। আমি ফার্মেসীওয়ালা খাটো করছি না বা অসম্মানও করছি না। ঔষধ জীবনদায়ী।

কিন্তু আমাদের অজ্ঞতা আর ফার্মেসীওয়ালাদের লোভ সাথে কোয়াক ডাক্তারদের যা খুশি করার কারণে জাতি মহাবিপর্যয়ের দিকেই যাচ্ছে।

আর হাঁ, কেবল ফার্মেসী বা কোয়াকদের দায় দিয়েই শেষ না। কিছু ডাক্তারেরও প্রবলভাবে এন্টিবায়োটিক প্রীতি আছে। এন্টিবায়োটিক দিলে ব্যথা কমে, রোগ কমে। ডাক্তারের যশ বাড়ে।

আবার কোম্পানী থেকে খানিকটা সুবিধা তো আছেই।

অস্বীকার করার উপায় নেই।

বর্তমানে যে কোন ডাক্তারই আমার সিনিয়র। তাঁদের বলার যোগ্যতা বা সাহস রাখি না। আশা করব যার যার অবস্থানে আমার সবাই সৎ থাকার চেষ্টা করব।

আপনি শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। যে রোগ ৩০ টাকা দামের দুইটা ট্যাবলেটেই কমে সেটাই আপনার জন্য মরণব্যাধী। কোন ঔষধ তখন কাজ করছে না।

সেই মুহুর্তে পৃথিবীর সব ডাক্তার না, সব হাসপাতাল গিলিয়ে খাওয়ালেও আপনি ভালো হবেন না। খুব সহজেই ধীরে ধীরে মারা যাবেন। আপনার কোন দোষ না, বদঅভ্যাস না..সামান্য অজ্ঞতার কারণেই…

ভয় লাগে না?

চলছে এন্টিবায়োটিক সপ্তাহ। মানবজাতির সামনে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। স্বাভাবিক কারণেই বাঙালী জাতির চ্যালেঞ্জ আরো বড়।

এতবড় পোস্ট দিয়ে আপনাকে কতটা ভাবাতে পারলাম জানি না। সমস্যা নীরব, বিষের প্রভাব ধীর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মারা যাওয়ার কারণ অাজানা থাকার কারণে কারো কোন মাথা ব্যথা সৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না।

তারপরও আপনার হাতে ধরে পায়ে পড়ে করা অনুরোধ…কোন স্বীকৃত ডাক্তার ছাড়া কারো কাছ থেকে এন্টিবায়োটিক নেবেন না। নিজে নিজে এন্টিবায়োটিক কিনতে যাবেন না। কোর্স শেষ না করে খাওয়া বন্ধ করবেন না।

আর দয়া করে এমবিবিএস, বিডিএস… ডিগ্রি ছাড়া কারো বিরাট বড়বড় ডিগ্রি দেখে বিভ্রান্ত হবেন না।

এর বাইরে যত বড় বড় অজানা অচেনা ডিগ্রি, তত বড় টাউট।

বাঁচতে হলে জানতে হবে, মানতেও হবে। না মানার আর কোন সুযোগ নেই।

মানছেন তো?

Next Post

“প্রাণির ছবি আঁকা, রাখা ইত্যাদিকে পবিত্র হাদিস শরিফে কঠোরভাবে নিষেধ করা হইয়াছে”

জঙ্গিবিরোধী লিফলেট ও বক্তব্যে ইসলাম ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ–কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার জাতীয় শিক্ষা মিশন বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা আবু বকর সিদ্দীকের […]